Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
mars

সৌরবায়ুই ছিনিয়ে নিচ্ছে মঙ্গলের প্রাণ থাকার সম্ভাবনা, প্রথম দেখালেন ২ বঙ্গসন্তান

গবেষণা পত্রটি বেরিয়েছে ‘মান্থলি নোটিশেস অব দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র অনলাইন প্রকাশনায়।

ইনসেটে, দুই বঙ্গসন্তান। অর্ণব বসাক (বাঁ দিকে) ও অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী। গ্রাফিক: নিরূপম পাল।

ইনসেটে, দুই বঙ্গসন্তান। অর্ণব বসাক (বাঁ দিকে) ও অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী। গ্রাফিক: নিরূপম পাল।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২১ ২৩:২৯
Share: Save:

‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের সবচেয়ে বড় শত্রুকে হাতেনাতে ধরে ফেললেন দুই বঙ্গসন্তান। শ্যামবাজারের দিব্যেন্দু নন্দী আর বালিগঞ্জের অর্ণব বসাক। সম্প্রতি লাল গ্রহে পা ছুঁয়েছে নাসার মহাকাশযান। নেমেছে একটি সর্বাধুনিক ল্যান্ডার ও রোভার ‘পারসিভের‌্যান্স’। প্রাণের সন্ধানে যা চষে ফেলা শুরু করেছে লাল গ্রহের মাটি। এই দুই বঙ্গসন্তানই প্রথম কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে দেখালেন মঙ্গলের অমঙ্গলের আপাতত সবচেয়ে বড় কারণ আর কেউ নয়। সূর্যই। তার থেকে বেরিয়ে আসা সৌরবায়ু (‘সোলার উইন্ড’)। এখনও যেটুকু আছে লাল গ্রহের ‘প্রাণ’- সেই বায়ুমণ্ডলকে প্রতি মুহূর্তে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সৌরবায়ু। যা প্রথমে ‘নাগপাশে’ চার দিক থেকে জড়িয়ে ধরছে লাল গ্রহকে। তার পর নিজেই সেই নাগপাশ খুলে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে সৌরবায়ু। মঙ্গলের যাবতীয় অমঙ্গলের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সূর্যই।

মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার কলকাতা)’-এর অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী এবং সংস্থার ‘সেন্টার অব এক্সেলেন্স ইন স্পেস সায়েন্সেস ইন্ডিয়া (সেসি)’-র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট অর্ণব বসাকের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবে এপ্রিলে, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘মান্থলি নোটিশেস অব দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি (এমএনরাস)’-র প্রিন্ট ভার্সানে।

মঙ্গলকে তিলে তিলে শেষ করেছে দুই দুশমন

মঙ্গল এক সময় বাসযোগ্যই (‘হ্যাবিটেব্‌ল’) ছিল। প্রাণের অস্তিত্ব আর তার টিঁকে থাকার জন্য যা যা দরকার সেই অক্সিজেন, তরল অবস্থায় থাকা জল আর প্রায় পৃথিবীর মতোই পুরু বায়ুমণ্ডল ছিল লাল গ্রহে।

কিন্তু মঙ্গলকে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে দুই ‘দুশমন’। তার একটিকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন দিব্যেন্দু, অর্ণব। অন্য দুশমনটিকে অবশ্য এখনও চেনা, জানা যায়নি। শুধুই সন্দেহ। তা হতে পারে সুবিশাল কোনও গ্রহাণু বা উল্কাপিণ্ড-র ধেয়ে আসা। হতে পারে অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তুর অভিঘাতও।

সূর্যের বায়ুমণ্ডল (করোনা)-এর বিভিন্ন স্তর। যেখান থেকে তৈরি হয় সৌরবায়ু। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

সূর্যের বায়ুমণ্ডল (করোনা)-এর বিভিন্ন স্তর। যেখান থেকে তৈরি হয় সৌরবায়ু। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।

একসময় ধুকপুক করত মঙ্গলের হৃৎপিণ্ডও!

জন্মের পর অন্তত ১০০ কোটি বছর ধরে ধুকপুক করেছিল মঙ্গলের ‘হৃৎপিণ্ড’। যা আদতে একটি ‘ডায়নামো’। যেটা ছিল মঙ্গলের ‘কোর’-এর একেবারে উপরের স্তরে। সেখানে থাকা প্রচণ্ড উত্তপ্ত তরলের মধ্যে। সেই কোর-এর নীচের স্তরে ছিল আরও বেশি উত্তপ্ত তরল। কেটলিতে জল ফোটালে যেমন নীচের জল গরম হয়ে উপরে যায়, আর উপরের ঠান্ডা জল নীচে এসে ফের গরম হয়ে উপরে ওঠে ঠিক তেমনই তাপমাত্রার ভিন্নতার দরুন মঙ্গলের অভ্যন্তর (কোর)-এর উপর ও নীচের স্তরের তরলের মধ্যেও পরিচলন হত সব সময়। বিদ্যুৎশক্তির জন্ম হত। হত বিদ্যুৎপ্রবাহ। তারই ফলে তৈরি হয়েছিল লাল গ্রহের চার দিকে বেশ শক্তিশালী একটি চৌম্বক ক্ষেত্র।

পৃথিবীরও এমন একটি ডায়নামো আছে। আছে বলেই পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে অদৃশ্য একটি চৌম্বক ক্ষেত্র। যা মহাজাগতিক রশ্মির ঝাপটা আর সূর্য থেকে অহরহ ছুটে আসা নানা ধরনের হানাদারের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে এই নীলাভ গ্রহটিকে।

কোনও গ্রহকে চার দিক থেকে অদৃশ্য বলয়ে ঘিরে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্র সব সময়েই হয়ে ওঠে সেই গ্রহের একটি বর্ম। যা সূর্য থেকে প্রতি মুহূর্তে ছুটে আসা নানা ধরনের হানাদারের (যেমন, সৌরকণা, সৌরবায়ু, সৌরঝড় (‘সোলার স্টর্ম’), ‘করোনাল মাস ইজেকশন (সিএমই)’-এর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে সেই গ্রহকে। বাঁচিয়ে রাখে সেই গ্রহের বায়ুমণ্ডলকে। এই অদৃশ্য বর্ম না থাকলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলও ফুৎকারে উড়িয়ে দিত সূর্য থেকে ছুটে আসা হানাদাররা।

সূর্যের বায়ুমণ্ডলের চৌম্বক রেখাগুলি। যার কিছু অংশ বেরিয়ে আসে সৌরবায়ুর সঙ্গে। ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা।

পৃথিবী ‘সেলাই’ করতে পেরেছে, কপাল মন্দ মঙ্গলের

পৃথিবীর কপাল ভাল। তার বায়ুমণ্ডলকে ফুৎকারে উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে পারেনি সেই সব সৌর হানাদাররা। পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড বা তার অভ্যন্তর (কোর)-এ থাকা ডায়নামোটি জন্মের পর থেকে এখনও পর্যন্ত সচলই রয়েছে। তাই সেই ডায়নামোটি পৃথিবীকে ঘিরে থাকা অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে। সৌর হানাদারদের আক্রমণে সেই বর্মেও চিড় ধরেছে। কিন্তু তার পরেও যখন চৌম্বক ক্ষেত্রের সেই ছিদ্র ভেদ করে ঢুকে সৌর হানাদাররা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে ফুৎকারে উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে পারেনি, তখন ধরে নেওয়াই যায় এই নীলাভ গ্রহের অন্দরে থাকা সচল ডায়নামোটিই চৌম্বক ক্ষেত্রের সেই সব ছিদ্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘সেলাই’ (রিফুও বলা যায়) করে দিয়েছে।

‘‘কিন্তু লাল গ্রহের কপাল ছিল মন্দ। তাই জন্মের প্রায় ১০০ কোটি বছর পরেই, আজ থেকে ৩৬০ কোটি বছর আগে কেউ পুরোপুরি অচল করে দিয়েছিল মঙ্গলের সেই হৃৎপিণ্ডটিকে। পরে আর যাকে সচল করে তোলা সম্ভব হয়নি। সেই হৃৎপিণ্ড বা ডায়নামোটা যত দিন সচল ছিল লাল গ্রহের অন্তরে অন্দরে, তত দিন ছিল গ্রহের চার দিকে অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্রও। পৃথিবীর তুলনায় দুর্বল হলেও। এটা আগে অনেকেই সন্দেহ করতেন। কৌতূহল ছিল লাল গ্রহের ডায়নামো বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্যই বোধহয় বায়ুমণ্ডল হারিয়‌ে ফেলেছে মঙ্গল। আমাদের কম্পিউটার মডেল সেই সন্দেহকেই প্রমাণ করল’’, বলছেন দিব্যেন্দু।

দিব্যেন্দু, অর্ণবের কৃতিত্ব কোথায়?

দিব্যেন্দু, অর্ণবের কৃতিত্ব তাঁরাই প্রথম কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে দেখাতে পেরেছেন, চৌম্বক ক্ষেত্র না থাকার ফলে সৌরবায়ু কী ভাবে তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল। লাল গ্রহের পিঠে (সারফেস) কোনও প্রাণের অস্তিত্বকে কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে।

দিব্যেন্দু ও অর্ণবের কথায়, ‘‘কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে আমরা দেখাতে পারলাম শুধু অক্সিজেন, তরল অবস্থায় থাকা জল আর বায়ুমণ্ডলই নয়, অন্য কোনও গ্রহে প্রাণের বিকাশ ও টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার চার দিকে অদৃশ্য চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিশালী বর্মও। না হলে তার বায়ুমণ্ডলটাই ছিনতাই করে তাকে হতসর্বস্ব করে যায় ভয়ঙ্কর সৌরবায়ু।’’

অর্ণব, দিব্যেন্দু তাঁদের কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে এও প্রথম দেখালেন মঙ্গলের ব্যাস যতটা লাল গ্রহ থেকে তার ৫ গুণ দূরত্বে ছিল সেই চৌম্বক ক্ষেত্রের অদৃশ্য বর্ম। তখন সৌরবায়ুর হানাদারি থেকে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলকে বাঁচিয়েছে ওই বর্মই।

মঙ্গলে নামার আগে-পরে পারসিভের‌্যান্সের পাঠানো প্রথম ৩টি ছবির কোলাজ। ছবি সৌজন্যে: নাসা।

মঙ্গলে নামার আগে-পরে পারসিভের‌্যান্সের পাঠানো প্রথম ৩টি ছবির কোলাজ। ছবি সৌজন্যে: নাসা।

উপরের দিকে ১০০ মিটার হাঁটলেই শেষ মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল

দুই বাঙালি বিজ্ঞানী দেখালেন, বর্মটা উধাও হয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় ৩৬০ কোটি বছর ধরে ক্ষয়ে যেতে যেতে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল এখন এতটাই পাতলা হয়ে গিয়েছে যে লাল গ্রহের পিঠ থেকে যদি সোজা উপরের দিকে হাঁটা সম্ভব হত, তা হলে ১০০ মিটার পরেই শেষ হয়ে যাবে সেই মুলুকের বায়ুমণ্ডল।

আরও গুরুত্বপূর্ণ, দিব্যেন্দু ও অর্ণবের কম্পিউটার মডেল লাল গ্রহের চার পাশে যেমন আবহাওয়া দেখিয়েছে তা মঙ্গলের কক্ষপথে থাকা নাসার মহাকাশযানের পাঠানো তথ্যাদির সঙ্গে মিলে গিয়েছে।

মঙ্গলে উপনিবেশের জন্য প্রয়োজন চৌম্বক ক্ষেত্রও

দিব্যেন্দু জানাচ্ছেন মঙ্গলে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তুলতে গেলে যে শুধুই তরল জলের সন্ধান আর বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন নিষ্কাশন করলেই হবে না, কৃত্রিম চৌম্বক ক্ষেত্রও বানাতে হবে, এই গবেষণা সেই দিকটির উপর আলোকপাত করল।

আর এক দশকের মধ্যেই লাল গ্রহে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ার লক্ষ্যে কী কী করণীয় তা বুঝে নিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে (ভারতীয় সময়) মঙ্গলের বুকে পা ছুঁইয়েছে নাসার রোভার পারসিভের‌্যান্স। সেই সময়ই দিব্যেন্দু, অর্ণবরা তাঁদের কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন ফের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য কৃত্রিম চৌম্বক ক্ষেত্রও বানিয়ে নিতে হবে লাল গ্রহের চার পাশে।

না হলে সূর্য থেকে প্রতি মুহূর্তে ছুটে আসা হানাদাররা সভ্যতার প্রায় ছুঁয়ে ফেলা স্বপ্নকে ছিনতাই করে নিয়ে যাবে!

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ ও নিরূপম পাল।

ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy