Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Price Tag

‘নয় নয়’ এ মধুর খেলা

দু’টি নয়, মানে নিরানব্বই। পরবর্তী একশো থেকে ঠিক এক কম। যেমন চারশোর আগে তিনশো নিরানব্বই কিংবা হাজারের আগে ন’শো নিরানব্বই। এ ভাবেই অধিকাংশ বিক্রেতারা পণ্যের দাম রাখেন।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৬:০১
Share: Save:

ছোটবেলায় গোপাল ভাঁড়ের একটি কাহিনি পড়েছিলাম। তার ছেলে রোজ এক টাকা করে জমাত, আর তার বাবাকে জানাত তার কত টাকা জমেছে। গোপাল শুনত, কিছু বলত না। ছেলে প্রায় নব্বই টাকা জমিয়ে ফেলেছে শুনে গোপাল বলেছিল, “নিরানব্বই হলে বোলো।”

ছেলেটি তার কারণ বুঝতে পারেনি। কিন্তু যে দিন তার নিরানব্বই টাকা জমল, সে দিন সে তার বাবাকে জানাল। নিরানব্বই হয়েছে শুনেই গোপাল এক গাল হেসে নিজের থেকে একটি টাকা ছেলের হাতে দিয়ে বলল, “যাও, একশো করে নাও। নিরানব্বইতে ফেলে রাখতে নেই, নিরানব্বই হলেই এক বারে একশো করে নিতে হয়, একে বলে নিরানব্বই-এর ধাক্কা।” গল্পটা সে হিসেবে গোপাল-সুলভ নয়। বাগ্‌ধারায় ‘নিরানব্বইয়ের ধাক্কা’ কথাটি দিয়ে সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি বোঝানো হয়, এই গল্পে সেটাই শেখানো হয়েছে। গল্পটা বলার কারণ হল, আজকের দুনিয়ার বিপণন ব্যবস্থা কিন্তু আর এই নিরানব্বইয়ের ধাক্কায় একশোয় পৌঁছে যাওয়ায় গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং তারা মনে করছে পণ্যের দাম নিরানব্বইয়ে রেখেই ক্রেতাকে তা কেনার জন্য জোরদার ঠেলা দেওয়া সম্ভব। কেমন করে? তা বোঝাতে হলে ডাক্তারবাবুর ঘটনাটা দিয়েই শুরু করতে হবে।

থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে, স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকের ধুকপুকানি পরখ করে চিকিৎসক লিখলেন, ‘টেম্পারেচার ১০০।’ নিদান দিলেন প্যারাসিটামল। প্যাড থেকে প্রেসক্রিপশনটা ছিঁড়ে রোগীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, “তেমন কিছুই হয়নি। নো চিন্তা। দু’দিনে সেরে যাবে। ভাল করে উৎসব কাটান।”

সামাজিক প্রথার ব্যাকরণ জানে, এ বারে রোগী পকেট থেকে ডাক্তারবাবুর ফি বের করবেন। বলবেন, “আসি তা হলে?”

এ বারে তেমন হল না। জ্বরের রোগী চেয়ারে তখনও গ্যাঁট হয়ে বসে।

ডাক্তারবাবু বললেন, “আপনি আর কিছু বলবেন?”

রোগী বললেন, “হ্যাঁ, একটা কথা ছিল স্যর।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “জলদি বলুন। বাইরে আমার প্রচুর পেশেন্ট।”

রোগী বললেন, “প্রেসক্রিপশনটা একটু পাল্টাতে হবে।”

ডাক্তারবাবুর ভ্রু-যুগল এ বারে দ্বিতীয় বন্ধনীর রূপ নেয়।

রোগী বললেন, “ওই যে টেম্পারেচারটা ১০০ লিখেছেন, ওটা কেটে ৯৯.৯ করে দিতে হবে।”

ডাক্তারবাবু গর্জে উঠে বললেন, “মানেটা কী?”

রোগী বললেন, “এই ৯ সংখ্যাটার মধ্যে একটা ম্যাজিক আছে ডাক্তারবাবু। হাতছানি আছে। করে দিন না প্লিজ়। আর একটা অনুরোধ আছে। আপনার তো চারশো টাকা ফি। আমি কিন্তু আপনাকে ৩৯৯ দেব। কথাটা ফেলবেন না দয়া করে।”

অবাক চোখে কিছু ক্ষণ তাকিয়ে থাকেন চিকিৎসক। প্রেসক্রিপশনে মাইক্রোসার্জারি করে দেন, কথামতো। পাঁচশো টাকার নোটটা নিয়ে একশো টাকার সঙ্গে আরও একটা এক টাকার কয়েন যোগ করে দেন, কথামতো।

তার পর রোগীকে বললেন, “আপনি ভূতগ্রস্ত।”

উত্তর উড়ে এল, “শুধু আমি নই ডাক্তারবাবু। দুনিয়া মজেছে যে সংখ্যায়, তার দিক থেকে আমি চোখ বুজে থাকি কী করে?”

পরিচিত ওই চিকিৎসক এক ঘরোয়া আড্ডায় বলছিলেন, “পেশেন্টের বলা শেষ লাইন দুটো আমার কানে অনুরণিত হচ্ছিল অনেক ক্ষণ। এমন মানুষের সংখ্যা বাড়বে ক্রমশ। নিজেকেই মনে হচ্ছে পাল্টাতে হবে এ বারে।”

সাবেকি ছাপাখানাগুলো যদি বেঁচে থাকত এখনও, অক্ষরের পাশে অক্ষর সেট করে যে মানুষরা তৈরি করতেন হ্যান্ডবিল বা লিফলেটের লে-আউট, তাঁরা আজ অর্ডার পেলে সমস্বরে বলে উঠতেন, “আমার কাছে যে আর ৯ নেই মশাই। অন্য কোনও সংখ্যা চলবে না?”

সারা জীবন ঘটাং ঘট শব্দ করা, আজকের দিনে ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যাওয়া এক প্রিন্টিং প্রেস-এর মালিককে বলতে শুনেছিলাম, “বানের জলের মতো ৯ সংখ্যার জোগান না পেলে আজ এমনিতেও বন্ধ করে দিতে হত আমার সাধের প্রেস। দশটা সংখ্যার মধ্যে শুধু একটা সংখ্যায় কী এমন মধু লুকিয়ে আছে জানি না বাপু।”

কথাটা নির্ভেজাল সত্যি। খবরের কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন জানান দেয়, যা কিছু কিনবেন তার দামের শেষটা ৯। জামাকাপড়ের খুচরো বিপণি মোজার ছবি দেখিয়ে হেঁকে যায়, ‘একটা কিনুন ৯৯। তিনটে কিনুন ১৯৯।’ মোবাইল ফোনের অনলাইন দোকান সদ্য জন্ম-নেওয়া ফোনের বিরাট ছবি দিয়ে তলায় লিখে দেয়, ‘মাসিক কিস্তি শুধুমাত্র ১৯৯৯।’ ফোনের আসল দাম কত, জানা দুষ্কর। দশ মিনিটের ডেলিভারি চেন বিজ্ঞাপনে কলার তুলে বলে, ‘দু’লিটার ঠান্ডা পানীয় আর ছ’প্যাকেট নুডলের আসল দাম ভুলে যান। এই দেখুন, আসল দাম ঘ্যাচাং করে কেটে দিয়ে লিখে দিয়েছি কম্বো অফার মূল্য। ৯৯ ওনলি।’ জ্যোতিষাচার্য বলেন, ‘দক্ষিণা ২৯৯, সারা বছরের প্রতি দিনের ভাগ্যবিশ্লেষণ— মাত্র ৯৯৯।’ খবরের কাগজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লিফলেট থেকে জানতে পারি, এসে গিয়েছে নিজের শরীরকে পরখ করে নেওয়ার সর্বকালীন সেরা ডিল। ‘লিভার বুঝতে ৭৯৯, লিভার আর কিডনির কম্বো ১৪৯৯।’ দিবারাত্রি ৯-স্নাত হওয়ার পরে আমার এক কবিবন্ধু বলেছিল, “এই বিজ্ঞাপনগুলো দেখে কবিগুরু কী লিখতেন জানিস? ‘৯ ৯ এ মধুর খেলা’। আর গানটা আগে ছাপা হয়ে গিয়ে থাকলে লালমোহনবাবুর মতো নেক্সট এডিশনে শুধরে দিতেন।”

৯-এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা অমৃতরসের সন্ধান ঠিক কবে, কোথায়, কী ভাবে পাওয়া গেল তা নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত। জানতে পেরে অবাক হলাম, ওয়াকিবহাল শিবিরের এক দল মনে করেন, আদি-যুগে দামের শেষ অক্ষর ৯ করে দেওয়াটা আসলে ছিল দোকানের কর্মচারীদের সততা যাচাই করে নেওয়ার লিটমাস টেস্ট। ‘আদি’ যুগ মানে গত শতকের প্রথম কয়েক দশক। আমেরিকা। দোকানে চালু করে দেওয়া হল ক্যাশ রেজিস্টার। আর দোকান মালিকরা বেশ কিছু এক ডলারের দ্রব্যের দাম এক সেন্ট কমিয়ে দিলেন। নতুন দাম হল ০.৯৯ ডলার। অর্থাৎ, কোনও ক্রেতা এক ডলার দিলে ক্যাশিয়ারবাবু ১ সেন্ট ফেরত দিতে বাধ্য থাকবেন। এই পাওয়া এবং দেওয়ার হিসাবটা ক্যাশ রেজিস্টারে ঠিকঠাক নথিবদ্ধ করা হচ্ছে কি না, পর্দার আড়ালে বসে সেই তথ্য অনুসন্ধানই ছিল ৯-মাখা দাম করার প্রকৃত উদ্দেশ্য। খাতায় লিখে রাখার অর্থ, ওই এক সেন্ট ক্যাশিয়ারে বসা কর্মচারী পকেটস্থ করেননি। মালিকের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘কী পাই নি তারি হিসাব’ মিলিয়ে দিয়ে সততার পরীক্ষায় পাশ করে যেতেন কর্মচারীরা। যাঁরা লিখতেন না, ঘাড়ধাক্কা খেতেন। দামের ইতিহাসের অন্দরে-অন্তরে ঘুরে বেড়ান যাঁরা, তাঁরা বলেন, এটাই পরে নজরে পড়ে যায় বিভিন্ন সংস্থার মার্কেটিংয়ের কর্তাব্যক্তিদের চোখে। ১-এর বদলে ০.৯৯ দামের আইডিয়াটা তাঁদের ভাল লেগে যায় খুব। সেই শুরু।

অনেকে আবার তুমুল আপত্তি জানান এই তত্ত্বের। তাঁদের বক্তব্য, ১৯০০ সালের কয়েক দশক আগে থেকেই হাতছানি দেওয়া শুরু করে ০.৯৯ ডলারের দাম। ১৮৯৬ সালে ফিলাডেলফিয়ার একটি খুচরো বিপণি ১ ডলারের পরিবর্তে ০.৯৯ ডলারে মহিলাদের কোট বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করেছিল বলে শোনা যায়। আবার বলা যায়, সেই শুরু। দুই ‘শুরু’তে, দুই তত্ত্বে, বিরোধ বাধে।

মার্কেটিং-দুনিয়ার বিশেষজ্ঞরা জানেন, কোনও জিনিস কেনার আগে ক্রেতাদের মনে যে প্রশ্নরাজির উদয় হয়, সামনে সাজিয়ে রাখা অনেক অপশনের মধ্যে লড়াইয়ে জিতে কোন দ্রব্যটি কোন যুক্তিতে শেষ পর্যন্ত ক্রেতার শপিং ট্রলিতে জায়গা পায়, তার চুলচেরা পর্যালোচনা চাউমিনের জট ছাড়ানোর মতো। বহু সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, কোনও জিনিসের দামের একেবারে বাঁ দিকের সংখ্যাটি নাকি আমাদের মনের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে সবচেয়ে বেশি। একটু সহজ করে বলা যায়, কোনও সামগ্রীর দাম ৯০০ টাকা দেখলে আমাদের মনে যত ডেসিবেলে ‘উফ কি ভয়ঙ্কর দাম রে বাবা’ কথাগুলো বাজতে থাকবে, তার দাম ৮৯৯ দেখলে এই ডেসিবেল কমে যাবে অনেকটাই। অথচ দুটো দামের মধ্যে ফারাক মাত্র ১ টাকার। বিপণন-বিশ্বে ‘সাইকোলজিক্যাল প্রাইসিং’ বলে যে বহুচর্চিত বিষয়টি রয়েছে, ৯-লেপে দেওয়া দাম তার মধ্যে এখন শিরোনামে। ৯ দিয়ে শেষ হওয়া দামকে অনেকে আবার ভালবেসে বলে থাকেন, ‘চার্ম প্রাইসিং’। শব্দটি যথার্থ!

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষা জানান দিচ্ছে, দামের শেষ সংখ্যা ৯ করে দিয়ে অগুনতি সংস্থা তাদের মুনাফা বাড়িয়েছে বহুগুণ। অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, দাম কমালে বিক্রি বাড়ে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১০৮ টাকার কোনও দ্রব্যের দাম ১০২ টাকা করে দিয়ে বিক্রি বাড়ানো গিয়েছে যতটা, ১০০ টাকার জিনিসের দাম মাত্র ১ টাকা কমিয়ে ৯৯ টাকা করে দিয়ে বিক্রি বাড়ানো গিয়েছে এর থেকে অনেক বেশি। চার্ম প্রাইসিং-এর সুধারস হয়তো লুকিয়ে এখানেই।

তবে সামান্য অর্থ বাঁচানোর সুযোগ পেয়ে ক্রেতাদের মনে যে বটবৃক্ষের মতো ‘জিতলাম, আমি জিতলাম’ ভাব আসে, তা আঁচ করতে পেরে হয়তো আড়ালে তুমুল হাসছেন বহুজাতিকের কর্তাব্যক্তিরা। খুচরো বিপণি সংস্থার এক সেলস অ্যাসোসিয়েটের কথায়, “পাবলিকের বুদ্ধির বলিহারি দাদা। এই দেখুন, দুটো আচারের প্রতিযোগী কোম্পানির প্রডাক্ট। বিক্রির হিসাবে এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। দুটোই নাইন্টি নাইন। একটা কোম্পানির নতুন লটের মাল এল। ওজন একই। নতুন দাম ১০৫। অন্যটারও নতুন লটের মাল এল। সেই ৯৯। কিন্তু ওজন কমে গিয়েছে ১৫ শতাংশ। ১০৫-এর কোম্পানি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ৯৯-এর আচার দৌড়চ্ছে উসেইন বোল্টের মতো। এক লাখ টাকার ফোনে ‘ইয়া, ইয়া’ বলতে বলতে লোকেরা ঠকছে জেনেবুঝে।” একটু থেমে ও বলল, “আমার কাজ বিক্রি করা। আমি করি। কোম্পানি তো আমায় রামমোহন রায় হওয়ার জন্য মাসের শেষে টাকা দেয় না।”

বিপণন-দুনিয়ার প্রভুরা জানেন, মানুষের মনের মধ্যে ৯-এর যে রং তাঁরা মাখিয়ে দিতে পেরেছেন, তা সহজে যাওয়ার নয়। এই সংখ্যার জালে ক্রেতাদের আরও মজিয়ে দেওয়া যায় কী ভাবে, তা নিয়ে গবেষণা চলছে বিস্তর, দুনিয়া জুড়ে।

বহু জায়গার চোরাবালি আপাত ভাবে আট লেনের মসৃণ হাইওয়ে।

সামগ্রীর গায়ে লাগানো বারকোডগুলো ক্যাশিয়ারের হাতে ধরে থাকা স্ক্যানারের দিকে যাওয়ার সময় গর্জে উঠে বলছে, “দৌড়োন, দাদা, দৌড়োন।” বলছে, “তুমিই আমার গ্রাফ। তুমিই আমার কলাম চার্ট। প্লিজ় গেট মি বিলড্, ফাস্ট।”

‘আজ থেকে আমার ফি ৩৯৯ করা হইল’-র গোটা তিনেক প্রিন্টআউট নিয়ে ডাক্তারবাবু কম্পাউন্ডারকে বললেন, “সেঁটে দাও। জলদি।”

অন্য বিষয়গুলি:

Shops
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy