যোগভূমি: গোরক্ষনাথ মন্দির, গোরক্ষপুর। বাঁ দিকে, ঘড়ির কাঁটার চলন অনুসারে, উপরে যোগী অবৈদ্যনাথ, যোগী আদিত্যনাথ ও যোগী দিগ্বিজয়নাথ। তিন প্রজন্মের গুরু-শিষ্য।
কেউ বলেছেন, মহাত্মা গাঁধীকে খুন করা উচিত। কেউ কুম্ভমেলায় রামমন্দিরের জন্য সাধুদের বিধান দিয়েছেন। আর এক জন হিন্দু-মুসলমানে বিয়ের লাভ জিহাদ আটকাতে ব্যতিব্যস্ত। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় তিন জনই নাথযোগী, গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মন্দিরের প্রধান।
তিন প্রজন্মের তিন মহন্ত—গুরু, শিষ্য ও প্রশিষ্যের হাত ধরেই গোরক্ষপুরের নাথযোগীরা আজ এ দেশে রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র।
প্রথমে গুরু দিগ্বিজয়নাথ। পিতৃদত্ত নাম স্বরূপ সিংহ, মেওয়ারের রাজপুত ঠাকুর পরিবারের সন্তান। আট বছর বয়সে মাতৃহারা। ফুলনাথ নামে এক নাথ যোগী তখন সেই বয়সেই তাঁকে রাজস্থান থেকে গোরক্ষপুরে নিয়ে আসেন। সেখানকার গোরক্ষনাথ মন্দিরই নাথযোগীদের পীঠস্থান।
অতঃপর স্বরূপ মঠে থেকেই লেখাপড়া শেখেন। গোরক্ষপুরের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ় কলেজে পড়তেন। ছাত্র হিসেবে মাঝারি মানের, কিন্তু চমৎকার টেনিস আর হকি খেলেন, ঘোড়ায় চড়ার কসরতও তাঁর জানা।
১৯২০-র গোরক্ষপুর, মহাত্মা গাঁধীর ডাকে উত্তাল চৌরিচৌরা আন্দোলন। কলেজ ছেড়ে স্বরূপ নাম লেখালেন সেই আন্দোলনে। কিন্তু দিন কয়েক পরেই চৌরিচৌরার পুলিশ চৌকিতে জনতার আগুন লাগানো, ২৩ জন পুলিশের মৃত্যু। ব্যথিত মহাত্মা স্থগিত করে দিলেন আন্দোলন। ক্রিস্টোফার জেফারলট ও অন্যান্য আধুনিক ইতিহাসবিদের মতে, আগুন লাগানোয় স্বরূপ ওরফে নানহু সিংহের বড় ভূমিকা ছিল।
চৌরিচৌরার পর স্বরূপ তাই আর প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেই। কয়েক বছর পর, ১৯৩২ সালে মঠের তৎকালীন মোহন্ত ব্রহ্মনাথ তাকে সন্ন্যাসদীক্ষা দিলেন। নতুন নাম হল দিগ্বিজয়নাথ। এর তিন বছর পরে ব্রহ্মনাথের মৃত্যু, তার আগে দিগ্বিজয়কে তিনি ভাবী মোহন্ত হিসেবে বাছাই করে গিয়েছেন।
মঠের চার দেওয়ালের বাইরে ব্রহ্মনাথের কোনও উচ্চাভিলাষ ছিল না। কিন্তু দিগ্বিজয়নাথ গোরক্ষপুরের মোহন্ত হওয়ার পরই হিন্দু মহাসভায় নাম লেখালেন। বিনায়ক দামোদর সাভারকর তখন দলের সভাপতি।
সেই সাভারকরের ছত্রচ্ছায়ায় দিগ্বিজয়ের রাজনৈতিক উত্থান। ক্রমে যুক্তপ্রদেশের (উত্তরপ্রদেশকে তখন এই নামেই ডাকা হত) হিন্দু মহাসভায় প্রধান। সাভারকর, গোলওয়ালকর মায় বাংলার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সকলে তখন এই মহাসভার মহাতরণিতে। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের ২৭ জানুয়ারি বক্তৃতা দিলেন, ‘দেশের স্বার্থে মোহনদাস গাঁধীকে হত্যা করা উচিত।’ তার তিন দিন পরেই বিড়লা হাউসে নাথুরাম গডসে। গাঁধীহত্যার তদন্তে তখন জেলও হয়েছিল এই নাথযোগীর।
সর্বজনশ্রদ্ধেয়, বৃদ্ধ রাজনৈতিক নেতাকে গুলি করে হত্যার বিধান দিচ্ছেন গোরক্ষনাথের মঠের মোহন্ত। কিন্তু আধুনিক ভারতীয় রাজনীতি এই রকমই। গাঁধী হত্যার পর ১৯৫০ সালে ভারত ফের উত্তাল। নতুন সংবিধানে কী থাকবে? নেহরু, পটেল, অম্বেডকরদের কথা আমরা জানি। তার বাইরে জনজীবনে বৃহত্তর যে রাজনৈতিক-ধর্মীয় মানস? স্বামী ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী বলছেন, যারা বেদ, বর্ণাশ্রম এবং চার আশ্রম মেনে নেবে, তারাই হিন্দু। ভারত তাদের। অন্যরা অতিথি হিসেবে থাকতে পারে। স্বামী করপাত্রী নামে আর এক রাজনৈতিক সন্ন্যাসীর বিধান, হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থাকার একটা ‘খিচুড়ি সংস্কৃতি’র কথা বলা হচ্ছে। সেটা মানা সম্ভব নয়। মোহন্ত দিগ্বিজয়নাথও এ নিয়ে গোরক্ষপুরের গীতা প্রেসের পত্রিকায় নিবন্ধ লিখলেন, ‘যাঁরা হিন্দুকে সাম্প্রদায়িক বলেন, সর্বতো ভুল। হিন্দু কে?’ নিজেই পরবর্তী অনুচ্ছেদে উত্তর দিলেন, ‘যে ভারতকে পিতৃভুমি এবং পুণ্যভূমি দুই হিসেবে স্বীকার করে, সে হিন্দু। কোনও ব্রিটিশ বা মুসলমান এই দেশকে তার পিতৃভুমি ভাবতেই পারে, কিন্তু যতক্ষণ না মক্কা এবং প্যালেস্টাইনকে ভুলে সে এ দেশকে পুণ্য তীর্থস্থান হিসেবে মানছে, সে এখানকার নাগরিক নয়।’ লেখার শেষে সাফ জানালেন, ‘সংখ্যালঘুদের এ বার হিন্দুদের নেতৃত্ব স্বীকার করেই এখানে থাকতে হবে।’ শুধু নাগপুরই সে দিন সংখ্যাগুরুবাদ ও হিন্দুত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেনি, গোরক্ষপুরের এই নাথযোগীরও বড় ভূমিকা ছিল।
দিগ্বিজয়নাথ এখানেই গোরক্ষপুর মঠে তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা। ব্রহ্মনাথ কোনও দিন মুসলিমদের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। বলার কথাও ছিল না। গোরক্ষনাথের বাণীর সঙ্কলন ‘গোরখবাণী’ জানায়, তুমি জন্মসূত্রে হিন্দু, জ্ঞানে মুসলমান অনেক কিছু হতে পারো, কিন্তু গোরখের শব্দ যে মেনে চলে, তার মধ্যে অস্তিত্বের সব দ্বৈততার অবসান। সে প্রকৃত যোগী।’
হিন্দু-মুসলিম বিভেদ নয়, যোগসাধনাই গোরক্ষপুরের ঐতিহ্য। তাঁদের বিশ্বাস, শিব পার্বতীকে হঠযোগ শিখিয়েছিলেন। তাঁদের থেকে মৎস্যেন্দ্রনাথ এই যোগ শেখেন। সেখান থেকে তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথ। যোগীদের শুভ-অশুভ তাই শ্বাসবায়ুতে নির্ধারিত হয়। গোরখপন্থীদের বিশ্বাস, দুই নাসারন্ধ্র দিয়ে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষতিকর। বাঁ দিকের নাসারন্ধ্র বন্ধ করে শুধু ডান দিকেরটি দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নিলে স্নান, খাওয়াদাওয়া, লেখাপড়া, ঘোড়ায় চড়া, যুদ্ধ করা ভাল হয়। ডান বন্ধ করে শুধু বাঁ দিকেরটিতে শ্বাস-প্রশ্বাস কেনাকাটা, বাড়ির ভিত তৈরি আর বীজ বপনের পক্ষে শুভ।
মেরুদণ্ড স্থির রেখে শ্বাস-প্রশ্বাসই প্রধান শর্ত। কুম্ভমেলায় নাথযোগীদের আখড়ায় তাই কোনও ভগবানের ছবি থাকে না। শুধু অষ্টপ্রহর ধুনি জ্বলে। সন্ন্যাসদীক্ষার সময় কানে কুণ্ডল পরিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণে ওঁদের ‘কানফট যোগী’ও বলা হয়। ধর্মের কারণেই যোগী আদিত্যনাথের কানে কুণ্ডল আছে।
কিন্তু আদিত্যনাথের আগে তাঁর গুরুর গুরু—দিগ্বিজয়নাথ। তাঁরই অনুপ্রেরণায় ১৯৪৯ সালে ‘অখিল ভারতীয় রামসভা’ অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের সামনে দশ দিন ব্যাপী রামকথার আয়োজন করল। রামগান হল, রাতে মসজিদে রামলালা বিরাজমান হলেন। হিন্দু মহাসভার টিকিটে ১৯৬৭ সালে গোরক্ষপুরের সাংসদও নির্বাচিত হলেন দিগ্বিজয়নাথ। তত দিনে তাঁর
মুকুটে যোগ হয়েছে আর একটি নতুন পালক। সর্বদলীয় গোরক্ষা মহা অভিযান সমিতি।
অতঃপর সাংসদ থাকতে থাকতেই ১৯৬৯
সালে যোগধামে।
দিগ্বিজয়ের পর গোরক্ষপুরের মোহন্ত হলেন তাঁর শিষ্য অবৈদ্যনাথ। তিনিও ক্ষত্রিয়। পিতৃদত্ত নাম কৃপাল সিংহ বিস্ত। কিন্তু রাজস্থানের নন, পউরি গঢ়বালে তাঁর জন্ম। এখন জায়গাটা উত্তরাখণ্ডে। নাথেরা জাতপাত মানেন না। কিন্তু অবৈদ্যনাথ,
তাঁর গুরু দিগ্বিজয়নাথ ও শিষ্য আদিত্যনাথ তিন জনেই ক্ষত্রিয়।
গোরক্ষপুর মন্দিরের চত্বর ছাড়িয়ে অবৈদ্যনাথও তাঁর গুরুর মতো রাজনীতিতে এলেন। কখনও নির্দল, কখনও বা হিন্দু মহাসভার হয়ে বিধানসভায় জিতলেন। তার পর ১৯৮৪ সালে রাম জন্মভূমি মুক্তিযজ্ঞ সমিতির প্রধান। সেই বছরেই রাম জন্মভূমিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সমিতি সীতামাঢ়হি থেকে অযোধ্যা অবধি যাত্রা করল। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ-কাণ্ড এমনি হয়নি। গোরক্ষপুরের কল্যাণে অনেক দিন ধরেই সলতে পাকানো হচ্ছিল।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে। ব্রহ্মনাথ, অবৈদ্যনাথের মতো নাথযোগীরা তাঁদের প্রাচীন যোগধর্ম ছেড়ে হঠাৎ রামের নামে উজ্জীবিত হলেন কেন? এখানেই কি তাঁরা ‘স্বধর্মচ্যুত’ হলেন?
উত্তর, না। একেবারেই নয়। গোরক্ষপুর থেকে গাড়িতে অযোধ্যার পাশে গোন্ডা, বলরামপুর হয়ে ঘণ্টা পাঁচেক গেলেই দেবীপত্তন মন্দির। মন্দিরটি নাথযোগীদের। এই জায়গাটি নিয়ে দুটি মিথ আছে। কেউ বলেন, এটি শাক্তপীঠ। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে ছিন্ন হয়ে এখানে সতীর বাহু পড়েছিল, তাই দেবীপত্তন। আর একটি মত, দ্বিতীয় অগ্নিপরীক্ষায় অপমানিতা সীতা এখানে পাতালপ্রবেশ করেছিলেন। শিবের সতী এবং রামচন্দ্রের সীতা প্রায় একাকার। হিন্দুর জনবিশ্বাসে একটি ব্যাখ্যাই সব নয়, অনেক ব্যাখ্যা, অনেক বিশ্বাস মিলেমিশে যায়।
শিব এবং তাঁর শক্তির এই গুরুত্বের কারণেই পাকিস্তানের হিংলাজ আজও যোগীদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। হিন্দু মতে সেটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম। করাচির স্থানীয় মুসলমানদের কাছেও এই ‘বিবি নানি’র গুহা অতি পবিত্র। হিন্দু নাথযোগীর কাছে যিনি শিবের শক্তি, মুসলমানের কাছে তিনিই বিবি নানি। মন্দিরের পাশে একটি ঝরনা আছে। সেটি হিন্দুরা শিবের ত্রিশূলসৃষ্ট মনে করেন। হিংলাজ মাতা এক বার ধ্যানস্থ শিবের জটায় লুকিয়ে ছিলেন। আকাশে পাতালে কোথাও শিব তাঁকে খুঁজে পেলেন না। তখন শিব তাঁর ত্রিশূল দিয়ে রাগে গর্ত খুঁড়লেন। ওই গর্ত বেয়ে এখন তিনি পাতালে থাকবেন। তখন হিংলাজ মাতা শিবকে দর্শন দিয়ে বললেন, এই তো, আমি তোমার জটায়। জর্জ ওয়েস্টন ব্রিগস তাঁর ‘গোরখনাথ অ্যান্ড কানফট যোগীজ়’ বইয়ে জানাচ্ছেন, মুসলমানরা বলেন, এই পবিত্র ঝরনায় বিবি নানির ভাই গরিব পির অন্তর্হিত হয়েছিলেন।
হিংলাজ অনেক দূর। ওই সব ভিসার চক্করে মাথা না ঘামিয়ে চলে যাওয়া যায় এ দেশেরই চুনার দুর্গে। শের শাহের কারণে ওই দুর্গ বিখ্যাত। ওই দুর্গের চূড়া থেকেই লাফিয়ে পালিয়েছিলেন মুঘল বাদশাহ হুমায়ুন, এক ভিস্তিওয়ালা তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছিল। এখনও সেই দুর্গের নীচে বয়ে যায় স্রোতস্বিনী, আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলাম অন্দরে। ধুনি জ্বলছে, সামনে দুই সন্ন্যাসী। মিথ বলে, এটি রাজা ভর্তৃহরির সমাধি। তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে নাথযোগী হয়ে যান। সেই সমাধির রক্ষণে ছয় মাস থাকেন নাথযোগীরা, বাকি ছয় মাস শৈব জুনা আখড়া। সারা বছরই ধুনি জ্বলে। এখানে নাথযোগীরা যাকে বলেন ভৈরবের ধুনি, জুনা আখড়া তাকেই বলে দত্তাত্রেয়র ধুনি।
এত মন্দির, তীর্থস্থান এবং প্রণামী যে ধর্মগোষ্ঠীর অধীনে, সেখানে মধ্যযুগের রাজশক্তি আঘাত হানবেই। বারাণসীতে কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরটি যেমন নতুন, মুঘল আমলের শেষে ইনদওরের রানি অহল্যাবাইয়ের তৈরি, গোরক্ষপুরের মন্দিরটিও সে রকম। যোগীদের আসল মন্দিরটি আলাউদ্দিন খিলজি ধ্বংস করেন। তার পর নতুন একটি মন্দির হয়। সেটি আওরঙ্গজেব ধ্বংস করেন। তার পর ১৮০০ সালে পাঁচ একর জায়গায় বাগিচা, গোশালা নিয়ে এখনকার মন্দিরটি গড়ে ওঠে।
আসলে, উনিশ শতক থেকেই নাথযোগীরা রাজপুতানার রাজ্যগুলিতে ক্ষমতার শস্ত্রধারী সৈনিক। জোধপুরের সেনাবাহিনীতে নাথযোগীরা ছিলেন, সেখানে অয়স দেব নাথ ছিলেন রাজা মান সিংহের গুরু ও মন্ত্রণাদাতা। ১৮১৫ সালে জোধপুরেই খুন হন তিনি। যোগীরা আজই প্রথম রাজনীতিতে নন, রাজনীতির শতরঞ্জে তাঁরা অনেক দিন ধরেই আছেন, প্রাক-আধুনিক ঐতিহ্য সে রকমই বলে।
আধুনিক যুগে ব্রহ্মনাথের যে দিকনির্দেশ, সেই ধারায় আরও এগিয়ে এলেন মোহন্ত অবৈদ্যনাথ। ১৯৮৬ সালে রাম জন্মভূমিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রয়াগ কুম্ভে সাধুদের ধর্মসংসদ। সেখানে প্রধান ভূমিকায় গোরক্ষপুরের ওই নাথযোগী। ত্রিবেণীসঙ্গমে এই ধর্মসংসদের পরেই হিন্দু মহাসভার রাজনীতিতে তাঁর ইতি। দল বদল করলেন মহন্ত, হিন্দু মহাসভা ছেড়ে দিলেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি পর পর দু’বার বিজেপি-র সাংসদ। আসলে গোরক্ষপুরের হিন্দুত্ববাদ অনড়, অচল প্রস্তরভূমি নয়। সেখানেও দলবদল ও নানা খেলা চলে।
অতঃপর তৃতীয় পুরুষ— মোহন্ত অবৈদ্যনাথের শিষ্য আদিত্যনাথ। তাঁর রাজনীতি আরও গতিময়। দিগ্বিজয়নাথ, অবৈদ্যনাথরা রামমন্দির মুক্তির রাজনীতি করেছেন। আদিত্যনাথ ওইটুকুতে সীমাবদ্ধ থাকলেন না।
গোরক্ষপুর এলাকায় ছোট্ট শহর মৌ। শহরটায় অনেক মুসলমান তন্তুবায় আছেন, বারাণসীর পরেই সিল্ক শাড়ির জন্য বিখ্যাত। ২০০৫ সাল, সে বার দশেরা আর রমজান প্রায় এক সঙ্গে। এ রকম সময়ে শহরে চাপা উত্তেজনা থাকে। এখানকার পুরনো প্রথা, শাহি কাটরা মসজিদের উল্টো দিকে রামলীলার ম্যারাপ বাঁধা হবে। সেখানে রাম আর ভরতের মিলন হবে। ভরতমিলাপ!
এই বছরে অন্য গল্প। সকাল থেকেই কসাইটোলায় যুবক বাহিনী-র দাপাদাপি। অতঃপর উত্তেজনা, দাঙ্গা। বেশ কিছু শাড়ির কারখানা পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হল, গুলি চলল। তৎকালীন শাসক সমাজবাদী, বহুজন সমাজ পার্টির মুখ পুড়ল। এবং উঠে এলেন আদিত্যনাথ। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালেও আদিত্যনাথের তৈরি এই বাহিনী বারংবার শিরোনামে আসবে। কখনও তারা অ্যান্টি-রোমিয়ো স্কোয়াড তৈরি করে প্রেমিকদের ধরপাকড় করবে, কখনও বা হিন্দু-মুসলমানে বিয়ে বা লাভ জিহাদ আটকাতে উঠেপড়ে লাগবে।
আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রিত্ব এই মৌ-দাঙ্গার এক যুগ পরে। ২০১৭ সালে সারা দেশকে হতবাক করে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহেরা এই যোগীকেই বেছে নেবেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে।
আসল নাম অজয়মোহন বিস্ত। বাবা আনন্দ সিংহ বিস্ত ছিলেন বনবিভাগের রেঞ্জার। অজয় বিস্ত গোরক্ষপুরের হৈমবতীনন্দন বহুগুণা কলেজ
থেকে অঙ্কের স্নাতক। পরীক্ষা পাশের পর ১৯৯৩ সালে মহন্ত অবৈদ্যনাথের কাছে সন্ন্যাসদীক্ষা। তত দিনে তিনি রামমন্দির আন্দোলনের পুরোভাগে। অতঃপর ১৯৯৮ সালে বিজেপির হয়ে লোকসভা ভোটে জয়। ২৬ বছর বয়সে তখন তিনিই দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাংসদ।
তাঁর পূর্বসূরি অবৈদ্যনাথ, দিগ্বিজয়নাথরা মুসলমান ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বহু গরমাগরম বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু পাঁচ বছর আগে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসে স্বাধীনতা দিবসে আদিত্যনাথ যে
নিদান দিলেন তা অভিনব। উত্তরপ্রদেশে মাদ্রাসায় স্বাধীনতা দিবস পালিত হচ্ছে কি না, প্রমাণ-সহ জানাতে হবে। তার পরেও যে কত বিভেদের হেট স্পিচ! এক বার বললেন, সুযোগ থাকলে সব মসজিদে হরগৌরী
ও নন্দীর মূর্তি বসানো উচিত। বিজ্ঞানের স্নাতক নারী-পুরুষে ভেদাভেদ করতেও ছাড়েননি। সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতায় বলেছিলেন, পুরুষের মধ্যে নারীসুলভ কমনীয়তা এলে দেবত্ব আসে। আর মেয়েদের মধ্যে পুরুষসুলভ জেদ জন্ম নিলে তা শয়তানি।
এখানেই নাথযোগীদের বৈশিষ্ট্য। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে শুধু নাগপুর এবং আমদাবাদ নয়, তিন প্রজন্মের গুরু-শিষ্য পরম্পরাতেই উঠে
আসছে গোরক্ষপুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy