ইনসেটে, বেঙ্গালুরুর রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক উর্বশী সিনহা।
ছোটবেলার সেই রিলে রেসের মজার দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনলেন উর্বশী সিনহা। হ্যাকাররা কস্মিন কালেও আড়ি পাততে পারবে না, ভারতে এই প্রথম তেমন টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে।
রিলে রেসে হাতবদল হতে হতে ব্যাটনের এগিয়ে যাওয়া তো একটা তরঙ্গেরই মতো। যদিও ছোটবেলার সেই রিলে রেসের পাল্লাটা তেমন পেল্লাই ছিল না। হাতবদল হতে হতে ব্যাটন খুব বেশি দূর পর্যন্ত এগোতে পারতো না। প্রথম থেকে দ্বিতীয় জন, তার হাত থেকে ব্যাটন যেত তৃতীয় জনে। টিম তো হত বড়জোর চার কি ছয় জনের। তাই হাতবদল হতে হতে ব্যাটন আর কতটাই বা এগোবে?
লং ডিসট্যান্স কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন
এ দেশে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গিয়ে উর্বশী রিলে রেসের সেই সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেরেছেন। তাই সঙ্গে জুড়েছেন একটি নতুন উদ্ভাবনী জবরদস্ত ব্যবস্থা (‘রিপিটার’), যা রিলের সঙ্গে মিলেমিশে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবে কোনও বার্তা বা ‘সিগন্যাল’কে।
শুধু তাই নয়, এই ভাবে পুরোপুরি সুরক্ষিত উপায়ে যে কোনও বার্তাকে বহু বহু দূরে পাঠানো যাবে। পাঠানো যাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, এমনকি মহাকাশেও। নিমেষে। আলোর গতিতে। সেটাই উর্বশীর লক্ষ্য। আক্ষরিক অর্থেই সুদূরপ্রসারী সেই টেলিযোগাযোগব্যবস্থার পোশাকি নাম- ‘লং ডিসট্যান্স কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন’।
যা গড়ে তোলা হবে ধাপে ধাপে। রেলের ট্র্যাক পাতা হয় যে ভাবে। কিছুটা অংশ পর্যন্ত ট্র্যাক পাতার পর আবার ট্র্যাক পাতা হয় আর একটু অংশে। পরে ওই দু’টি অংশকে জুড়ে দেওয়া হয়। ঠিক একই ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার চাইছে দেশ জুড়ে এই কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে।
‘কোয়েস্ট’ ও উর্বশীর প্রকল্প
ভারতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, কমিউনিকেশন ও টেকনোলজির উন্নতিতে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের (ডিএসটি) অর্থানুকুল্যে যে ‘কোয়ান্টাম এনহ্যান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (কোয়েস্ট)’ প্রকল্পের কাজ চলছে, বেঙ্গালুরুর ‘রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আরআরআই)’-এর অধ্যাপক উর্বশী সিনহার গবেষণা তার একটি অলঙ্কার। তাঁর প্রকল্পের নাম- ‘লং ডিসট্যান্স কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন্স: রিপিটার্স অ্যান্ড রিলে টেকনোলজিস’।
লন্ডনের উর্বশী কলকাতা, কেম্ব্রিজ, কানাডা ঘুরে কোয়ান্টামে
লন্ডনে জন্ম উর্বশীর। তার পর মা, বাবার সঙ্গে ফিরে আসেন ভারতে। বাবার বদলির চাকরি। প্রথমে মুম্বই, পরে পশ্চিমবঙ্গের সিউড়ি, কলকাতা হয়ে বেঙ্গালুরু, দিল্লি ঘুরে আবার কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে বি এসসি করে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যাচারাল সায়েন্সে ট্রাইপস করতে। মাস্টার্সের পর কেম্ব্রিজেই পিএইচডি উর্বশীর। প্রথম পোস্ট ডক্টরালও কেম্ব্রিজেই। কানাডার ওয়াটার্লু বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল। তার পর দেশে ফেরেন ২০১২-য়। আরআরআই-এর অধ্যাপক হয়ে। সেখানেই দেশের প্রথম ফোটনিক্স বেস্ড কোয়ান্টাম টেকনোলজির গবেষণাগার নিজের হাতে গড়ে তোলেন উর্বশী। ২০১৭ থেকে ইসরোর সঙ্গে যৌথ ভাবে দেশের প্রথম উপগ্রহভিত্তিক কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রকল্পেরও গোড়াপত্তন করেন তিনি। উর্বশী এখন জাতীয় কোয়ান্টাম মিশনের ড্রাফটিং কমিটিরও এক জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
সেই সূত্রেই ডিএসটি-র কোয়েস্ট প্রকল্পের মাধ্যমে উর্বশী তাঁর গবেষণায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চান। আর সেই যাত্রাপথের মূল হাতিয়ার হল, ‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট’ ব্যবহার করে ‘কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন’।
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট, টেলিপোর্টেশন ও দুই যমজ ভাই
ধরা যাক, দুই যমজ ভাইয়ের জন্ম হল। নন্টে আর ফন্টে। যারা আদতে আলোর কণা ফোটন। যাদের একই সঙ্গে একই উৎস থেকে জন্মের পর একে অন্যের থেকে অনেক দূরে সরে গেলেও এক জনের কোনও আচার আচরণ বদলালে মুহূর্তের মধ্যে অন্য যমজ ভাইয়েরও আচার আচরণ একই ভাবে বদলে যেতে থাকে। এই দু’জনের জীবন যেন একই সূত্রে বাঁধা। এক অদৃশ্য সুতোয়। এরই পোশাকি নাম কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট। যা আধুনিক কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মূল ভিত্তি।
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের একটা চমকপ্রদ ব্যবহার হল কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন।
টেলিপোর্টেশন বলতেই আমাদের কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলিতে কল্পিত টেলিপোর্টেশনের কথা মনে পড়ে। কিন্তু সেই টেলিপোর্টেশনে গল্পের নায়ক বা নায়িকাকেই মহাকাশের বিভিন্ন প্রান্তে স্থানান্তরিত করা হয়।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন বলতে কিন্তু ঠিক তা বোঝায় না। এই ধরনের টেলিপোর্টেশনের ক্ষেত্রে যে কোনও বস্তুকে সরাসরি না পাঠিয়ে তার কোয়ান্টাম সত্তাকে (‘কোয়ান্টাম স্টেট’) বহু দূরদূরান্তের বস্তুতে স্থানান্তরিত করা হয়। কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগের এটি একটি অন্যতম প্রধান পদ্ধতি। যার সুদূরপ্রসারী ব্যবহার আগামী দিনে বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিক খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে ইতিমধ্যেই।
এই পদ্ধতিতে এনট্যাঙ্গলমেন্টকে কী ভাবে কাজে লাগানো হয়, সেটা এ বার সহজে বুঝে নেওয়া যাক।
আগেই বলা হয়েছে দুই যমজ ভাই নন্টে আর ফন্টে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গল্ড অবস্থায় আছে। ফন্টের উপর রাগ করে এ বার নন্টে চাইছে তার প্রিয় বন্ধু বাঁটুলের সত্তাকে ফন্টের মধ্যে স্থানান্তরিত করতে। সেটা নন্টে আর বাঁটুল মিলে এমন ভাবে কিছু মাপজোক করে করতে পারে, যাতে বাঁটুলের কাছ থেকে ফোটনের সত্তাটা ফন্টের ফোটনের কাছে চলে যাবে। এটাকেই বলা যায় বাঁটুলের কাছ থেকে ফন্টের কাছে একটা সত্তা ‘টেলিপোর্টেড’ হল।
উর্বশী বললেন, ‘‘এই ভাবে বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই যমজ ফোটনের মধ্যে সরাসরি কোনও যোগাযোগ থাকে না ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি একটা টেলিফোন চ্যানেল থাকে যাতে বাঁটুল আর নন্টের করা মাপজোকের ফলাফল ফন্টের কাছে পাঠানো যায়। তার ভিত্তিতেই বাঁটুলের সত্তাতে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে ফন্টে।’’
কোয়ান্টাম যোগাযোগের ক্ষেত্রে টেলিপোর্টেশনের পরের ধাপটাই হল এনট্যাঙ্গল্ড অবস্থাটাকে স্থানান্তরিত করা। যে রিলে রেসের কথা প্রথমে বলা হয়েছে সেই রেসে এনট্যাঙ্গল্ড অবস্থাটাকেই ব্যাটন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। উর্বশী বললেন, ‘‘এটাই আমরা কোয়েস্ট প্রকল্পে পরীক্ষামূলক ভাবে করে দেখাচ্ছি।’’
চিঠির বোঝা পিঠে নিয়ে ছুটে চলা ‘রানার’-এর সঙ্গে টেলিপোর্টেশনের মাধ্যমে বার্তা পাঠানোর ফারাকটা এই যে, সেই বার্তাটা ছুটছে আলোর গতিতে। ‘রাত নির্জন, পথে কত ভয়’-এর ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু ‘তবুও রানার ছোটে’র মতো ধকল সইতে হবে না তাকে।
তবে কিছু ঝুঁকি তো আছেই। যেমন, ফোটন নানা ভাবে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে বিক্ষিপ্ত হতে পারে। হারিয়ে যেতে পারে।
‘‘তা কতটা কমানো যায় সেটাই আমাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’’, বললেন উর্বশী।
এই ভাবে এনট্যাঙ্গলমেন্টকে স্থানান্তরিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সুরক্ষিত কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফিকে বাস্তবায়িত করার জন্য।
কেন হ্যাকাররা পারবে না আড়ি পাততে?
ক্লাসিক্যাল ক্রিপ্টোগ্রাফির দুর্বলতা হল, দু’জনের মধ্যে বার্তা বিনিময়ের মাঝখানে এক জন মেধাবী হ্যাকার ঢুকে পড়ে তা জেনে ফেলতে পারে। হ্যাকার যে ঢুকে পড়ে সেই বার্তা জেনে ফেলেছে, তা বিন্দুমাত্রও টের পাবেন না বার্তা বিনিময়কারীরা। এর পর যদি কোয়ান্টাম কম্পিউটার চালু হয়ে যায় তখন সেই বিপদ আরও বেড়ে যাবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে সেই বার্তা অনায়াসেই হ্যাক করা যাবে।
মজার ব্যাপার হল, হ্যাকিংয়ের বিরুদ্ধে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এই হাতিয়ার ধরার উপায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্রগুলির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। তারই ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির বিভিন্ন পদ্ধতি।
সুরক্ষিত বার্তা পাঠাতে এই রকম একটি পদ্ধতিই উর্বশী ব্যবহার করেছেন আরআরআই-এর গবেষণাগারে। ভারতে এটাই কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফির প্রথম সফল পরীক্ষা। যার ফলাফল ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তা বহু আলোচিতও।
হ্যাকিং কেন অসম্ভব কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগে?
কোয়ান্টাম ফিজিক্স দ্বারা সুরক্ষিত বার্তা-চালাচালিকে হ্যাক করতে পারবে না কোনও কোয়ান্টাম কম্পিউটারও।
সেটা করতে গেলেই দুই যমজ ফোটনের অন্য জন সেটা বুঝে ফেলবে। তখন দূরে থাকা তার যমজ ভাইয়ের আচার, আচরণ বদলে যাওয়ার বার্তাটা সে আর গ্রহণই করবে না।
কোয়ান্টাম রিলে ও রিপিটার
তবে শুধুই যে ছোটবেলার রিলে রেসের মতো এগোলেই হবে, তা কিন্তু নয়।
উর্বশীর কথায়, ‘‘তাতে খুব বেশি দূরত্ব পর্যন্ত কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের পর এক-একটা পয়েন্ট থাকে। যেখানে রিলে পদ্ধতিটা যে ভাবে এগিয়েছে, তার ছবিটা ধরা থাকে। এটাকে বলা হয় ‘মেমরি’। এই মেমরিকেও কাজে লাগাতে হবে। যা একটা রিপিটারের মতো বার্তাকে অনেক দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারবে। আমাদের কাজটা আসলে রিলে ও রিপিটারের মেলবন্ধন।’’
কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগ সম্ভব কত দূর পর্যন্ত?
উর্বশী বলছেন, ‘‘অসীম। যত দূর খুশি। তার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই।’’
তবে এটাও জানাচ্ছেন, পৃথিবীতে খুব বেশি হলে ৩০০ কি ৪০০ কিলোমিটার। কারণ, তার পরেই এসে পড়বে দিগন্ত (‘হরাইজ্ন’)। ফাইবারের মাধ্যমেও এই ধরনের টেলিযোগাযোগ হয়। কিন্তু ফাইবারের মাধ্যমে পাঠানো হলে কিছুটা তথ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
যেটা ‘ফ্রি-স্পেস’ (বায়ুমণ্ডল বা মহাকাশ)-এ একেবারেই হবে না। আর সেটা একমাত্র সম্ভব কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে। ইসরোর সঙ্গে এই রকম প্রকল্পেই উর্বশী কাজ করে চলেছেন। তার প্রাথমিক পর্বের কাজের পর এখন ১০০ মিটার বা তারও বেশি দূরত্ব পর্যন্ত সেটা করা যায় কি না, তারই কাজ চলছে এখন পুরোদমে।
এই রকম কাজের উপর ভিত্তি করেই রেলের ট্র্যাক যে ভাবে জোড়া হয়, সেই ভাবেই গোটা ভারতে এই কোয়ান্টাম টেলিযোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের।
সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রধান কারিগর বঙ্গললনা উর্বশীই।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: অধ্যাপক উর্বশী সিনহা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy