পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে এল১ পয়েন্টে পৌঁছল আদিত্য-এল১। —ফাইল চিত্র।
ছোটবেলায় দেখতাম বিদেশি স্যাটেলাইট, বিদেশি যন্ত্রপাতির উপর নির্ভর করে গবেষণা চলছে। এখন যখন দেখি দেশীয় প্রযুক্তিতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আকাশ ছুঁচ্ছেন, দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত দূর এগিয়ে গিয়েছে— শিহরণ জাগে। বিশেষ করে, গত দশ বছরে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো-র হাত ধরে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায়।
২০০৫-’০৬ সাল। আমি তখন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এর সঙ্গে যুক্ত। সূর্যের উপর নজর রাখতে মহাকাশ অভিযানের কথা প্রথম বার ভাবা হয়েছিল সে সময়ে। করোনাগ্রাফ মেশিন তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালে এসে শিকে ছেঁড়ে। ইসরোর তরফ থেকে জানানো হয়, এই করোনাগ্রাফ মেশিনটিই লাগরাঞ্জিয়ান পয়েন্ট (এল১)-এ পাঠানো যেতে পারে, কিংবা আমরা চাইলে যন্ত্রের আরও আধুনিকীকরণ করতে পারি। এ প্রস্তাব পাওয়ার পরে আর ঘুরে তাকাইনি আমরা।
কাট টু ২০২৪ সাল। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে এল১ পয়েন্টে পৌঁছল আদিত্য-এল১। প্রথম চেষ্টাতেই সফল হল ইসরোর সৌর-অভিযান। এই প্রকল্পে আমি সায়েন্স ওয়ার্কিং গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান। ইসরো এবং দেশের বিভিন্ন গবেষণাগার, বেশ ক’টি বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের বহু বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্রছাত্রী এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। গত দশ বছর ধরে গবেষণা চলেছে। আরও উন্নত করোনাগ্রাফযন্ত্র তৈরি করেছে আমাদের দল। আদিত্য-এল১-এ ৭টি যন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে ৪টি রিমোট সেন্সিং ইনস্ট্রুমেন্ট এবং ৩টি ইনসিটু ইনস্ট্রুমেন্ট। এল১ পয়েন্ট থেকে সূর্যের উপর নজর রাখা হবে। এই পয়েন্টের বিশেষত্ব হল, এখান থেকে একটানা সূর্যের উপর পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব, কখনও সূর্যগ্রহণও হয় না।
এই এল১ পয়েন্টেই রয়েছে ‘সোলার অ্যান্ড হেলিওস্ফেরিক অবজ়ারভেটরি’ (সোহো)। ‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’ (ইএসএ) তৈরি করেছিল মহাকাশযানটি। যদিও এটি আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ও ইএসএ-র যৌথ অভিযান। ১৯৯৫ সালে সোহো-র উৎক্ষেপণ হয়েছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে পুরোপুরি ভাবে কাজ শুরু করে সে। সোহোতে ১৩টি ইনস্ট্রুমেন্ট ছিল। বেশির ভাগ যন্ত্রই এখন আর কাজ করে না। কিন্তু তা-ও যানটি সক্রিয় রয়েছে। তার ২টি করোনাগ্রাফ যন্ত্র এখনও কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে কেউ বলতেই পারেন, নাসা ১৯৯৫ সালে যে জায়গায় মহাকাশযান পাঠিয়েছিল, ইসরো ২০২৩-’২৪ সালে সেখানে যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। আমাদের লক্ষ্য হল, সোহো যা যা করেনি, সেই শূন্যস্থানগুলো পূরণ করা। সোহোতে যেযন্ত্রগুলি ছিল না, সেই সব যন্ত্র রয়েছে আদিত্য-এল১-এ। বিজ্ঞান এমনই। একে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে ধাপে ধাপে সার্বিক ভাবে এগোনো। গবেষণা চলতে থাকবে। এর কোনও শেষ নেই। আদিত্যের গন্তব্যে পৌঁছনো নিয়ে চিন্তা ছিল। তা ভাল ভাবে মিটেছে। এ বার আসল কাজ শুরু। ইসরোর একের পর এক সাফল্য কিন্তু সত্যিই অভাবনীয়।
স্বল্প খরচ, বিশ্বাসযোগ্যতা— এই দু’টি বিষয়ের জন্য মহাকাশ-বাণিজ্যে ভারতের চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে। এর পাশাপাশি, গবেষণার সুযোগ পেতে এত দিন যে বিজ্ঞানীরা বিদেশ পাড়ি দিতেন, তাঁরা ঘরমুখো হবেন। আমিও সাত বছর বিদেশে গবেষণা করে ফের দেশে এসে কাজ করছি। আমেরিকার মতো দেশে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে। ভারতে এখনও সে তুলনায় সুযোগ কম। কিন্তু ছবিটা বদলাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় ওয়ার্কশপ করছি। ডেটা হ্যান্ডলিং ও আরও নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কলকাতাতেও ওয়ার্কশপ করার ভাবনাচিন্তা রয়েছে। চন্দ্রযানের সাফল্যের পরে দেখেছি, মানুষের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা। জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান-সচেতনতা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে উৎসাহও। আনন্দের বিষয়, সরকারও সেটা বুঝতে পারছে। তাদের সাহায্যে আমরা আরও এগিয়ে যাব।
লেখক পরিচিতি: ডিরেক্টর, আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব অবজ়ারভেশনাল সায়েন্সেস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy