ইনসেটে, প্রয়াত অধ্যাপক মৃণাল দাশগুপ্ত। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
স্যর আইজাক নিউটন একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, তিনি যদি অন্যদের চেয়ে বেশি দূরে দেখতে পেয়ে থাকেন, তবে তার কারণটা হল, তিনি অতিমানবদের কাঁধের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলেন!
যে কোনও বিজ্ঞানীককেই এগোতে হয় তাঁর পূর্বসূরীদের কাজের ভিত্তিতে। এই বছর ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণার জন্য যাঁদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল তাঁরাও এর ব্যাতিক্রম নন। নোবেল পুরস্কারের অর্ধেকটা এ বার যে জন্য রজার পেনরোজকে দেওয়া হয়েছে, তাঁর (ও সেই সঙ্গে স্টিফেন হকিং-এর) সেই কাজের অন্যতম পূর্বসূরী ছিলেন কলকাতার এক জন মাস্টারমশাই। তদানীন্তন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক অমলকুমার রায়চৌধুরী। যাঁর জন্ম ১৯২৩ সালে। মৃত্যু ২০০৫-এ। কলকাতার সঙ্গে এ বারের এই অর্ধেক নোবেল পুরস্কারের যোগাযোগ নিয়ে সম্প্রতি বহু আলোচনা হয়েছে।
নোবেল পুরস্কারের বাকি অর্ধেকটা দেওয়া হয়েছে আন্দ্রিয়া ঘেজ এবং রাইনহার্ড গেনজেলকে। যাঁরা আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে সূর্যের চেয়ে ৪০ লক্ষ গুণ ভারী একটি দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোলের প্রথম সন্ধান দিয়েছিলেন। এই গবেষণারও এক জন পূর্বসূরী ছিলেন কলকাতারই আর এক মাস্টারমশাই। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়োফিজিক্স ও ইলেকট্রনিক্স বিভাগের অধ্যাপক মৃণালকুমার দাশগুপ্ত। তাঁরও জন্ম হয়েছিল ১৯২৩-এ। মৃত্যু ২০০৫ সালে। এ বারের নোবেল পুরস্কারের এই বাকি অর্ধেকটার সঙ্গে মৃণালের ১৯৫৩ সালের গবেষণার যোগাযোগ নিয়ে কোনও সাম্প্রতিক আলোচনা আমাদের চোখে পড়েনি। তাই এই প্রবন্ধের অবতারণা।
অমল তাঁর বিখ্যাত কাজটি করেছিলেন কলকাতায় বসে। আর মৃণাল তাঁর কাজটা করেছিলেন ইংল্যাণ্ডের ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সময়। যদিও ম্যাঞ্চেস্টারের সাড়ে ৩ বছর ছাড়া তাঁর কর্মজীবনের পুরোটাই কেটেছে কলকাতার সায়েন্স কলেজে।
দুই লেখক ঋতবান চট্টোপাধ্যায় এবং অর্ণব রায়চৌধুরী (ডান দিকে)।
‘সিগনাস-এ’ গ্যালাক্সিতে রেডিয়ো তরঙ্গের যুগ্ম উৎস আবিষ্কার
১৯৫০-এ তরুণ মৃণাল একটি স্কলারশিপের জন্য নির্বাচিত হন। যাতে তাঁর সুযোগ হয় ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার।
সেই যুগে রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষণাকেন্দ্র ছিল ম্যাঞ্চেস্টারের জড্রেল ব্যাঙ্কে। সেখানেই প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানী হ্যানবেরি ব্রাউনের তত্ত্বাবধানে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ মিলে যায় মৃণালের।
হ্যানবেরি ব্রাউনের আর এক ছাত্র ছিলেন রজার জেনিসন। মৃণালেরই সমবয়সী, ফলে দু’জনের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বও হয়ে যায়। দুই বন্ধু মিলে একটি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার করে ফেলেন।
আরও পড়ুন- হকিং, পেনরোজ কি উদ্ভাসিত অমল আলোয়? কী বলছে ইতিহাস
রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানের তখন শৈশব। রেডিয়ো তরঙ্গের অনেকগুলো মহাজাগতিক উৎস চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু আকাশে সেগুলোর একেবারে নির্ভুল অবস্থান বা সঠিক আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জানা ছিল, সিগনাস-এ নামে একটি গ্যালাক্সি রেডিয়ো তরঙ্গের একটি উৎস। কিন্তু গ্যালাক্সিটার ভিতরে ঠিক কোন জায়গা থেকে রেডিয়ো তরঙ্গ বেরিয়ে আসছে তার হদিশ তাঁরা তখনও পাননি।
জড্রেল ব্যাঙ্কে মৃণাল দাশগুপ্ত (সৌজন্যে: জড্রেল ব্যাঙ্কের সংরক্ষণাগার)
আমরা জানি, যে টেলিস্কোপ আকারে যত বড় তার সাহায্যে কোনও নক্ষত্রের আকৃতি ও অভ্যন্তরীণ গঠন তত ভাল ভাবে দেখতে পাওয়া যায়।
৪০-এর দশকের শেষ ভাগে রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন যার মাধ্যমে একটি সুবিশাল রেডিয়ো টেলিস্কোপ ছাড়াও কোনও রেডিয়ো নক্ষত্রের আকৃতি নির্ণয় করা সম্ভব হল।
ধরা যাক, ১ কিলোমিটার ব্যবধানে রাখা দু’টো ছোট রেডিয়ো টেলিস্কোপ এক সঙ্গে একটা জ্যোতিষ্ককে পর্যবেক্ষণ করছে। এই দু’টো রেডিয়ো টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণের সমন্বয় ঘটিয়ে জ্যোতিষ্কটির এমন একটা ছবি বানানো গেল যা অনেকাংশেই ১ কিলোমিটার আয়তনের একটা রেডিয়ো টেলিস্কোপ দিয়ে তোলা ছবির প্রায় সমতুল্য।
এই পদ্ধতির নাম ‘রেডিয়ো ইন্টারফেরোমেট্রি’। যার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্টিন রাইল। যিনি নোবেল পান ১৯৭৪ সালে। জড্রেল ব্যাঙ্কে এই পদ্ধতিটিরই আরও উন্নতি ঘটালেন হ্যানবেরি ব্রাউন।
এই পদ্ধতিতে সিগনাস-এ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে রজার জেনিসন এবং মৃণাল দাশগুপ্ত যে অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারটা করে বসলেন তার জন্য সেই সময় কেউই তৈরি ছিলেন না। তাঁরা দেখতে পেলেন, রেডিয়ো তরঙ্গের উৎসটা গ্যালাক্সির ভিতরে নেই। বরং গ্যালাক্সির খানিকটা বাইরে তার দু’পাশে দু’টো রেডিয়ো তরঙ্গের উৎস রয়েছে।
রেডিয়ো তরঙ্গ ব্যবহার করে সিগনাস-এ’র যে ছবিটা তাঁরা তুললেন সেটা নীচে দেওয়া হল।
রজার-মৃণালের তোলা সিগনাস-এ’র ছবি। (গ্যালাক্সিটি রয়েছে দু’টি আয়তক্ষেত্রের মাঝামাঝি জায়গায়)।
যেন একটা ভুতুড়ে ব্যাপার। গ্যালাক্সির দু’পাশে প্রায় দেড় লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে মহাকাশের দু’টো শূন্যস্থান থেকে রেডিয়ো তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে।
রজার এবং মৃণালের সেই গবেষণাপত্রটি ’৫৩-য় ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতেই আলোড়ন পড়ে যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে। কোনও বিজ্ঞানীই এই অদ্ভূত আবিষ্কারের কোনও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না।
সেই সময়ের বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। তাই রজার এবং মৃণালের আবিষ্কারের সঙ্গে যে ব্ল্যাক হোলের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা বুঝে উঠতেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আরও প্রায় ১৫ বছর লেগেছিল।
স্বাভাবিক ভাবেই রজার এবং মৃণালের গবেষণাপত্রের কোনও অংশেই ‘ব্ল্যাক হোল’ কথাটা এক বারও উল্লিখিত হয়নি।
সক্রিয় গ্যলাক্সির কেন্দ্রে ব্ল্যাক হোলের কাণ্ডকারখানা
মেঘের বর্ণনা দিতে গিয়ে কালিদাস লিখেছিলেন, মেঘ হল ‘ধূমজ্যোতিসলিলমরুতাংসন্নিপাতঃ’। যার অর্থ, ধূম, জ্যোতি, জল ও বায়ুর সমষ্টি মেঘ। তেমনই একটা গ্যালাক্সি হল নক্ষত্র, গ্যাস ও ধূলিকণার সমষ্টি।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী, আমাদের গ্যালাক্সিতে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র। একটা গ্যালাক্সি থেকে বেরিয়ে আসা আলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্যালাক্সিটার ভিতরে থাকা নক্ষত্রগুলোর সমন্বয়।
কিন্তু ১৯৪৩ সালে কার্ল সিফার্ট কতগুলো গ্যালাক্সিকে শনাক্ত করলেন, যেগুলোর কেন্দ্র খুব উজ্জ্বল।
সেই প্রথম বোঝা গেল, সব গ্যালাক্সির আলো শুধুই তাদের ভিতরে থাকা নক্ষত্রগুলির আলোর সমন্বয় নয়, গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও অন্য কিছু একটা থাকতে পারে।
যে সব গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এই রকম কিছু থাকে সেই সব গ্যালাক্সিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ‘সক্রিয় গ্যালাক্সি’ নাম দিলেন।
সিফার্টের গবেষণার ভিত্তি ছিল দৃশ্যমান আলো। যে আলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হল তখন বিজ্ঞানীরা মহাকাশ দেখার জন্য যেন একটা নতুন ‘চোখ’ পেয়ে গেলেন। সেই নতুন চোখের সহায়তায় সক্রিয় গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণাও দ্রুত গতিতে এগোতে লাগল।
প্রাথমিক ভাবে মনে হতে পারে, রজার এবং মৃণালের কাজের সঙ্গে সক্রিয় গ্যালাক্সির কোনও সম্পর্কই নেই।
কারণ, তাঁরা তো গ্যালাক্সির কেন্দ্রে কিছু দেখেননি। রেডিয়ো তরঙ্গের উৎসদু’টিকে তাঁরা দেখেছিলেন সিগনাস-এ গ্যালাক্সির বাইরে, খানিকটা দূরে। দেখেছিলেন, গ্যালাক্সির বাইরের শূন্যস্থান থেকে রেডিয়ো তরঙ্গ আসছে।
রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁদের কাজ কেন সক্রিয় গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণার প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়, সেই আলোচনায় একটু পরে আসছি।
আরও পড়ুন- আমার বন্ধু রজার
৬০-এর দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা রেডিয়ো তরঙ্গের কতগুলো উৎস আবিষ্কার করলেন। যেগুলোকে বলে, ‘কোয়েজার’।
বেশির ভাগ কোয়েজারই দৃশ্যমান আলোতেও দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলিকে অনেকটা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেখতে লাগে। কোয়েজারগুলো যে ঠিক কী বস্তু, তা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে সেই সময় কয়েক বছর ধরে তীব্র বাদানুবাদ চলেছিল।
মার্টেন স্মিড্ট এবং আরও কয়েক জন বিজ্ঞানীর গবেষণায় শেষ পর্যন্ত বোঝা যায়, কোয়েজারগুলো আসলে অত্যন্ত শক্তিশালী সক্রিয় গ্যালাক্সি। তাঁরা এও দেখালেন, কোয়েজারগুলোর কেন্দ্রগুলি আয়তনে আমাদের সৌরমণ্ডলের চেয়ে বড় নয়, কিন্তু এগুলোর ঔজ্জ্বল্য বহু ক্ষেত্রেই একটা গ্যালাক্সির সমান! অর্থাৎ, সূর্যের প্রায় ১০ হাজার কোটি গুণ।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠল, একটা ছোট জায়গা থেকে এত বিপুল পরিমাণে শক্তির বিকিরণ কী ভাবে হতে পারে?
১৯১৫ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব অনুমিত হল। ব্ল্যাক হোলের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের বল এত বেশি যে আলোও সেই বল কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে না।
প্রায় অর্ধেক শতাব্দী ধরে অধিকাংশ জ্যোতির্বিজ্ঞানীই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বে সন্দিহান ছিলেন। অনেকে আবার মনে করতেন, ব্ল্যাক হোল থাকলেও তার অস্তিত্ব কখনও আমাদের টেলিস্কোপে ধরা পড়বে না, কারণ ব্ল্যাক হোলের ভিতর থেকে তো আলো বেরিয়ে আসতে পারে না।
মস্কো ও কেম্ব্রিজের কয়েক জন তাত্ত্বিক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী অবশেষে দেখালেন, যদি আমরা ধরে নিই যে একটা সক্রিয় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে সূর্যের চেয়ে কয়েক লক্ষ থেকে কয়েক কোটি গুণ ভারি ব্ল্যাক হোল রয়েছে, তা হলে সমস্ত পর্যবেক্ষণ সুষ্ঠু ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।
আরও পড়ুন- দার্জিলিঙের সকালে রজার আমাকে সৃষ্টির রূপ বোঝাতে শুরু করলেন
অনেক গ্যালাক্সিরই কেন্দ্রের আশেপাশে গ্যাসের ভাণ্ডার যথেষ্টই মজুত রয়েছে। ব্ল্যাক হোলের প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণের টানে এই গ্যাস ক্রমাগতই আকৃষ্ট হতে থাকে।
স্কুলের উঁচু ক্লাসের পদার্থবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে একটা আলোচনা থাকে।সকোনও বস্তু মাধ্যাকর্ষণের টানে নিচের দিকে নামতে থাকলে তার স্থিতিশক্তি কমতে থাকে। ব্ল্যাক হোলের টানে যে গ্যাস আকৃষ্ট হয়, সেই গ্যাস ব্ল্যাক হোলের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার আগেই তার হ্রাসপ্রাপ্ত স্থিতিশক্তির অনেকটা বিকিরণে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। এই ভাবেই ব্ল্যাক হোলের আশপাশে খুব অল্প জায়গার মধ্যে প্রচণ্ড বিকিরণ সৃষ্টি হয়ে নিঃসৃত হতে থাকে।
এটাই যে সক্রিয় গ্যালাক্সির উজ্জ্বল কেন্দ্রের সবচেয়ে সুসঙ্গত ব্যাখ্যা, তা আজ প্রায় সব জ্যোতির্বিজ্ঞানীই মেনে নিয়েছেন।
যুগ্ম রেডিও লোবে শক্তির সরবরাহ
রজার জেনিসন এবং মৃণাল দাশগুপ্তের আবিষ্কারের সঙ্গে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাক হোলের কী সম্পর্ক সেই আলোচনায় আমরা এ বার আসব।
প্রথমেই বলে নিই, রজর-মৃণালের ’৫৩ সালের আবিষ্কারের কয়েক বছরের মধ্যেই রেডিও ইন্টারফেরোমেট্রি ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আরও বেশ কয়েকটি মহাজাগতিক রেডিয়ো উৎসে একই রকম যুগ্ম গঠন দেখতে পেলেন।
বোঝা গেল, জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে সিগনাস-এ একমেবাদ্বিতীয়ম নয়।
গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দূরে দু’পাশে যে দু’টো জায়গা থেকে রেডিয়ো তরঙ্গের সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলোকে বলা হয় ‘রেডিয়ো লোব’।
বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখালেন, সিগনাস-এ’র রেডিয়ো লোবদু’টি থেকে মোট যতটা রেডিয়ো তরঙ্গের বিকিরণ হচ্ছে তার শক্তি প্রায় ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র থেকে বেরিয়ে আসা আলোর শক্তির সমান।
মূল গ্যালাক্সি থেকে অত দূরে কী ভাবে এই পরিমাণ শক্তির বিকিরণ হচ্ছে, তার উত্তর খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানীদের আরও কয়েক বছর সময় লেগে গেল।
আমরা অনেক সময়ই বলে থাকি, হাজারটা কথায় যার ব্যাখ্যা হয় না, তা শুধুমাত্র একটা ছবিতেই বুঝিয়ে দেওয়া যায়। এ বার আমরা একটা ছবি দেখাব যেটা দেখে পাঠকেরা নিজেরাই হয়তো আমাদের প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে যাবেন।
ছবিটা হল, সাম্প্রতিক কালের পৃথিবীর একটা শ্রেষ্ঠ রেডিয়ো টেলিস্কোপ দিয়ে ইন্টারফেরোমেট্রি পদ্ধতি ব্যবহার করে তোলা সিগনাস-এ’র ছবি। রজার এবং মৃণালের ’৫৩ সালে তোলা ছবির সঙ্গে এই ছবিটার তুলনা করলেই বোঝা যায়, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রেডিয়ো ইন্টারফেরোমেট্রি পদ্ধতিটার কী অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল।
ইন্টারফেরোমেট্রি পদ্ধতি ব্যবহার করে তোলা সিগনাস-এ’র ছবি (ন্যাশনাল রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি অবজারভেটরির সৌজন্যে)
কী ভাবে তৈরি হচ্ছে রেডিয়ো জেট?
সিগনাস-এ’র এই আধুনিক ছবিটায় স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে দু’পাশে দু’টো সরু গ্যাসের প্রবাহ। যেগুলোকে আমরা ‘রেডিও জেট’ বলি, তা বেরিয়ে এসেছে। এই জেটগুলো যেখানে শেষ হয়েছে সেখানেই লোবগুলোর সৃষ্টি।
অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে জেটের মধ্যে দিয়ে যে শক্তি লোবগুলোতে এসে পৌঁছচ্ছে, সেই শক্তিই লোবগুলো থেকে রেডিয়ো তরঙ্গ হয়ে বিকিরিত হচ্ছে।
এ বার আমাদের সামনে যে প্রশ্নটা উঠে এল, তা হল; এই জেটগুলো কী ভাবে তৈরি হচ্ছে?
বেগেলম্যান, ব্ল্যাণ্ডফোর্ড ও রিসের প্রবন্ধে রজার-মৃণালের কাজের উল্লেখ
পৃথিবী যেমন নিজের অক্ষ ঘিরে ২৪ ঘন্টায় আবর্তিত হচ্ছে, ঠিক সেই ভাবেই গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাক হোলগুলোও নিজেদের অক্ষ ঘিরে আবর্তিত হয়ে চলেছে বলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
এই রকম ঘূর্ণমান ব্ল্যাক হোলের উপর আশপাশ থেকে যে গ্যাস এসে পড়তে থাকে সেই গ্যাসের খানিকটা ব্ল্যাক হোলের মেরু অঞ্চল থেকে সবেগে নিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে।
এই ভাবেই যে রেডিয়ো জেটের সৃষ্টি হচ্ছে তা ১৯৭০-এর দশকে মার্টিন রিস, রজার ব্ল্যান্ডফোর্ড এবং তাঁদের সহকর্মীরা বিস্তারিত গণনা করে দেখালেন।
আরও পড়ুন- ‘আমার তত্ত্বের ফাঁকফোকর খুঁজছি, তোমরাও খুঁজে দেখ’, এখনও বলেন জিম পিবল্স
জেট ও লোব যে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাক হোল থেকে উৎপন্ন হচ্ছে তা আজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে স্বীকৃত।
রজার এবং মৃণালের আবিষ্কৃত সিগনাস-এ’র রেডিয়ো লোব যে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, তা আজ আর আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সিফার্টের যাত্রাপথে স্মরণীয় পদক্ষেপ রজার-মৃণালের
আমাদের গ্যালাক্সিকে যে হেতু সক্রিয় গ্যালাক্সি নয় বলেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তাই আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও ব্ল্যাক হোল রয়েছে কি না তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে খানিকটা সন্দেহ ছিল।
এই বছরের নোবেলজয়ী গেনজেল এবং ঘেজের গবেষণার ফলে ২০০৯-’১০ সাল নাগাদ বোঝা গেল, আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও ব্ল্যাক হোল রয়েছে। তাঁদের কাজ নিয়ে সম্প্রতি অনেক আলোচনা হয়েছে। তাই তাঁদের কাজের বিস্তৃত আলোচনায় যাব না।
সিফার্টের ’৪৩ সালের গবেষণাপত্রে যে যাত্রাপথের শুরু, সেই যাত্রাপথের অন্যতম পদক্ষেপ গেনজেল এবং ঘেজের আবিষ্কার।
গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ব্ল্যাক হোল সন্ধানের এই যাত্রাপথে সিফার্টের কাজের পরে রজার এবং মৃণালের কাজই নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
মৃণালের জীবন নিয়ে কয়েকটা কথা লিখে আমাদের আলোচনার ইতি টানব। তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশালে, ১৯২৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এসসি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই এল স্বাধীনতা ও দেশভাগ। তাঁর পরিবারের সকলেই সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতায় চলে আসার। সৌভাগ্যবশত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিশির কুমার মিত্রের সহকারীর কাজ পেয়ে গেলেন মৃণাল। শিশিরের উদ্যোগেই ম্যাঞ্চেস্টারে গিয়ে রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানের কাজ হাতেকলমে শেখার ব্যবস্থা হয়ে যায় মৃণালের। ম্যাঞ্চেস্টার থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে মৃণাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপকের পদ পান এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত করেন।
মৃণাল দাশগুপ্তই যে প্রথম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় রেডিয়ো জ্যোতির্বিজ্ঞানী সেই কথাটা আমরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
(অর্ণব রায়চৌধুরী বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের অধ্যাপক। ঋতবান চট্টোপাধ্যায় কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।)
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy