Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Science News

রামানুজনের পূণ্যভূমির মাটিই কি উতরে দেবে বিক্রমকে?

রামানুজনের সেই আরাধ্যা দেবীর মন্দিরের মাটিতেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল ল্যান্ডার বিক্রমকে। এক বার দু’বার নয়। বার বার। চাঁদ মুলুকে রওনা হওয়ার আগে।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

বিমান নাথ
বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৪:০৮
Share: Save:

নামাক্কালের সেই বিখ্যাত মহালক্ষ্মী দেবীর মন্দিরেরই দ্বারস্থ হতে হয়েছিল ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোকে! ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’কে নিয়ে চন্দ্রযান-২-কে চাঁদ মুলুকে পাঠানোর জন্য।

যে মন্দিরে রয়েছেন কিংবদন্তী গণিতপ্রতিভা শ্রীনিবাস রামানুজনের আরাধ্যা দেবী মহালক্ষ্মী। যাঁর উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল রামানুজনের। মন্দিরের মহালক্ষ্ণী দেবীর ভক্ত ছিলেন গণিতবিদ রামানুজন। মনে করতেন, নামাক্কালের মহালক্ষ্মী দেবীর বর ছাড়া গণিতে তাঁর কোনও গবেষণাই সফল হত না।

রামানুজনের সেই আরাধ্যা দেবীর মন্দিরের মাটিতেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল ল্যান্ডার বিক্রমকে। এক বার দু’বার নয়। বার বার। চাঁদ মুলুকে রওনা হওয়ার আগে।

ওই অগ্নিপরীক্ষায় উতরে যেতে না পারলে আর বিক্রমের যাওয়াই হত না চাঁদে। চাঁদ অধরা থেকে যেত বিক্রমের শরীরের ভিতরে থাকা রোভার প্রজ্ঞানেরও।

নামাক্কালের মাটিতেই অগ্নিপরীক্ষা হয় বিক্রমের

তামিলনাড়ুর সালেমের কাছে নামাক্কালের মাটি যে খুবই অন্য রকমের। অভিনব। যে ধরনের মাটি চট করে ভূপৃষ্ঠে পাওয়া যায় না। ভারতেও দাক্ষিণাত্য (দক্ষিণ ভারতের কোনও কোনও অংশ) ছাড়া সেই মাটি যে খুবই দুর্লভ।

কারণ, সেই মাটি অনেকটাই চাঁদের মতো। বিজ্ঞানের পরিভাষায়, যে মাটির নাম- ‘এনোর্থোসাইট’।

কিংবদন্তী গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন, (পিছনে) তামিলনাড়ুর নামাক্কালে সেই বিখ্যাত মহালক্ষ্ণী দেবীর মন্দির

ভূতত্ত্ববিদরা জানিয়েছিলেন, সালেমের কাছে নামাক্কালেই ‘এনোর্থোসাইট’ নামে এক ধরনের আগ্নেয়শিলা পাওয়া যায়। যা গুঁড়ো করে চাঁদের মাটির মতো মাটি পাওয়া যেতে পারে।

কেন নামাক্কালের মাটির প্রয়োজন হয়েছিল ইসরোর?

আমেরিকার বিভিন্ন ‘অ্যাপোলো’ অভিযানের মহাকাশচারীরা চাঁদ থেকে যে সব পাথরের টুকরোটাকরা কুড়িয়ে এনেছিলেন, তাতে এই এনোর্থোসাইট ছিল প্রচুর পরিমাণে। বিশেষ করে, চাঁদের যে অংশগুলিকে আমরা অত্যন্ত উজ্জ্বল দেখি, অর্থাৎ ‘চাঁদের কলঙ্কে’র অংশ থেকে দূরে যে এলাকাগুলি, সেই সব জায়গায় এই পাথর এবং মাটি পাওয়া যায়।

ভূপৃষ্ঠেও কিছু কিছু জায়গায় পাওয়া যায় এনোর্থোসাইট। যেখানে ভূগর্ভস্থ ম্যাগমা ওপরে উঠে এসেছে এবং অপেক্ষাকৃত ভাবে হাল্কা হওয়ার জন্য সেই এনোর্থোসাইট ভূপৃষ্ঠের উপরে ভেসে উঠেছে। যেমনটা হয়েছে নামাক্কালের মতো ভারতের দাক্ষিণাত্যেরও বিভিন্ন অংশে।

ভাগ্যিস, এমন এক ধরনের পাথর কাছাকাছি পাওয়া গিয়েছিল! তাই সহজে কাছাকাছি একটি গবেষণাগারও বানিয়ে ফেলেছিল ইসরো। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সেই গবেষণাগারে চাঁদের পরিবেশও তৈরি করা হয়েছিল।

সেখানেই ‘বিক্রম’কে চাঁদে নামানোর রিহার্সাল দেওয়া হয়েছে বার বার। নামাক্কাল থেকে সেই মাটি নিয়ে আসার জন্য ঠিকাদাররা কোনও টাকাও নেননি। ফলে, খরচও বিশেষ হয়নি ইসরোর বিক্রমের অগ্নিপরীক্ষা নিতে।

তবু রিহার্সাল আর স্টেজে অভিনয় যে এক নয়!

কিন্তু যতই রিহার্সাল দেওয়া হোক না কেন, আসল অনুষ্ঠানের সময় স্টেজে উঠে প্রায় সকলকেই ঢোঁক গিলতে হয়। তাই বিক্রমের অবতরণের শেষ পনেরো মিনিট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমন অনেক কিছুই তখন ঘটতে পারে, যার ফলে ইসরোর এত দিনের যাবতীয় গবেষণাই বিফলে যেতে পারে। বিক্রমকে চাঁদে নামানোর সময় তার গতি চটপট কমাতে ‘ব্রেক’ কষতে হবে। তার জন্য ‘থ্রাস্টার’ চালাতে হবে। চাঁদে তো আর বায়ুমণ্ডল নেই যে, প্যারাসুট খুলে ধীরে ধীরে নেমে পড়া যাবে!

বিক্রম নামার সময় চাঁদের মাটিতে ধুলো উড়লেই সর্বনাশ!

তাই আলতো ভাবে চাঁদের মাটিতে পালকের মতো ‘পা’ ছোঁয়াতে গেলে (সফ্‌ট ল্যান্ডিং) ছোট একটা ‘রকেট’ চালাতে হবে। তার জন্য যদি চাঁদের মাটির ধুলো ওড়ে, তা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে, তা হলে খুব মুশকিল! সেই ধূলিকণা গিয়ে আবার না বেতার যোগাযোগের যন্ত্রের উপরে পড়ে। তা হলেই সর্বনাশ! পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটতে পারে। অবতরণের শেষ মুহূর্তের চটজলদি সিদ্ধান্তগুলো বিক্রমকে জানানোর কাজটা কঠিন হয়ে যেতে পারে।

যে ভাবে পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌঁছচ্ছে বিক্রম ও প্রজ্ঞান, দেখুন ভিডিয়ো

পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চাঁদে যাওয়া তো খুব সহজ ছিল না

তার আগে গত কাল পর্যন্ত ইসরোকে যে কাজগুলি করে যেতে হয়েছে চন্দ্রযান-২ থেকে বিক্রমকে আলাদা করা ও বিক্রমকে ধীরে ধীরে চাঁদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সেটাও ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চন্দ্রযান-২ থেকে বিক্রমকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে তিন দিন আগে। এখন যে অংশটি চাঁদের চার দিকে ঘুরছে, সেটি চাঁদের মাটি থেকে ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে থাকবে। আর আলাদা হয়ে যাওয়া অংশটি এখন এমন একটি কক্ষপথে ঘুরছে, যা তাকে চাঁদের মাটি থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে এনে আবার ১০০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে যাবে।

তখন পৃথিবীর মায়া কাটাতে ধাক্কা মেরে ঠেলা হয়েছে চন্দ্রযান-২-কে

মনে হতেই পারে, এই ভাবে কাছে এনে আবার দূরে নিয়ে যাওয়ার দরকারটা কী ছিল? আসলে এখন যা করা হচ্ছে, সেটা পৃথিবী থেকে চাঁদে পাঠানোর সময় যা করা হয়েছিল, তার ঠিক উল্টো কাজটা। যখন চন্দ্রযান-২-কে রকেটে চাপিয়ে পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল তখন তাকে পৃথিবীর চার দিকে ঘোরানো হয়েছিল।

ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’

চন্দ্রযান-২ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসছিল, তখনই তাকে একটু একটু করে ধাক্কা দিয়ে একটা লম্বাটে কক্ষপথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল। যাতে সেই লম্বাটে আবর্তনপথের (উপবৃত্তাকার কক্ষপথ) সর্বোচ্চ সীমায় তাকে ধীরে ধীরে চাঁদের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়। তার ফলে, বেশি জ্বালানি খরচ না করেই চাঁদ মুলুকে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল চন্দ্রযান-২-কে।

এখন করা হচ্ছে উল্টো কাজ

এখন ঠিক তার উল্টো পদ্ধতিতে চাঁদের মাটির কাছে নিয়ে আসা হচ্ছে চন্দ্রযান-২ ও ল্যান্ডার বিক্রমকে। যেহেতু চন্দ্রযান-২-এর মূল অংশটি ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকবে, তাই ভারতীয় মহাকাশযানের থেকে বিক্রমকে আলাদা করে তাকে এমন একটা লম্বাটে কক্ষপথে (উপবৃত্তাকার) রাখা হল, যাতে সেই পথের একটি অংশ চাঁদের মাটির খুব কাছে চলে আসতে পারে। বিচ্ছিন্ন করার ঠিক পরের মুহূর্তে বিক্রম যে কক্ষপথে ছিল, তা কাটছাঁট করে এখন ৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে।

শেষের সেই বিপজ্জনক ১৫ মিনিট!

তবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে তার গন্তব্যে বিক্রমকে নামিয়ে আনার কাজটিই হতে চলেছে সবচেয়ে বিপজ্জনক। উপর থেকে নিচে চাঁদের মাটিতে নামিয়ে আনার সময় প্রতি মুহূর্তে চোখে চোখে রাখতে হবে বিক্রমকে। হুড়মুড় করে যাতে না এসে পড়ে চাঁদের পিঠে। নামার সময় বিক্রমে রাখা ক্যামেরা দিয়ে লক্ষ্য রাখা হবে, যেখানে নামছে সেই জায়গাটি বিপজ্জনক কি না। যদি মনে হয়, সেখানে নামলে বিক্রমের ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা হলে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে কাছেপিঠেই নামার জন্য অন্য জায়গা খুঁজতে হবে।

রামানুজনের আরাধ্য দেবীর আশীর্বাদই হয়তো সেই হিমশীতল উত্তেজনার অন্তিম মুহূর্তে উতরে দেবে বিক্রমকে!

লেখক রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত, বেঙ্গালুরুর রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী

ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস ও শৌভিক দেবনাথ

অন্য বিষয়গুলি:

Chandrayaan 2 VIKRAM Lander Ramanujan Moon Biman Nath বিক্রম চন্দ্রযান ২
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy