Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Doll Making

বৌদের হাতেই বেঁচে পাতিহালের পুতুল

পালপাড়ায় বিয়ে হয়ে এসে নতুন বৌ দেখতেন, স্বামী তৈরি করেন মাটির নানা জিনিসপত্র, পুতুল। স্বামীকে সাহায্য করতে করতেই পুতুলশিল্পে হাতেখড়ি। মেয়ে-বৌরাই বজায় রেখেছেন পুতুল তৈরির ঐতিহ্য। পুতুল তৈরি শেখার গল্প শোনালেন পুষ্প পাল। পাতিহালের মাটির পুতুল তৈরির ধারার শেষ প্রতিনিধিদের এক জন। হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর ব্লকের পাতিহাল। এই গ্রামের কুম্ভকারদের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ।

দীপক দাস
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২০ ০০:৪৪
Share: Save:

তখন সন্ধে গড়িয়েছে রাতের দিকে। স্বামী লম্ফ জ্বেলে কাজ করছেন। মাটির নানা জিনিসপত্র। হাঁড়ি, সরা, গরুর জাবনা দেওয়ার ডাবা। রোজই করেন। পাশে বসে স্বামীর কাজ দেখছেন স্ত্রী। নতুন বিয়ে হয়েছে। বাপের বাড়িতে মাটির কাজের চল ছিল না। স্বামী প্রায়ই বলেন, দেখে দেখে শিখে নিতে। হাঁড়ি, সরা করতে হবে না। কিন্তু পুতুল গড়া শিখতে তো পারে নতুন বৌ। পাড়ার মেয়ে-বৌরা করে। শিখে নিলে সময় কাটবে। পুতুল বিক্রি করে হাতে দুটো পয়সাও আসবে।

পুতুল তৈরি শেখার গল্প শোনালেন পুষ্প পাল। পাতিহালের মাটির পুতুল তৈরির ধারার শেষ প্রতিনিধিদের এক জন। হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর ব্লকের পাতিহাল। এই গ্রামের কুম্ভকারদের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। পাতিহালের মাটির হাঁড়ির এক সময়ে খুব নামডাক ছিল। নৌকো করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির জন্য যেত। তার সঙ্গে ছিল পুতুলেরও সুনাম। দু’ধরনের পুতুল। প্রথমটা কাঠের পুতুল। ঘাগরা পরা, মাথায় ঝুমঝুমির ঝুঁটি লাগানো কাঠের জোড়া পুতুল। এগুলো নিয়ে সাপুড়ে বেদেরা সাপ খেলা দেখানোর আগে দর্শকদের বিনোদন করে। তবে সে পুতুল গ্রামে তৈরি হয় না। দ্বিতীয়টি হল মাটির পুতুল, গ্রামের কুম্ভকারেরা যে পুতুলের ঐতিহ্য বংশপরম্পরায় বয়ে নিয়ে এসেছেন। মূলত কুম্ভকারদের বাড়ির মেয়েদের হাতেই সমৃদ্ধি এই গ্রামের মাটির পুতুলের।

পাতিহালে দুটো পালপাড়া, মানে কুম্ভকার পাড়া। বড় পালপাড়া আর ছোট পালপাড়া। দুই পালপাড়ায় কী ভাবে বইত পুতুল তৈরির ধারা? পুষ্প পালের বয়স এখন প্রায় সত্তর। শ্বশুরবাড়ি এসে দেখেছিলেন, ঘরে ঘরে পুরুষেরা মাটির জিনিসপত্র তৈরি করেন। মেয়েরাও তৈরি করতে পারেন। তাঁরা স্বামীকে সাহায্য করার পর অবসরে তৈরি করতেন নানা রকমের পুতুল। ছোট ছোট অসম্পূর্ণ হাত, পুরোপুরি পা-হীন টেপা পুতুল তো ছিলই। এ ছাড়াও ছিল পালকি, চাকা-লাগানো নৌকো, চাকা লাগানো হাতি, ঘোড়া। হাতি, ঘোড়ার উপরে সওয়ারিও থাকত। তৈরি হত ছোট, বড় ঘোড়া। পুষ্প পালের ভ্রাতৃজায়া, সাধন পালের স্ত্রী সুধা পাল সুন্দর পুতুল তৈরি করতে পারতেন। সে সব দেখেই পুতুল তৈরি শিখে নেন পুষ্প। দুই পালপাড়ায় বৌ হয়ে আসা মেয়েরা এ ভাবেই শিখে নিতেন পুতুল তৈরির কাজ।

বিক্রিও হত ভাল। মুন্সিরহাটের জাতের মেলায়, মানসিংহপুরের রথের মেলায়, পাতিহালের রায়বাড়ির দোলে। বাড়িতে এসেও লোকজন কিনে নিয়ে যেতেন। পুতুলগুলো ছিল ছোটদের খেলনাবাটির উপকরণ। বাচ্চারা চাকা লাগানো ঘোড়া, হাতি দড়ি বেঁধে টানতে টানতে রাস্তায় ঘুরত। চাকা লাগানো ছাড়াও আর এক ধরনের ঘোড়া তৈরি হয়। সেগুলো বেশির ভাগই মানত পূরণের জন্য। পাতিহালের গুমোতলায় আছেন গুমোরাজ ঠাকুর। সেখানে মাটির ঘোড়া দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। কয়েকটা গ্রাম পরে মুন্সিরহাটে ফতে আলির দরগাতেও ঘোড়া দেওয়ার রীতি রয়েছে। ফলে বিক্রি ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরা দেখেছিলেন পাতিহালের চাকা লাগানো পুতুল, টেপা পুতুল, পালকি। ‘পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ’ বইয়ে তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। মাটির খেলনাগুলো রং করেও দিতেন কেউ কেউ।

কিন্তু পাতিহালের পুতুলের সেই দিন আর নেই। চাকা লাগানো বা সওয়ারি পুতুল তৈরি একেবারেই শেষ। পুষ্প পালকে বরাত দিয়ে এ রকম কিছু পুতুল তৈরি করানো হয়েছিল। তা-ও তিনি অন্যের পণে (যেখানে সদ্য তৈরি নরম মাটির জিনিস পুড়িয়ে শক্ত করা হয়) সেগুলো পুড়িয়ে তৈরি করেছেন। সেগুলোই হয়তো শেষ নির্দশন হিসেবে থাকবে। বা ব্যক্তিগত সংগ্রহে যদি কারও কাছে কিছু পুতুল থেকে যায়, সেগুলো। এখন পালপাড়ায় শুধু তৈরি হয় কিছু টেপা পুতুল। কেন এই ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে? একটা কারণ, চাহিদা কমেছে। শৌখিন পুতুলের সঙ্গে লড়াইয়ে অনেক দিন ধরে হারছে মাটির পুতুল। মেলা, হাটের রমরমা কমেছে। সেখানে মাটির পুতুলের চাহিদা প্রায় নেই বললেই চলে। মাটিরও অভাব। আগে মাটি আসত গ্রামের লস্করদিঘি আর পাশের গ্রামের হাজরা দিঘি থেকে। এখন মাটি কিনতে হয়। দামও বেশি পড়ে। শুধু পুতুল নয়, মাটির তৈরি অন্য জিনিসপত্রের চাহিদাও কমেছে। দুই পালপাড়া মিলিয়ে এখন কুমোরের চাক আছে গোটা চারেক। আর মাটির তৈরি জিনিস পোড়াবার পণ আছে মেরেকেটে পাঁচটি।

নতুন প্রজন্মের ছেলে বা মেয়ে কেউই মাটির কাজ করতে ইচ্ছুক নন। আগে পুষ্পর স্বামী জীবন পাল মাটি তৈরি করে দিতেন। তিনি মারা গিয়েছেন বহু বছর। ফলে পুতুল তৈরির কাজ প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন পুষ্প। এখন শুধু মানতের ঘোড়া তৈরি করেন। দুই পালপাড়া ঘুরে পুষ্প ছাড়া মাত্র তিন জনের সন্ধান পাওয়া গেল, যাঁরা পুতুল করেন বা করতেন। যেমন শমিতা পাল। মাঝবয়সি শমিতা কাজ শিখেছেন শাশুড়ি সরলা পালের কাছে। এখনও পুতুল করেন। তবে খুবই কম। পৌষ পার্বণের সময়ে হাঁড়িকুড়ি কিনতে আসেন মেয়েরা। তাঁদের সঙ্গে আসা বাচ্চারা পুতুলের জন্য বায়না করে। তাদের জন্যই কিছু পুতুল তৈরি রাখেন এঁরা। রয়েছেন চাঁপা ও লক্ষ্মী পাল। দুজনেই বাপের বাড়িতে মাটির কাজ করতেন না। বিয়ের পর পাতিহালে এসে কাজ শেখেন। এঁরা সম্পর্কে দুই জা। দুজনেই ১৮-১৯ বছর হল মাটির কাজ ছেড়েছেন। অশীতিপর এই দুই পুতুল-শিল্পীর হাত কাঁপে। কেউ কেউ ছাঁচে পুতুল তৈরি করেন। কিন্তু ছাঁচ আর হাতের তফাত তো আছেই। পাতিহালের মাটির পুতুলের দিন বোধহয় শেষ হয়ে এল!

একটা প্রশ্ন ওঠে, পাতিহালে মেয়েদের হাতেই মাটির পুতুলের ঐতিহ্য বজায় ছিল। কিন্তু মেয়েরা আগে কেউ কাজ জানতেন না। প্রথম দিকে তাঁদের শেখালেন কারা? চাঁপা, লক্ষ্মীরা জানালেন, পুরুষদের কেউ কেউ পুতুল তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু পুরুষরা শিখলেন কোথা থেকে? বাংলার কুম্ভকাররা পুতুল তৈরি করতে পারেন। বহু জেলাতেই এর উদাহরণ রয়েছে। তারাপদ সাঁতরা সে বিষয়ে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। পাতিহালের বড় পালপাড়ার বাসিন্দা জগন্নাথ পাল অন্য একটি তথ্য দিচ্ছেন। তিনি পরিবারের প্রবীণদের থেকে শুনেছেন, তাঁদের কোনও এক পূর্বপুরুষ কৃষ্ণনগর থেকে পাতিহালে এসেছিলেন। তবে এই দাবির সমর্থনে কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Doll Making Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy