গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
নতুন ‘হিরো’ এসে গেল। যে বলছে, “কান পেতে শোনো। চোখ মেলে দেখো। আমরাও পারি।’’ হ্যাঁ, একেবারেই অন্য ধরনের হিরো পেয়ে গেল দেশের নতুন প্রজন্ম।
সিনেমার অভিনেতা নন। ক্রিকেট, ফুটবল, হকি খেলোয়াড় বা সুইমার, স্প্রিন্টারও নন। সেই ‘হিরো’ ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’।
সেই হিরো কোনও অংশে কম চটকদার বা কম ক্ষমতাশালী নয় কোনও বলিউড, টলিউড বা হলিউডের অভিনেতার চেয়ে। কারণ, সে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের অত্যন্ত জোরালো ‘মায়া’ কাটানোর সাহস দেখিয়েছে ‘চন্দ্রযান-২’-কে নিখুঁত পরিকল্পনায় চাঁদ-মুলুকে পাঠিয়ে।
চাঁদে পা ফেলার দিকে বীরদর্পে পা বাড়িয়ে দিয়ে হয়ে উঠতে পেরেছে চরম রোম্যান্টিকও। হিরো হয়ে উঠতে গেলে আর কী চাই?
হিরোর যে বড়ই দরকার শৈশবে!
ছোট থেকে ঠিকঠাক ভাবে বড় হয়ে ওঠার সময়, নিজেদের গড়ে তোলার সময় প্রত্যেকেরই লাগে এক বা একাধিক হিরো। ছোটবেলায় তাঁরা কেমন ছিলেন, তার পর কী ভাবে জীবনের স্রোতে ভাসতে ভাসতে, বিপ্রতীপ স্রোতের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে তাঁরা ধাপে ধাপে এগতে এগতে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন, হিরো হয়ে উঠেছেন, তা জানার কৌতূহল তো থাকেই। সেই জানাটাই জানতে বা অজান্তে কখন যেন আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করে দেয়। অনুপ্রেরণা দিতে শুরু করে। মনের ভিতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে, ‘‘দেখে শেখো। এই ভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। জেগে উঠতে হবে। পারলে, তুমিও পারবে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছতে।’’
আরও পড়ুন- রামানুজনের পূণ্যভূমির মাটিই কি উতরে দেবে বিক্রমকে?
শিখতে হবে, জানতে হবে আর পারতে হবে। এই ইচ্ছেগুলো সবচেয়ে বেশি অদম্য থাকে তো শৈশবেই। শিশুর মনে সেই জেদটা তৈরি করেন হিরো। অন্য শিশুর চেয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে, এগিয়ে থাকতে হবে যে! আর সেটা শৈশব তো। প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পলে, অনুপলে বদলে যাওয়ার, নিজেকে বদলে ফেলার, বদলে নেওয়ার ক্ষেত্রে জীবনের সবচেয়ে ফসলি সময়! ফলে, হিরো বদলায় শৈশবে, তাঁরা এক থেকে একাধিক হন শিশুর চোখে, মননে, প্রতিজ্ঞায়।
পটৌডি আর ফারুখ থেকে হিরো হয়ে গেলেন আর্মস্ট্রং!
যেমন আমার হয়েছিল। মানুষ যখন প্রথম পা রাখল চাঁদে। সেটা ১৯৬৯-এর জুলাই। আমি পড়ি ক্লাস টু-তে। মনসুর আলি খান পটৌডি আর ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার থেকে হিরো বদলে গিয়ে হলেন নিল আর্মস্ট্রং। বাজ অলড্রিন। মাইকেল কলিন্স। আমার শৈশবের চোখ টেনে নিয়েছিল চাঁদ। আকাশ। শুকতারা (শুক্রগ্রহ), ঝিকমিক করে জ্বলা তারাগুলো।
আরও পড়ুন- সূর্যের রহস্যভেদ, আন্দিজের পাহাড়চূড়ায় উড়ল বাঙালির বিজয়পতাকা!
একটা ৬ ফুটের তোয়ালে দিয়ে শুরু। বাবা কিনে দিয়েছিলেন। গোটা তোয়ালে জুড়ে আর্মস্ট্রং, অলড্রিন, কলিন্সের ছবি। চাঁদে মানুষের পা ছোঁয়ানোর ছবি। অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযানের ছবি। স্নানের সময় সেই তোয়ালেই ব্যবহার করছি। আবার সেই তোয়ালেই শুকিয়ে ঝুলিয়ে রাখছি সামনে, পড়ার টেবিলের ধারেকাছে। যেন সব সময় চোখে পড়ে। তখন তো আর টেলিভিশন ছিল না। খবরের কাগজে রোজ ছবি ছাপা হচ্ছিল আর্মস্ট্রং, অলড্রিনদের। সেই সব পড়ছি, পেপার কাটিং কেটে রাখছি। দেখছি।
৬ ফুটের তোয়ালে থেকে শুরু করে ৫টা দশক...
সেই ৬ ফুটের তোয়ালে থেকে শুরু করে আজ ৫টা দশক পেরিয়ে আমি এক জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ক্রিকেটার হতে পারিনি। হয়তো জ্যোতির্বিজ্ঞানীও হতে পারতাম না, সেই শৈশবে আর্মস্ট্রং আমার জীবনে নতুন হিরো হিসেবে না দেখা দিলে।
ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ নামবে কী ভাবে? দেখুন ইসরোর ভিডিয়ো
নিজের একান্ত আপন ব্রহ্মাণ্ড (পার্সোনাল ইউনিভার্স)-টা তো শৈশবেই তৈরি হয়। তখনই তৈরি হয় একঝাঁক মূল্যবোধ। এটা ভাল, ওটা ভাল নয়। এটা করলে এগতে পারব, ওটা করলে পিছিয়ে যাব। জানার জন্য, শেখার জন্য, নিজেকে গড়ে তোলার জন্য শৈশবের সেই উর্বর মস্তিষ্কের চেয়ে উর্বর জমি আর কীই-বা হতে পারে?
সেই ‘ইনস্পিরেশন’ বা প্রেরণাটা দু’ভাবে আসে। হয় কোনও ব্যক্তি বা চরিত্রের মাধ্যমে। না হলে তা আসে কোনও ঘটনার মাধ্যমে।
আমার শৈশবে তা দু’ভাবেই হয়েছিল। চাঁদে মানুষের প্রথম পা ছোঁয়ানোর ঘটনা যেমন আমাকে পরবর্তী জীবনে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার তাগিদ জুগিয়েছিল, দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে তেমনই হিরো হয়ে উঠল ইসরো। চন্দ্রযান-২-এর চাঁদ-মুলুকে যাওয়ার মাধ্যমে। যদি শেষমেশ নামতে গিয়ে ভেঙেও পড়ে বিক্রম (সম্ভাবনা যে শূন্য, গণিতের ভাষায় তো তা বলা যায় না!), তা হলেও নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে হিরো হয়েই থাকবে ইসরো।
অভিনেতা নন, খেলোয়াড় নন, হিরো এ বার ইসরো
যেটা খুবই দরকার ছিল। অভিনেতা হিরো হয়েছেন, হচ্ছেন আকছারই। ক্রিকেটার, ফুটবলার, স্প্রিন্টার, সুইমারের হিরো হয়ে ওঠার ঘটনা তো ষথেষ্টই। এখন যেমন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু ‘হিরোইন’। ক্রিকেটে নতুন হিরো ‘বুম বুম’ যশপ্রীত বুমরা।
চন্দ্রযান-২ কিন্তু ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নতুন হিরোর জন্ম দিয়েছে। তাই মহারাষ্ট্রে গণপতি পুজোর উদ্বোধনে দেখা যায় মূর্তির ব্যাকড্রপে চন্দ্রযান-২ আর মহাকাশচারীদের ছবি। চোখে পড়ে কলকাতায় এ বারের পুজোয় চন্দ্রযান-২-কে ‘থিম’ করে প্রতিমা ও মণ্ডপসজ্জার উৎসাহ।
হিরো হতে গেলে যে আমজনতার কাছে পৌঁছে যেতে হয়
হিরোর কিছু দায়-দায়িত্বও থাকে অবশ্য। তাকে আমজনতার কাছে পৌঁছে যেতে হয়। হিরোর খুব একটা রাখঢাক রাখলে চলে না। শৈশব যে তাকে তার কাছের, নিজের মানুষ বলে দেখছে, ভাবছে। মেনে নিচ্ছে।
আরও পড়ুন- মুঠো মুঠো সোনা, প্ল্যাটিনাম ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে! ঘটকালি করছে ব্ল্যাক হোল
সেই দায়িত্বটাই এ বার পালন করতে হবে ইসরোকে। তাকে আরও আরও বেশি করে পৌঁছে যেতে হবে আমজনতার কাছে। ফেসবুকে, টুইটারে, ইনস্টাগ্রামে। পৌঁছে যেতে হবে স্কুলে স্কুলে শিশুদের কাছে। ক্লাসরুম ছেড়ে তাদের বাড়িতে বাড়িতে পড়ার টেবিলে। বিছানায় রাতঘুমে চোখ জড়িয়ে আসার প্রাক মুহূর্তে পড়া বইটার খোলা পাতাগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে ইসরোকে।
ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ (বাঁ দিকে) ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’
মানতেই হবে, এটা বদলে দেবে ইসরোকেও। কারণ, ইসরো এত দিন অত্যন্ত শক্তিশালী ও সর্বাধুনিক মিসাইল বানানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করত। মিসাইল বানাত। পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য সেগুলির উৎক্ষেপণ করত। কাগজে ছবি বেরত। কিন্তু সেই প্রযুক্তিটা কী, দেশের নিরাপত্তার কারণেই ইসরো সে ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে থাকত। স্বাভাবিক ভাবেই। এখনও থাকে। কারণ, প্রযুক্তিটা সকলকে বলে দিলে তো শত্রু দেশও তা বানিয়ে ফেলবে! তাই গোপনীয়তা বজায় রাখতেই হত, এখনও হয়, যেহেতু সেগুলি হয় প্রতিরক্ষা গবেষণা উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) বা কেন্দ্রীয় পরমাণু শক্তি মন্ত্রকের (ডিএই) তত্ত্বাবধানে।
ইসরোর আড়ালটা ভেঙে দিল চন্দ্রযান-২
চন্দ্রযান-২ সেই আড়ালটা ভেঙে দিল। সামনে আরও বড় বড় বিজ্ঞান অভিযানে নামছে ইসরো। আগামী বছরে যাবে সুর্যসন্ধানী মহাকাশযান। ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’। তার পর যাবে ‘শুক্রযান’। যাবে ‘গগনযান’। পাঠানো হবে ‘দ্বিতীয় মঙ্গলযান’। যাবে ‘এক্সপোস্যাট’। হয়ত যাবে ‘দক্ষ’। আর ১০ বছরের মধ্যে হতে পারে ‘সিএমবি ভারত’ প্রকল্পও।
এখন কেন্দ্রীয় পরমাণু শক্তি মন্ত্রকও এগিয়ে আসছে মৌলবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায়। ফলে, তাকেও খোলামেলা হয়ে যেতে হবে। কারণ, বিজ্ঞানের একটা স্বাভাবিক ধর্ম রয়েছে। ‘ওপ্ননেস’। কোনও রাখঢাক নেই তার। হাতের সব তাস দেখিয়ে খেলে। আর হ্যাঁ, তার পরেও বুক বাজিয়ে জেতে।
বিজ্ঞানের এই স্বভাবজাত ‘ওপ্ননেস’, আমার ধারণা, ইসরোকেও বদলাবে। তাকে আরও বেশি করে হিরো করে তুলবে।
আমাদেরও ইসরো আছে!
তাতেই মঙ্গল যে! ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার বয়স বুঝে নেবে ‘নাসা’র মতো গর্ব করার একটা সংস্থা আমার দেশেই রয়েছে। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডে আর যেতে হবে না উচ্চশিক্ষা বা গবেষণার জন্য। ইসরো রয়েছে। আগামী দিনে মৌলবিজ্ঞানের গবেষণায় যদি ইসরো বেশি বেশি করে হাত মেলায় দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হাতে, তাতে নতুন প্রজন্মের লাভ যথেষ্টই। দেশেই উচ্চশিক্ষা, গবেষণার সুযোগটা তো এক লাফে অনেকটা বাড়বেই, বাড়বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভারতেই অনেক বেশি সংখ্যায় চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও।
ইসরো তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলিকে যদি রোজকার জীবনে আরও বেশি করে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে পারে, তা হলে ইসরো হিরো হয়ে উঠবে আরও দ্রুত গতিতে। আর সেই সব প্রযুক্তি যদি ইসরো অন্য পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে বেচতে পারে, তা হলে তো সোনায় সোহাগা! ঘরে বিদেশি মুদ্রা আরও বেশি করে এলে ইসরো স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে উত্তরোত্তর। তাতে দেশেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নতুন প্রজন্মের ভাল চাকরি পাওয়ার সুযোগটা বেড়ে যাবে।
ইসরো আরও বেশি করে হিরো হয়ে উঠবে ঘরে। হিরো হয়ে উঠবে বাইরে, বিদেশেও।
চন্দ্রযান-২ আমার ছোটবেলার সেই ‘আর্মস্ট্রং’ হয়ে গেল এখনকার ক্লাস টু, থ্রি’র ছেলেমেয়েদের কাছে।
একই সঙ্গে ‘স্বভাবগম্ভীর’ ইসরোকেও হিরো বানিয়ে দিল!
লেখক পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অস্ট্রোফিজিক্সের (আয়ুকা) অধিকর্তা, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী
অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ ও তিয়াসা দাস
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy