অল্প কথায় বলি। ১৯৬৫ সালে পুনে-র ‘ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া’ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরনোর পরও সাত সাতটা বছর লেগেছিল, আমার প্রথম ফিচার ছবি বানাতে। ভেবেই রেখেছিলাম, ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়েই নিজের ছবির প্রোডাকশন নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়ব। কিন্তু, ভাবলেই কি আর হয়? নামকরা প্রযোজকদের কেউই আনকোরা কোনও পরিচালককে সাহস করে ছবির ভার দিতে চান না। তার ওপর এ তো আবার ফিল্ম-স্কুল ফেরত, পড়াশোনাওলা ডিরেক্টর। ছবি বানানো নিয়ে যে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর প্রশিক্ষণ সম্ভব, এ জিনিস তখনও কেউ শোনেইনি। আমি যতই বলি না কেন আমি একটা ছবি বানাতে পারব, কেউ বিশ্বাসই করে না।
তাই কয়েক জন বন্ধু মিলে একটা কো-অপারেটিভ তৈরি করলাম, ঠিক করলাম সরকারি সাহায্য চাইব। এই আর একটা ভুল করলাম। কারণ, সরকার সাহায্য করা বলতে আমাদের কো-অপারেটিভে কিছু শেয়ার রাখতে চাইলেন মাত্র। একটা অল্প বাজেটের ফিচার ছবি বানাতে চাইছি, শেয়ার দিয়ে আমাদের কী লাভ? তখন ‘ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশন’ বলে একটা সংস্থা ছিল, তাদের কাছে লোন-এর আবেদন করলাম। সেটাও পত্রপাঠ খারিজ হয়ে গেল। মলয়ালম ভাষার প্রখ্যাত এক লেখক চিত্রনাট্য লিখেছিলেন। সেই চিত্রনাট্যে নাকি সামাজিক দায়বদ্ধতাটদ্ধতা জাতীয় কিচ্ছু নেই, দেশ-গড়ার মহান লক্ষ্যে এই স্ক্রিপ্ট কোনও অবদান রাখতে পারবে না!
আর একটা শিক্ষে পেলাম: নিজের ছবির স্ক্রিপ্ট নিজেকেই লিখতে হবে। পরের দু’বছর তাতেই মন দিলাম। তার পর ফের আবেদন করলাম লোন-এর। এ বার শিকে ছিঁড়ল। দেড় লক্ষ টাকা লোন, সাড়ে আঠেরো পার্সেন্ট ইন্টারেস্টে। আমার ছবির বাজেট ছিল আড়াই লাখ, মানে বাকি এক লাখ টাকা নিজেকে জোগাড় করতে হবে।
ছবি প্রায় শেষের পথে, আবার একটা সমস্যায় পড়লাম। ডিস্ট্রিবিউটর পাই না। শেষমেশ ঠিক হল, আমরা নিজেরাই ছবির পরিবেশনার ভার নেব। একটা নতুন পন্থা খুঁজে বের করলাম। সিনেমা হলগুলোর সঙ্গে নিজেরাই সরাসরি যোগাযোগ করলাম, তার আগে আমাদের প্রতিনিধিদের শিখিয়েপড়িয়ে দিলাম ভাল করে। কেরলের কিছু অগ্রগণ্য শিল্পী আমাদের খুব সাহায্য করলেন, ছবি এঁকে দিয়ে, পোস্টার বানিয়ে। সেই সময়কার ইন্ডাস্ট্রির নিরিখে এ সব একেবারে অভিনব ব্যাপার ছিল। তাই দর্শকরাও সব কিছু দেখেশুনে মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলেন একটা নতুন ধরনের সিনেমা-অভিজ্ঞতার। আমাদেরও আর তর সইছিল না। ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর কেরল জুড়ে মুক্তি পেল আমার প্রথম ছবি, ‘স্বয়ম্বরম’।
ছবিতে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। কেউ কেউ অতিপরিচিত মুখ, আবার অনেকেরই জীবনের প্রথম অভিনয়। সিনেমা হলের লোকেরা সন্দিহান ছিলেন ছবির হিট হওয়া নিয়ে। কেননা, ছবিতে কোনও কমেডিয়ান নেই। তার চেয়েও বড় কথা, নাচ-গান— যা ছাড়া ভারতীয় ছবি ভাবাই যায় না— তা-ও নেই। দর্শকদের একাংশ আবার ছবির শুরুর দৃশ্যটা দেখতে গিয়ে খুব অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। বাসযাত্রা নিয়ে একটা গোটা সিন, কিন্তু কোনও সংলাপ নেই। জনপ্রিয় মেনস্ট্রিম ছবি হলে এত ক্ষণে সব চরিত্র, তাদের আপদবিপদ, সমস্যা-টমস্যা বুঝিয়ে ছাড়ত, যাতে বাকি ছবিটুকু ধরতে বা বুঝতে আমদর্শক বিন্দুমাত্র মুশকিলে না পড়েন। আর সেখানে এই ছবি শুধু ‘দেখাচ্ছে’। ‘বলছে’ না। দর্শকরা যা যা জানতে চান, সেগুলো বুঝে নিতে হচ্ছে, কেউ গড়গড় হড়হড় করে বুঝিয়ে দিচ্ছে না। কঠিন কাজ।
সবাই বললেন, মোটের ওপর ভালই ছবি হয়েছে। সব হল-এর সব শো অবশ্য ভর্তি হয়নি। এক সপ্তাহ পরেই অনেক হল থেকে ছবি উঠে গেল, বাকি হলগুলোয় চলতে থাকল, তবে দর্শক অনেক কম। শেষে জানলাম, বক্স অফিসে আমার প্রথম ছবি এক্কেবারে ফ্লপ। আমরা সবাই ভেঙে পড়লাম। ছবির বাকি প্রিন্টগুলো আরও অনেক হল-এ পাঠানোর প্ল্যান ছিল। হল না। খবরকাগজের রিপোর্টার, চলচ্চিত্র-সমালোচকরা ‘স্বয়ম্বরম’কে তুলোধোনা করলেন। আরও মুষড়ে পড়লাম।
সে বছর ‘কেরল রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার’-এ আমার ছবি কোনও পাত্তাই পেল না। অবশ্য এর পিছনে লোকের স্বার্থও ছিল। ছবিটা নিয়ে যাতে কোনও কথাই না ওঠে, সেই নিয়ে বেশ কিছু লোক উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ জাতীয় পুরস্কারের আঞ্চলিক নির্বাচন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। জাতীয় স্তরের বিচারকরা যাতে আমার ছবিটা না দেখেন, তা নিশ্চিত করতে তাঁরা ময়দানে নামলেন। খবরের কাগজ থেকেই জানতে পারলাম, আঞ্চলিক কমিটি আমার ছবি নির্বাচন করেননি। উপায়ান্তর নেই দেখে আমরা সটান একটা টেলিগ্রাম করলাম জাতীয় নির্বাচকদের। লিখলাম, আমার ছবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কার কথা। অনুরোধ করলাম, এক বার অন্তত ছবিটা দেখা হোক। কোনও উত্তর এল না। জাতীয় নির্বাচকরা কী ভাবলেন ছবিটা দেখে, আদৌ দেখলেন কি না, জানতেই পারলাম না। সব আশা ছেড়ে দিলাম।
মাসখানেক পর, এক সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে একটা রেস্তরাঁয় বসে চা খাচ্ছি। তখনকার দস্তুরই ছিল, দোকান যত ক্ষণ খোলা, দোকানের রেডিয়োটাও তত ক্ষণ চালু থাকবে। সন্ধে ছ’টার ইংরেজি ন্যাশনাল নিউজ শুরু হল, প্রথমেই ঘোষণা: ‘স্বয়ম্বরম’ নামের মলয়ালম ছবিটি শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। আরও ঘোষণা: ছবিটা একই সঙ্গে শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রী আর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারও জিতে নিয়েছে। আমাদের কাছে এ যেন একটা মিরাক্ল! আনন্দে, উত্তেজনায় সবাই লাফিয়ে উঠলাম। কী যে হল, কী করে যে হল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দিল্লির সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক থেকে তো আমাদের কাছে ছবির একটা প্রিন্টও চায়নি! ওঁরা দেখলেন কোত্থেকে ছবিটা!
অনেক পরে জেনেছি, মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে আমার ছবির যে প্রিন্টটা গিয়েছিল, সেটাই ফিরে দিল্লিতে ওই মন্ত্রকে পড়ে ছিল। ওই প্রিন্টটাই জাতীয় নির্বাচকরা দেখেছিলেন। সব নির্বাচকেরই ছবিটা এত ভাল লেগেছিল যে ওঁরা পরে আঞ্চলিক নির্বাচন কমিটি তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেন, কেননা খেয়োখেয়ির রাজনীতি আর ব্যক্তিগত আকচাআকচির পাঁকে পড়ে আমার ছবিটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল। পরের পঁচিশ বছর নিয়ম করে জাতীয় নির্বাচকরা দিল্লিতে বসেই জাতীয় পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত সমস্ত ছবি দেখতেন। গত দু’বছর ধরে দেখছি এই প্রথাটা উঠে গিয়েছে। যে কে সেই। আঞ্চলিক কমিটির জাঁতাকলে পড়ে ‘অন্য রকম কিন্তু ভাল’ ছবিগুলো রিফিউজ্ড হচ্ছে। আমরা ঠেকেও শিখি না!
একটাই ছবি জাতীয় পুরস্কারের প্রথম সারির সব পুরস্কার জিতে নিচ্ছে, এ জিনিস খুব সম্ভবত ব্যতিক্রম। স্বার্থান্বেষী কিছু লোকের খপ্পরে পড়ে আমার ছবিটা যত অবিচার সয়েছে, জাতীয় নির্বাচকরা যেন তার ঢালাও ক্ষতিপূরণ দিলেন।
এ বার কেরলের সমস্ত খবরকাগজের প্রথম পাতার হেডলাইন হল ‘স্বয়ম্বরম’ নিয়ে। মানুষও মাতামাতি শুরু করলেন, সব্বাই ছবিটা দেখতে চান। আমরা গোটা রাজ্য জুড়ে ছবিটা রি-রিলিজের সিদ্ধান্ত নিলাম। এমন প্রচার হল, যেন এটা প্রথম বারেরই রিলিজ। অসম্ভব সাড়া ফেলল ছবিটা। সব শো হাউসফুল। আর সাফল্যের দারুণ স্বাদটা পেলাম, প্রথম বার। দু’সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের লগ্নি করা টাকাটাও পেয়ে গেলাম। ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশন থেকে সুদ-সহ যে টাকাটা ধার নিয়েছিলাম, সেটা সময়ের আগেই শোধ করার উপায় হল।
জাতীয় পুরস্কার কী করে দেশের একটা অংশে একটা নতুন চলচ্চিত্র-আন্দোলন শুরু করতে পারে, আমার প্রথম ছবিটা তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। আমার তো মনে হয়, এই একটা দিকে অন্তত আমার প্রথম ছবি নতুন ছবি-করিয়েদের পথ দেখিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy