Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Theatre Song

নাট্যগানে কণ্ঠের অভিনয়ই আসল

নাট্যগীতির সঙ্গে এ ক্ষেত্রে মিল আছে লোকসঙ্গীত বা বাউলগানের। গানের বাণীকে অভিব্যক্তি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা, অর্থাৎ গান দিয়ে ছবি আঁকাটাই প্রধান, কণ্ঠ ততটা নয়। অম্বরীশ ভট্টাচার্য

অম্বরীশ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪ ০৯:২৮
Share: Save:

সঙ্গীতের ব্যাপারে ছেলেবেলা থেকেই আমার দারুণ উৎসাহ। অল্প বয়স থেকেই বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্য ও প্রশ্রয় পেয়ে এসেছি। বিভিন্ন গান শুনতে শুনতেই বোধহয় কণ্ঠের আগে কান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কুড়িয়ে পাওয়া এই সব মণিমুক্তোই আমাকে নাটকের গান গাইতে প্রভূত সাহায্য করেছে।

আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যখন থেকে নাটক দেখতে শুরু করে, তখন থেকেই (নব্বই দশকের মাঝামাঝি) নাটকে গানের গুরুত্ব কমতে থাকে। যে ক’টি নাটকে গান ব্যবহার হত বা এখনও হয়, বেশির ভাগই দৃশ্যনির্ভর (সিচুয়েশনাল) গান, যা কখনওই নাটকের বাইরে স্বতন্ত্র গুরুত্ব পায় না। নাটকের গান তখনই জনপ্রিয়, যখন তা দৃশ্যনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি সঙ্গীতরসেও পরিপূর্ণ। তবেই সে গান অভিনয় ছাড়াও গাওয়া সম্ভব।

অনেকের ধারণা, নাটকের গান সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম উদাসীন। কথাটা মোটেই ঠিক নয়। নাট্যশিল্পে উৎসাহী বহু ছেলেমেয়ে ও নাট্যকর্মীর নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি বহু বার। নাটকের গান সম্পর্কে তাঁদের অনেক প্রশ্ন। আমি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল-সহ প্রায় সারা দেশ ঘুরেছি, নাট্যগানের অনুষ্ঠান করে। দেখেছি এ রাজ্যে ও বহির্বঙ্গের একাধিক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যুবক-যুবতীদের কী প্রবল আগ্রহ নাটকের গান নিয়ে। প্রায় সমস্ত অনুষ্ঠানের শেষেই তাঁদের মধ্যে কেউ না কেউ এসে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাইতেন এ বিষয়ে। জানতে চাইতেন— নাটকের গান কী ভাবে অন্য গানের থেকে পৃথক, অন্য গানের গায়কির সঙ্গে নাটকের গানের কী তফাত, নাট্যগীতি পরিবেশনের জন্য কতটা রেওয়াজ প্রয়োজন ইত্যাদি। বার বারই তাগিদ অনুভব করেছি, সামান্য যতটুকু যা জেনেছি, সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার। সেই প্রয়াস চরিতার্থ করতেই এই লেখা।

প্রথমেই বলি, শুধুমাত্র নাটকের গান গাইতে চাইলে কণ্ঠ খুব উন্নত না হলেও চলবে। তবে কণ্ঠে পূর্ণমাত্রায় থাকতে হবে অভিনয়। এক জন অত্যন্ত শিক্ষিত সুগায়কের ভিতরেও যদি অভিনয়ক্ষমতা না থাকে, তা হলে তাঁর পক্ষে নাটকের গান যথার্থ ভাবে গাওয়া সম্ভব হবে না। তুলনায় কম শিক্ষিত বা সামান্য ‘বেসুরো’ কোনও অভিনয়প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি কিন্তু সে জায়গায় জিতে যাবেন অনায়াসে। যে কোনও ধরনের গান গাইতে গেলেই তাতে অভিনয় থাকতে হয় অন্তত চল্লিশ শতাংশ। কিন্তু নাটকের গানের ক্ষেত্রে তা বেড়ে দাঁড়ায় আশি শতাংশ। এ ক্ষেত্রে নাট্যগীতির সঙ্গে কিছুটা হলেও মিল পাওয়া যায় লোকসঙ্গীত বা বাউলগানের। সে ক্ষেত্রেও গায়কি বা গানের বাণীকে অভিনয় দিয়ে ফুটিয়ে তোলা, গান দিয়ে ছবি আঁকাটাই প্রধান, ‘কণ্ঠ’ ততটা নয়।

নাটকের গান গাইতে হলে স্কেল সম্বন্ধে অবশ্যই স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। নাট্যগান অনেক সময় খালি গলায় গাইতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্কেল ঠিক না করে গান গাইতে শুরু করলে গান চলাকালীন খুব সমস্যা হতে পারে। দু’টি উদাহরণ দিলেই কথাটা বোঝা যাবে— ‘সীতা’ (১৯২৪) নাটকে ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে’ (নাট্যকার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, গানের কথা: হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুর: গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, পরিচালনা: শিশির ভাদুড়ী) গানটির সুর তিনটি সপ্তকই ছুঁয়ে যায়। এই গান খালি গলায় গাইতে গেলে প্রাথমিক ভাবে কণ্ঠের মন্দ্র বা তারসপ্তকে বিচরণক্ষমতা বিবেচনা করা উচিত, না হলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা।

গানটি শুরু হয় ষড়জ থেকে। মাঝখানে, অর্থাৎ ‘ফিরবো না আর প্রাণ কাঁদানো, মা হারানো ঘরে’ লাইনে, তারসপ্তকের মধ্যমের স্পর্শ লাগিয়ে কোমল গান্ধারে এসে সরাসরি আবার মধ্যসপ্তকের ‘সা’-তে ফিরে আসে। আবার ‘কোথায় সীতা’ লাইনের সুরটি, মন্দ্রসপ্তকের ‘পা’ ছুঁয়ে ‘সা’-তে ফিরে এসে ‘কাজলা রাতের বেদন বাঁশি’র জায়গায় তারসপ্তকের পঞ্চম ছুঁয়ে, আবার ‘বাজল করুণ সুরে’-তে মধ্যসপ্তকের ‘সা’, অর্থাৎ যেখান থেকে গানটি শুরু হয়েছিল সেখানেই ফিরে আসে।

অতএব বোঝা-ই যাচ্ছে, এ ধরনের গান গাইতে গেলে স্কেল অথবা তিনটি সপ্তক সম্বন্ধে অসম্ভব স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। আবার ‘আবু হোসেন’ (১৮৯৩) নাটকের ‘সরল প্রাণে ব্যথা লেগেছে’ (নাট্যকার: গিরিশচন্দ্র ঘোষ) গানটি শুনতে বেশ সহজ মনে হলেও আসলে তা নয়। আবুর যখন ধনদৌলত, প্রতিপত্তি ছিল, তার টাকায় বন্ধুবান্ধবরা ফুর্তি করেছে অঢেল। কিন্তু আজ যখন সে সর্বস্বান্ত, তখন তার পাশে দাঁড়ানোর আর কেউ নেই। আবু তখন দুঃখে, যন্ত্রণায় তার মায়ের কাছে এসে কেঁদে ফেলে এবং গান ধরে ‘সরল প্রাণে ব্যথা লেগেছে মা, বুঝেছি শিখেছি ঠেকে, সোনার স্বপন ভেঙে গেছে’। গানটি আবু ও তার মা’র দ্বৈতকণ্ঠে গীত। দেবকণ্ঠ বাগচীর সুরে।

‘সরল প্রাণে ব্যথা লেগেছে’ অবধি গানটির সুর মধ্যসপ্তকের ‘সা রে মা গা রে’ এই স্বরসমূহে স্থায়ী থেকে ‘মা!’ বলে ডাকটির সময় তড়িৎগতিতে এক বার তারসপ্তকের মধ্যম ছুঁয়ে আবার প্রথম লাইনে, অর্থাৎ সেই মধ্যসপ্তকের ‘সা’তে ফিরে আসে। অতএব এ গানটির ক্ষেত্রে যেমন মাথায় রাখতে হবে সুরের অস্থির ওঠানামা, আবার তেমনই আবুর মনের যন্ত্রণা, তার ‘মা’ বলে প্রায়-হাহাকারটিও যথাযথ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে, প্রত্যেক বার।

এক বার হাড়োয়ার একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে নাটকের গান গাইতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল ক্লাস ইলেভেনের এক কিশোরীর সঙ্গে, অবাক হয়েছিলাম নাট্যগীতির প্রতি তার ভালবাসা দেখে। তার দাদুর সংগ্রহে ছিল পুরনো নাটকের কিছু রেকর্ড। সেগুলি শুনে শুনে অনেক নাটকের গান তুলে ফেলেছিল সে। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম তার গান শুনে। সে প্রশ্ন করেছিল, নাটকের গান গাইতে গেলে সেই নাটকটির ইতিহাস কতটা জানা প্রয়োজন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একটি নাটকের কোনও গান গাইতে গেলে অবশ্যই নাটকটির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানা প্রয়োজন। নাটকটি কার রচনা, কত সালে রচিত, কে কবে কোন মঞ্চে তা কত বার অভিনয় করেছিলেন, নাটকটি কোন পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধেও জানা থাকলে ভাল হয়। এবং অবশ্যই জানা প্রয়োজন, নাটকে গানটির ঠিক আগের মুহূর্তের অভিনয়াংশ, অর্থাৎ গানটি কোন পরিপ্রেক্ষিতে গাওয়া হচ্ছে। গায়ক বা গায়িকা কি নাটকেরই কোনও চরিত্র, না কি শুধুই এক জন সঙ্গীতশিল্পী বা ‘বিবেক’ (আগেকার নাটকে, অন্ধ ভিক্ষুক বা ফকিরের সাজে এ ধরনের চরিত্র থাকত) জাতীয় কেউ। যদি নাটকেরই কোনও নির্দিষ্ট চরিত্র গানটি গেয়ে থাকেন, তবে জানতে হবে চরিত্রটির সেই সময়ের মানসিক অবস্থান। এ সমস্ত তথ্য না জানা থাকলে, নাটকের গান কখনওই ঠিক করে গাওয়া সম্ভব নয়।

দিল্লির ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টার-এ নাটকের গানের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে আলাপ হয় এনএসডি-র এক ছাত্রের সঙ্গে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, নাটকের গান ভাল করে গাইতে হলে কী ধরনের কণ্ঠসাধনার প্রয়োজন। নাট্যগীতি গাওয়ার জন্য আগেই বলেছি, নিজের গলার স্কেল ও অক্টেভ সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। কণ্ঠের ব্যাপ্তির জন্য ভোরবেলা মন্দ্রসপ্তকের স্বরগুলিতে এবং সন্ধেবেলায় মধ্য ও তারসপ্তকের স্বরগুলিতে গলা সাধতে হবে। স্বর পরিচিতির জন্য পাল্টা অভ্যাস করতে হবে। ব্যক্তিগত স্কেল নির্বাচনের জন্য হারমোনিয়ামের যে কোনও একটি স্বরকে ‘সা’ ধরে (পুরুষের ক্ষেত্রে সাধারণত ‘সি’ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ‘বি’ ফ্ল্যাটে) দেখতে হবে, কণ্ঠ মন্দ্রসপ্তকের পঞ্চম এবং তারসপ্তকের ‘গা’ অথবা ‘সা’ অবধি পৌঁছয় কি না। এ বিষয়ে পথনির্দেশের জন্য কোনও অভিজ্ঞ সঙ্গীতশিক্ষকের নির্দেশ মেনে অগ্রসর হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

এ সব তো গেল জ্ঞান ও তথ্যের কচকচানি। কিন্তু এত সবের পরেও যদি শিল্পীর প্রাণেই গান না থাকে, তবে বাঁশিতে সে গান খুঁজে আর লাভ কী? সেই কারণেই আকাশবাণীতে একটি সাক্ষাৎকারে এক বার প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাহানা দেবী বলেছিলেন, “প্রাণের ভেতরকার যে সুর, তাকে ধারণ করতে হবে কণ্ঠে… তবেই তো গান!”

অন্য বিষয়গুলি:

Voice Artist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE