ছবি: এএফপি।
এ বড় বিচিত্র জগত। বড় বড় প্রাণির সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য অনুজীব। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও এই অনুজীবদের একাংশ মানুষ-সহ প্রাণিকুলকে যুগযুগ ধরে ঘায়েল করে আসছে। এদের দাপটে কত প্রাণ মুছে গিয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকার সাহার মরু অঞ্চল, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বড় অংশে এই অনুজীবদের কর্তৃত্বে মাঝেমধ্যে ত্রাহিত্রাহি রব উঠেছে। এদের দ্বারা সৃষ্ট অসংখ্য রোগের মধ্যে অন্যতম তিনটি ‘রিভাব ব্লাইন্ডনেস’, গোদ বা ‘লিম্ফাটিক ফাইলেরিয়া’ এবং ম্যালেরিয়া। এ বার চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল স্বীকৃতি দিল এই তিনটি রোগের সঙ্গে বিজ্ঞানের লড়াইকে। পুরস্কার হাতে উঠল তিন জনের। আমেরিকায় কর্মরত, জন্মসূত্রে আইরিশ উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল ও জাপানের সাতোশি ওমুরা আর চিনের ইউইউ তু-এর হাতে।
জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এই পুরস্কার দু’ভাগে হবে। গোলকৃমির সংক্রমণের চিকিৎসার বিষয়ে অবদানের জন্য এই পুরস্কারের এক ভাগ, ভাগ করে নেবেন জন্মসূত্রে আইরিশ উইলিয়াম সি ক্যাম্পবেল এবং জাপানের সাতোশি ওমুরা। আর ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য পুরস্কারের অন্য ভাগ পাবেন চিনের ইউইউ তু।
গোলকৃমির সংক্রমণ উন্নয়শীল দেশগুলির জনস্বাস্থ্যের সামনে বড় বিপদ। ‘রিভাব ব্লাইন্ডনেস’ চোখের কর্নিয়াকে প্রভাবিত করে। এর থেকে মানুষ অন্ধ হয়েও যেতে পারে। অন্য দিকে, এই কৃমির কারণে প্রায় ১০ কোটি মানুষ প্রতি বছর গোদে আক্রান্ত হন। সারা জীবন গোদের লজ্জা বহন করতে হয়। আর এর চিকিৎসায় ক্যাম্পবেল আর ওমুরা অ্যাভারমেকটিন ওষুধের অবিষ্কার করেন। এই ওষুধ ‘রিভাব ব্লাইন্ডনেস’ আর গোদের চিকিৎসায় অত্যন্ত কার্যকারী।
কাজটা শুরু করেন জাপানের মাইক্রোবায়োলজিস্ট ওমুরা। তাঁর নজর পড়ে ‘স্ট্রেপটোমাইস’ গোত্রের ব্যাক্টিরিয়ার উপরে। মাটিতে বসবাসকারী এই গোত্রের ব্যাক্টিরিয়া নানা ধরনের অ্যান্টি-ব্যাক্রিয়াল পদার্থ উৎপাদন করে। ওমুরা নতুন গোত্রের স্ট্রেপটোমাইস’কে চিহ্নিত করে, মাটি থেকে সংগ্রহ করে, গবেষণাগারে কালচার করেন। এই কালচার থেকে ওমুরা অনুজীবের সংক্রমণের চিকিৎসায় কার্যকরী হতে পারে এমন ৫০টি কালচারকে বেছে নেন আরও বিশ্লেষণের জন্য।
আমেরিকায় কর্মরত ক্যাম্পবেল এই বিশ্লেষণের কাজ শুরু করেন। পরজীবী বিশেষজ্ঞ ক্যাম্পবেল দেখেন এই ৫০টি কালচারের মধ্যে একটি গৃহপালিত পশুর পরজীবী সংক্রমণে ভাল কাজ দিচ্ছে। এই কালচার থেকেই মেলে অ্যাভারমেকটিন। যার থেকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে আরও শক্তিশালী ইভারমেকটিন তৈরি করা হয়। মানুষের উপরে ইভারমেকটিন পরীক্ষা করে দেখা যায় নানা পরজীবির সংক্রমণের সুফল মিলছে। বিশেষ করে ‘রিভার ব্লাইন্ডনেস’ আর গোদে চিকিৎসায় ইভারমেকটিন অত্যন্ত সফল।
পাশাপাশি কাজ চালাচ্ছিলেন তু-ও। চিনের এই মহিলা বিজ্ঞানীর ক্ষেত্র ছিল অতিপরিচিত ম্যালেরিয়া। মানব ইতিহাসে ম্যালেরিয়ার কালো ছাপ সেই কবে থেকে রয়ে গিয়েছে। ছিল চিকিৎসা পদ্ধতিও। কিন্তু সেই প্রথাগত চিকিৎসা, ক্লোরকুইনের ব্যবহারের কার্যকারিতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিল। ১৯৬০-এর দশক থেকেই এটা লক্ষ করা যাচ্ছিল। কিন্তু ম্যালেরিয়ার দাপট কমা তো দূর অস্ত্, ক্রমেই আরও ভয়ঙ্কর আকার নিচ্ছিল। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলিতে ম্যালেরিয়ায় অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছিলেন। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির খোঁজে চিনের প্রাচীন আয়ুর্বেদে ডুব দেন তু। তাঁর চোখে পড়ে ‘আর্টেমিসিয়া আনুয়া’ উদ্ভিদটির উপরে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ ঘেঁটে তু এই উদ্ভিদ থেকে একটি বিশেষ উপাদানকে চিহ্নিত করেন। পরে উপাদানটির নাম হয় ‘আর্টেমিসিনিন’। দেখা যায়, ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় আর্টেমিসিনিন খুব ভাল কাজ দিচ্ছে। ম্যালেরিয়ার পরজীবীকে সংক্রমণের এক বারে প্রথম দিকে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম আর্টেমিসিনিন। গরিব দেশে আর্টেমিসিনিন প্রায় জাদুর মতো কাজ করেছে। কম্বিনেশন থেরাপিতে এই ওষুধের ব্যবহার পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারে মৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর অর্থ, শুধু আফ্রিকা মহাদেশেই এই ওষুধটি প্রায় এক লক্ষ প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাই বোধহয় নোবেল কমিটির মতে, মানব ইতিহাসে এই দুই অবিষ্কারের মূল্য অপরিসীম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy