Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Chandrayaan 2

চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!

প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের মতো দেশের পক্ষে চাঁদে রকেট পাঠিয়ে লাভ কী? আমাদের দেশের দারিদ্র, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো বিস্তর সমস্যা নিয়ে তো প্রতি মুহূর্তে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। চাঁদে যাওয়ার তোড়জোড় কি আমাদের সাজে? তা কি ‘বামনে’র চন্দ্রাভিলাষ নয়? বা, স্বপ্নবিলাস?

চন্দ্রযান-২।

চন্দ্রযান-২।

বিমান নাথ
বেঙ্গালুরু শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ১৮:০৩
Share: Save:

আমরা কি ‘বামন’ হয়ে চাঁদে হাত বাড়াচ্ছি? কেউ কেউ বলতে পারেন কথাটা। কিছু তো একটা বলতে হবেই!

প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের মতো দেশের পক্ষে চাঁদে রকেট পাঠিয়ে লাভ কী? আমাদের দেশের দারিদ্র, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো বিস্তর সমস্যা নিয়ে তো প্রতি মুহূর্তে হিমশিম খাচ্ছি আমরা। চাঁদে যাওয়ার তোড়জোড় কি আমাদের সাজে? তা কি ‘বামনে’র চন্দ্রাভিলাষ নয়? বা, স্বপ্নবিলাস?

না, নয়। প্রথমত, হাজার কোটি টাকা খরচ শুনে কারও মনে হতে পারে, তা অনেক! কিন্তু তা-ও নয়। দেশের অন্যান্য খরচের তুলনায় ভারতের চন্দ্রাভিযানের খরচ সামান্যই বলা যায়। এ দেশে আকাশছোঁয়া মূর্তি তৈরি করতেই এর তিন গুণ টাকা খরচ করা হয়! তাই চাঁদে যাওয়ার জন্য অযথা খরচ হচ্ছে, সেই কথাটা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। আবার অনেকের এও মনে হতে পারে, চাঁদে রকেট পাঠানো আর মূর্তি বানানো- দু’টোই বেহিসাবি কাজ; তাই এই যুক্তি ধোপে টেঁকে না।

কথাটা অপ্রাসঙ্গিক কি না জানি না। তবু মনে পড়ল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিশ্বে অন্য অভাব অনেক আছে। শুধু নিন্দুক আছে যথেষ্ট।’

দেরি করলে পিছিয়ে পড়তে হবে...

আকাশছোঁয়া মূর্তি বানানোর চেয়ে বেশি কাজে লাগবে ‘চন্দ্রযান-২’

একটু ভাবলেই বোঝা যাবে, এই হাজার কোটি টাকা বাজে খরচ করা হচ্ছে না। মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহের উৎক্ষেপণ বা সেখানে রাখা যন্ত্রপাতি দিয়ে পৃথিবীর পর্যবেক্ষণ শুধু প্রযুক্তিগত কৌতূহল মেটানোর জন্য নয়। আজকাল বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এই প্রযুক্তিবিদ্যা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাইছে। কারণ, শুধু আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, জাপানই নয়, আরও অনেক দেশই কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করতে ও পাঠাতে চাইছে। তা সে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যই হোক বা নিরাপত্তার প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের খবরাখবর রাখতে।

আরও পড়ুন- ৩০ বছরের মধ্যেই চাঁদে বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে ফেলবে মানুষ!​

আরও পড়ুন- চাঁদই হতে চলেছে আগামী দিনের সেরা ল্যাবরেটরি!​

ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’ ইতিমধ্যেই বহু বছর ধরে এই প্রযুক্তিবিদ্যার চর্চা ও তাকে ব্যবহার করে এসেছে। অন্যান্য দেশের উপগ্রহ পাঠিয়ে বাহবা কুড়িয়েছে। আর মহাকাশ প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকতে গেলে থেমে থাকলে চলে না। তাই শুধু কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে আরও দূরে যাওয়ার, আরও কঠিন অভিযানে সামিল হওয়ার চেষ্টা করা খুব জরুরি। চাঁদের বুকে ল্যান্ডার ও রোভার নামানো সেই রকমই একটি রোমাঞ্চকর ও স্মরণীয় অভিযান। মহাকাশ-প্রযুক্তির এই অভিজ্ঞতা ভারতকে আগামী দিনে মহাকাশে পাড়ি দিতে সক্ষম দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার পুরোভাগে এনে দেবে।

কী ভাবে চাঁদে পৌঁছবে ‘চন্দ্রযান-২’? দেখুন ভিডিয়ো

যদি আর কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ না হয়, তা হলে ভারতের চন্দ্রযান-২ সোমবার দুপুরেই চাঁদের উদ্দেশে রওনা হচ্ছে। তার দু’মাসের মধ্যেই চাঁদে নামার চেষ্টা করবে চন্দ্রযান-২-এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ ও রোভার ‘প্রজ্ঞান’। সেটা যদি করে দেখানো যেতে পারে তা হলে বিশ্বে চারটি দেশের একটি হয়ে উঠবে ভারত। চাঁদের বুকে নামার নিরিখে।

কাজটা সহজ হলে ইজরায়েল মুখ থুবড়ে পড়ত না!

কাজটা যে মোটেই সহজ নয় সেটা এপ্রিলের একটি দুর্ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ইজরায়েলের পাঠানো মহাকাশযানটি চাঁদে পৌঁছনোর পর যখন চাঁদের পিঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই তার ইঞ্জিন বিগড়ে গিয়েছিল। ফলে, সেটি মুখ থুবড়ে পড়ে চাঁদের বুকে। তীরে পৌঁছে তরী ডোবে সেই ইজরায়েলি মহাকাশযানের। তাই চন্দ্রযান-২ যাতে ধপাস করে না পড়ে গিয়ে ঠিক মতো নামতে পারে চাঁদের বুকে, তা নিয়ে ইসরোর প্রযুক্তিবিদদের এখন উদ্বেগের শেষ নেই।

কী ভাবে চাঁদে গড়ে তোলা হবে মানবসভ্যতার কলোনি? দেখুন ভিডিয়ো

অ্যান্টার্কটিকায় পদার্পণের মতোই দূরদর্শী পদক্ষেপ

আন্তর্জাতিক কূটনীতির ব্যাপারে দূরদর্শী না হলে যে পরে পস্তাতে হয় সেটা ভারতের পারমাণবিক বোমা তৈরির ইতিহাস মনে করলেই বোঝা যায়। বোমা তৈরি যে শুধু যুদ্ধের জন্য দরকার, তা নয়; আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই ধরনের হাতিয়ার না থাকলে এখন আর কেউ তোয়াক্কা করে না। ভারত যখন গত শতাব্দীর সাতের দশকে প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করেছিল, তত দিনে আন্তর্জাতিক নিরিখে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তিবিদ্যায় এগিয়ে না গেলে যে নানা ধরনের বাধানিষেধ চলে আসে, সেগুলো যত অন্যায্যই হোক না কেন, সেটা আমরা এখন টের পাচ্ছি। প্রথম সারিতে যারা থাকে তাদের দলে অন্যদের নিতে চায় না। এই শিক্ষা পেয়ে সেই সময় ভারত আরও একটি ব্যাপারে দূরদর্শী পদক্ষেপ করেছিল। যখন বোঝা গেল, প্রথম সারির সবক’টি দেশ অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণাগার তৈরির নামে জায়গা দখল করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, তখন সেই সাতের দশকে ভারত ছোটখাটো চেহারার হলেও একটি খুঁটি গেড়ে এসেছিল পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে। ‘মৈত্রী’ নামে একটি স্টেশন তৈরি করেছিল। সেটা যথেষ্টই দূরদর্শীতার প্রমাণ ছিল। কারণ, তার পরেই আন্তর্জাতিক নিয়ম তৈরি হয়। অ্যান্টার্কটিকায় যারা আগে পৌঁছেছে, শুধু তারাই সেখানে গবেষণা করতে পারবে। অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে যে কোনও আলোচনায় সামিল হতে পারবে। সাতের দশকের ওই পদক্ষেপের ফলে ভারতের আর তা নিয়ে কোনও আপসোস নেই।

চাঁদে পৌঁছনোর ব্যাপারটাও প্রায় একই রকম। ভবিষ্যতে চাঁদে কে যাবে, কারা সেখানে গিয়ে খনিজ আনবে বা মহাকাশ স্টেশন বানাবে, সেই সব প্রশ্ন এখনও কেউ তুলছেন না। কিন্তু এখন এক বার গিয়ে খুঁটি গেড়ে না এলে পরে এই নিয়ে কোনও আলোচনায় কেউ ভারতকে না-ও ডাকতে পারে। সেই কথা ভেবেই চন্দ্রযান পাঠানো দরকার। বিশেষ করে, যখন এই প্রযুক্তির জন্য কারও সাহায্যই নিতে হচ্ছে না।

সাফল্য বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তুলবে নতুন প্রজন্মকে

শুধুই কি তাই? এমন একটি অভিযান যদি সফল হয়, তা হলে সেটা আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতি আগ্রহ আরও বাড়াবে।

ছয়ের দশকে চন্দ্রাভিযানের পর আমেরিকায় যে বিজ্ঞান- শিক্ষার একটা জোয়ার এসেছিল, সেটা কারও অজানা নয়। আমাদের দেশে নেতিবাচক খবরেরই তো রমরমা। তার মধ্যে এই খবর অন্তত আমাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার কাজে লাগবে।

সাধারণত, আমাদের দেশের পড়ুয়াদের মধ্যে বিশেষ কেউ আর এখন প্রযুক্তিবিদ্যা শেখার দিকে ঝোঁকেন না। তাঁদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢোকার লক্ষ্যটাই হল, পাশ করার পর ম্যানেজার হওয়া। প্রযুক্তিবিদ্যার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার মতো মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছেন আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা। কারণ, দেশের অর্থনীতি এখন আর উৎপাদনের উপর দাঁড়িয়ে নেই। তাই ইঞ্জিনিয়ারদেরও আর তেমন দরকার নেই।

এই পরিবেশে যদি চাঁদে মহাকাশযান নামানোর মতো দুঃসাহসী কাজ করে দেখানো যায়, তা হলে হয়তো দেশে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার উৎসাহ ফিরে আসবে।

আরও পড়ুন- চার বছরের মধ্যেই চাঁদের পাড়ায় ‘বাড়ি’ বানাচ্ছে নাসা!​

আরও পড়ুন- হুগলির চন্দ্রকান্তের তৈরি অ্যান্টেনার ভরসায় ফের চাঁদের কক্ষপথে ঢুকছে ইসরো​

চন্দ্রযান-২-এর যাত্রা যে শুধু প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে একটি বড় মাইল ফলক হবে, তাই নয়; বিজ্ঞানের গবেষণাতেও তা নতুন নতুন আবিষ্কারের দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

‘চন্দ্রযান-১’ তো চমকে দিয়েছিল!

প্রথম চন্দ্রযান যে অপ্রত্যাশিত ভাবেই চাঁদে বরফের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছিল, এটা সকলেরই জানা। সেই বরফ কত দূর বিস্তৃত এবং তার মোট পরিমাণ কত, সেটা কিন্তু এখনও আমাদের জানা নেই। চন্দ্রযান-২ চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি অবতরণ করার চেষ্টা করবে। কারণ, মেরু অঞ্চলেই বরফ থাকার সম্ভাবনা বেশি। চাঁদে জল কোথা থেকে এল, কী ভাবে এল এই সব প্রশ্ন নিয়ে গবেষণার জানালা তো খুলবেই, তার সঙ্গে পৃথিবীতে জলের উৎসের প্রশ্নটাও জড়িয়ে রয়েছে। আমাদের পৃথিবীতে জল কোথায়, কী অবস্থায় রয়েছে, সেটা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।

চাঁদ বহু দূর, অতলান্তিকের তলায় লুকোনো রহস্যই অজানা!

সম্প্রতি জানা গিয়েছে, অতলান্তিক মহাসাগরের নীচে ভূগর্ভে বিশাল পরিমাণে স্বচ্ছ জল রয়েছে। যার অস্তিত্ব সকলকে চমকে দিয়েছে। চাঁদের কথা দূরে থাক, আমরা যে আমাদের গ্রহ সম্পর্কেই এখনও অনেক কিছু জানি না, এই আবিষ্কার সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে। চাঁদে জল, বরফের পরিমাণ ও তা কোথায় কোথায় রয়েছে, সেই সব তথ্য আগামী দিনে চাঁদে আমাদের বাসস্থান বা চাঁদ থেকে আরও দূরে পাড়ি জমানোর জন্য স্টেশন বানানোর সময় কাজে লাগবে।

অধ্যাপক বিমান নাথের আঁকা চাঁদ

তাই চন্দ্রযান-২ চাঁদে গিয়ে যে সব গবেষণা করবে, সেই দিকে অনেকেরই নজর থাকবে। জল ছাড়াও চাঁদে ‘হিলিয়াম-৩’ মৌল নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন। সে জন্যও চন্দ্রযান-২-এর পাঠানো তথ্য খুবই সাহায্য করবে।

এখন না গেলে পরে হয়তো পস্তাতেই হোত ভারতকে!

বেঙ্গালুরুর রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বিমান নাথ ‘বিক্রম সারাভাই’ ও রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী

ছবি সৌজন্যে: ইসরো, নাসা ও অধ্যাপক বিমান নাথ

ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইসরো ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘ইসা’)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE