Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

পিঠেবিলাসের হালহদিশ, কোন পুলি কী ভাবে বানাবেন?

বারো মাসের তেরো পার্বণের অন্যতম হল পৌষপার্বণ। বাংলাদেশের রন্ধনপ্রণালীতে সেই পিঠের অকালবোধন করা হল।

মনামি সাধুখাঁ চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০০:৫১
Share: Save:

অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন হওয়ার পরেই বাজারে ওঠে নতুন গুড়। এই গুড়ের সঙ্গে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে তা সেঁকে, ভেজে, ভাপিয়ে তৈরি হয় পিঠে। প্রাচীন কালে পিঠে মিষ্টান্নেরই অঙ্গ ছিল। কৃত্তিবাসী রামায়ণেও সীতার পরিবেশনে উল্লেখ পাওয়া যায়, ‘...দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত।।’ মঙ্গলকাব্যেও রয়েছে পুলি-পিঠের রন্ধনপ্রণালী। ক্রমে তা নতুন রূপে পরিচিত হয়েছে দুই বাংলায়। তবে ও পার বাংলায় পিঠের বিস্তার বহুল। ঢাকার রাস্তায় সারা বছরই গরম পিঠে পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গে রানিনগর-জলপাইগুড়ি ও মালদা স্টেশনেও পিঠে বিক্রি হয়। স্টেশন সংলগ্ন গ্রাম্য বধূরা নারকেল কোরা আর চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠে ভাপিয়ে কলাপাতায় মুড়ে বিক্রি করেন। গরম তাওয়ায় তেলে চালের গুঁড়ো ছিটে দিয়ে তৈরি হয় ছিটা পিঠা। দেখতে অনেকটা সরুচাকলির মতো। এই পিঠা খাওয়া হয় মাংসের ঝোল বা ডিম ভাজা দিয়ে। আর আছে পুলি। চালের গুঁড়ো গরম জলে দিয়ে কাই তৈরি করে ভিতরে পুর দিয়ে তৈরি হয় পুলি। এই পুলি দুধে সিদ্ধ করলে দুধপুলি, ক্ষীরে সিদ্ধ হলে ক্ষীরপুলি আর ভেজে তুলে নিলে হয় ভাজা পুলি। পূর্ববঙ্গের কিছু পিঠের রন্ধনপ্রণালী রইল।

বিবিখানা পিঠে

কেকের মতো এই পিঠে উৎসব- অনুষ্ঠানেই খাওয়ার চল।

উপকরণ: চালের গুঁড়ো দেড় কাপ, নুন অল্প, বেকিং পাউডার ১ চা চামচ, ডিম ২টি, ঘি ১/৪ কাপ, গুড় ১ কাপ, চিনি ১/৩ কাপ, নারকেল কোরা ১ কাপ, দুধ ১ লিটার।

প্রণালী: দুধ ঘন করে নিন। চালের গুঁড়ো, ময়দা, নুন ও বেকিং পাউডার ছাঁকনিতে চেলে নিন। ডিম, ঘি, দুধ, চিনি ও গুড় মেশান। ভাল করে মিশে গেলে এর মধ্যে নারকেল কোরা মেশান। শুকনো উপাদান একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। আগের মিশ্রণে এই শুকনো উপকরণের মিশ্রণ অল্প অল্প করে মেশাতে থাকুন। যে পাত্রে পিঠে তৈরি করবেন, তাতে ভাল করে ঘি ব্রাশ করে নিন। ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আভেন প্রি-হিট করে এক ঘণ্টা বেক করুন। ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন।

গোলাপ পিঠে

গোলাপের মতো দেখতে হওয়ায় এমন নামকরণ। তবে এ পিঠেতে গুড় নয়, ব্যবহার হয় চিনির রস।

উপকরণ: ময়দা ২ কাপ, দুধ ১ কাপ, চালের গুঁড়ো আধ কাপ, চিনি ২ টেবিল চামচ, ঘি ১ টেবিল চামচ, নুন স্বাদ মতো, সাদা তেল ১ কাপ। শিরার জন্য: চিনি ২ কাপ, এলাচ ৩টি, গোলাপ জল ২ চা চামচ।

প্রণালী: ময়দায় চালের গুঁড়ো, নুন, চিনি ও ঘি মিশিয়ে ময়ান দিন। ঈষদুষ্ণ দুধ দিয়ে মণ্ড তৈরি করুন। তা কেটে বল তৈরি করে পাতলা রুটি বেলে নিন। এই রুটি থেকে সমান মাপের ছ’টি গোল টুকরো কেটে নিন। এই গোল টুকরো একটির উপরে আর একটি রাখুন। এই ছ’টি স্তরের রুটি একসঙ্গে রোল করে নিন। রোল মাঝখান থেকে ছুরি দিয়ে কাটুন। কাটার জায়গা হাতের চাপে জুড়ে নিন। এ বার গোলাপের পাপড়ির মতো খুলে দিন। গরম তেলে পিঠে সোনালি করে ভাজুন। অন্য পাত্রে গরম জলে চিনি, এলাচ, দারচিনি দিয়ে ফুটিয়ে রস বানান। নামিয়ে গোলাপজল দিন। এতে পিঠে ডুবিয়ে রাখুন। তৈরি গোলাপ পিঠে।

নকশি পিঠে

চালের আটা মোটা করে বেলে উপরে খেজুর কাঁটা দিয়ে পদ্ম, মাছ, চক্র, পাখি ফুটিয়ে তোলা হয়। এই পিঠে বহু দিন রেখে দেওয়া যায়। পরিবেশন করা হয় গুড়ের সঙ্গে। আগে নববধূর সঙ্গে এই পিঠে তত্ত্ব হিসেবে পাঠানো হত শ্বশুরবাড়িতে। নাম দেওয়া হত কাজললতা, শঙ্খলতা, হিজলপাতা, উড়িফুল, পদ্মদিঘি। আবার মেয়ে-জামাইকে নিয়েও নাম দেওয়া হত— কইন্যামুখী, জামাইবরণ, জামাইসুখ, সতীনমছুড়া, আরও কত কী...

উপকরণ: চালের গুঁড়ো ২ কাপ, নুন অল্প, উষ্ণ জল ২ কাপ, নারকেল কোরা ২ কাপ, নলেন গুড় ২ কাপ, ঘি স্বাদ মতো।

প্রণালী: নারকেল কোরা ও খেজুরের গুড় একসঙ্গে জ্বাল দিয়ে পুর তৈরি করে নিন। একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো, নুন ও গরম জল একসঙ্গে মেখে মণ্ড বানাতে হবে। এই মণ্ড থেকে ছোট ছোট অংশ কেটে বলের আকারে গড়ে নিন। এর মধ্যে নারকেলের পুর ভরে মুখটা আটকে পুলির মতো গড়ে নিন। পুলির গায়ে পছন্দ মতো নকশা করে নিন। একটি পাত্রে জল গরম করে মিনিট দশেক ভাপিয়ে নিলেই তৈরি নকশি পিঠে।

চিতই পিঠে

মাটির সরায় সেঁকে তৈরি হয় চিতই পিঠে। একে ‘আসকে পিঠে’ও বলা হয়। চট্টগ্রামে ভর্তা দিয়েও এই পিঠে খাওয়ার চল রয়েছে।

উপকরণ: চালের গুঁড়ো ১ কাপ, নারকেল কোরা আধ কাপ, ঘি ২ টেবিল চামচ, নুন স্বাদ মতো, উষ্ণ জল ১ কাপ।

প্রণালী: চালের গুঁড়ো, নারকেল কোরা, ঘি, নুন ও গরম জল একসঙ্গে মিশিয়ে লেই তৈরি করতে হবে। ঢাকা সমেত মাটির সরা নিয়ে গ্যাসে বসান। সরাটা গরম করে ঘি ব্রাশ করুন। এক হাতা লেই সরার মাঝখানে দিন। ঢাকা দিয়ে জলের ছিটে দিতে হবে। মিনিট পাঁচেক রাখুন। চারপাশে খুন্তি দিয়ে ঠেলে পিঠে আলগা করে তুলে নিন। গুড় বা ভর্তার সঙ্গে খেতে পারেন ।

মুগ পাকন

এই পিঠে কিন্তু ডালের তৈরি। এই বাংলায় একে পাকানও বলা হত। খুব নকশাদার না হলেও বেশ স্বাদু।

উপকরণ: মুগ ডাল আধ কাপ, চালের গুঁড়ো ১ কাপ, ময়দা আধ কাপ, দুধ ১ কাপ, তেল ২ টেবিল চামচ ও রস।

প্রণালী: শুকনো প্যানে মুগ ডাল ভেজে নিন। ঘণ্টা দুয়েক জলে ভেজান। ডাল, দু’কাপ জল, এক কাপ দুধ ও নুন দিয়ে ডাল সিদ্ধ করুন। এর মধ্যে চালের গুঁড়ো ও ময়দা মিশিয়ে খামির তৈরি করে নিন। ২ টেবিল চামচ তেল দিয়ে কিছুক্ষণ মাখুন। ভিজে কাপড়ে মিনিট দশেক ঢেকে রাখুন। তার পরে সন্দেশের মতো নকশা করে গড়ে নিন। অন্য পাত্রে রস তৈরি করুন। পিঠে সোনালি করে ভেজে রসে ছেড়ে দিন। তৈরি মুগ পাকন।

ডিম পোয়া

পূর্ববঙ্গে কিন্তু ঝাল পিঠেও সমান জনপ্রিয়। সন্ধেবেলায় মুড়ির সঙ্গেই ডিম পোয়া বেশি খাওয়া হয়।

উপকরণ: ডিম ২টি, চালের গুঁড়ো ১ কাপ, জিরে গুঁড়ো আধ চা চামচ, লঙ্কা গুঁড়ো আধ চা চামচ, আদা-রসুন বাটা ২ চা চামচ, পেঁয়াজ বাটা ১ চা চামচ, কাঁচা লঙ্কা কুচি ২ চা চামচ, ধনে পাতা ২ টেবিল চামচ, নুন স্বাদ মতো, তেল ১ কাপ।

প্রণালী: ডিমের মধ্যে চালের গুঁড়ো, পেঁয়াজ, আদা-রসুন বাটা, কাঁচা লঙ্কা কুচি, ধনে পাতা কুচি, নুন, হলুদ, তেল, লঙ্কা গুঁড়ো, জিরে গুঁড়ো মিশিয়ে নিন। এর পরে তেলে ভেজে নিলেই তৈরি ডিম পোয়া।

আরও বহু রকমের পিঠে আছে। পাকা তালের নির্যাস দিয়ে তাল পিঠে হয় শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে। শীতের পিঠের মধ্যে ভাপা, চুষি, দুধ পিঠের যেমন চল, তেমনই আছে পুলি। তবে পিঠে তৈরিতে পূর্ববঙ্গ যে পশ্চিমবঙ্গকে বলে বলে টেক্কা দেবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

রান্না ও রেসিপি: মনামি সাধুখাঁ চৌধুরী

ছবি: তন্ময় সেন

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy