মথুরায় দই-দুধ বেচতে যায় ব্রজের গোয়ালিনিরা। সুন্দরী যুবতী বধূ রাধারানির সঙ্গে যায় বুড়ি বড়াই, সম্পর্কে রাধার দিদিমা। চোখে চোখে আগলে রাখে আগুনযৌবনা শ্রীমতীকে। তা, এক দিন সখীদের সঙ্গে রঙ্গ-পরিহাস করতে করতে মশগুল রাধা বড়াইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন অনেকখানি। রাধাকে খুঁজে না পেয়ে বুড়ির তো মাথায় হাত। অবশেষে দেখেন, যমুনার ঘাটে অনেক গরুর রাখোয়াল এক সবল রাখাল যুবক। তাকেই শুধোন— ‘আমার নাতনিকে দেখেছ?’ শ্যামলকান্তি পুরুষটি বলে, ‘কে তোমার নাতনি? তার বিবরণ দাও। নইলে খুঁজব কী করে?’ বুড়ি তো রাধার রূপের সাতকাহন গাইতে বসে— ‘আমার নাতনির রূপের কথা আর কী বলব? পদ্মের মতো অপরূপ তার মুখ দেখে লজ্জা পায় চাঁদ, কালো কুচকুচে কেশরাশি লজ্জা দেয় কৃষ্ণ-তমাল কলিদের, কাজলকালো নয়নযুগল দেখে গভীর দুঃখে নীলপদ্ম জলের তলায় ডুব দেয়, স্তনের শোভা দেখে লজ্জিত হয় পাকা ডালিম ফল, গুরু নিতম্বভারে রাধা মরালগামিনী, রাধার নবযৌবন শশিকলার মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে...’ এমন বর্ণনা শুনে কৃষ্ণ পঞ্চশর দ্বারা আহত হলেন। অভিজ্ঞা বড়াই তখন রাধাপ্রেমপ্রার্থী কৃষ্ণের অনুরোধে দূতীর ভূমিকা পালনে তৎপর হয়ে বলল, ‘সে সতী নারী, কূলবধূ। তোমার সন্দেশ নিয়ে যাব, ফুলটুল কিছু দাও তার জন্য!’ কৃষ্ণ রাধার জন্য অতি যত্নে সুগন্ধি কর্পূর দিয়ে পান সাজলেন, আর দিলেন নাগকেশরের ফুল। যদিও প্রথমে রাধা কৃষ্ণের পাঠানো প্রেমের তত্ত্ব অবহেলায় পায়ে দলেছিলেন, কিন্তু শেষমেষ কৃষ্ণপ্রেমে বাঁধা পড়তেই হল তাঁকে। অনেকে বলেন, পানে নাকি ভালবাসার টান থাকে, তা এড়ানো খুব মুশকিল।
কৃষ্ণ যেমন রাধাকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে বড়াইয়ের হাতে পান সেজে পাঠিয়েছেন, তেমনই প্রেমের পরিণত দশায়ও এসেছে ‘পান’ অনুষঙ্গ— ‘অম্বুজ মণির মধ্যে গোবিন্দ আইলা/ কুসুম শয্যাতে আসি শয়ন করিলা/ তবেত তুলসী নিজ সখীগণে লয়্যা/ কৃষ্ণসেবা করে অতি হরষিত হয়্যা/ কেহ কৃষ্ণ পাদপদ্ম সংবাহন করে/ কেহ বা তাম্বুল দেয় বদন ভিতরে।’ পানের এমনই মহিমা!
পুরাণে আছে, দেবতা ও অসুরদের সমুদ্রমন্থনে যখন উঠে এল অমৃত, তখন কয়েক ফোঁটা অমৃত পাতালে নাগরাজ্যে গিয়ে পড়ে আর সেখান থেকে এক লতার জন্ম হয়। এই লতাকে পুরাণে ‘নাগবল্লী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কথিত আছে, পরবর্তী কালে ওই লতার পাতাই ‘পান’ পাতা হিসেবে পরিচিত। ওষধির দেবতা ধন্বন্তরি পানপাতার ওষধি গুণ জানতে পারেন। আনুমানিক প্রায় আড়াই-তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষে পান খাওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদাচার্য সুশ্রুত রচিত ‘সুশ্রুত-সংহিতা’-য় ভুক্তবস্তু পরিপাকের আলোচনা প্রসঙ্গে গুরুভোজনের পর কোনও কোষ্ঠরোধক বা কটুস্বাদযুক্ত ফল কিংবা সুপারি, কর্পূর, জায়ফল, লবঙ্গ সহযোগে তাম্বুল চর্বণের নির্দেশ পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের ‘চিরঞ্জীব বনৌষধি’ এবং অন্যান্য আয়ুর্বেদ গ্রন্থ অনুযায়ী বৈদিক যুগ থেকে বঙ্গদেশে পানের প্রচলন। জাতকের গল্পে এবং ‘হিতোপদেশ,’ ‘চরক-সংহিতা’ ও কালিদাসের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থেও পানের উল্লেখ আছে। খ্রিস্টীয় ষোলো শতকের প্রথম দিকে রচিত ‘জ্যোতির্নিবন্ধ’ গ্রন্থে পর পর চব্বিশটি স্তবকে পান খাওয়ার শুভ মুহূর্ত, ব্রাহ্মণকে তাম্বুল দানের পুণ্য, দেবতার প্রীত্যর্থে পানের ভূমিকা, মিত্র অথবা শত্রুর জন্য পান সাজার বিভিন্ন প্রক্রিয়া, নানা শ্রেণির পানের গুণাগুণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তৃত নির্দেশ রয়েছে। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা তথা সমগ্র ভারতবর্ষে পান খাওয়ার প্রথা প্রায় সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল।
হৃদয়াকৃতির পান সাহিত্যিকদের হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা পেয়ে এসেছে যুগে যুগে। কবি সৈয়দ আলাওল তার পুঁথিতে বলেছেন, ‘অধর রাতুল কৈল তাম্বুল রসে’। পানের রসে ঠোঁট রাঙানো ছিল তখনকার দিনে সাজগোজের অঙ্গ।
পানে বিষ মিশিয়ে শত্রুকে হত্যা করার এক চমকপ্রদ কাহিনি বর্ণনা করেছেন বাংলায় আগত বিদেশি পর্যটক বার্নিয়ের। সম্রাট শাহজাহান, নজর খাঁ নামের এক উচ্চবংশীয় সুপুরুষ যুবাকে তাঁর বড় মেয়ে জাহানারার সঙ্গে গোপন প্রেমে লিপ্ত সন্দেহে এক দিন রাজদরবারে সর্বসমক্ষে নিজের হাতে উপহার দেন এক খিলি পান। মহাসম্মানসূচক ওই প্রথা অনুযায়ী কৃতার্থ যুবক তখনই ওই পান মুখে দিলেন, বাড়ি ফেরার পথে তীব্র বিষক্রিয়ায় পালকির মধ্যেই তার মৃত্যু হল।
পান গাছের বৈজ্ঞানিক পরিচিতি ‘পাইপার বিটল’, সংস্কৃত ভাষায় ভুজঙ্গলতা পত্র। পানের পিক গাঢ় লালচে খয়েরি এবং শুকিয়ে গিয়ে তাম্রবর্ণ ধারণ করে। অনেকে মনে করেন, তাম্রবর্ণ থেকেই হয়তো তাম্বুল কথাটি এসেছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পানের চাষ হয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জল-মাটি ভেদে বাংলা, মিঠা, সাচি, কর্পূরী, গ্যাচ, উজানী, মাঘি, মহানলী, চেরফুলি, ভাবনা, জাইলো, ভাওলা, ঝালি প্রভৃতি হরেক স্বাদের ও জাতের পান চাষ হয়। সাধারণত উঁচু জমি এবং দোঁআশ মাটিতে, উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় পানের ফলন ভাল হয়। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যেমন পাকিস্তান, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, তাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, লাওস এবং ভিয়েতনামেও প্রাচীনকাল থেকেই পান জনপ্রিয়।
বাংলার সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গেও পানের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। খাওয়ার শেষে এক খিলি পান মুখে দেওয়া ছিল রেওয়াজ। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে, চুক্তিপত্র পাকা করতে লাগত পান, অতিথি আপ্যায়নে, বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করতে কন্যা ও পাত্রপক্ষের মধ্যে থালাভরা মিষ্টি ও সুগন্ধি পানের তত্ত্ব দেওয়ার রীতি ছিল, পুজো-পার্বণে ও যাবতীয় শুভ অনুষ্ঠানে পান ছিল অপরিহার্য মাঙ্গলিক অনুষঙ্গ। পান সাজা তো রীতিমতো শিল্প। কোন পানে কী কী মশলা কতটুকু করে দিতে হবে, সেই সব মশলা পানের বাটায় সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা— বিয়ের আগে কনেকে এই সমস্ত ট্রেনিং নিতে হত। পাত্রপক্ষের সামনে হবু কনেকে গুরুজনদের নিজে হাতে পান সেজে গুণপনার পরীক্ষা দিতে হত। অনেকে মনে করতেন, পানে মাপমতো মশলা সাজিয়ে আঁটোসাঁটো খিলি না মুড়তে পারলে সে মেয়ে সংসার সামলাবে কী করে! এ তো গেল কনে দেখা পর্ব। বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েই বিয়ের একাধিক আচার-অনুষ্ঠানের নামের সঙ্গেও জুড়ে যেত পান। যেমন পানকড়াল, পানখিলি, পানচিনি, পান-পত্তর, পান-বাতাসা, পানশল্লা, পানের আলাপ ইত্যাদি। বাটা ভরা পানের কয়েকটি খিলির মধ্যে লঙ্কা পুরে দিয়ে ঝাল পান খাইয়ে নতুন জামাইকে নাকের জলে-চোখের জলে করার রেওয়াজ তো ছিলই। বিয়ের পর মেয়ে যখন শ্বশুরবাড়ি যেত, তখন নববধূর সঙ্গে তার বাবার বাড়ি থেকে মিষ্টি ও অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে অবধারিত ভাবে পাঠাতে হত পান-সুপারি ও পান খাওয়ার অন্যান্য উপকরণ। এ সব প্রাচীন রীতি-রেওয়াজ আজ বিলুপ্তির পথে।
নানা রকম পানের খিলি তৈরি করে, লবঙ্গ দিয়ে গেঁথে, সবুজ পানের উপর উজ্জ্বল রুপোলি তবক দিয়ে মনোহর নকশাদার বাটায় সাজিয়ে অতিথিদের পরিবেশন করা বিশেষ শিল্পরুচির পরিচায়ক ছিল। সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে, জয়রামবাটী বা উদ্বোধনে, যখন যেখানে থাকতেন, অসংখ্য নিত্যকর্মের সঙ্গে ভক্তদের জন্য নিত্য স্বহস্তে একশো খিলি পান সাজতেন। স্বামী অরূপানন্দ লিখেছেন, ‘খাওয়ার সময় ছাড়া অন্য যে সময় ভক্তেরা বাড়ির মধ্যে মাকে দর্শন করিতে যাইতেন, তখনই তিনি তাঁহাদিগকে মিষ্টি, জল ও পান খাইতে দিতেন। পান কাহাকেও দু’-খিলির কম দিতেন না।... জয়রামবাটীর নিকটবর্তী শ্যামবাজারে ভাল পান পাওয়া যায়। ঐ অঞ্চলে গরিব ভক্তেরা কখন কখনও একগোছ
পান লইয়া মাকে দর্শন করিতে আসিতেন। দেখিতাম, মা তাহা পাইয়াই কত খুশি।’
প্রাচীন বাংলা সাহিত্য চর্যাপদ থেকে শুরু করে হালের কবি, সাহিত্যিক, গীতিকারদের বিভিন্ন লেখায় তাম্বুল-প্রসঙ্গ এসেছে নানাভাবে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে আশ্রিতা বাংলাদেশের এক মহিলার কাছে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল— ‘ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি ঘুমের বাড়ি যেয়ো/ বাটা ভরে পান দেব, গাল ভরে খেয়ো’। কিংবা, ‘ভালবাসার এমনি গুণ, পানের সঙ্গে যেমনি চুন/ বেশি হলে পোড়ে গাল, কম হলে লাগে ঝাল,’ আবার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো মায়ের ভাষ্যে ‘পানের সজ্জা পানের ডাবর পান মশলার বাটি, কন্যারে পাঠালাম আমি করি পরিপাটি।’
শুধু কি পান? পানের বাটা, পানদান, চুনের কৌটা, পিকদানি, জাঁতি প্রভৃতির বাহারি কারুকার্যও ছিল কত! আর সে সব সরঞ্জাম তৈরিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল রকমারি বাণিজ্য। সোনা, রুপো, কাঁসা, পিতলে তৈরি বাটা, জাঁতি, ডিবা প্রভৃতির গায়ে সূক্ষ্ম তার ও ঝালরের অলঙ্কার এবং বহুবর্ণ মিনার কাজের অপরূপ শিল্প এখন দুর্লভ, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই কারিগররা বহু কাল আগেই ভিন্ন বৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
পাশ্চাত্যের বাজারেও এখন গ্রামবাংলার বরজের পানের চাহিদা। অমিতাভ বচ্চন অভিনীত হিন্দি ছবি ‘ডন’-এর ‘খাইকে পান বনারসওয়ালা’ গানটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছেছিল। দিল্লির ‘পাণ্ডে পান শপ’, লখনউ-এর ‘আজহার কি শাহি পান দরবার’, বারাণসীর ‘কেশওয়া পান ভাণ্ডার’, মুম্বই-এর ‘মুচ্ছাদ পানওয়ালা প্রভৃতি দোকানের পানের খ্যাতি বিশ্ব জুড়ে।
পানের গুণ গেয়েছেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণও। শিষ্য গঙ্গাধর এক দিন দক্ষিণেশ্বরে দ্বিপ্রহরে প্রসাদ গ্রহণ করলে, তিনি তাঁর হাতে এক খিলি পান দিয়ে বলেছিলেন, ‘খা, খাওয়ার পর দুটো একটা খেতে হয়, নইলে মুখে গন্ধ হয়। দ্যাখ, নরেন একশটা পান খায়, যা পায় তাই খায়। এত বড় বড় চোখ— ভেতর দিকে টান। কলকাতার রাস্তা দিয়ে যায় আর বাড়ি, ঘরদোর, ঘোড়া, গাড়ি সব নারায়ণময় দেখে। তুই তার কাছে যাস।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy