Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

এখনও ব্যর্থ বলার সময় আসেনি, ল্যান্ডিং না হোক যাত্রাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়

এই অরবিটারেই আছে দু’টো অত্যন্ত শক্তিশালী হাই-রেজ়োলিউশন ক্যামেরা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এর আগে কখনও পা পড়েনি।

ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

সোমক রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০২:০৭
Share: Save:

বিক্রম হঠাৎ সিগন্যাল পাঠানো বন্ধ করে দিল কেন! এ বার তা হলে কী হবে? শুক্রবার মাঝরাত থেকেই প্রশ্নগুলো ঘুরছে অনেকের মনে। কিন্তু চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি নামার ঠিক আগে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, ইসরো কিছু জানায়নি। তাই আসল কারণ বলা মুশকিল। সংস্থার প্রধান কে শিবন শুধু জানিয়েছেন, তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ‌এখন তাই অপেক্ষার পালা। ক’ঘণ্টা, কত দিন— কিছুই জানা নেই।

চাঁদের মাটি থেকে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে বিক্রম যখন তার পেটে রোভার প্রজ্ঞানকে নিয়ে অরবিটার থেকে বেরিয়ে এসেছিল, তখন তার গতিবেগ ছিল প্রায় ৬ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। সেই অবস্থা থেকে ক্রমে দূরত্ব কমিয়েছে বিক্রম। আর প্রস্তুতি নিয়েছে ‘সফ্‌ট ল্যান্ডিং’-এর। পালকের মতো নামা মানে, সে সময়ে ল্যান্ডারের গতিবেগ হওয়ার কথা ছিল ২ মিটার/সেকেন্ড। খুব বেশি হলে ৫ মিটার/সেকেন্ড। আমাদের গাড়িতে যাতায়াতের হিসেবে ১৮ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। এর বেশি গতিবেগ থাকলে ঝামেলা।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায় ঠিকঠাক গতিবেগ কমিয়েই নামছিল বিক্রম। তার পর দেখলাম, চাঁদে নামার যে গতিপথ ঠিক করা ছিল, সেখান থেকে হঠাৎ যেন একটু বেরিয়ে এল বিক্রম। যে ভাবে গতি কমছিল, তা-ও যেন ধাক্কা খেল। চাঁদের মাটি থেকে বিক্রম যখন ২.১ কিলোমিটার দূরে, তখন তার গতিবেগ ছিল ৫০ মিটার/সেকেন্ড অর্থাৎ ১৮০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। অর্থাৎ, আরও বেশ খানিকটা গতি কমাতে হত। সেটা কি হয়নি? বিপরীতমুখী যে থ্রাস্টারগুলির কাজ ছিল গতি কমানো, তার এক বা একাধিক কি শেষ মুহূর্তে কাজ করেনি? এমন হলে তো ঘোরতর বিপদ। আশঙ্কা তাই থাকছেই।

যে পথে নিরুদ্দেশ

শুক্রবার
রাত ১টা ৩৮ মিনিট


• ঠিক ছিল, চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে বিক্রম অবতরণ শুরু করবে (রাফ ব্রেকিং)।
• তা-ই হল। চালু
চারটে ইঞ্জিন।
• ঠিক ছিল, প্রথম ১০ মিনিটে খাড়া নেমে আসবে তরতরিয়ে। সেই সঙ্গে কমে আসবে গতি।
• হিসেব মতোই হল।

১টা ৪৮মিনিট
• প্রথম পর্যায়ের অবতরণ শেষ। মাটি থেকে বিক্রমের উচ্চতা ৭.৪ কিমি।
• অবতরণের দ্বিতীয় ধাপ শুরুর কথা (ফাইন ব্রেকিং)। গতিপথ হবে অধিবৃত্তাকার। সে উচ্চতাও কমাবে, আবার আনুভূমিক গতি কমিয়ে সামনে এগোবে।
• কাজ শুরু

১টা ৪৯ মিনিট
• ইসরোর কন্ট্রোল রুমে ঘোষণা, বিক্রম মাটির আরও কাছাকাছি। মোট অধিবৃত্তাকার গতিপথের অর্ধেক পেরিয়ে গিয়েছে।

১টা ৫১ মিনিট
• চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে বিক্রমের উচ্চতা ২.১ কিমি। গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১৮০ কিমি। এই পর্যায়ে বিক্রমের গতি আরও কমার কথা ছিল। আচমকাই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

ইসরোর প্রস্তুতিতে গলদ ছিল না। বিক্রমের পা বা স্ট্যান্ডের ডিজাইনও করা হয়েছিল খুব ভেবেচিন্তে। ‘শক অ্যাবজর্ব’ করার প্রযুক্তি ছিলই। কিন্তু নামার মুহূর্তে গতিবেগ সহ্যের সীমা ছাড়ালে ল্যান্ডারের মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

এই অবস্থায় তার পেট থেকে খেলনা গাড়ির মতো ছ’চাকার রোভার প্রজ্ঞানের নিজে থেকেই বেরিয়ে আসা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, বিক্রম পালকের মতোই নেমেছিল। শুধু তার একটা পা খানায় পড়েছে বলে বিপত্তি।

এখন যে হেতু যোগাযোগই নেই, তাই কিছু বলা যাচ্ছে না। হয়তো রোভারের যন্ত্রপাতি সব ঠিকই আছে, শুধু রেডিয়ো লিঙ্ক কাজ করছে না। জাপানের এক মহাকাশ অভিযানে কয়েক সপ্তাহ পরে হারিয়ে যাওয়া রেডিয়ো লিঙ্ক ফের সাড়া দিয়েছিল। ইসরো তাই এক বারও বলেনি যে, এ মিশন ব্যর্থ।

বলার কারণও নেই। বিক্রম চাঁদের মাটিতে নামলে সেখানকার ভূমিকম্পের প্রকৃতি নির্ধারণের মতো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হত। এখন যদি ধরেও নিই, ল্যান্ডারের অ্যাক্সিডেন্টাল ব্রেকডাউন হয়েছে, তাতেও বিশেষ ক্ষতি নেই। কারণ, ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে হলেও অরবিটার অন্তত এক বছর ধরে টানা তথ্য-ছবি পাঠাবে চাঁদের। আরও বহু বছর সক্রিয় থাকতে পারে অরবিটার। তাতেই ৯৫ শতাংশ কাজ এখনও সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস।

চাঁদের মাটিতে ১৪ দিন কাজের জন্য রোভারের কাছে দু’টো যন্ত্র ছিল, আর ল্যান্ডারের তিনটে। কম গুরুত্বপূর্ণ বলব না, কিন্তু অরবিটারে থাকা ৮টা যন্ত্র এখনও ঠিকঠাক কাজ করে যাচ্ছে। আগামী দিনে আমরা যদি চাঁদে ঘাঁটি গাড়তে চাই, তা হলে জলের খোঁজ জরুরি। চাঁদে যে জল আছে, চন্দ্রযান-১ আমাদের আগেই সে খবর দিয়েছে। এখন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে কতটা জল আছে, মাটি থেকে কতটা নীচে, সেই জল বার করতে কতটা ঝামেলা হতে পারে— সব বলে দেবে অরবিটারে থাকা যন্ত্র। ‘চন্দ্রযান টু লার্জ এরিয়া সফ‌্ট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (ক্লাস)’, ‘ইমেজিং ইনফ্রা-রেড স্পেকট্রোমিটার’, ‘ডুয়াল ফ্রিকোয়েন্সি সিন্থেটিক অ্যাপারচার রেডার’ -এর মতো যন্ত্র আরও স্পষ্ট করে চিনিয়ে দেবে চাঁদকে। চাঁদের উপরিভাগে কী ধরনের আয়নিত কণা আছে, যে গ্যাস আছে তাতে জল তৈরি সম্ভব কি না, মাটির নীচে কী কী খনিজ পাওয়া যাবে, চাষাবাদ সম্ভব কি না— সব বলে দেবে অরবিটারে থাকা যন্ত্রসমূহ।

কী হওয়ার কথা ছিল

• আরও ধাপে ধাপে নেমে ৪০০ মিটার উচ্চতায় নামার কথা। গতি কমে হত ঘণ্টায় ১০০ কিমি।
• তার পর ১২ সেকেন্ড
ভেসে থাকত বিক্রম। উচ্চতা কমত না কিন্তু গতিবেগ কমত। চন্দ্রপৃষ্ঠের তথ্য সংগ্রহ করত।
• পরের ৬৬ সেকেন্ডে গতির পাশাপাশি উচ্চতা কমিয়ে ১০০ মিটারে নামত। অবতরণস্থল খুঁজত।
২৫ সেকেন্ড ভেসে
ভেসে এগোত। গতিবেগ আরও কম।
• স্থান পছন্দ হলে পরের ৬৫ সেকেন্ডে ১০ মিটারে নামত। পালকের মতো ভেসে ১৩ সেকেন্ড ধরে মাটি ছুঁত। মিনিট তিনেকের মধ্যে মাটি ছুঁত সে।

চাঁদ ছোঁয়ার কথা ছিল রাত ১টা ৫৪ মিনিটে

এই অরবিটারেই আছে দু’টো অত্যন্ত শক্তিশালী হাই-রেজ়োলিউশন ক্যামেরা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এর আগে কখনও পা পড়েনি। ওই অঞ্চলের মানচিত্র এনে দেবে এই দু’টি ক্যামেরা। এটা জরুরি।

ধরে নেওয়া যাক, যাবতীয় তথ্য বিশ্লেষণের পরে দেখা গেল, চাঁদ বসবাসের অযোগ্য। মঙ্গলই উপযুক্ত। তা হলেও মঙ্গলে যাওয়ার পথে ‘মুনস্টেশন’-এ বিরতি নেওয়াটা জরুরি হয়ে দাঁড়াতে পারে একটা সময়ে। চন্দ্রযান-২-এর অরবিটার যখন সুরক্ষিত, তখন মিশন কোনও ভাবেই ব্যর্থ বলা যায় না।

সত্তরের দশকে আমেরিকা চাঁদে গিয়েছিল মাত্র চার দিনে। আমাদের এ বার চাঁদের কাছাকাছি পৌঁছতেই লাগল ৪০ দিন!

কেন? ওরা গিয়েছিল বিপুল শক্তিশালী এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল স্যাটার্ন-৫ রকেটে চড়ে। আর আমাদের বাহন জিএসএলভি মার্ক-থ্রি, যা বানাতে খরচ ওদের থেকে ৩০ গুণ কম। বহনক্ষমতা মাত্র ৪ টন। সেই কারণেই আমাদের অনেক জটিল পথ বেছে নিতে হয়েছিল।

কয়েক হাজার লক্ষ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে শেষমেশ গন্তব্য থেকে ২ কিলোমিটার আগে থমকে গেল চন্দ্রযান-২। তাতে আর হলটা কী? গ্রীক কবি কনস্টানটিন কাভাফির ‘ইথাকা’ কবিতায় আছে— গন্তব্যে পৌঁছনো নয়, ঘটনাবহুল যাত্রাপথই গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদে পাড়ি দেওয়ার এই মিশন নিয়েও আমার অনুভূতি এমনই। ইসরোর কয়েক হাজার বিজ্ঞানী-ইঞ্জিনিয়ার তো বটেই, এত জটিলতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রায় শিখর ছোঁয়া জীবনের ক্ষেত্রেও একটা বড় শিক্ষা। ‘মুন ল্যান্ডিং’ না-হোক, ‘জার্নি টু দ্য মুন’-ই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (পুণে)-এর ডিরেক্টর

অন্য বিষয়গুলি:

Chandrayaan 2 ISRO চন্দ্রযান ২ Moon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy