Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus in West Bengal

‘মহাসংক্রামক’ হয়ে উঠছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, তবে মৃত্যু কম, প্রায় সুরক্ষা টিকাতেও

করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নতুন রূপ। এখনও পর্যন্ত ভারতেই এই রূপটির হদিশ মিলেছে।

 ভাইরাসের এই রূপ অন্যান্য নতুন রূপের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়। সেটাই আতঙ্কের কারণ।

ভাইরাসের এই রূপ অন্যান্য নতুন রূপের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়। সেটাই আতঙ্কের কারণ। ছবি: রয়টার্স।

সুজয় চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৩১
Share: Save:

একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর! গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসেই মনে হয়েছিল, স্বস্তি ফিরিয়ে কনোরা কমছে। সম্ভবত তার পুরোপুরি বিদায়ের ক্ষণও এসেই গিয়েছে। কিন্তু এ বঙ্গ এখনও রঙ্গে ভরা। সেই রঙ্গের নাম ‘ভেরিয়্যান্ট’। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে যা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্ক, কারণ, করোনাভাইরাসের এই নতুন রূপ (ভেরিয়্যান্ট) দ্রুত ‘মিউটেট’ করে।

মহারাষ্ট্র থেকে পশ্চিমবঙ্গ— করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নতুন রূপ। এখনও পর্যন্ত ভারতেই এই রূপটির হদিশ মিলেছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে পশ্চিমবঙ্গে গত রবিবার পর্যন্ত যত জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই এই ভারতীয় রূপের শিকার। রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমের কথায়, এক জনের দেহ থেকে অন্য জনের দেহে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে ভাইরাসের এই রূপ অন্যান্য নতুন রূপের তুলনায় অনেক বেশি সক্রিয়। সেটাই আতঙ্কের কারণ।

‘মিউটেশন’ হল এমন একটি অমোঘ আইন, যা সারা পৃথিবীকে একই সূত্রে চালনা করে। এ হল বংশরক্ষার সূত্র। সে ভাইরাসই হোক বা পাকিস্তানের আইএসআই। এর সূত্রধর হলেন মহর্ষি চার্লস ডারউইন। যে সূত্রের বলে রাজনীতিকরা তাঁদের সন্তান বা ভাইপোদের তাঁদের পেশায় নিয়ে আসেন। যাতে বংশানুক্রমে তাঁদের উত্তরাধিকার রক্ষিত হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা কমতে শুরু করার পর থেকেই ‘মিউটেশন’-এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ফোটোকপি যন্ত্রে প্রতিলিপি বার করার সময় কখনও সখনও কয়েকটি প্রতিলিপি ভুল আসে। অল্প কয়েক পাতা ফটোকপি করলে প্রতিটি প্রতিলিপিতে কালি আবছা হওয়া বা প্রতিলিপি বাঁকাচোরা হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু একই সঙ্গে কয়েক হাজার পাতা ফটোকপি করাতে গেলে কিছু না কিছু ভুলভ্রান্তি হয়ই। কোথাও কালি আবছা হয়, কোনওটি খানিক বাঁকাতেড়া হয়। ভাইরাসেরও তেমনটা হয়। একই ভাবে ‘মিউটেশন’ হয় ভাইরাসের।

বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘র‌্যান্ডম এরর’। এটি উন্নত প্রাণীদের ক্ষেত্রেও হয়। কিন্তু তা শুধরে নেওয়ার জন্য উন্নত প্রাণীদের দেহে নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে। যা ভাইরাসের নেই। তাই ‘মিউটেশন’ নিয়ে ভাইরাসের নতুন নতুন রূপের জন্ম হয়। আর তার হার বাড়ে নতুন নতুন আশ্রয়দাতা মানুষ বা অন্য উন্নত প্রাণীর দেহে বাসা বাঁধতে পারলে। অর্থাৎ, বংশবৃদ্ধি করতে পারলে। এই ‘মিউটেশন’ ভাল বা খারাপ— দু’দিকেই যেতে পারে। সুখের বিষয়, এটি কদাচিৎ খারাপ দিকে যায়। আপাতত এই ভাইরাস নিজেদের আরও বেশি সংক্রামক করছে। কারণ, তারা মানবদেহে পরগাছা হিসাবে বেঁচে থেকে বংশবৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে মৃত্যুহার অত্যন্ত কম। কারণ, যে মানবশরীরের তারা বাসা বেঁধেছে, তাকে মেরে ফেললে পরগাছার মৃত্যুও নিশ্চিত। ফলে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বহুগুণ বেশি হলেও তাতে মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। যেমন শুক্রবার রাজ্যে সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৬,৯১০। মৃত্যু ২৬। অর্থাৎ, আক্রান্তদের মধ্যে ১ শতাংশেরও কম রোগী মারা গিয়েছেন।

  তা হলে কি টিকা নিলেও সুরক্ষা নিশ্চিত নয়? এই আতঙ্ক এবং উদ্বেগ কি অমূলক?

  তা হলে কি টিকা নিলেও সুরক্ষা নিশ্চিত নয়? এই আতঙ্ক এবং উদ্বেগ কি অমূলক? ছবি: রয়টার্স।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজ্যে কোভিডে আক্রান্তদের মধ্যে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের মূলত চারটি নতুন রূপের হদিশ মিলেছে। এর মধ্যে শুধু ভারতীয় রূপটির শিকার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নতুন রোগী শিকার হয়েছেন ভাইরাসটির আরও তিনটি নতুন রূপের। তার একটি ‘ইউকে ভেরিয়্যান্ট’। বছরের গোড়ার দিকে এই রূপটির হদিশ প্রথম মেলে ব্রিটেনে। রাজ্যে দ্বিতীয় তরঙ্গে কোভিড রোগীদের ১০ থেকে ১২ শতাংশ এই রূপের শিকার। ভাইরাসের অন্য একটি নতুন রূপকে বলা হচ্ছে ‘সাউথ আফ্রিকান ভেরিয়্যান্ট’। যার হদিশ প্রথম মিলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। রাজ্যে এখনও পর্যন্ত এই রূপের শিকার কোভিড রোগীদের ৫ থেকে ৬ শতাংশ। কিন্তু আশঙ্কার কথা, এই দক্ষিণ আফ্রিকান রূপটির ক্ষেত্রে টিকা কাজ করছে না। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ২ শতাংশের কিছু কম আক্রান্ত হয়েছেন ‘ব্রাজিলিয়ান ভেরিয়্যান্ট’-এ। এর দেখা প্রথম মিলেছিল ব্রাজিলে।

তা হলে কি টিকা নিলেও সুরক্ষা নিশ্চিত নয়? এই আতঙ্ক এবং উদ্বেগ কি অমূলক?

টিকা নিলে সুরক্ষা প্রায় নিশ্চিত। এমনই বলছেন গবেষকরা। করোনাভাইরাসের নতুন নতুন রূপগুলি চালু টিকাকে অকেজো করে ফেলছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকান রূপটির ক্ষেত্রে। ইজরায়েলে টিকা নেওয়ার পর ১৪৯ জনের উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, আট জন ওই নতুন রূপ বা ‘ভেরিয়্যান্ট’-এর শিকার হয়েছেন। ওই সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিসিন এবং ক্যানসার গবেষক অধ্যাপক আদি স্টার্ন বলছেন, “দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ১৪ দিন পর একজনকেও আমরা ওই দক্ষিণ আফ্রিকান রূপে সংক্রমিত দেখতে পাইনি।” যার সূত্র ধরে আমেরিকার গবেষক অধ্যাপক এরিক টোপোল বলছেন, “আমার স্ত্রী পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ডাবল মিউট্যান্ট ব্যাপারটা কী’? লোকজন অকারণে ভয় পাচ্ছেন। আপনার যদি ঠিকমতো টিকা নেওয়া থাকে, পুরো ডোজের দু’সপ্তাহ পর কোনও রূপ নিয়েই চিন্তা করার নেই।” গবেষকদের মতে, টিকা নেওয়ার পরেই নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয় যে, আর কোভিড সংক্রমণ হবে না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, পুরো টিকা (দু’টি ডোজ) নেওয়ার নির্দিষ্ট সময় পর নতুন করে সংক্রমণের সম্ভাবনা শুধু যে ক্ষীণ, তা-ই নয়, সংক্রমণ হলেও তাতে মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম। কলকাতার এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এর সঙ্গে হেলমেট পরে মোটরবাইক চালানোর তুলনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ, হেলমেট পরলেই যে দুর্ঘটনা ঘটবে না, তা নয়। দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু আঘাত কম লাগবে।’’

নতুন রোগীরা কোন কোন রূপের ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তা জানতে সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও প্রতি সপ্তাহে ‘জিনোম সিকোয়েন্সিং’ করা হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণে হচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট নন অনেকেই।

নতুন রোগীরা কোন কোন রূপের ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তা জানতে সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও প্রতি সপ্তাহে ‘জিনোম সিকোয়েন্সিং’ করা হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমাণে হচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট নন অনেকেই। ছবি: রয়টার্স।

স্বাস্থ্যসচিবের দাবি, নতুন কোভিড রোগীরা কোন কোন রূপের ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তা জানতে সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও প্রতি সপ্তাহে ‘জিনোম সিকোয়েন্সিং’ করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, “চারটি নতুন রূপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রামক ভারতীয় রূপটি। চলতি সপ্তাহে কোভিড রোগীদের রক্তে এই রূপটির হদিশ আরও বেশি পরিমাণে মিলতে পারে। এটির দু’বার মিউটেশন হয়েছে। তাই এদের ‘ডাব্‌ল মিউট্যান্ট’ বলা হচ্ছে।” তবে জিনতত্ত্ববিদ পার্থ মজুমদারের কথায়, ‘‘এটা সুনিশ্চিত ভাবে বলতে গেলে যে পরিমাণে কোভিড রোগীর জিনোম সিকোয়েন্সিং হওয়া প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, গোটা দেশেই তার চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। সারা দেশের সঙ্গে এই রাজ্যেও জিনোম সিকোয়েন্সিং এখনও পর্যন্ত ১ শতাংশেরও কম হয়েছে।’’

রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের ধারনা, মহারাষ্ট্র থেকেই এই রূপটি এ রাজ্যে এসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর রাজ্যের বহু পরিযায়ী শ্রমিক ও বেসরকারি সংস্থাগুলির কর্মচারী আবার মুম্বই-সহ মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জেলায় ফিরে গিয়েছিলেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ গোড়া থেকেই ভয়াবহ হয়ে ওঠায়, আর তার ভরকেন্দ্র মূলত মহারাষ্ট্র হওয়ায় তাঁদের একটা অংশ ইতিমধ্যেই আবার পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই এই ডাব্‌ল মিউট্যান্ট রূপটি রাজ্যে ঢুকেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পার্থপ্রতিম অবশ্য এই যুক্তিও মানতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘পর্যাপ্ত তথ্যাদি হাতে না আসা পর্যন্ত এমন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। কোন রাজ্য থেকে ডাব্‌ল মিউট্যান্ট পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছে তা নিখুঁত ভাবে জানতে হলে কনট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের প্রয়োজন। যা গত বছর লকডাউন উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর কথায়, ‘‘হু-র গাইডলাইন অনুয়ায়ী কোনও দেশের জনসংখ্যার প্রতি ৩০০ জনে একটি করে জিনোম সিকোয়েন্সিং হওয়া উচিত। ভারতে দু’টি ঢেউ মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ১০ হাজারেরও কম সংখ্যক মানুষের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা সম্ভব হয়েছে। আগের মতো কনট্যাক্ট ট্রেসিং বা ক্লাস্টার ম্যাপিংও করা হচ্ছে না’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy