(বাঁ দিক থেকে ডান দিকে) উদিতি শরাফ, শৌভিক মাইতি, দেবজ্যোতি চক্রবর্তী, অর্কশুভ্র ঘোষ। — নিজস্ব চিত্র।
সাফল্যই শেষ কথা বলে।
নাহ্, ভুল।
ব্যর্থতা জয়ের কথা বলে। বিশেষত লড়াই যখন মৃত্যুর হাতছানি বনাম সময়ের। দিল্লির কিশোরী উদিতি শরাফ এই লড়াইয়ে হার মানলেও, তাঁকে সুস্থ করতে গিয়ে দেশীয় গবেষণাগারে আবিষ্কার হয়েছে এমন এক নতুন প্রোটিনের, যার মাধ্যমে নিখুঁত ভাবে করা গিয়েছে জিন সম্পাদনার কাজ। পাল্টে ফেলা যাচ্ছে খারাপ জিন। তাই উদিতিকে বাঁচানোর ওই লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়েছে ‘নেচার’-এর মতো বিজ্ঞান-জার্নাল। যেখানে লেখা হয়েছে, ‘যদিও ব্যর্থ, তবু ওই প্রচেষ্টা ওষুধ শিল্পের কাছে শিক্ষণীয়। উদিতির দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু তাই
আশার কাহিনি’।
উদিতির কাহিনি সফল, কারণ তা জিনঘটিত বিরল রোগে আক্রান্তদের নতুন করে বাঁচার দিশা দেখাচ্ছে। এ দেশে যার প্রথম প্রয়োগ শুরু হতে চলেছে খুব দ্রুত। দেশের জনজাতিদের মধ্যে সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় আক্রান্তদের জিন সম্পাদনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে তাঁদের সুস্থ করার কাজে নামছেন ভারতীয় বিজ্ঞানী-চিকিৎসকেরা।
এই কাহিনি কয়েক জন বাঙালি বিজ্ঞানির অদম্য লড়াইয়ের কাহিনিও। প্রাথমিক লড়াইয়ে পরাজয় হলেও, যা নতুন করে প্রেরণা জোগাচ্ছে দিল্লির কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রিসার্চের অন্তর্গত সেন্টার জেনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি (সিএসআইআর আইজিআইবি) প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর সৌভিক মাইতি, গবেষক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী, (এই দেবজ্যোতি ও সৌভিক কোভিডের সময়ে করোনা চিহ্নিতকারী ফেলুদা কিট বানিয়েছিলেন) এবং বেঙ্গালুরুর নারায়ণ নেত্রালয়ের জিন থেরাপি কেন্দ্রের গবেষক অর্কশুভ্র ঘোষকে। তাঁদের আশা, জিনগত বিরল রোগের চিকিৎসায় যে নতুন পথ খুলে গিয়েছে, তা নিশ্চিত ভাবেপথ দেখাবে।
উদিতির ভালবাসা ছিল নাচ। দশ বছর বয়েসে হঠাৎ মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়। শক্তি হারাতে শুরু করে তার পেশি। সমস্যার মূলে যেতে উদিতির কোষের ডিএনএ-সিকোয়েন্স বা ক্রমবিন্যাস করার সিদ্ধান্ত নেন বাবা-মা। জানা যায় জিনের মধ্যে কিছু অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের ফলে নিউরোসারপিন প্রোটিনের চরিত্র পালটে গিয়ে তা ত্রুটিপূর্ণ প্রোটিনে পরিণত হচ্ছে। যার ফলে মারা যেতে শুরু করেছে উদিতির স্নায়ুকোষ। বিজ্ঞানের ভাষায় বিরল ওই রোগটির নাম ফ্যামিলিয়াল এনসেফালোপ্যাথি উইথ নিউরোসারপিন ইনক্লুসন বডিজ় (এফইএনআইবি)।
প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় হাতে গোনা ব্যক্তি আক্রান্ত হন এই রোগে। কোনও ওষুধ নেই। বাণিজ্যিক ভাবে লাভের সম্ভাবনা না থাকায় যা নিয়ে ওষুধ তৈরির কথা ভাবেও না ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি। দেবজ্যোতি জানান, উদিতির বাবা-মা প্রথমেই যোগাযোগ করেন নিউ ইয়র্কের ল্যাংগন হেল্থ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। সেখানে উদিতির ত্রুটিপূর্ণ জিনবিন্যাস পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত হয় ‘ক্রিসপর জিনোম এডিট’ পদ্ধতির মধ্যে। ক্রিসপর প্রযুক্তি হল জিনগত রোগ সংশোধন করার কৌশল। এর মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএ-তে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সম্ভব।
সাল ২০১৯। বিশ্ব জুড়ে ছড়াতে শুরু করে কোভিড। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন উদিতির বাবা-মা। করোনা আক্রান্ত হয় উদিতি। বিদেশ যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। হাল না ছেড়ে দেশে একই ধরনের কাজে যুক্ত আইজিআইবি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে উদিতির পরিবার। বাবা-মায়ের আর্তিতে লাল ফিতের ফাঁস দ্রুত খুলতে থাকে। আর্থিক সাহায্য আসে উদিতির বাবা-মায়ের কাছ থেকেই। কাজে নেমে পড়েন দেবজ্যোতি-সৌভিক। আর বেঙ্গালুরুতে অর্কশুভ্র।
অর্কশুভ্রের বৈজ্ঞানিক দল বেঙ্গালুরুতে উদিতির মস্তিষ্কের কোষগুলিতে সরবরাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাডিনো অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস (এএভি) তৈরি করতে শুরু করে।এই এএভি-র কাজ হল জিনে প্রয়োজনীয় কাটাছেঁড়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনকে কোষে বহন করে নিয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে উদিতির ব্লাড সেলকে স্টেম সেলে পরিণত করে এবং সেই স্টেম কোষের মধ্যে এএভির মাধ্যমে ক্রিসপার ক্যাস৯ পদ্ধতিতে এফএনক্যাস৯ প্রোটিন পাঠান।
জিন সম্পাদনার জন্য ক্রিসপার ক্যাস৯ চিকিৎসাশাস্ত্রে উল্লেখজনক আবিষ্কার হলেও, এটির সমস্যা হল কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঠিক জিনে লক্ষ্যভেদে তা ব্যর্থ হয়। কিংবা অন্যান্য জিনেও বাড়তি পরিবর্তন করে ফেলে। তাই দেবজ্যোতি ও সৌভিক এবং তাঁদের গবেষক ছাত্র সুন্দরম আচার্য গবেষণাগারে একটি ক্যাস৯ প্রোটিন চিহ্নিত করে তাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটান। এই প্রোটিনটির নাম দেওয়া হয় ইএন-এফএনক্যাস৯। উদিতির ক্ষেত্রে গবেষকরা জিন সম্পাদনার জন্য ইএন-এফএনক্যাস৯ প্রোটিন ব্যবহার করেন। দেবজ্যোতিদের কথায়, এ ক্ষেত্রে ওই ইএন-এফএনক্যাস৯ প্রোটিনের ব্যবহারে কেবল নির্দিষ্ট জিনেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হয়, বাড়তি কোথাও তার প্রভাব দেখা যায়নি। এক কথায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে তা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। এই আবিষ্কার, এই ক্ষেত্রে ভারত থেকে সর্বপ্রথম আমেরিকান পেটেন্ট পেয়েছে।
ইএন-এফএনক্যাস৯ প্রোটিন ব্যবহার করে আইজিআইবি-এর গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা উদিতির স্টেম কোষের জিনে অনাকাঙ্ক্ষিত মিউটেশন পরিবর্তন করতে সফল হন। পরবর্তী ধাপে ‘ক্লিনিক্যাল ট্র্যায়ালে’র মাধ্যমে তা উদিতির স্নায়ুকোষে প্রয়োগ করার কথা ছিল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, দেশীয় বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নিয়ন্ত্রক কাজ করতে শুরু করেন হাত মিলিয়ে। দেবজ্যোতি-সৌভিকের কথায়, এমন সার্বিক প্রচেষ্টা বিশ্বের যে কোনও জায়গাতেই বিরল। সব কাজ যখন দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে, তখনই মারা যায় উদিতি। দেবজ্যোতির আক্ষেপ, আর মাত্র কয়েক মাস সময় পেলেই উদিতির স্নায়ুকোষে তা প্রয়োগ সম্ভব হত। অর্কশুভ্র বলেন, ‘‘উদিতিকে সুস্থ করতে না পারলেও, আগামী দিনে যে সব জিনঘটিত রোগের কোনও চিকিৎসা নেই, সে সব রোগে আক্রান্তদের জিন থেরাপির মাধ্যমে সারিয়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।’’
উদিতির অসুখ নিয়ে গবেষণার সূত্রেই বিজ্ঞানীরা জিন ঘটিত আর একটি রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। যা হল সিকল সেল অ্যানিমিয়া। যা মূলত পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্যের জনজাতি সমাজে বেশি দেখা যায়। দেবজ্যোতিদের গবেষণাকে হাতিয়ার করে কেন্দ্রীয় জনজাতি মন্ত্রক ও দিল্লির এমস হাসপাতালে খুব শীঘ্রই আক্রান্ত জনজাতির মানুষদের উপরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হওযার পথে। দেবজ্যোতি বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে ইএনএফএন ক্যাস৯ প্রোটিন ব্যবহার করে সিকল সেলে আক্রান্তদের লোহিত রক্তকণিকায় যে অস্বাভাবিকতা রয়েছে, তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।’’ সৌভিকের কথায়, ‘‘উদিতিকে বাঁচাতে লড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে গবেষক, চিকিৎসক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি একসঙ্গে কাজ করলে পরিবর্তন আনা সম্ভব।’’
উদিতির মৃত্যু নেই।
যেতে যেতে আরও অনেক উদিতির বাঁচার পথ খুলে দিয়েছে সে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy