ছবি- রয়টার্স।
বেহালা থেকে প্রথম গিয়েছেন বেঙ্গালুরুতে। হোটেল থেকে রাস্তায় নামতেই দূর থেকে কুকুরদের দেখে একটা কাগজের টুকরো ফেলে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন। একেবারেই অচেনা কুকুরটি বুঝে গেল, আপনি কী বোঝাতে চাইছেন! লেজ নাড়াতে নাড়াতে চলে এল সেই ফেলে রাখা কাগজটির কাছে, খাবার খুঁজতে। আপনি অবাক হয়ে গেলেন! কারণ, কুকুরটির চোখে চোখ রাখেননি আপনি। তাকে ‘আ চুুক চুক’ করে ডাকেনওনি। কুকুরটি আগে আপনাকে দেখেনি। আপনিও তাকে দেখেননি এর আগে। তাই ট্রেনিং দেওয়া তো দূরের কথাই। শুধু আঙুলের ইশারা করেছিলেন। অচেনা কুকুরটি বুঝে গেল আপনার ইশারা, ইঙ্গিতের অর্থ।
আমাদের সঙ্গে কুকুরের সম্পর্কের সমীকরণ, রসায়ন নিয়ে একটি অভিনব গবেষণায় এটাই দেখালেন যাদবপুরের অনিন্দিতা। মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার), কলকাতা’-র অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অনিন্দিতা ভদ্র। তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’তে। গত ১৭ জানুয়ারি।
গবেষকরা এই প্রথম দেখালেন, আমাদের না চিনে, না জেনেও আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না রাস্তার কুকুরদের। আর সেগুলি তারা মনেও রাখতে পারে। যার অর্থ, আমাদের জটিল ইশারা, ইঙ্গিতগুলি বোঝার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে কুকরদের। যা এত দিন জানতে পারা যায়নি। কারণ, এযাবৎ সব গবেষণাই হয়েছে পোষা কুকুরদের নিয়ে। যাদের ট্রেনিং দেওয়া হয় আমাদের ইশারা, ইঙ্গিতগুলিতে রপ্ত হয়ে ওঠার জন্য।
তাঁরা এও দেখালেন, আমাদের ইশারা, ইঙ্গিতে যদি তারা ঠকে যায় এক বারও, তা হলে আর সে পথ মাড়ায় না পরে। তখন আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত দেখে, বুঝেও সে সব উপেক্ষা করে রাস্তার কুকুর। ঠকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে। ‘ন্যাড়া (এখানে পড়ুন, নেড়ি কুকুর) কেনই-বা বেলতলায় যাবে বার বার!’ আদরের পোষা কুকুর কিন্তু ঠকে গেলে তা থেকে কিছু শেখে না।
‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’তে প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্র।
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের ‘ইয়ার অফ সায়েন্স চেয়ার প্রফেসর’ ও বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (আইআইএসসি)’-এর ‘সেন্টার ফর ইকোলিজক্যাল সায়েন্সেস’-এর অনারারি প্রফেসর রাঘবেন্দ্র গাদাগকর ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বলেছেন, ‘‘এটা অভূতপূর্ব পর্যবেক্ষণ। কুকুরদের চিনতে, বুঝতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যখন বেশির ভাগ গবেষণাই চলছে পোষ্যদের নিয়ে, তখন অনিন্দিতার কাজের অভিনবত্ব, তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের জন্য বেছে নিয়েছেন রাস্তার কুকুরদের।’’ যাদের আমরা বলি, ‘স্ট্রে ডগ’। প্রাণীবিজ্ঞানের ভাষায় যাদের বলা হয়, ‘ফ্রি-রেঞ্জিং ডগ বা, ফ্রি রোমিং ডগ’।
আরও পড়ুন- এ বার সব ক্যানসার সারবে একই উপায়ে? যুগান্তকারী আবিষ্কার
এর আগে রাস্তার কুকুরদের নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য গবেষণা সম্ভব হয়নি, উন্নত দেশগুলিতে রাস্তার কুকুরের হদিশ মেলে না বলে।
সেই ‘আপদের দল’!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (‘হু’) একটি সমীক্ষার পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে রাস্তার কুকুরের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। তার সবটাই রয়েছে উন্নয়নশীল ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলিতে। তার মধ্যে ভারতেই রয়েছে কম-বেশি ৩ কোটি রাস্তার কুকুর। এদের আমরা ভয় পাই। মাঝেমধ্যে আক্রান্তও হই, যেনতেনপ্রকারে তাদের হঠিয়ে দিতে চাই বলে। রাস্তার কুকুরের কামড়ে ভারতে ফি-বছরে গড়ে মৃত্যু হয় অন্তত ২০ হাজার মানুষের। যাদের বেশির ভাগই শিশু।
বিপদ এড়াতেই চিনতে হবে ‘আপদ’দের!
‘‘তাই রাস্তার কুকুরদের চেনা, বোঝাটা আমাদের খুবই দরকার। এটাও জানা দরকার তারা আমাদের কতটা বোঝে। জানা দরকার, আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত তারা কতটা বুঝতে পারে, তেমন কিছু শেখানো না হলেও। আর সেটা সম্ভব হলে নিজেদের বাঁচাতে আর রাস্তার কুকুর মারতে হবে না আমাদের। এঁটোকাঁটা, বিয়েবাড়ির ফেলে দেওয়া খাবারদাবার ছুঁড়ে দিতে গিয়ে আর রাস্তার কুকুরদের হাতে আমাদের আক্রান্ত হতে হবে না’’, বলছেন অনিন্দিতা।
তাঁর দাবি, এর ফলে মানুষ ও রাস্তার কুকুরের শান্তিতে সহাবস্থান সহজতর হবে।
গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?
অনিন্দিতা ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের গবেষণাই প্রথম দেখাল, শুধু শেখাচ্ছি বলেই যে কুকুর শেখে, তা কিন্তু নয়। মানুষকে চেনার, বোঝার একটা সহজাত ক্ষমতা রয়েছে কুকুরের। তাই একেবারেই অচেনা, অজানা একটি রাস্তার কুকুরও আমার, আপনার ইশারা, ইঙ্গিত চট করে বুঝে ফেলতে পারছে। কী বলতে চাইছি ইশারা, ইঙ্গিতে তা বোঝানোর জন্য রাস্তার কুকুরদের কিন্তু আলাদা ভাবে ‘ট্রেনিং’ দেওয়ার দরকার হচ্ছে না।
অনিন্দিতারা এও দেখালেন, আমাদের ফন্দিগুলির ফাঁদে পা দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিতে পারে রাস্তার কুকুর। তাই তাদের দ্বিতীয় বার ‘বোকা’ বানানো যায় না। সে যে ঠকেছিল, সেটা মনে রাখতে পারে।
অনিন্দিতার কথায়, ‘‘দেখেছি, আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত বোঝার ক্ষমতা প্রাপ্তবয়স্ক রাস্তার কুকুরের থাকলেও সেই ইশারা মেনে তাদের এগনোর সম্ভাবনা কিন্তু ৫০: ৫০। এক বার ইশারা মেনে একটা বাটির দিকে গিয়ে খাবার পেলে পরের বার তারা ইশারা মানে। কিন্তু ইশারা মেনে খাবার না পেলে পরের বার আর বিশ্বাস করে না সেই মানুষকে।’’
বোলতাদের রাজনীতি থেকে কুকুরে...
ঠাকুরপুকুরের বিবেকানন্দ কলেজ থেকে প্রাণীবিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়তে গিয়েই প্রাণীদের আচার, আচরণ জানা, বোঝায় কৌতূহলী হয়ে পড়েন অনিন্দিতা। এক অধ্যাপক শিলাঞ্জন ভট্টাচার্যের অনুপ্রেরণায়। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে এমএসসি করার পর পিএইচডি করতে যান বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি-তে। সেখানে মন দেন বোলতাদের রাজনীতিতে। বেঙ্গালুরু ছেড়ে আইসার-কলকাতায় পড়াতে এসে কেরিয়ার গড়ে তোলার তাগিদে বোলতাদের ছেড়ে কুকুরকেই বেছে নিয়েছিলেন অনিন্দিতা। ছোটবেলা থেকেই তারা যে অনিন্দিতার খুব প্রিয়।
১৫ হাজার বছর একসঙ্গে...
ইতিহাস বলছে, আমাদের (আদিম মানব ও আধুনিক মানুষ) সঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার বছরের সম্পর্ক কুকুরের। বিবর্তনের পথে নেকড়ে থেকে বিশেষ একটি শাখা বেরিয়ে এসে কুকুর হওয়ার প্রায় পরপরই। নেকড়ে থেকে কুকুর এসেছে মানুষের হাত ধরেই। মানে, মানুষই নেকড়েদের কোনও না কোনও ভাবে পোষ মানিয়ে কুকুর তৈরি করেছে।
বেদেও কুকুরের উল্লেখ রয়েছে। আর ‘মহাভারত’-এ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কুকুরের স্বর্গারোহণের কাহিনী তো আমাদের সকলেরই জানা। এই সুদীর্ঘ পারস্পরিক সম্পর্কে মানুষের ইশারা, ইঙ্গিতগুলি রাস্তার কুকুররাও চিনতে, বুঝতে বাধ্য হয়েছে বেঁচে থাকার, জীবনযুদ্ধে টিঁকে থাকার প্রয়োজনেই।
কী ভাবে পরীক্ষা চালিয়েছিলেন অনিন্দিতারা?
না, তাঁরা খুব ছোট্ট কুকুরছানাদের নিয়ে পরীক্ষা চালাননি। কারণ, এর আগে অনিন্দিতারা একটি পরীক্ষায় দেখেছিলেন, একদম দুগ্ধপোষ্য কুকুরছানাদের আঙ্গুল দিয়ে এক দিকে দেখালে তারা সুরসুর করে সেই দিকেই চলে যায়।
না, তাঁরা মায়ের দুধ খাওয়ার অভ্যাস থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা ‘টিন এজার’ রাস্তার কুকুরদের নিয়েও পরীক্ষাটা চালাননি। কারণ, ‘‘টিন এজারদের স্বভাবটাই হল উল্টো দিকে যাওয়া’’, বলছেন অনিন্দিতা।
আরও পড়ুন- বিশ্বকে ঘিরে ফেলেছে অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের ধোঁয়া, তীব্র আশঙ্কায় ভারতও
গবেষকরা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন প্রাপ্তবয়স্ক ১৬০টি রাস্তার কুকুর নিয়ে। মানুষের ইশারা বোঝার ক্ষমতা কতটা প্রবল রাস্তার কুকুরদের, সেটা বুঝতেই এ বার পরীক্ষা চালিয়েছিলেন গবেষকরা।
রাস্তায়, ঘরে: কাউকে বেঁচে থাকতে হয় লড়াই করে, কেউ থাকে সুখে-বৈভবে!
এক জন গবেষক মাঠের একটি জায়গায় রেখে আসেন দু’টি বাটি। কিছুটা দূরত্বে। একটি বাটিতে ছিল কাঁচা মুরগির মাংস। অন্য বাটিতে শুধুই মাংসের গন্ধ ভাল ভাবে মাখানো ছিল। কিন্তু তাতে কোনও মাংসের টুকরো ছিল না। এ বার দু’টি বাটির মধ্যে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আর এক জন গবেষক কোনও একটি বাটির দিকে আঙুল দেখালেন। সামনে দাঁড়ানো পথের কুকুরদের চোখে চোখ না রেখেই। দ্বিতীয় গবেষকেরও জানা ছিল না কোন বাটিতে মাংস রয়েছে আর কোন বাটিতে সেটা নেই।
তাঁরা দেখেছেন, কুকুরদের অর্ধেক গবেষকদের ইশারায় কোনও সাড়া দিল না। বরং সন্দেহের চোখে তাকাল। ‘‘হয়তো অতীতে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে ঠকতে হয়েছে’’, বলছেন অনিন্দিতা।
অচেনার ইশারাও তাদের চেনা!
কুকুরদের বাকি অর্ধেক অংশটি কিন্তু গবেষকদের ইশারায় সাড়া দিয়েছিল। আর তারা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক গবেষকের আঙুলের ইশারা দেখে একটি বাটির কাছে পৌঁছেছিল।
অনিন্দিতার ব্যাখ্যা, ‘‘ইশারা দেওয়ার সময় যেহেতু কুকুরদের দেখেননি গবেষক, তাই অচেনা কুকুররাও তাঁর চোখের ভাষা বোঝার সুযোগ পায়নি। তারা বাটির দিকে এগিয়েছিল শুধুই সেই গবেষকের আঙুলের ইশারা বুঝে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, অচেনা পথের কুকুররাও আমাদের ইশারা, ইঙ্গিত বুঝতে পারে, তাদের আগেভাগে কিছু না শেখানো হলেও।’’
ইশারা, ইঙ্গিতে কী বলি, তারা মনেও রাখতে পারে
গবেষকরা এর পর আরও একটি পরীক্ষা করেন। ইশারা এক বার দেখিয়েই তা বন্ধ করেন। আবার কিছু ক্ষণ পর ইশারা করেন। তাতেও দেখা গিয়েছে, গবেষকদের ইশারা দেখেই বাটির কাছে পৌঁছে গিয়েছিল পথের কুকুররা।
অনিন্দিতার ব্যাখ্যা, ‘‘এটা বোঝাচ্ছে, ওরা আমাদের ইশারা, ইঙ্গিতগুলি কেমন, সেটা এক বার দেখার পর মনেও রাখে। ফলে ইশারা বন্ধ করে দিলেও তারা বাটির দিকেই এগিয়ে গিয়েছিল।’’
অভিজ্ঞতা থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে ওরা
পরীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। গবেষকের ইশারার সূত্র ধরে কোনও পথের কুকুর কোনও বাটির কাছে গিয়ে মাংসের টুকরো না পেয়ে থাকলে, তাকে দ্বিতীয় বার ইশারা করে আর টেনে আনা যায়নি।
অনিন্দিতার ব্যাখ্যা, ‘‘এটা প্রমাণ করছে, ওরা ঠকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে। তার পর ওরা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর ঠকবে না।’’
কেন কুকুরের চোখে চোখ রেখে ইশারা করা হয়নি?
অনিন্দিতা জানাচ্ছেন, এর আগে বিদেশে কিছু কাজ হয়েছে পোষা কুকুর নিয়ে। যাতে দেখা গিয়েছে, কুকুরের চোখে আমাদের চোখাচোখি হলেই আমাদের রক্তে ‘অক্সিটোসিন’ নামে এক ধরনের হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়। তার ফলে, আমাদের মধ্যে অপত্য স্নেহের জন্ম হয়। আর কুকুর তখন লেজ নাড়াতে শুরু করে। কুকুর এই চোখাচোখিটা চায়। কুকুরের চোখের বিশেষ একটি গঠনও আমাদের মধ্যে অপত্য স্নেহের জন্ম দেয়। সেটা যাতে না হয়, তাই এ বারের পরীক্ষায় চোখাচোখি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল ভেবেচিন্তেই।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ মনে করছেন, অনিন্দিতাদের পরীক্ষানিরীক্ষা ও তার পদ্ধতির অভিনবত্ব যথেষ্টই। কারণ, রাস্তার কুকুরদের নিয়ে কাজ খুবই কম হয় গোটা বিশ্বে। ভারতে তো প্রায় হয়ই না। তাঁদের পর্যবেক্ষণগুলিও উল্লেখযোগ্য।
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর পাঠানো ই-মেলের জবাবে ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ এভোলিউশনারি বায়োলজিস্টস (আইএসইবি)’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি-র অধ্যাপক রাঘবেন্দ্র গাদাগকর জানিয়েছেন, প্রাণীদের আচার, আচরণ, মনস্তত্ত্ব, বাস্তুতন্ত্র ও বিবর্তনমূলক জীববিদ্যার মূল নীতিগুলিকে বুঝতে অনিন্দিতারা রাস্তার কুকুরদের বেছে নিয়েছেন। খুব বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। কারণ, তাদের পেতে অসুবিধা হয় না। যথেষ্ট পর্যবেক্ষণের সুযোগ মেলে। তাদের ভাল, মন্দ দু’ধরনের প্রভাবই রয়েছে আমাদের উপর। তাই তাদের বোঝার প্রয়োজন যথেষ্টই। পোষা কুকুর আর ক’টা? রাস্তার কুকুরই তো সংখ্যায় অনেক বেশি। তাই রাস্তার কুকুরদের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা কুকুরদের জন্মগত আচার, আচরণ বুঝতে অনেক বেশি সাহায্য করে। টিঁকে থাকার জন্য পোষা কুকুরদের তুলনায় তাদের অনেক বেশি লড়াই করতে হয়। তাই পরিবেশ, প্রকৃতি আর তার প্রায় সব সময় চোখে পড়া মানুষের আচার, আচরণগুলি চট করে বুঝে ফেলার জন্য তাকে রপ্ত হয়ে উঠতে হয়। পর্যবেক্ষণের ফলাফলগুলি যে ভাবে খতিয়ে দেখেছেন অনিন্দিতারা, তা-ও দৃষ্টান্তমূলক।
অনিন্দিতার গবেষণা নিয়ে প্রায় একই সুর আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও ‘ক্যানাইন সায়েন্স কোল্যাবরেটরি’র অধিকর্তা ক্লাইভ ডি এল উইনেরও।
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর পাঠানো প্রশ্নমালার ই-মেল জবাবে উইন লিখেছেন, ‘‘এই গবেষণার অভিনবত্বই হল, রাস্তার কুকুরদের নিয়ে কাজ করা হয়েছে। কারণ, বেশির ভাগ বিজ্ঞানীরাই থাকেন ও গবেষণা করেন সেই সব দেশে, যেখানে রাস্তার কুকুর পাওয়া যায় না। তাই তাঁরা পোষা কুকরদের নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু কুকুরদের পুরোপুরি বুঝতে চাইলে রাস্তার কুকরদের নিয়েই গবেষণার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। কারণ, তারা আমাদের ট্রেনিং পাওয়ার সুযোগ পায় না। আর একেবারে অচেনা কুকুর তো সুযোগ পায় না দূর থেকে আমাদের দেখে চিনে রাখারও।’’
রাস্তার অর্ধেক কুকুর কেন সাড়া দিল না ইশারায়?
গাদাগকর ও উইনের কথায়, ‘‘স্বাভাবিক পরিবেশে, তাদের নিজস্ব মহলে প্রাণীদের আচরণে নানা ধরনের বৈপরীত্য (ডাইভার্সিটি) দেখা যায়। তাই পরিবেশের সঙ্গে কেই রি-অ্যাক্ট করে, কেউ করে না। বা, কেউ অন্য ভাবে করে। সেটা করে তাদের নিজের নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। এটা গবেষণাগারে প্রাণীদের উপর পরীক্ষায় ততটা আশা করা যায় না। যা ফের প্রমাণিত হল অনিন্দিতারা খোলা মাঠে রাস্তার কুকুরদের উপর পরীক্ষা চালানোয়। ইশারায় যারা সাড়া দেয়নি, আমার ধারণা, তারা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে আগে ঠকেছে। বা কোনও ভাবে আমাদের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছে।’’
রাস্তার ‘টিন এজার’ কুকুররা কি আমাদের ইশারা বুঝতে পারে না?
অনিন্দিতারা এটা নিয়ে এখনও গবেষণা করেননি। তবে উইন ও গাদাগকরের মতে, ‘‘প্রাণীদের আচরণের বৈপরীত্য বোঝার জন্য বয়সের ভূমিকাটা আমার কাছে গৌণই মনে হয়। তবে আমার ধারণা, রাস্তার ‘টিন এজার’ কুকুররা ভালই সাড়া দেবে আমাদের ইশারায়। অল্প বয়সের স্বাভাবিক কৌতূহলে। তাদের ভয়-ভীতি অনেকটাই কম। আর মানুষের দুর্ব্যবহার তারা প্রাপ্তবয়স্ক কুকুরদের চেয়ে কম দেখেছে বলে।’’
‘গবেষণার বাধা কিছু মানুষই!’ বলছেন অনিন্দিতা
রাস্তার কুকুরদের আমরা কী চোখে দেখি, গবেষণা করতে গিয়ে তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছেন অনিন্দিতা। বারে বারে। রাস্তার কুকুরদের নিয়ে কাজ। তাই গবেষণাগারের নীরবতা ছেড়ে তাঁকে হামেশাই নামতে হয়েছে পথে। ঢুকে পড়তে হয়েছে এ-পাড়া, ও-পাড়ায়। অলিগলিতে। ফলে, বিস্তর হ্যাপা সামলাতে হয়েছে।
অনিন্দিতার কথায়, ‘‘রাস্তায় কাজ করতে গিয়ে আমাদের অসুবিধা একটাই। মানুষ। আমাদের কাজে তাঁরা অনেক সময় বাধা দেন। কেন কুকুরের ছবি তুলছি আমরা, কেন তাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে, জানতে চান। ওঁরা সন্দেহ করেন, আমরা হয়তো বিষ খাওয়াচ্ছি। আবার পাড়ায় ঢুকে কুকুরদের নিয়ে পরীক্ষা চালাতে গেলে সেখানকার বাসিন্দারা আমাদের বাধা দেন। রেগে গিয়ে যদি সেখানকার কুকুররা পরে ওঁদের আক্রমণ করে!’’
যে চোখে আমরা দেখি রাস্তার কুকুরদের, তাদের সম্পর্কে আমাদের যা ধারণা, অনিন্দিতা কি পারবেন তা বদলে দিতে?
তাঁর গবেষণা তো রাস্তার কুকুরদের মতিগতি বোঝার কাজটা আমাদের সহজ করে দিল অনেকটাই। তাই না?
ফাইল ছবি।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy