যে কোনও মুহূর্তে ফুটো হয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
ভয়ঙ্কর বিপদে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে বড়সড় দুর্ঘটনা।
যে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও হতে পারে নভশ্চরদের। বা সারা জীবনের জন্য তাঁরা পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
এই আশঙ্কাতেই এখন প্রহর গুনছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজা চারি-সহ সাত জন মহাকাশচারী। মহাকাশ স্টেশনে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরে। মহাকাশে, পৃথিবীর কক্ষপথে। ভরশূন্য অবস্থায়, পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে করতে।
হিউস্টনে মহাকাশ স্টেশনের মিশন কন্ট্রোল রুমের অন্যতম এক সদস্য বৃহস্পতিবার ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে এ কথা জানিয়েছেন। টেলিফোনে।
ওই সদস্য বলেছেন, ‘‘ওই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের পরপরই মহাকাশ স্টেশনে থাকা সাত জন মহাকাশচারীকে প্রতি মুহূর্তে নির্দেশ পাঠাতে শুরু করে হিউস্টনের মিশন কন্ট্রোল রুম। তাঁদের জানানো হয়, মহাকাশ স্টেশনের কোন কোন অংশের ‘হ্যাচ’ (এক রকম দরজা) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে রাখতে হবে। মহাকাশচারীদের আশ্রয় নিতে হবে কোন কোন জায়গায়।’’
গত সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাশিয়া চার-চারটি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে পৃথিবীর কক্ষপথে কয়েক দশক ধরে থাকা একটি গোয়েন্দা উপগ্রহ ‘কসমস-১৪০৮’-কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। তার ফলে, বড় ও মাঝারি আকারের প্রচুর টুকরো জমা হয়েছে এখন পৃথিবীর কক্ষপথে। যা মহাকাশ স্টেশন-সহ মহাকাশযান, উপগ্রহ ও মহাকাশচারীদের পক্ষে খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
কোন কোন বিপদের শঙ্কায় মহাকাশ স্টেশন, মহাকাশচারীরা?
দিন-রাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা অন্তর এক বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। ২৪ ঘণ্টায় ১৫ থেকে ১৬ বার। সেই প্রদক্ষিণের পথেই তৈরি হয়েছে বিশাল মেঘ। রাশিয়ার ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গুঁড়িয়ে যাওয়া উপগ্রহের ছিন্নভিন্ন অংশগুলির টুকরোগুলিই তৈরি করেছে সেই জমাট বাঁধা মেঘ।
ওই সদস্য জানিয়েছেন, পৃথিবীকে মহাকাশ স্টেশনের প্রদক্ষিণের পথে রয়েছে গুঁড়িয়ে যাওয়া উপগ্রহের কম করে দেড় থেকে দু’হাজার টুকরো। ভূপৃষ্ঠ থেকে অতটা উচ্চতায় ভরশূন্য অবস্থায় (পার্থিব মাধ্যাকর্ষণ নেই যেখানে) যে টুকরোগুলির গতিবেগ এখন ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কিলোমিটার। আর সেগুলি ছুটছেও এখন দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে। মহাকাশে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণের সময় তারা কোন পথ ধরবে, তা আগেভাগে আঁচ করাও খুবই কঠিন কাজ। টুকরোগুলির বেশির ভাগই বেশ বড় আকারের। রয়েছে মাঝারি ও ছোট আকারের প্রচুর টুকরোও। মহাকাশবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের নাম ‘স্পেস ডেব্রি’ বা ‘স্পেস জাঙ্ক’। মহাকাশের আবর্জনা।
সবচেয়ে বেশি যেটা উদ্বেগের কারণ, তা হল, কোনও বড় টুকরোকে পাশ কাটাতে গিয়ে কোনও মাঝারি বা ছোট টুকরোর পথে পড়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। তাদের আঘাতে যে কোনও মুহূর্তে ফুটো হয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি। সেগুলির আঘাতে মৃত্যু হতে পারে মহাকাশ স্টেশনের মূল ক্যাপসুল থেকে নানা ধরনের মেরামতির কাজ ও মহাকাশ ভ্রমণে বেরনো মহাকাশচারীদের। বা তাঁরা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
কী ভাবে তৈরি হয় মহাকাশের আবর্জনা?
যে কোনও কৃত্রিম উপগ্রহ বা মহাকাশে পাঠানো মহাকাশযানের কার্যকালের মেয়াদ ফুরলেই তা হয়ে পড়ে মহাকাশের আবর্জনা। উল্কা খণ্ড বা ছোট গ্রহাণু-সহ নানা ধরনের মহাজাগতিক বস্তুর আঘাতে মহাকাশের সেই সব আবর্জনা ভেঙে গিয়ে বড়, মাঝারি ও ছোট আকারের রাশি রাশি টুকরোর জন্ম দেয়। সেগুলির নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বা কোনও অচল হয়ে পড়া মহাকাশযান অথবা কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশে আবর্জনার পরিমাণ বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। দু’টুকরো ভেঙে দশ টুকরো হয়। আর তাতেই বিপদ বেড়ে যায় মহাকাশে যাতায়াত করা মহাকাশযানগুলির। বিপদ বাড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা উপগ্রহগুলিরও।
ওই সদস্য ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে জানিয়েছেন, ১৯৫৭ সাল থেকে মহাকাশ অভিযানে সভ্যতা পা বাড়ানোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত ১৩ হাজারেরও বেশি উপগ্রহ পাঠানো হয়েছে মহাকাশে। যাদের মধ্যে এখনও ৮ হাজার উপগ্রহ পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে রয়েছে। সেই ৮ হাজার উপগ্রহের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার উপগ্রহ এখনও চালু রয়েছে। বাকিগুলি সবই মহাকাশের আবর্জনা হয়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন অকেজো মহাকাশযান ও তাদের অংশগুলি। রয়েছে মহাকাশচারীদের ফেলে যাওয়া নানা ধরনের জিনিসপত্র। হাজার হাজার রকেটের একেবারে উপরের স্তরের খোলক। অত উচ্চতায় পৌঁছনোর পর যেগুলি আর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
৩৪ কোটি বিপজ্জনক আবর্জনা পৃথিবীর কক্ষপথে
ওই সদস্যের কথায়, ‘‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির সাম্প্রতিক হিসাবমতো মহাকাশে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথে এখন মহাকাশ আবর্জনার সংখ্যা প্রায় ৩৯ হাজার। যেগুলির প্রত্যেকটি কম করে চার ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার চওড়া। এ ছাড়াও রয়েছে ১০ লক্ষ আবর্জনা, যাদের প্রত্যেকটি চওড়ায় ০.৪ ইঞ্চি থেকে ৪ ইঞ্চি বা এক থেকে ১০ সেন্টিমিটারের মধ্যে। রয়েছে আরও ৩৩ কোটি আবর্জনা যাদের প্রত্যেকটি চওড়ায় ০.৪ ইঞ্চি (বা এক সেন্টিমিটার) থেকে ছোট হলেও ০.০৪ ইঞ্চি বা এক মিলিমিটারের চেয়ে বড়। ২০০৯ সালে রাশিয়ারই অচল ‘কসমস-২২৫১’ উপগ্রহটি একটি চালু যোগাযোগের উপগ্রহ ‘ইরিডিয়াম ৩৩’-কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। তার ফলে কম করে ২ হাজার আবর্জনা তৈরি হয়েছিল।’’
এই বিপদগুলির পাশ কাটিয়েই এত দিন পৃথিবীর কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে হচ্ছিল মহাকাশ স্টেশনকে। এ বার বিপদ অনিবার্য ভাবেই আরও অনেক গুণ বেড়ে গেল।
খবর পাওয়ার পর কী করেছিল নাসা?
ওই সদস্য জানিয়েছেন, সোমবার রাশিয়ার ছোড়া চার নম্বর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের আগে কিছু জানতেই পারেনি নাসা। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি-সহ পৃথিবীর কোনও দেশের কোনও মহাকাশ গবেষণা সংস্থাই। বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই মহাকাশ স্টেশনে থাকা রাজা চারি-সহ আমেরিকার চার জন, রাশিয়ার দু’জন ও জার্মানির এক জন মহাকাশচারীর ঘুম ভাঙানো হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁদের চলে যেতে বলা হয় মহাকাশ স্টেশনের প্রাঙ্গণে রাখা পৃথিবীতে ফেরার দু’টি মহাকাশযান- ‘সয়ুজ-এমএস-১৯/৬৫এস’ এবং ‘ক্রু ড্রাগন’-এ।
ওই সদস্যের কথায়, ‘‘সামনের দিনগুলিতেও যথেষ্টই বিপদে রয়েছে মহাকাশ স্টেশন। কারণ সেই মেঘ চট করে সরবে না পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে। সেগুলি থেকে যে টুকরোগুলি ছিটকে বেরচ্ছে, তাদের গতিবেগ বন্দুক থেকে ছিটকে বেরনো গুলির গতিবেগের প্রায় ১০ গুণ। সেগুলি মহাকাশ স্টেশনের মূল ক্যাপসুল ছেড়ে মহাকাশ ভ্রমণে বেরনো মহাকাশচাকরীর শরীর এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে মুহূর্তেই। তা যদি খুব ছোট আকারের ছিদ্রও তৈরি করে মহাকাশ স্টেশনের বিভিন্ন অংশে তাতেও স্টেশনের নানা ধরনের কাজকর্ম বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে কত দিন তা এখনই বলা সম্ভব হচ্ছে না।’’
তাই অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা বুকে নিয়েই আপাতত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে মহাকাশ স্টেশন। প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিয়েই সেখানে কাটাতে হচ্ছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজা চারি-সহ সাত জন মহাকাশচারীকে।
ছবি সৌজন্যে- নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy