Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

পরিবেশনায় থাকুক বাঙালিয়ানার ছোঁয়াচ

ভাল বাজার বিনা স্বাদু রান্না হয় না যেমন, স্বকীয় পরিবেশনায় রোজকারের পাতও হয় লোভনীয়।

ঈপ্সিতা বসু
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০০:৩৭
Share: Save:

নানা রকম নিরামিষ-আমিষের পদ সাজিয়ে পরিবেশনের নিপুণতা বাঙালির রক্তে। আসলে খাওয়া কেমন হবে যতটা খাবারের মান ও পরিমাণের উপরে নির্ভর করে, পরিবেশনের উপরে তার চেয়ে কিছু কম নির্ভর করে না। বাঙালি তেতো জাতীয় পদ দিয়ে খাওয়া শুরু করে। আর শেষ পাতে চাটনির পরে মিষ্টি। কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার খাদ্য পরিবেশন বা ঈশ্বর গুপ্তের ছড়ায় বাজার বৃত্তান্ত পড়েই বোঝা যায়, অবিভক্ত বাংলাতেও ঝালে-ঝোলে-অম্বলে খাবার পরিবেশন পুরোদস্তুর এক পারফর্মিং আর্ট ছিল।

জুঁইফুলের মতো সুন্দর ধবধবে সাদা সামান্য গরম ভাত আলুসিদ্ধ ও সুগন্ধি ঘিয়ের সঙ্গে পাতে কাঁচা লঙ্কা সমেত হাজির করলেই মুখ ফিরিয়ে থাকা যাবে না। কিন্তু এই ভাত কী ভাবে আরও সুচারু রূপে পরিবেশন করা যায়, তার পরিচয় পাই কবি শ্রীহর্ষের বর্ণনায়। সেখানে লেখা, ধোঁয়া ওঠা ভাত মোটেই ভাঙা নয়, গোটা পরপর আলাদা, কোমল ভাব হারায়নি, সুস্বাদু, সাদা, সরু সুগন্ধযুক্ত। ‘প্রাকৃত পৈঙ্গলে’ যে নারী রোজ কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল আর পাট শাক পরিবেশন করেন, তার স্বামীর ভাগ্যবান হওয়ার কথা বলা হয়েছে। ইতিহাস ছাড়িয়ে রোজকার জীবনে প্রবেশ করলে দেখতে পাই, দুই বাংলায় স্থানভেদে ভাত পরিবেশনের ধরন বদলেছে। ঘটি বাড়িতে যতগুলি পদ আছে, সেগুলোর সঙ্গে খাওয়ার পরিমাণ মতো ভাত একবারেই থালায় সাজিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ। সেখানে বাঙালরা মনে করেন, এক একটি পদের সঙ্গে পরিমাণ মতো ভাত পরিবেশন করলে, মান বাড়ে।

খাদ্য পরিবেশনের জন্য চাই পূর্বপ্রস্তুতিও। এই প্রস্তুতি কেমন হতে পারে, তার একটি আভাস মেলে বিশ্বেশ্বর তর্কালঙ্কারের ‘পাকরাজেশ্বরঃ’ বইয়ে, ‘‘সরল সহাস্য মুখ প্রসন্ন হৃদয়।/ ভাগ্যবন্ত লক্ষ্মীকান্ত পূজনে আশয়।/ তৎপর স্বামীর স্নেহে পাকেতে নিপুণ।/ শুদ্ধমতী দানশীল অকথ্য সে গুণ।’’ পরিবেশনার গূঢ় রহস্য লুকিয়ে বাজারে। বাজার করতে করতেই মেনু ভিস্যুয়ালাইজ় করতে হয়। জানা চাই, কার সঙ্গে কী যাবে। আর কথায় বলে, মানুষের সুখী জীবনের চিত্র— ব্যাগভর্তি বাজার করে ঘরে ফেরা, সে বাঙালি এ পারের হোক বা ও পারের। ছোটবেলায় দেখেছি, বাবার সঙ্গে ছেলেদের বাজার করতে নিয়ে যাওয়া হত ‘ট্রেনিং’ দিতে। তিন-চারটি নানা মাপের চটের ব্যাগ হাতে প্রথমে বাজার ‘সার্ভে’, তার পরে ‘অ্যাটাক’। আনাজ বাছার সময়ে মনে মনে ছকে নিতেন, কী কী পদ হতে চলেছে, সেই অনুযায়ী বাজার। কচি পটোল হলে ডালনা হবে। তাতে একটু ঘি ভাসা ভাসা। নয়তো দু’ফালা করে ভাজা। পটলের পাশেই যদি পেঁপে পাওয়া যায়, তার গড়নপেটনও ভাল হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, পাটনাই ছোলা ছাড়া পেঁপের তরকারি জমবে না। আবার লাল নটে কী আর এমন জিনিস! কিন্তু রাঁধুনির পরিবেশনেই সামান্য মশলা দেওয়া সিদ্ধ সিদ্ধ নটে শাক, সরু চালের ভাতে মেখে নিলেই জাম রঙের ছোঁয়া। কোথাও কালো জিরে দিয়ে শালুকের লতি বা তেলে মাখা ওল সিদ্ধ। ঘটি হোক বা বাঙাল, রান্নার কায়দাতেই মুনশিয়ানা। ঘটি পরিবারে সরষে বাটা দিয়ে কচি ঢ্যাঁড়শ জনপ্রিয়। ঢ্যাঁড়শ বাছতে হবে নিয়ম মেনে একটি একটি করে। ডান হাতের প্রথম আঙুল দিয়ে প্রতিটি ঢ্যাঁড়শের ডগার দিকটা সামান্য নুইয়ে দেখতে হবে, নমনীয় কি না। বিনা আওয়াজে মুচড়ে গেলে বুঝতে হবে তা বৃদ্ধ। অতএব বাদ। ‘অফিস টাইম’-এর মেনুও আছে। তাড়াহুড়োর সময়ে নরম ভাত, বিউলির ডাল, আলুপোস্ত ঘটিদের পছন্দ। কোথাও পাতলা মুগ ডাল, সরষের তেলে পোস্তবাটার বাটিচচ্চড়িতে লম্বা-লম্বা কাঁচা লঙ্কা চিরে দেওয়া। রোজকার জীবনে গৃহিণীর নিজস্ব ভাবনার এই পরিবেশনও তারিফযোগ্য।

পরিবেশনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হল যাচাই। কে চাইছেন আর কে চাইছেন না, তা বোঝার জন্য চাই পরিবেশনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। ভোজবাড়িতে এই যাচাই পর্বের চল বহু দিন ছিল। যতক্ষণ না হাঁসফাঁস করছেন, ততক্ষণ চলছে পরিবেশন। শোনা যায়, অবিভক্ত বাংলায় ভোজবাড়িতে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি খেলে গৃহকর্তা নিজে হাতে দিতেন ‘যাচন’ বা প্রতিশ্রুত দক্ষিণা। এখন ভাবলে অবাকই লাগে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE