বাঘারু তিস্তাপার ছেড়ে চলে যাচ্ছে।… এই নদীবন্ধন, এই ব্যারেজ দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে, উৎপাদন বাড়াবে। বাঘারুর কোনও অর্থনীতি নেই, কোনও উৎপাদনও নেই। বাঘারু এই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল।
গত কয়েক সপ্তাহে দেশ জুড়ে অভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের মাইলের পর মাইল হাঁটার দুর্দশা দেখে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণবাজি থেকে অর্থমন্ত্রীর খুদকুঁড়ো দান, সাহায্যের নামে ঋণদানের তঞ্চকতা, সব কিছুকেই মাদারি ও বাঘারুরা করোনা-পরিস্থিতির ঢের আগে থেকেই প্রত্যাখ্যান করে। বাংলা সাহিত্যের জয় বোধহয় এখানেই!
সেই জয়ের টীকাকার, দেবেশ রায় বৃহস্পতিবার রাতে চলে গেলেন। সেই রাতে সেটি দ্বিতীয় মৃত্যুসংবাদ। সন্ধ্যেবেলায় খবর এসেছিল, ঢাকার হাসপাতালে মারা গিয়েছেন প্রাবন্ধিক আনিসুজ্জামান। দু’জনেই মৃত্যুকালে আশি বছরের ওপরে। দেবেশ রায় ৮৪, আনিসুজ্জামান ৮৩। দু’জনেই হৃদ্রোগে ভুগছিলেন, শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও খনিজ লবণের ভারসাম্য ছিল না। মৃত্যুকালে আনিসুজ্জামান কোভিড পজ়িটিভ ছিলেন। দেবেশ রায়ের অবশ্য তা হয়নি।
মৃত্যুকালীন অসুস্থতা চিকিৎসাশাস্ত্রের উত্তরাধিকার হতে পারে, সাহিত্যের নয়। দুই লেখকই যাবতীয় কাঁটাতারের সীমানা ভেঙে সমসাময়িক দেশ ও রাজনীতি নিয়ে বিপুল উদ্যমে আলোচনা করতেন, এ-ও গৌণ। দেবেশ জন্মেছিলেন বাংলাদেশের পাবনায়, আনিসুজ্জামান এ পারের বসিরহাটে… তাতেই বা কী এল গেল! কিন্তু শেষ অবধি তিনিও তো তাঁর ‘আমার একাত্তর’ বইয়ে আর এক রকম হাঁটাই তুলে ধরেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলা পৌঁছনোর কথায় জানান, ‘আমার চার পাশেও মিছিল, সত্যিকারের মিছিল।…শস্তা নীলশাড়ি-পরা তরুণী, চলেছে ধীর পদক্ষেপে। তার সঙ্গীরা দ্রুত তাকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে, পেছনের দল এসে তার পাশে হাঁটছে কয়েক মুহূর্ত, তার পর তারাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাকে। আঁচলের তলায় দু’হাতে সে ধরে রেখেছে সদ্যোজাত শিশুকে— পথেই সে শিশু জন্মেছে কি না কে জানে!’ দুই বাংলার দুই লেখকই বিভিন্ন সময়ে ছুঁয়ে যান নিরন্ন মিছিলের মুখ।
এই মিছিলে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন নেই। ৫ অগস্ট, ১৯৪৭। ট্রেনে চড়ে করাচি রওনা দিয়েছে বরিশালের যোগেন মন্ডল। পূর্ব পাকিস্তানের এই মানুষটি দেশভাগের পর পাকিস্তানে গিয়ে মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, এ দেশে নমঃশূদ্র ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা মুসলমানদের পাশাপাশিই থাকে। দুই পক্ষই উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে জর্জরিত। দেবেশ রায়ের উপন্যাসের শেষে এক বিকেলে করাচিগামী ট্রেন পঞ্জাবের এক ছোট্ট স্টেশনে থামে। যোগেন ভাবে, ‘এই পথেই তো আর্যরা এসেছিল। তাদের সঙ্গে কোনও শূদ্র ছিল না। তার পর দুই হাজার মাইল হেঁটে হেঁটে তারা শূদ্র পেতে থাকে ও শেষে মৈস্তারকান্দি, যোগেনের পূর্বপুরুষকে শূদ্র বানাতে।… যোগেন নিঃসংশয় জানে মুসলিম লিগও আর্য। তারও শূদ্র দরকার।’ যোগেন মণ্ডল কেন শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে এ দেশে চলে আসেন এবং মারা যান, সে সব ইতিহাসের সত্য। কিন্তু সাহিত্যের এবং
জীবনের সত্য দেবেশের ওই ক্ষুরধার লাইন, ‘মুসলিম লিগও আর্য। তারও শূদ্র দরকার।’
এই মুসলমানি আর্যত্বের অভিমান সদ্যোজাত পূর্ববঙ্গে প্রাবন্ধিক আনিসুজ্জামানেরও নজর এড়ায়নি। তাঁর ‘স্বরূপের সন্ধানে’ প্রবন্ধগ্রন্থে পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের এক অ্যাকাডেমিক তর্কের কথা আছে। সেখানে গোলাম মোস্তাফা বলেন, কাজি নজরুল ইসলাম হিন্দু ভাবধারায় পুষ্ট, তাই তাঁর কবিতার অবাঞ্ছিত অংশ বাদ দেওয়া হোক। কেউ কেউ নাট্যকারদের নারীবর্জিত নাটক লেখার পরামর্শ দেন। এ সবের বিরুদ্ধে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের মঞ্চে কড়া ভাষায় জানান, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালী।’ প্রচুর চেঁচামেচি ও ছিছিক্কারের মধ্যে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন। পরদিন ঢাকার খবরের কাগজগুলিও শহীদুল্লাহের বিরুদ্ধে মুখর হয়। রবীন্দ্রনাথ, সাভারের মুক্তিমঞ্চ তার অনেক পরের কথা। দেশকে এই ভাবেই বিভিন্ন স্রোতের বাঁক এবং উজান ঠেলে এগোতে হয়। কিন্তু দেবেশ এবং আনিসুজ্জামান দু’জনেই বারংবার বুঝিয়ে দেন, যে সব স্রোতের পঙ্কিল আবর্তে জাতীয়তাবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা ঘাপটি মেরে থাকে, তাদের বারংবার পরাস্ত করাটাই দুই বাংলার ঐতিহ্য।
দুই লেখকই সমকালীন রাজনীতি থেকে কখনও বিবিক্ত হননি। দেবেশ রায় আজীবন সিপিআই সদস্য, আনিসুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শিক্ষক সংগঠনের সম্পাদক। পাকিস্তানি স্বৈরশাসন থেকে নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পিছপা হননি। বছর পাঁচেক আগেও বাংলাদেশে ব্লগার-হত্যার প্রতিবাদ করায় তাঁকে খুনের হুমকি দেওয়া হয়। দেবেশ খুনের হুমকি পাননি, দেশভাগ নিয়ে তাঁর ‘রক্তমণির হারে’ বা ‘দলিত’-এর মতো সঙ্কলন এখন বেরোলে কী হত বলা যায় না। মরাঠি ভাষায় দলিত মেয়েদের কবিতাও স্থান পেয়েছিল তাঁর সেই অনুবাদগ্রন্থে: ‘আমরা জানি গোলমালটা কোথায়/ কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।’ ১৯৯১ সালে বেরনো এই সঙ্কলনে দেবেশের ভূমিকা আজও প্রাসঙ্গিক— ‘ইংরেজি-জানা আমলাদের এক ভারতবর্ষ আছে, ইংরেজি-জানা সমাজবিজ্ঞানী বা ভাষাবিজ্ঞানীদের একটা ভারতবর্ষ আছে, আঞ্চলিক ভাষাগুলির একটা ভারতবর্ষ আছে, বিভিন্ন উপভাষারও একটা ভারতবর্ষীয় সীমা আছে।’ বিপিন রাওয়ত বা নাগপুরের মস্তিষ্করা এই লক্ষ ভারতকে কখনই চিনতে পারেননি, শুধু ‘এক দেশ, এক আইন’-এর শূন্যগর্ভ স্লোগান দিয়ে গিয়েছেন। বাংলা ভাষায় লিখেও দেবেশ রায় তাই অনুভবে সর্বভারতীয়।
এই যে ক্ষুদ্র বাঙালির গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর পৃথিবীতে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠা, এটা সদ্যপ্রয়াত আনিসুজ্জামানেরও বৈশিষ্ট্য। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি কখনও প্যারিস, কখনও বা আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির ভিজ়িটিং ফেলো। দুই আন্তর্জাতিক বাঙালির শেকড় আসলে উনিশ শতকের ঢের আগে থেকে মননে, বৈদগ্ধ্যে রসগ্রহণ করেছে। আনিসুজ্জামান তাঁর এক প্রবন্ধে পরিষ্কার দেখিয়েছিলেন, বাংলা ভাষার সূচনায়, চর্যাগানে কৃষির উল্লেখ নেই। তাঁর বক্তব্য, থাকার কথাও ছিল না। ক্ষয়িষ্ণু নগরই চর্যাগীতির পটভূমি। দেবেশও ঐতিহ্য খনন করেছেন নগরবৃত্তে। ১৯৮৭ সালেই বেরিয়ে গিয়েছিল তাঁর বই: আঠারো শতকের বাংলা গদ্যের চিঠিপত্রে কিছু নতুন প্রমাণ। অতঃপর ‘উপনিবেশের সময় ও বাংলা সাংবাদিক’। আনিসুজ্জামানের বহুনন্দিত তিন খণ্ডের আত্মজীবনীও ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন কাগজে। দুই অক্লান্ত সাহিত্যযোদ্ধাই সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জোড়া রণপায়ে বঙ্গবিজয় সম্পূর্ণ করেছেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিসরে দুই বিজয়ীর ব্যূহ রচনা আলাদা। দেবেশ এগিয়েছেন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’-এর মতো উপন্যাস বা ‘দুপুর’-এর মতো গল্পের রাজবর্ত্ম ধরে, আনিসুজ্জামান তীক্ষ্ণধী প্রবন্ধপথে। বাংলা মঙ্গলকাব্যে ঝুড়ি ঝুড়ি বাল্যবিবাহ অক্লেশে উঠিয়ে আনেন তিনি, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে শ্রীকৃষ্ণ যখন আইহনের স্ত্রী রাধার প্রতি আকৃষ্ট হন, তখন রাধার বয়স এগারো বৎসর মাত্র। কালকেতুর যখন বিয়ে হয়, তখন সে ‘একাদশ বৎসরের যেন মত্ত হাতী’, ফুল্লরার বয়স আরও কম।’ রাধার খোঁপায় চাঁপাফুল, বেহুলার নাকে মোতি, কানে কুণ্ডলের ব্যাখ্যা করতে করতে তিনি অক্লেশে জানিয়ে দেন, ষোড়শ শতকে মহিলাদের অন্তত ষোলো রকমের পুষ্পালঙ্কার ছিল। তাঁর আত্মজীবনীর শেষ খণ্ড ‘বিপুলা পৃথিবী’ বছর তিনেক আগে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিল। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো তাঁর এই আত্মজীবনীও ব্যক্তির নিজস্ব গণ্ডিকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে সমসাময়িক সমাজ ও রাজনৈতিক ঘটনার দর্পণ। দু’জনের সময় আলাদা, মেজাজও। আত্মজীবনী লেখার সময় দু’জনেই স্মৃতির উপর নির্ভরশীল, কিন্তু সেটাই সব নয়। ‘এই লেখা পড়ে যদি কেউ বা কারো স্বজনেরা ক্ষুব্ধ হন, তাঁদের কাছে আমার একটাই কৈফিয়ত। যা সত্য বলে জেনেছি, তাই লিখেছি,’ আত্মজীবনীর মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত খণ্ডে লিখেছেন আনিসুজ্জামান।
সত্যান্বেষণ ভয়ঙ্কর। একাত্তরের কলকাতা। ইতিহাসবিদ বরুণ দে আনিসুজ্জামানদের নিয়ে গিয়েছেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বেলতলার বাড়িতে। লাল শার্ট এবং শর্টস পরে নেমে এলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর, ‘শাজাহানের খবর কী?’ আনিসুজ্জামান জানতেন, বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর ডাক নাম শাজাহান। জানালেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি লন্ডনে আছেন। সিদ্ধার্থ জানালেন, শাজাহান ও তিনি একসঙ্গে ব্যারিস্টারি পড়েছেন। তার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ পেতে কত দিন লাগবে?’ আনিসুজ্জামানের সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধা বললেন, ‘এই বছরেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ ফিরে পাবো।’ সিদ্ধার্থ চমকে গেলেন, ‘বলেন কী।’ আনিসুজ্জামান অকপট স্বীকার করেছেন, তিনি একটু দমে গিয়েছিলেন, এটা বাড়াবাড়ি রকমের অনুচিত আশার কথা হল না তো! মুক্তিযোদ্ধারাও স্বাধীনতা লাভের আলটপকা কথায় তা হলে ভেবড়ে যেতেন!
মানে, সব যোদ্ধাই এক রকম নন। কেউ একটু বক্তিমে দেন, কেউ বা তাতে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যান। মিছিলের সবাই কি এক রকম হয়? তিস্তাপারের বৃত্তান্তে যেমন নেংটি পরা বাঘারুকে দেখে শ্রমিকশ্রেণির মিছিলটা হাসে, মজা পায়। এই নেংটি পরা নগ্নতা মিছিলের সয় না। মিছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরেও যে উচ্চাবচ, অস্পৃষ্ট এক মানবজমিন থাকে, বাংলা ভাষার দুই প্রান্তের, দুই ভিন্ন দেশের সমাজসচেতন গদ্যকার সেটিই তুলে ধরেন। কেউ আত্মজীবনীতে, কেউ বা উপন্যাসে। ‘নো পলিটিক্স প্লিজ়’-এর হাল ফ্যাশনের ভ্রান্ত চেতাবনি এঁদের দু’জনের কারও জন্যই নয়। সেখানেই এঁরা এক সূত্রে গাঁথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy