Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
কী যাতনা বিষে

বিবর্তনে পাল্টে যাচ্ছে গরল, ক্রমশ কঠিন হচ্ছে অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ

বিষাক্ত প্রাণী ‘পয়জনাস’ নয়, ‘ভেনোমাস’। যে সমস্ত প্রাণীর কামড়ের জন্য বিষ শরীরে যায় এবং বিষক্রিয়া দেখা যায়, তারা ভেনোমাস। আর যাদের খেয়ে ফেললে তাদের শরীরের সঞ্চিত বিষ আমাদের দেহে আসে, তারা পয়জনাস।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

সুমন প্রতিহার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:৫৭
Share: Save:

মাঝরাতে মায়ের চিৎকারে বাবা ঘুম থেকে উঠে দেখেন দেড় বছরের শিশুপুত্রের মাথার সামনে কুণ্ডলী পাকিয়ে সাপ। ছেলেকে রক্ষা করতে বাবা সাপটিকে সরাতে গেলে বাবার হাতে কামড় পড়ে। সেই রাতেই বাবাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কালো রঙের বিষধর সাপ ‘কালাচ’, বেশ কিছু অঞ্চলে কালচিতিও বলা হয়। চিতি সাপের সঙ্গে মিল থাকলেও এরা সাংঘাতিক বিষধর। যে চারটি সাপের কারণে ভারতে সর্বাধিক মৃত্যু হয়, তাদের অন্যতম। পর দিন সকালে আবার মায়ের বিভিন্ন শারীরিক অস্বস্তি শুরু হয়। মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে জানা যায় সাপটি মাকেই কামড়েছিল। ঘটনাটি ঝাড়গ্রাম-সংলগ্ন এক গ্রামের।

এখন বর্ষা শরতে ঢুকে পড়েছে। খালবিল পরিপূর্ণ। জলে-জঙ্গলে এই সরীসৃপের কামড়ে প্রাণহানি প্রায়ই খবরে। এক-একটি সংবাদ আবার অবিশ্বাস্য পর্যায়ের। এই যেমন যে ঘটনা দিয়ে এই লেখার সূচনা।

বিষাক্ত প্রাণী ‘পয়জনাস’ নয়, ‘ভেনোমাস’। যে সমস্ত প্রাণীর কামড়ের জন্য বিষ শরীরে যায় এবং বিষক্রিয়া দেখা যায়, তারা ভেনোমাস। আর যাদের খেয়ে ফেললে তাদের শরীরের সঞ্চিত বিষ আমাদের দেহে আসে, তারা পয়জনাস। আমাদের দেশে পাওয়া জলঢোঁড়ার আত্মীয় গার্টার সাপের (উত্তর আমেরিকায় পাওয়া যায়) যকৃতে সঞ্চিত হয় বিষ, যার কারণে তারা ‘পয়জনাস’। সাপেদের উপরের চোয়ালে চোখের ঠিক পিছনে থাকে তাদের বিষথলি, যা লালাগ্রন্থির পরিবর্তিত রূপ। আর সাপের বিষ হল বিশেষ ভাবে প্রস্তুত করা জুটক্সিন সমৃদ্ধ ‘লালা’। প্রচলিত মতবাদ অনুসারে, প্রায় ১০ কোটি বছর আগে টক্সিকোফেরা সরীসৃপ গ্রুপ থেকে বিষের উৎপত্তি, তার পর বিস্তার। ভারতে পাওয়া ৩০০-র অধিক সাপের মধ্যে মাত্র ৫০টির বেশি বিষধর। মূলত, কেউটে, চন্দ্রবোড়া, ফুরসা ও কালাচের কামড়ে মৃত্যুর হার সর্বাধিক। এদেরকে ‘মহাচার’ বলা হয়। বিষের শ্রেণিবিন্যাস মূলত তাদের ক্ষতিসাধন করার স্থানের উপর হয়। নিউরোটক্সিন (কালাচ, শাখামুঁটি), যা মূলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে নষ্ট করে। মায়োটক্সিন (র‌্যাটল স্নেক) যা মাংসপেশিকে নষ্ট করে। এবং সাইটোটক্সিন, যার মধ্যে কোষপর্দা-ধ্বংসকারী (গোখরো), হৃদযন্ত্রের উপর ক্ষতিসাধনকারী (কোবরা) এবং রক্তকোষকে (চন্দ্রবোড়া) ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে। সাপের বিষ মূলত প্রোটিন, এনজাইম (ট্রান্সফারেজ, হাইড্রোলেজ ও অক্সিডোরিডাকটেজ) নিয়ে গঠিত। সাপের বিষ বিশ্লেষণ করে এক ডজন থেকে একশো পর্যন্ত যৌগের সন্ধান পাওয়া গেছে। যদিও প্রাপ্ত যৌগের সংখ্যা বাড়লেই সাপ যে বেশি বিষাক্ত— এই ধরনের কোনও সরল সমীকরণ মেলেনি। সাপের বিষ তাদের বয়স, খাবার ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে তো একই প্রজাতির বিভিন্ন সাপের বিষথলিতে বিষের তারতম্য হয়। তবে এই বিষ ইমিউনিটি বা অনাক্রমতা তৈরি করে। যেমন, লিবিয়ার আদিম জনজাতি ‘সাইলি’রা সদ্যোজাত শিশুকে সাপের কামড় খাওয়ায়। তাদের বিশ্বাস, এই পদ্ধতিতে শিশু কতটা খাঁটি এবং মায়ের প্রতি বিশ্বস্ত, তার প্রমাণ মেলে। এই পদ্ধতিকে বলে ‘মিথ্রিডাটিজ়ম’—স্বল্প পরিমাণে বিষ দীর্ঘ দিন নিয়ে এক ধরনের অনাক্রমতা তৈরি করা।

সারা ভারতে মূলত ‘মহাচার’-এর কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম তৈরি হয়। কলকাতার বেঙ্গল কেমিক্যালেই দেশের প্রাচীন অ্যান্টিভেনম ইউনিট ছিল। হিমাচলের কসৌলি, মহারাষ্ট্রের হ্যাফকিন, চেন্নাইয়ের কিং ইনস্টিটিউট পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম তৈরি করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের সাপেদের বিষের গুণগত পার্থক্য তৈরি হয়েছে, যা থেকে আরও জটিল হচ্ছে অ্যান্টিভেনম তৈরির প্রক্রিয়া।

সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা স্বাভাবিক হলেও সাপ ও মানুষের সম্পর্কের রসায়নটা বেশ জটিল। মানুষের হাতে সাপের মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। খুব স্পষ্ট একটা চিত্র পাওয়া যেতে পারে ‘আগতা’ জনজাতি আর সাপের লড়াইয়ের ইতিহাসে। এই জনজাতি লুজ়ান দ্বীপপুঞ্জে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বসবাস করত। তারা মূলত দুটি কারণে পাইথনের শিকার শুরু করে। প্রথমত, সাপের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য। দ্বিতীয়ত, এই সাপেরা তাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছিল। ভারতেও এই প্রতিযোগিতা বহাল তবিয়তেই ছিল। দক্ষিণ ভারতের ইরুলা জনজাতি সাপ চিনতে ও ধরতে সিদ্ধহস্ত ছিল। এরা অত্যন্ত পটু সাপ থেকে বিষ বের করার পদ্ধতিতেও। সেই বিষ থেকেই তৈরি হত অ্যান্টিভেনম, যা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ত। রোমুলাস হোয়াইটেকার-এর মতে ইরুলারা পৃথিবীর সবচেয়ে পটু জনজাতি, যারা সাপকে চিনতে, ধরতে ও বুঝতে পারে। ভারতের ইরুলার মতোই দক্ষিণ আমেরিকার ইয়াওয়ানাওয়া জনজাতি সাপের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সাপের বিষের প্রভাব রুখতে ২০০ রকমের গাছের তথ্য ও গুণাবলি এই জনজাতির হাতের মুঠোয়। ২০১৭ সালে এরা প্রথম তাদের তথ্যভাণ্ডার খুলে দেয় পৃথিবীর কাছে।

কম্বোডিয়ার টোনলে স্যাপ লেক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাপ শিকার কেন্দ্র। সেখানে জলজ সাপের শিকার ও মাংস খাওয়া চালু। মাছের ব্যবসায়ীরা সাপের মাংস বিক্রি করে। সাপের চামড়াকে মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়, আবার কেউ ঘরেও নিয়ে যায় বিক্রির জন্য। সাপের মাংস বেশ পুষ্টিকর। শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট তো রয়েইছে, সঙ্গে রয়েছে বেশ ভাল পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন। চিনে সাপের স্যুপ পরিবেশন করা হয় লেবু পাতা আর চন্দ্রমল্লিকা ফুলের সঙ্গে। শরীর গরম করতে শীতকালে এই স্যুপ-এর চাহিদা ভালই। আমাদের দেশে নাগাল্যান্ডে সাপের মাংস খাওয়ার ঘটনা ঘটে। সাপের বিষ বহুমূল্য। ১ গ্রাম বিষের দাম প্রায় ২০০০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এ ছাড়াও বহু সাপ মারা পড়ে মানুষের অজ্ঞতার কারণে, যা পরিসংখ্যানেও আসে না। প্রতি বছর ভারতে কয়েক হাজার লোক সাপের কামড়ে মারা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হওয়া এবং ভয়। মানুষের জন্যও মারা পড়ে অনেক সাপ।

এই অবস্থায় আশার আলো দেখাচ্ছে ভারতই। ‘পাম্বু কুলাম’ (সাপের জন্য তৈরি গর্ত) এবং মানুষের বসতির সহাবস্থান ভারতের তামিলনাড়ু অঞ্চলেই। তামিলনাড়ুর এই অঞ্চলে সাপের জল পানের জন্য খোঁড়া হয় এই ‘পাম্বু কুলাম’। প্রতি বছর একটু একটু করে এই গর্তের গভীরতা বাড়ানো হয়। এবং জল শুকিয়ে গেলে গ্রামবাসীরা সেই গর্ত জল দিয়ে ভর্তি করে। সাপেরা জলপানের সঙ্গে আশ্রয় লাভ করে এই গর্তে। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে সহাবস্থান শেখাবে, হয়তো পথ দেখাবে এই ‘পাম্বু কুলাম’।

অন্য বিষয়গুলি:

Snake Anti Venom Evolution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy