ঝাঁকে ঝাঁকে কণা বেরিয়ে আসছে গ্রহাণু ‘বেন্নু’ থেকে। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
মহাকাশে এত দিন যাদের নিষ্প্রাণ বলে মনে করা হতো, তাদের মধ্যেও দেখা গেল যেন প্রাণের স্পন্দন! এই প্রথম।
এই স্পন্দনকে অবশ্য জৈবিক বলা যাচ্ছে না। তবে দেখা গেল, দূর থেকে এত দিন যাদের শুধুই নির্জীব, নিছকই পাথুরে বলে ভাবা হতো, তাদের মধ্যেও নিয়মিত ভাঙাচোরা হয়। পাথরে ফাটল ধরে। আর আপাতদৃষ্টিতে সেই নির্জীব, নিষ্প্রাণ পাথুরে মহাজাগতিক বস্তুটি মহাকাশে মুহুর্মুহূ উগরে দেয় রাশি রাশি কণা। যার বেশিটাই ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। কিছুটা ফিরে আসে উৎসেই। সেই চঞ্চলতা প্রাণের স্পন্দনের মতোই গতিময়।
নাসার মহাকাশযান ‘ওসিরিস রেক্স’-এর চোখেই প্রথম ধরা পড়ল আপাত-নিষ্প্রাণ আদ্যোপান্ত পাথুরে গ্রহাণুতে (‘অ্যাস্টারয়েড’) প্রাণের স্পন্দন। গ্রহাণুটির নাম- ‘বেন্নু’।
সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে লেখা গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে গত কাল, ৯ সেপ্টেম্বর। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘জার্নাল অব জিওফিজিক্যাল রিসার্চ: প্ল্যানেটস’-এ।
বলা যেতে পারে এই প্রথম কোনও গ্রহাণুর বুকের ধুকপুকুনি চাক্ষুষ করা গেল। দেখা গেল, কোনও গ্রহাণু থেকে কী ভাবে রাশি রাশি কণা প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে ছিটকে পড়ে মহাকাশে। কেন সেই প্রাণের স্পন্দন, তার যথাসম্ভব ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে গবেষণাপত্রে।
ধূমকেতু আর গ্রহাণুর ফারাক
ধূমকেতু আর গ্রহাণুর মধ্যে ফারাক অনেকটাই। ধূমকেতুতে থাকে বরফ, পাথর আর ধুলোবালি। সেগুলি সূর্যের যত কাছে আসে ততই তার বরফ গলে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তৈরি করে ধূমকেতুর লেজ। তাই ধূমকেতুকে বদলে যেতে দেখা যায়। কিন্তু গ্রহাণু তৈরি হয় মূলত পাথর আর ধুলোবালি দিয়ে। বরফ থাকে যৎসামান্যই। তাই কোনও গ্রহাণুর আচার, আচরণ, চেহারা, চরিত্রে রদবদল ততটা চোখে পড়ে না আমাদের। তাদের নির্জীব, নিষ্প্রাণ বলেই মনে হয়।
নাসার মহাকাশযান যা দেখেছে বেন্নুতে, দেখুন সেই অ্যানিমেশন
মূল গবেষক অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লুনার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি ল্যাবরেটরির অধ্যাপক কার্ল হার্জেনরোথার ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে জানিয়েছেন, কোনও গ্রহাণুর বুকের এই ধুকপুকুনি প্রথম দেখা গিয়েছিল গত বছরের জানুয়ারিতে। বেন্নুর কক্ষপথে নাসার মহাকাশযান ওসিরিস-রেক্স পৌঁছনোর পর।
মনে হয়েছিল গুচ্ছ গুচ্ছ তারা!
কিন্তু সেটা যে কোনও গ্রহাণুর প্রাণের স্পন্দন, তা বোঝা যায়নি প্রথমে, জানিয়েছেন কার্ল। তাঁরা দূর থেকে ওসিরিস-রেক্স-এর পাঠানো ছবি দেখে ভেবেছিলেন, ওই রাশি রাশি কণা আসলে গুচ্ছ গুচ্ছ তারা।
এক সময় নাবিকরা আকাশের তারা দেখে মহাসাগরে তাঁরা কোথায় আছেন, তা বোঝার চেষ্টা করতেন। এখন মহাকাশযানগুলিও সেটাই করে। মহাকাশে ছুটতে ছুটতে তারাদের অবস্থান দেখে বুঝে নেয়, কোন পথ ধরে সে এগচ্ছে। ছুটছে। আশপাশে রয়েছে কোন কোন নক্ষত্রপুঞ্জ। আর সেই সব নক্ষত্রপুঞ্জের মানচিত্র যেহেতু জানা থাকে মহাকাশযানগুলির, এমনও ধারণা থাকে, সেই নক্ষত্রপুঞ্জগুলিতে কতগুলি তারা আছে বা থাকতে পারে, তাই অতল অন্ধকারের মহাকাশে পথ চিনে এগিয়ে চলতে তাদের অসুবিধা হয় না। বিপদ এড়াতে প্রয়োজনে পথও বদলে নিতে পারে।
আরও পড়ুন- মঙ্গলের আকাশ ভরে যাবে ড্রোনে-কপ্টারে, জানাল নাসা
আরও পড়ুন- এ বার মঙ্গল অভিযানে নাসার বড় ভরসা ভারতের বলরাম
অত তারা যে ওখানে থাকতেই পারে না!
কার্লের কথায়, ‘‘আমি প্রথমে ওসিরিস-রেক্সের পাঠানো ছবি দেখে চমকে উঠেছিলাম। এত তারা? এত তারা রয়েছে ওই এলাকায়? এমন তো আমার জানা ছিল না কস্মিনকালেও! বড়জোর ওখানে ১০টি তারা দেখা যেতে পারে। কিন্তু নাসার মহাকাশযানের পাঠানো ছবিতে দেখলাম ছোট ছোট অন্তত ২০০টি বিন্দু। অবাক হয়ে গেলাম, ২০০টি তারা রয়েছে ওখানে? পরে সব ছবি খতিয়ে দেখে বুঝতে পারি ওখানে কোনও নক্ষত্রপুঞ্জ নেই। ওগুলি আসলে রাশি রাশি কণা। যা উগরে দিচ্ছে গ্রহাণু বেন্নু। কোনও গ্রহাণুতে যে এই ভাবে প্রাণের স্পন্দন চাক্ষুষ করা যাবে আগে ভাবিনি কখনও।’’
অধ্যাপক কার্ল হার্জেনরোথার (বাঁ দিকে), মতামতে, জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী।
কার্ল ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে এও জানিয়েছেন, বেন্নুতে পৌঁছনোর পর এমন রাশি রাশি কণা উগরে দেওয়ার অন্তত ৩০০টি ঘটনা চাক্ষুষ করেছে নাসার মহাকাশযান ওসিরিস-রেক্স। এদের বেশির ভাগই ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। কিছু গ্রহাণুকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। আর কিছু ফিরে আসে গ্রহাণুর বুকেই।
উগরে দেয় বিকেল থেকে সন্ধ্যার দু’ঘণ্টায়
কার্ল বলেছেন, ‘‘এই ঘটনাগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটে গ্রহাণুর বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে। ঘণ্টাদু’য়েক ধরে। সবচেয়ে বড় আকারের যে কণাগুলিকে আমরা বেন্নু থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে দেখেছি, সেগুলির ব্যাস ৬ সেন্টিমিটার (২ ইঞ্চি)। খুবই ছোট। সংখ্যাও ততটা বেশি কিছু নয়। গতিবেগও খুব কম। ফলে, এদের থেকে মহাকাশযানের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও নেই বললেই চলে। আমরা গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন ঘটনায় বেন্নুর উগরে দেওয়া এমন ৬৬৮টি কণা পরীক্ষা করে দেখেছি। বেশির ভাগেরই ব্যাস ০.২ থেকে ০.৪ ইঞ্চির মধ্যে। তাদের গতিবেগ সেকেন্ডে ৮ ইঞ্চি। গুবরে পোকার গতি। এদের মধ্যে প্রথম ঘটনার পর যে ২০০টি কণা আমরা দেখেছিলাম সেগুলি ৪ ইঞ্চি লম্বা ৪ ইঞ্চি চওড়া টাইলের মতো।’’
গ্রহাণু ‘বেন্নু’।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার: অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তী
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, পাথুরে গ্রহাণুগুলি থাকে মূলত মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝখানে থাকা গ্রহাণুপুঞ্জে (‘অ্যাস্টারয়েড বেল্ট’)। এগুলি আসলে কোনও গ্রহ হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু এরা যেহেতু সৌরজগত তৈরির সময়কার পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়েছিল, তাই এদের সম্পর্কে জানাটা খুব জরুরি। মূলত পাথর আর ধুলোবালি দিয়েই তৈরি। বরফও থাকে যৎসামান্য। তবে অদ্ভূত কক্ষপথে প্রদক্ষিণের সময় এদের বরফ উবে যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। যেহেতু এদের কোনও বায়ুমণ্ডল নেই, তাই দিনে আর রাতে গ্রহাণুগুলিতে তাপমাত্রার হেরফের হয় খুবই। পাথরে ফাটল ধরে। তাতে এদের পিঠ থেকে কণা, পদার্থ ছিটকে বেরিয়ে আসে। তার ফলে যে অনেক ক্ষেত্রে এদের এক ধরনের লেজও তৈরি হয়, সেটাও জানা ছিল। পরে মূলত বরফ আর বালি দিয়ে গড়া সেই লেজ খসে পড়ে গ্রহাণুর মূল শরীর থেকে। পৃথিবী সেই পথ দিয়ে গেলে তখনই আমরা উল্কাবৃষ্টি হতে দেখি। প্রতি বছর ১৩ ডিসেম্বর এমন উল্কাবৃষ্টি দেখা যায় যখন গ্রহাণু ‘ফায়থন-৩২০০’-এর খসে পড়া লেজের এলাকা দিয়ে যায় পৃথিবী।
সন্দীপের কথায়, ‘‘এটি নাসার মহাকাশযানের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। গ্রহাণুদের চেহারা খুব এবড়োখেবড়ো হয় বলে তাদের মাধ্যাকর্ষণ বল সব জায়গায় সমান হয় না। দেখা গেল, গ্রহাণুর উগরে দেওয়া সব কণাই ছিটকে বেরিয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে না তাদের পর্যাপ্ত এসকেপ ভেলোসিটি থাকে না বলে। কেউ কেউ গ্রহাণুকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। কেউ ফিরে আসে গ্রহাণুর বুকে। এর আগে এই ভাবে গ্রহাণুর উগরে দেওয়া কণাদের চালচলন চাক্ষুষ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে গ্রহাণুর মধ্যে কোন কোন পদার্থ রয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের জানা-বোঝার কাজটা সহজতর হবে।’’
ছবি ও অ্যানিমেশন সৌজন্যে: নাসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy