মেডেল: গডফ্রে কোপলে এবং আলফ্রেড নোবেলের নামাঙ্কিত পদক
প্রতি বছর অক্টোবরের শুরুতে বিজ্ঞানের ছাত্র, গবেষক, অধ্যাপক থেকে একেবারে প্রথম সারির বিজ্ঞানী— সকলেরই এক বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, সন্দেহ নেই, নোবেল পুরস্কারই এখন সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। বিশেষত, বিজ্ঞানের যে শাখাগুলিতে পুরস্কারটি দেওয়া হয়, অর্থাৎ পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রথম সারির বিজ্ঞানীরা বিশেষ উৎসাহ নিয়ে প্রতি বছর অক্টোবরের গোড়া থেকেই তাকিয়ে থাকেন সুইডেনের রাজধানী স্টকহলমের ঘোষণার দিকে। আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছাপত্র অনুযায়ী, বিজ্ঞান শাখার এই পুরস্কারগুলি ঘোষণা করার দায়িত্ব রয়েছে ওই শহরের দু’টি সংস্থার। ১৯০১ সাল থেকে শুরু করে যুদ্ধবিগ্রহের কারণে কয়েক বছর বাদ গেলেও নোবেল পুরস্কার যথেষ্ট নিয়মিত ভাবেই দেওয়া হয়েছে। নোবেলে ভূষিত হয়েছেন বহু নামী বিজ্ঞানী, আবার এমন কয়েক জন বিজ্ঞানী এই পুরস্কারে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছেন, যা সকলকেই বিস্মিত করেছে। দেখতে দেখতে পুরস্কারের বয়সও হয়ে গেল প্রায় ১২০ বছর।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু করে বহু বিজ্ঞানীর গুরুত্বপূর্ণ অবদানে আধুনিক বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, গালিলেয়ো-র সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় সাড়ে তিনশো বছরে কেবল আইজাক নিউটন নন, উঠে এসেছেন এমন সব বিজ্ঞানী, যাঁদের অবদানের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক বিজ্ঞানের ইমারত গড়ে উঠেছে। এই তালিকায় রয়েছেন রবার্ট হুক, বেলিজে পাস্কাল, ড্যানিয়েল বার্নোলি, জেমস জুল, চার্লস ডারউইন, রবার্ট বুন্সেন, অ্যামেদিয়ো অ্যাভোগাড্রো, মাইকেল ফ্যারাডে, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল— এ রকম অজস্র নাম। রয়েছেন বহু আধুনিক বিজ্ঞানী। প্রশ্ন, ১৯০১ সালে নোবেল শুরুর আগে বিজ্ঞানীদের জন্য কি কিছু বিশেষ স্বীকৃতি বা পুরস্কার ছিল?
বস্তুত, বিজ্ঞানের অতি আধুনিক বিষয়ে নতুন দিশা দেখানো উচ্চমানের গবেষণার জন্য আজ যাঁরা নোবেল জয় করে নিচ্ছেন, তাঁদের সেই কাজের তাৎপর্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিদ্যালয় বা স্নাতক স্তরের ছাত্রের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তা কেবল ধরা দেয় বিশেষজ্ঞদের মননে বা গবেষকদের কাছে। অথচ, নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের আগে অনেক বিজ্ঞানীর অবদান পড়ুয়ারা একেবারে পাঠ্যবই থেকেই জানতে পারে; যাঁদের কাজের তাৎপর্য এই ছাত্রদের কাছে সহজেই ধরা দেয়, সেই বিজ্ঞানীরা আদৌ কোনও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কি? কিংবা কোনও পুরস্কার তাঁদের জন্য সেই সময় ছিল কি?
বিংশ শতাব্দীর আগে বিজ্ঞানীদের অবদানের স্বীকৃতির কথা যে ভাবা হয়নি, তা নয়। তার শুরু আজ থেকে প্রায় ২৯০ বছর আগে ১৭৩১ সালে। নাম তার কোপলে মেডেল এবং সব পুরস্কারের মতোই এখানেও ছিল মানপত্র, মেডেল এবং কিছু অর্থ। প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি স্যর গডফ্রে কোপলে এবং পুরস্কারের নামকরণও হয়েছিল তাঁর নামে। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি দায়িত্ব পেল পুরস্কারপ্রাপক নির্বাচন করার। কাজটা অবশ্য খুব সহজ ছিল না। কারণ, শর্তানুযায়ী বিজ্ঞানের যে কোনও শাখায় অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছেন এমন মাত্র এক জন বিজ্ঞানীকে বেছে নিতে হবে এই পুরস্কারের জন্য।
আমাদের ওই সময়টা খেয়াল রাখতে হবে। নিউটন প্রয়াত হয়েছেন মাত্র চার বছর আগে ১৭২৭ সালে। ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কিছু অংশে তখন এক দিকে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে, অন্য দিকে বাণিজ্যিক ও রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছে সমুদ্রাভিযান। এর মধ্যে দিয়েও বিজ্ঞানের নানা শাখায় উৎসাহী হয়ে উঠেছেন কিছু মানুষ এবং ইউরোপীয় সমাজের একটা অংশে বিজ্ঞানকে ঘিরে খানিকটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
প্রথম বছর ১৭৩১ সালে এই পুরস্কার পেলেন স্টিফেন গ্রে তাঁর বিদ্যুৎসংক্রান্ত কাজের জন্য, এবং দ্বিতীয় বছরেও তিনিই বিজেতা। এ বার তাঁর নতুন এক্সপেরিমেন্টের জন্য। মনে রাখতে হবে, এই সব পরীক্ষাই স্থির তড়িতের ওপর, কারণ চল-তড়িৎ তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। অবশ্য স্যর গডফ্রের শর্ত ছিল যে, পুরস্কার দেওয়া হবে নতুন পরীক্ষাভিত্তিক উদ্ভাবনার জন্য, নতুন তত্ত্বের জন্য নয়। সঙ্গে এটাও ঠিক হল যে, এক বছর এই পুরস্কার ভৌতবিজ্ঞানের জন্য দেওয়া হবে, আর পরের বছর সেটি পাবেন কোনও জীববিজ্ঞানী।
কোপলে মেডেল এখন বিজ্ঞানের চালু পুরস্কারগুলির মধ্যে কেবল সবচেয়ে পুরনোই নয়, খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দিন ধরে চলে আসা একটি পুরস্কার। পুরস্কারটি এখনও তার শর্ত অক্ষুণ্ণ রেখে প্রতি বছর প্রদান করা হয়। অধিকাংশ বছরে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে মাত্র এক জন বিজ্ঞানীকে। তবে খুব কম কয়েকটি ক্ষেত্রে কোপলে মেডেল একই বছরে দু’জন বিজ্ঞানীকে দেওয়া হয়েছে— এমন নজির পাওয়া যাচ্ছে। আবার একেবারে এই মেডেল দেওয়া হয়নি, এমন বছরের সংখ্যাও কিছু রয়েছে। এই কারণে তুলনায় অনেক পুরনো হওয়া সত্ত্বেও কোপলে মেডেলজয়ীর সংখ্যা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারজয়ীর তুলনায় বেশ কম। কারণ, প্রতি বছর নোবেল তিনটি বিজ্ঞান বিষয়েই শুধু দেওয়া হয় না, প্রতিটি পুরস্কার তিন জন পর্যন্ত বিজ্ঞানীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
পুরস্কারটির শততম বছরে, অর্থাৎ, ১৮৩১ সালে কোপলে মেডেলের শর্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। উঠে যায় কেবল পরীক্ষাধর্মী গবেষণা কাজের জন্য পুরস্কার প্রদানের নিয়ম। এর পর ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বহু তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী এবং অবশ্যই পরীক্ষাভিত্তিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নানা দেশের অনেক বিজ্ঞানী। এই তালিকায় রয়েছেন মাইকেল ফ্যারাডে, কার্ল ফ্রিডরিখ গাউস, জর্জ ওহ্ম, ফ্রিডরিখ হোলার, লর্ড কেলভিন, দিমিত্রি মেন্ডেলিভ, চার্লস ডারউইন, জেমস জুল, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, আলবার্ট আইনস্টাইন— এ রকম আরও অনেকে। সাম্প্রতিক কালে এই মেডেল পেয়েছেন স্টিফেন হকিং এবং তারও পরে পিটার হিগ্স। ২০১৭ সালে এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বিখ্যাত গণিতবিদ অ্যান্ড্রু ওয়াইলস, যিনি গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ফার্মার শেষ উপপাদ্য প্রমাণ করেছিলেন। নোবেল প্রাইজ কিন্তু কোনও গণিতজ্ঞের ভাগ্যে জোটে না। মোট ৫২ জন বিজ্ঞানী নোবেল ও কোপলে মেডেল উভয়েরই অধিকারী হয়েছেন। তবে কোপলে মেডেল এখনও পর্যন্ত পেয়েছেন মাত্র এক জন মহিলা বিজ্ঞানী। না, তিনি মেরি কুরি নন, তিনি রসায়নের আর এক নোবেলজয়ী ডরোথি হজকিন।
একটা জরুরি কথা বলা হয়নি। কোপলে মেডেল চালু করার সময় তার অর্থমূল্য ছিল স্যর গডফ্রের দান করা একশো পাউন্ডের থেকে আসা সুদ। এখন নানা সূত্র থেকে পাওয়া অর্থে তা অনেক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৩০,৭৫০ মার্কিন ডলার)। তবে, নোবেলের ১০ লক্ষ ১৮ হাজার মার্কিন ডলারের তুলনায় কোপলে মেডেলের পুরস্কার অর্থ অনেকটাই কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy