আর এক দশক পর মঙ্গলে সভ্যতার বসতির মডেল। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
কে বলে চোখের জলের হয় না কোনও দাম? ঘাম, রক্ত ঝরাতে হয় কি শুধুই পার্থিব প্রয়োজনেই? না। ঘাম, রক্ত, চোখের জল আর মূত্রের বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে মহাকাশেও। কারণ, এই সব দিয়েই গড়া হতে পারে চাঁদ ও মঙ্গলে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশের ইমারত।
উপনিবেশ যখন পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে কোনও উপগ্রহ বা অন্য কোনও গ্রহে, তখন তো গড়তেই হবে আস্তানা। কিন্তু তার মালমশলা ইট-বালি-চুন-সুরকি-কংক্রিট তো আর পৃথিবী থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ বলে। অনেক সময় লাগবে বলে।
মহাকাশে বসতি ঘাম-রক্ত-চোখের জলে!
অথচ সময় নেই আর হাতে। আর এক-দেড় দশকের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে চাঁদ ও মঙ্গলে ইমারত গড়ার কাজ। যা গড়া হতে পারে ঘাম, রক্ত, চোখের জল আর মূত্রে। আমার, আপনার নয়। মহাকাশচারীদের। যাঁরা এখন রয়েছেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে, পরে যাঁরা যাবেন, আর তিন-চার বছর পর থেকে যাঁরা ঘনঘন যাবেন চাঁদে, থাকবেন সেখানে টানা বেশ কিছু দিন, তাঁরাই প্রতি দিন দিয়ে যাবেন তাঁদের ঘাম, রক্ত, চোখের জল আর মূত্র।
সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার জন্য চাঁদে ও মঙ্গলে।
কল্পকাহিনী নয়। আষাঢ়ে গপ্পোও নয়। উপগ্রহে বা অন্য কোনও গ্রহে ইমারত বানানোর জন্য যে ঘাম, রক্ত, চোখের জল আর মূত্রই হয়ে উঠতে পারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মালমশলা, সেই খবর দিয়েছে একটি সাম্প্রতিক গবেষণা। ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সেই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘মেটিরিয়্যালস টুডে বায়ো’–তে।
পৃথিবীর কংক্রিটকেও হার মানাবে, শক্তি-সামর্থ্যে!
গবেষকরা এমন এক ধরনের পদার্থ বানিয়েছেন যা পৃথিবীতে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কংক্রিটকেও হার মানাতে পারে শক্তি-সামর্থে।
চাঁদ আর মঙ্গলের পিঠের উপরের স্তরের ধুলো, ময়লা তুলে গবেষকরা তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন মানবরক্তের প্লাজমায় থাকা প্রোটিন অ্যালবুমিনকে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যার নাম- ‘হিউম্যান সেরাম অ্যালবুমিন (এইচএসএ)’। তাঁরা গভীর বিস্ময়ে দেখেছেন, তাতেই কেল্লা ফতে হয়ে যাচ্ছে। রক্তের অ্যালবুমিনই চাঁদ, মঙ্গলের ধুলো, ময়লাকে খুব শক্তপোক্ত ভাবে একে অন্যের সঙ্গে বেঁধে ফেলতে পারছে। তার ফলে যে পদার্থটি তৈরি হয়েছে গবেষণাগারে তা পৃথিবীর প্রায় নিত্য ব্যবহার্য কংক্রিটের মতোই প্রায় শক্তপোক্ত হয়। অন্য গ্রহে ইমারত গড়ার জন্য এই সদ্য উদ্ভাবিত পদার্থটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যাস্ট্রোক্রিট’।
গবেষকরা হিসাব কষে দেখেছেন, সাধারণ কংক্রিট যেখানে ২০ থেকে ৩২ মেগাপাস্কাল (চাপের একক, এক মেগাপাস্কাল বলতে বোঝায় ১০ লক্ষ পাস্কাল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপের ১০ গুণ) চাপ সইতে পারে, সেখানে অ্যাস্ট্রোকিট পারে ২৫ মেগাপাস্কাল চাপ সহ্য করতে।
তবে গবেষকরা এও দেখেছেন, তাঁদের উদ্ভাবিত পদার্থে (অ্যাস্ট্রোকিট) যদি ঘাম, চোখের জল আর মূত্রে থাকা ইউরিয়া বা ইউরিক অ্যাসিড মিশিয়ে দেওয়া যায় তা হলে তা হয়ে ওঠে আরও অনেক বেশি শক্তপোক্ত। যা আরও অনেক বেশি ঘাত-প্রতিঘাত ও চাপ সইতে পারে। সাধারণ কংক্রিট যদি ৩২ মেগাপাস্কাল পর্যন্ত চাপ সইতে পারে তা হলে এ ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রোকিট সর্বোচ্চ ৩৯.৭ মেগাপাস্কাল পর্যন্ত চাপ সহ্য করতে পারবে।
৬ জনের রক্তেই ৫০০ কিলোগ্রামের মহাকাশ ইট!
গবেষকরা দেখেছেন ছ’জন মহাকাশচারী টানা দু’বছর ধরে যদি রক্তদান করেন তা হলে তাঁদের রক্তের প্লাজমা থেকে নেওয়া অ্যালবুমিন দিয়ে তৈরি হতে পারে অন্তত ৫০০ কিলোগ্রাম ওজনের অ্যাস্ট্রোকিট। চাঁদে, মঙ্গলে ইমারত গড়ার প্রধান হাতিয়ার।
যা মহাকাশেই বানানো যাবে। তবে সৌর বিকিরণ, মহাজাগতিক রশ্মির ঝাপটা সহ্য করে মহাকাশে দীর্ঘ দিন কাটানোর পর রোজ রক্ত, ঘাম, চোখের জল দান করার ক্ষমতা কতটা থাকবে, এ বার সেটাও খতিয়ে দেখবেন গবেষকরা।
পৃথিবীর একটি ইট মঙ্গলে পাঠাতে কত খরচ জানেন?
গবেষকরা এ বার সেটাই করে দেখিয়েছেন। আগামী দিনে চাঁদে, মঙ্গলে সভ্যতার বসতি বানাতে নাসা মালমশলা তৈরির যে সব পদ্ধতির কথা ভেবে রেখেছে, এটি তার অন্যতম।
তার প্রধান কারণ, এই পদ্ধতি খরচ বাঁচাবে অনেক গুণ। নাসার হিসাব জানাচ্ছে, সর্বাধুনিক রকেটে বাড়তি এক কিলোগ্রাম ওজন চাপিয়ে তা মহাকাশে পাঠাতে হলে খরচ পড়ে আমেরিকার দেড় হাজার ডলার। আর নাসার ২০১৭-র রিপোর্ট বলছে, পৃথিবী থেকে মহাকাশযানে চাপিয়ে লাল গ্রহ মঙ্গলে আমাদের নিত্যব্যবহার্য একটি ইট নিয়ে যেতে হলে খরচ পড়বে আমেরিকার ২০ লক্ষ ডলার।
মানবরক্ত: কামানের গোলা থেকে মহাকাশে…
জমাট বাঁধিয়ে কোনও পদার্থকে শক্তপোক্ত, ঘাতসহ করে তুলতে মানবরক্তের ব্যবহার চালু ছিল প্রাচীন কালেও। রোমান সাম্রাজ্যে, গ্রিক সভ্যতায় মানবরক্তকে কাজে লাগানো হত কামানের গোলাকে আরও মজবুত, আরও শক্তপোক্ত করতে। তবে তার সঙ্গে ঘাম, চোখের জল আর মূত্র মেশালে যে তা আরও মজবুত হয়ে উঠতে পারে তা সম্ভবত জানা ছিল না প্রাচীন কালের প্রযুক্তিবিদদের।
তাই কামানের গোলার গণ্ডি ছাড়িয়ে এ বার মহাকাশে বসতি গড়ার মূল ভূমিকায় দেখা যেতেই পারে মানবরক্তকে। সঙ্গে থাকতে পারে মহাকাশচারীদের ঘাম, চোখের জল আর মূত্রও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy