গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন আর তার ভিতরে থাকা সাত জন মহাকাশচারীকে বাঁচানোর লড়াইয়ে রয়েছেন এক বঙ্গতনয়া। দমদম নাগেরবাজারের উত্তীর্ণা মুখোপাধ্যায়।
গত সোমবার রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে পৃথিবীর কক্ষপথে একটি উপগ্রহ চুরচুর করে ভেঙে পড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ব়ড়, মাঝারি, ছোট আকারের রাশি রাশি ধাতব টুকরো। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে ভরশূন্য অবস্থায় (পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ যেখানে প্রায় নেই বললেই হয়) সেই রাশি রাশি ধাতব টুকরোটাকরা দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ছুটছে এ দিক ও দিকে। ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কিলোমিটার গতিবেগে। যা ‘অ্যাসল্ট রাইফেল-১৫’ মডেলের বন্দুকের নল থেকে বেরনো বুলেটের গতিবেগের প্রায় ১০ গুণ। যা মহাকাশ স্টেশনের বিভিন্ন অংশকে ফুটো করে বিপদ ডেকে আনতে পারে যখন তখন। শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে মেরামতির কাজে বা মহাকাশে পদচারণার (‘স্পেস ওয়াক’) জন্য মহাকাশ স্টেশনের মূল ক্যাপসুল ছেড়ে বেরিয়ে আসা মহাকাশচারীদের।
সেই ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে কী ভাবে বাঁচানো যায় মহাকাশ স্টেশন আর তার ভিতরে থাকা সাত জন মহাকাশচারীকে, এখন তারই চিন্তায় ঘুম ছুটে গিয়েছে আমেরিকার হিউস্টনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য নাসার মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে। সেই সেন্টারেরই শ’খানেক বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের অন্যতম উত্তীর্ণা মুখোপাধ্যায়।
উদ্বেগে উত্তীর্ণা
মধ্য তিরিশের উত্তীর্ণার জীবনের পরিক্রমা আপাতত কলকাতা থেকে আবু ধাবি হয়ে হিউস্টন। তিন দশকের কিছুটা বেশি সময়ে এতটা পথ পেরনোর পর কি এ বারও উত্তীর্ণ হতে পারবেন দমদম নাগেরবাজারের উত্তীর্ণা? পারবেন মহাকাশ স্টেশন আর সেখানে থাকা সাত জন মহাকাশচারীর দুশ্চিন্তা দূর করতে? উত্তীর্ণার সেই পরিক্রমার পথ যে এ বার আর পার্থিব নয়! পৌঁছে গিয়েছে মহাকাশে। পৃথিবীর অনেক দূরের কক্ষপথে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উপরে।
যেখানে থেকে গত দু’দশক ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। দেড় ঘণ্টায় এক বার। ২৪ ঘণ্টায় ১৫ থেকে ১৬ বার।
হিউস্টনে মহাকাশ স্টেশনের মিশন কন্ট্রোল সেন্টারের অন্যতম সদস্য উত্তীর্ণা মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে টেলিফোনে বললেন, ‘‘হবই, এ কথা এই মুহূর্তে খুব জোর দিয়ে বলতে পারছি না। যথেষ্টই সংশয়ে রয়েছি। গভীর উদ্বেগে। অসম্ভব দুশ্চিন্তায়।’’
মহাকাশ স্টেশনে রয়েছেন আমেরিকার চার জন, রাশিয়ার দু’জন ও জার্মানির এক জন মহাকাশচারী। তাঁদের অন্যতম ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকার নভশ্চর রাজা চারি।
উত্তীর্ণা জানিয়েছেন, গত সোমবার রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে পৃথিবীর কক্ষপথে থাকা একটি কৃত্রিম উপগ্রহ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে মহাকাশ স্টেশনে থাকা সাত জন মহাকাশচারীর পক্ষে। সঠিক ভাবে কোনও সময়ও বলা সম্ভব হচ্ছে না যে কত দিনের মধ্যে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে মহাকাশ স্টেশন ও সেখানে থাকা মহাকাশচারীরা।
টেলিফোনে উত্তীর্ণার খুব চাপা স্বরই যেন বুঝিয়ে দিল, এ বারের ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় কতটা উত্তীর্ণ হওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন উত্তীর্ণাও।
নাগেরবাজার, আবু ধাবি হয়ে হিউস্টনে
নাগেরবাজারের বাড়ি থেকে তিন বছরের উত্তীর্ণা আর তাঁর দেড় বছরের ভাই উত্তরীয়কে নিয়ে তাঁদের বাবা, মা পাড়ি দেন আবু ধাবিতে। আটের দশকের একেবারে শেষের দিকে। সেখানে কয়েক বছর কাটিয়েই উত্তীর্ণার বাবাকে পরিবার নিয়ে চলে যেতে হয় আমেরিকার হিউস্টনে। কর্মসূত্রে। তার পর আমেরিকাতেই থেকে যান উত্তীর্ণারা।
উত্তীর্ণার কথায়, ‘‘কলকাতার একটি নার্সারি স্কুলে মা, বাবা আমাকে ভর্তি করানোর পরপরই আমাদের আবু ধাবিতে চলে যেতে হয়েছিল বলে মায়ের মুখে শুনেছি। তার পর আবু ধাবিতে গিয়ে পড়াশোনা করি সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা একটি কলেজে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম মহাকাশে যাওয়ার। খুব ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ারও। সেই সময়েই বাবা কর্মসূত্রে চলে গেলেন আমেরিকায়। আমি গ্র্যাজুয়েশন করতে ভর্তি হলাম টেক্সাস সাদার্ন ইউনিভার্সিটিতে। সেখানেই মাস্টার্স করার পর পিএইচডি করি অ্যাস্ট্রোনটিক্সে। পোস্ট ডক্টরাল করার পরিকল্পনা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই হিউস্টনে নাসার মিশন কন্ট্রোল সেন্টারে ফ্লাইট ডিরেক্টরের অফিসে কাজের নিয়োগপত্র পাই। নাসায় আমার কর্মজীবনের সেই শুরু।’’
সে দিন কী কী হয়েছিল
গত সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাশিয়া চার-চারটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে পৃথিবীর কক্ষপথে কয়েক দশক ধরে থাকা একটি গোয়েন্দা উপগ্রহ ‘কসমস-১৪০৮’-কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। তার ফলে, বড় ও মাঝারি আকারের প্রচুর টুকরো জমা হয়েছে এখন পৃথিবীর কক্ষপথে। যা মহাকাশ স্টেশন-সহ মহাকাশযান, উপগ্রহ ও মহাকাশচারীদের পক্ষে খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
উত্তীর্ণা ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে বলেছেন, ‘‘ওই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের পরপরই মহাকাশ স্টেশনে থাকা সাত জন মহাকাশচারীকে প্রতি মুহূর্তে নির্দেশ পাঠাতে শুরু করে হিউস্টনের মিশন কন্ট্রোল রুম। তাঁদের জানানো হয়, মহাকাশ স্টেশনের কোন কোন অংশের ‘হ্যাচ’ (এক রকম দরজা) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে রাখতে হবে। মহাকাশচারীদের আশ্রয় নিতে হবে কোন কোন জায়গায়।’’
সৃষ্টির উল্লাস থেকে সর্বনাশ!
উত্তীর্ণা জানিয়েছেন, পৃথিবীকে মহাকাশ স্টেশনের প্রদক্ষিণের পথে রয়েছে গুঁড়িয়ে যাওয়া উপগ্রহের কম করে দেড় থেকে দু’হাজার টুকরো। ভূপৃষ্ঠ থেকে অতটা উচ্চতায় ভরশূন্য অবস্থায় (পার্থিব মাধ্যাকর্ষণ নেই যেখানে) যে টুকরোগুলির গতিবেগ এখন ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কিলোমিটার। আর সেগুলি ছুটছেও এখন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে। মহাকাশে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সময় তারা কোন পথ ধরবে, তা আগেভাগে আঁচ করাও খুবই কঠিন কাজ। টুকরোগুলির বেশির ভাগই বেশ বড় আকারের। রয়েছে মাঝারি ও ছোট আকারের প্রচুর টুকরোও। মহাকাশবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের নাম ‘স্পেস ডেব্রি’ বা ‘স্পেস জাঙ্ক’। মহাকাশের আবর্জনা।
যেটা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ, তা হল, কোনও বড় টুকরোকে পাশ কাটাতে গিয়ে কোনও মাঝারি বা ছোট টুকরোর পথে পড়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। তাদের আঘাতে যে কোনও মুহূর্তে ফুটো হয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি। সেগুলির আঘাতে মৃত্যু হতে পারে মহাকাশ স্টেশনের মূল ক্যাপসুল থেকে নানা ধরনের মেরামতির কাজ ও মহাকাশ ভ্রমণে বেরনো মহাকাশচারীদের। বা তাঁরা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
১৯৫৭ সাল থেকে মহাকাশ অভিযানে সভ্যতা পা বাড়ানোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত ১৩ হাজারেরও বেশি উপগ্রহ পাঠানো হয়েছে মহাকাশে। যাদের মধ্যে এখনও ৮ হাজার উপগ্রহ পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে রয়েছে। সেই ৮ হাজার উপগ্রহের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার উপগ্রহ এখনও চালু রয়েছে। বাকিগুলি সবই মহাকাশের আবর্জনা হয়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন অকেজো মহাকাশযান ও তাদের অংশগুলি। রয়েছে মহাকাশচারীদের ফেলে যাওয়া নানা ধরনের জিনিসপত্র। হাজার হাজার রকেটের একেবারে উপরের স্তরের খোল। অত উচ্চতায় পৌঁছনোর পর যেগুলি আর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
উত্তীর্ণার কথায়, ‘‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাম্প্রতিক হিসাবমতো মহাকাশে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে এখন মহাকাশ আবর্জনার সংখ্যা প্রায় ৩৯ হাজার। যেগুলির প্রত্যেকটি কম করে চার ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার চওড়া। এ ছাড়াও রয়েছে ১০ লক্ষ আবর্জনা, যাদের প্রত্যেকটি চওড়ায় ০.৪ ইঞ্চি থেকে ৪ ইঞ্চি বা এক থেকে ১০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। রয়েছে আরও ৩৩ কোটি আবর্জনা যাদের প্রত্যেকটি চওড়ায় ০.৪ ইঞ্চি (বা এক সেন্টিমিটার) থেকে ছোট হলেও ০.০৪ ইঞ্চি বা এক মিলিমিটারের চেয়ে বড়। ২০০৯ সালে রাশিয়ারই অচল ‘কসমস-২২৫১’ উপগ্রহটি একটি চালু যোগাযোগের উপগ্রহ ‘ইরিডিয়াম ৩৩’-কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তার ফলে কম করে ২ হাজার আবর্জনা তৈরি হয়েছিল।’’
সোমবার রাশিয়ার ছোড়া চার নম্বর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের আগে কিছু জানতেই পারেনি নাসা। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি-সহ পৃথিবীর কোনও দেশের কোনও মহাকাশ গবেষণা সংস্থাই। বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই মহাকাশ স্টেশনে থাকা রাজা চারি-সহ আমেরিকার চার জন, রাশিয়ার দু’জন ও জার্মানির এক জন মহাকাশচারীর ঘুম ভাঙানো হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁদের চলে যেতে বলা হয় মহাকাশ স্টেশনের প্রাঙ্গণে রাখা পৃথিবীতে ফেরার দু’টি মহাকাশযান- ‘সয়ুজ-এমএস-১৯/৬৫এস’ এবং ‘ক্রু ড্রাগন’-এ।
সামনের দিনগুলো উদ্বেগের
উত্তীর্ণার কথায়, ‘‘সামনের দিনগুলিতেও যথেষ্টই বিপদে রয়েছে মহাকাশ স্টেশন। কারণ সেই মেঘ চট করে সরবে না পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে। ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনেক বেশি বলে সেগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ফুঁড়ে মাধ্যাকর্ষণের টানে ফিরেও আসতে পারবে না। থেকে যাবে মহাকাশেই। বিস্ফোরণের পর কক্ষপথে জমাট বাঁধা মেঘের সৃষ্টি হয়েছে। তার থেকে যে টুকরোগুলি ছিটকে বেরচ্ছে, তাদের গতিবেগ অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে ছিটকে বেরনো গুলির গতিবেগের প্রায় ১০ গুণ। সেগুলি মহাকাশ স্টেশনের মূল ক্যাপসুল ছেড়ে মহাকাশ ভ্রমণে বেরনো মহাকাশচাকরীর শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে মুহূর্তেই। তা যদি খুব ছোট আকারের ছিদ্রও তৈরি করে মহাকাশ স্টেশনের বিভিন্ন অংশে তাতেও স্টেশনের নানা ধরনের কাজকর্ম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে কত দিন তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।’’
বঙ্গতনয়া এ-ও জানিয়েছেন, সমস্যার জট খুলতে কী কী করণীয় তা নিয়ে নাসার মিশন কন্ট্রোল সেন্টার ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা)’-র সঙ্গে আলোচনা করছে। মহাকাশের আবর্জনাগুলির উপর নজর রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে এসা-কেও। একই অনুরোধ জানানো হয়েছে রুশ মহাকাশ সংস্থা রসকসমস, জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘জাক্সা’-কেও।
এ কীসের অশনি সঙ্কেত!
এর পরেও উত্তীর্ণা জানাতে ভোলেননি তাঁর আশঙ্কার কথা। মহাকাশ নিয়ে। মহাকাশে সম্ভাব্য অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে। বলেছেন, ‘‘হয়তো সে দিনও খুব বেশি দূরে নেই যে দিন মহাকাশে গিয়েই অন্য কোনও উপগ্রহ উড়িয়ে, গুঁড়িয়ে দেবে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের কোনও গুরুত্বপূর্ণ উপগ্রহকে। ক্ষতি করবে কোনও মহাকাশযানের বা কোনও উপগ্রহের মহাকাশে কোনও উপগ্রহ থেকেই লেসার রশ্মি পাঠিয়ে।’’
‘‘এখন যেন তারই অশনি সঙ্কেত পাচ্ছি’’, মহাকাশ স্টেশন আর সেখানে থাকা সাত জন মহাকাশচারীর জন্য গভীর উদ্বেগ বুকে নিয়ে টেলিফোনে এ কথা বলেই শেষ করলেন উত্তীর্ণা। খুব চাপা স্বরেই!
ছবি সৌজন্যে- নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং উত্তীর্ণা মুখোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy