Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2023

নদীর জলধারা যেখানে দেবীপুজোর নির্দিষ্ট অঙ্গ

নদিয়া জেলার দুই প্রাচীন দুর্গা, নস্করী মা এবং রাজবল্লভী। এক দেবী পদ্মার শাখানদীর পাশে নিজের অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছিলেন, এক দেবীর কষ্টিপাথরের দশভুজা বিগ্রহ উঠে এসেছিল ভান্ডারদহ বিল থেকে। দৈব মহিমার প্রাচীন কিংবদন্তিতে জুড়ে গিয়েছে নদীমাহাত্ম্যও।

দশভুজা: তেহট্টের নস্করী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমা। ডান দিকে,

দশভুজা: তেহট্টের নস্করী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমা। ডান দিকে, Sourced by the ABP

সুপ্রতিম কর্মকার
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৩২
Share: Save:

সে  বহু দিন আগের কথা। পথ বলতে কেবল নদীপথ। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াতত হত নদীপথ ধরেই। বড় বড় নৌকো, বাণিজ্যতরী ভেসে যেত এই নদীপথে। নদীটার নাম পদ্মা। এই নদী দিয়েই মা দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি নিয়ে ভেসে যাচ্ছিলেন রাজশাহী জেলার ‘চলন কমল’-এর জমিদার। হঠাৎই আকাশের কোণে কালো মেঘ। ঝড়-জলের আশঙ্কায় জমিদার তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য পদ্মার এক ছোট শাখার মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। নদীর এই শাখাটির নাম তখন কামারখালির দাঁড়া। এই শাখাটি পদ্মা থেকে বেরিয়ে গোদাগারী, দয়ারামপুর, কাছারিপাড়া, মানিকনগর, তারাপুরের পাশ দিয়ে পদ্মায় মিশত। নৌকো দাঁড়ায় ঢোকার একটু পরেই আটকে যায়। ও দিকে কালো মেঘে আকাশ ঢাকা পড়েছে, চরাচরে অন্ধকার। পরের দিন ষষ্ঠী। আজ মায়ের মূর্তি নিয়ে না পৌঁছলে পুজো হবে না। ভেঙে পড়লেন জমিদার। রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন। মা স্বপ্নে স্বয়ং এসে বললেন, “নদীর পাশে জঙ্গলে একটি নিম গাছ আছে। সেখানে থাকেন এক সন্ন্যাসী। তাকেই রাজসিক ভাবে পুজো করতে বল।”

সেই রাতেই জমিদার জঙ্গলে খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলেন নিম গাছের কাছে। সেখানে দেখলেন তিনি নস্কর বর্মণ নামে সাধুকে। জমিদার গিয়ে সাধুকে বললেন সব কথা। সাধু শুনে বললেন ক’টা পাটকাঠি, কমণ্ডলু আর একটা চিমটে ছাড়া কিচ্ছু নেই তার কাছে। সে কী করে রাজসিক পুজো করতে পারবে! শুনে জমিদার বললেন, তিনি সমস্ত খরচ দেবেন। একটাই অনুরোধ, তিনি যেন পুজোটা করেন। পুজো হল। সময়টা আনুমানিক ৯৫০ সাল। যে হেতু নস্কর নামের সাধু মায়ের পুজো করলেন, তাই লোকমুখে এই পুজো ধীরে ধীরে পরিচিত হয় ‘নস্করী মা’ বলে।

পুজো শুরু হওয়ার পর থেকে লোকে নানা সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করল নস্কর সন্ন্যাসীর কাছে। তাঁর জপধ্যানে খুব সমস্যা হচ্ছিল। অতিষ্ঠ সন্ন্যাসী স্থানত্যাগ করেন। আনা হল জয়রামপুর থেকে সপরিবার প্রসন্ন রায়কে। তাঁরা সেখানেই থাকবেন, পুজো করবেন। কেচুয়াডাঙ্গা থেকে কৃষ্ণগোপাল চাটুজ্জেকে এনে প্রসন্ন রায়ের মেয়ে মৃণালিনীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হল। কৃষ্ণগোপাল তখন চোদ্দো বছরের তরুণ। আর মৃণালিনী বারো। তখন থেকে পুরোহিত বংশের বাস নস্করী মায়ের মন্দিরের পাশে।

নস্করী মায়ের পুজোয় ষষ্ঠী আর নবমীর দিন লুচিভোগ হয়। সপ্তমী আর অষ্টমীতে অন্নভোগ। দশমীতে খই আর দই। মানুষের বিশ্বাস, মা সকলের বাসনা পূরণ করেন। মনের সুপ্ত বাসনা পূরণ হলেই এখানে এক বিশেষ ধরনের মিষ্টি দিয়ে পুজো দিতে হয়। চিনি গলিয়ে নারকেল দিয়ে তৈরি হয় সেই মিষ্টি। সেই মিষ্টি মাটির হাঁড়িতে করে মানসিকের পুজো দিতে হয় মায়ের কাছে। আগে এখানে পাঁঠাবলি হত। এখন বন্ধ। ইংরেজ আমলে সিপাইরা আসত বলির পাঁঠা নিয়ে। সঙ্গে আসতেন ইংরেজ সাহেব। আর আসতেন কাছারিপাড়ার জমিদার আর তাঁর পাঁচ লেঠেল। সে বার পাঁঠা বলি দেওয়ার জন্য এসেছিলেন এক সাহেব। গ্রামের লোকেরা বললেন অত্যাচারী সাহেবের আনা পাঁঠা আমরা বলি হবে না। বচসা হতে হতে মারামারি বেঁধে যায় সাহেবের সঙ্গে। সেই লড়াই আদালত পর্যন্ত গড়ায়। তার পর থেকে বন্ধ হয় পাঁঠাবলি। তবে ‘কদলী বলি’ আর ‘মাষভক্ত বলি’ দেওয়ার রীতি আছে। আতপ চাল, মাষ কলাই আর হলুদ এক সঙ্গে দিয়ে হয় আঁশ। সেটাই পুজোতে বলি হিসেবে প্রদত্ত হয়। আগে তান্ত্রিক মতে পুজো হত। বলি বন্ধ হওয়ার পর হয় বৈষ্ণবমতে পুজো হয় এখন।

নদিয়ার করিমপুর থেকে প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরে তেহট্টে এই নস্করী মায়ের পুজোর বিসর্জনের রীতি বড় অদ্ভুত। পাকা রাস্তা দিয়ে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হয় না। প্রাচীন পথ দিয়ে না নিয়ে গেলেই প্রতিমা নাকি এত প্রচণ্ড ভারী হয়ে যান যে, আর তাঁকে নিয়ে এগোনো যায় না। বহু মানুষ এই ঘটনার সাক্ষী। প্রতিমা এখানে কাঁধে করে পুরনো শ্মশান ঘেঁষা বাঁশবাগান, মাঠঘাট, খালপাড় হয়ে কুঠিবাড়ির পুকুরে যান। সেখানেই বিসর্জন। লোকমুখে ‘নস্করী ডোবানো বিল’ বলে এই পুকুর পরিচিত। কুঠিঘাট থেকে হোগলামারি পর্যন্ত এক কিলোমিটার পথ সাত বার প্রদক্ষিণ করে প্রতিমার শোভাযাত্রা।

নস্করী ডোবানো বিলের সঙ্গেই জুড়ে আছে নস্করী মায়ের শাঁখা পরার কাহিনি। কোনও এক সময় এই পুকুরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন বাজিতপুরের শাঁখারি হরিপদ পাল। সেই সময় ঘাটের পাশে বসে ছিলেন এক সধবা মহিলা। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা। সিঁথি-ভর্তি সিঁদুর। শাঁখারিকে দেখে সেই মহিলা এক জোড়া শাঁখা পড়তে চান। সধবা সেই মহিলাকে শাঁখারি বলেন, “পুকুরঘাটে বসে কেউ শাঁখা পরে না।” তা শুনে মহিলাটি বলেন, “আমি মাঠে শাঁখা পরি, আবার ঘাটেও শাঁখা পরি। তুমি এখানেই শাঁখা আমায় পরিয়ে দাও। তবে দেখো, শাঁখা তুলতে গিয়ে আমার হাতে আঘাত দিয়ো না।” তার পর শাঁখা পরানোর পয়সা চাইলে সধবা মহিলাটি বলেন, “তুমি কৃষ্ণগোপালের কাছে গিয়ে বলো কুলুঙ্গিতে পয়সা তোলা আছে। সেখান থেকে যেন পয়সা দিয়ে দেয়।” শাঁখারি তখন কৃষ্ণগোপালের কাছে গিয়ে সব কথা বলেন। তা শুনে তিনি অবাক হয়ে যান। কেউ বিশ্বাস করতে চান না শাঁখারির কথা। পুকুরের ধারে সেই সধবা মেয়ের খোঁজ করতে গেলে শাঁখা-পরা দুটো হাত পুকুরের জল থেকে উঠে দেখা দেয়। তার পর থেকে আজও সেই শাঁখারি পরিবার প্রতি বার পুজোয় মায়ের কাছে শাঁখা দিয়ে যায়।

নস্করী দুর্গাপুজোর মতো আর একটি দুর্গাপুজোতেও নদীই সূত্রধরের কাজ করেছে। করিমপুরের কাছে ধোড়াদহ ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত। করিমপুর-২ ব্লকের থানারপাড়া থানার অধীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ দোগাছি গ্রাম। এখানে ঘটনার সূত্রপাত অবিভক্ত বাংলার নাটোরের (এখন বাংলাদেশ) রানি ভবানীর সময়ে। এই গ্রামে থাকতেন রাজবল্লভ দাস নামে এক মৎস্যজীবী। মাছ ধরতে যেতেন ভাগীরথী নদীর প্রাচীন এক প্রবাহপথে। বর্তমানে এই ধারাটির তিনটে অংশে তিনটে নাম। উত্তরের দিকের ধারার নাম গোবরা নালা, মধ্যভাগের নাম ভান্ডারদহ বিল, আর নীচের দিকের নাম সুতী খাল। রাজবল্লভ মাছ ধরতেন এই ভান্ডারদহ বিলে। এক দিন মাছ ধরতে গিয়ে তাঁর জালে একটা ভারী পাথর ওঠে। খুব বিরক্ত হয়ে ওই পাথরটি আবার জলের মধ্যে ফেলে দেন। সে দিন আর তাঁর জালে কোনও মাছ ওঠেনি। ফলে হাতেও পয়সা নেই। কাজেই বাড়ি ফিরে খালি পেটে এক ঘটি জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। রাতে স্বপ্নাদেশ হয়। যে পাথরটি রাজবল্লভ জলে ফেলে দিয়েছেন, সেটি জল থেকে তুলে প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করতে হবে। ঈশ্বরের আদেশ পেয়ে পরের দিন সকালে ভান্ডারদহ বিলে জাল ফেলতেই উঠে আসে কষ্টিপাথরের এক দেবীমূর্তি। চালচিত্রে দেবীর সঙ্গে তাঁর চার ছেলেমেয়েও রয়েছেন। আছে সিংহ ও মহিষাসুরও। তাকে নিয়ে রাজবল্লভ ফেরেন তাঁর ঘরে। এই খবর পৌঁছে যায় রানি ভবানীর কানে। সব কথা শুনে রানি ভবানী নির্মাণ করে দেন এক পোড়ামাটির মন্দির। এলাকার প্রাচীন মানুষজন এই মন্দিরটি জীর্ণ অবস্থায় দেখেছিলেন। ১৩০৪ বঙ্গাব্দের এক ভূমিকম্পে প্রথম মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। একই ভিত্তিভূমির উপর এলাকার নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সাহায্যে আরও একটি মন্দির নির্মিত হয়। সেটিও ভেসে যায় বন্যায়। বর্তমানে একটি পঞ্চরত্ন মন্দির নির্মিত হয়েছে। মন্দিরে তিন ফুট লম্বা ও দেড় ফুট চওড়া দশভুজা মূর্তিটি দুষ্প্রাপ্য কালো কষ্টিপাথরের।

দোগাছি গ্রামের রাজবল্লভী দুর্গার কষ্টিপাথরের বিগ্রহ

দোগাছি গ্রামের রাজবল্লভী দুর্গার কষ্টিপাথরের বিগ্রহ

এই মন্দিরে দশভুজা দুর্গা পরিচিত রাজবল্লভী নামে। এখানে শাক্ত তান্ত্রিক মতে দেবীকে চণ্ডিকারূপে পুজো করা হয়। পুজোর শেষে ঘট বিসর্জন হলেও মূর্তি বিসর্জন হয় না। তিনি সারা বছর মন্দিরে নিত্য পুজো পান। রাজবল্লভীর পুজোতে নবমীর দিন মাছ ভোগ হত। গ্রামের বিধবা মহিলারা মাছ ভোগের প্রসাদ খেতে পারতেন না। তার পর থেকে মাছ ভোগ উঠে যায়। ১৯৯১-৯২ সাল নাগাদ এক দুর্যোগের রাতে এই মন্দির থেকে রাজবল্লভীর মূর্তি চুরি হয়ে গিয়েছিল। লোকমুখে শোনা যায়, রাজবল্লভী পুলিশকে স্বপ্নাদেশে জানান চোরেরা তাঁকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। সেই নির্দেশ অনুসারে অনুসন্ধান চালাতেই একটি বাঁশঝাড়ের মধ্য থেকে রাজবল্লভী বিগ্রহ উদ্ধার হয় এবং স্থানীয় থানা সেই প্রতিমা মন্দিরে ফিরিয়ে দেয়। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, দেবী স্বয়ং ডাকাতদের গতিরোধ করেছিলেন, ফলে ডাকাতেরা জঙ্গলেই মূর্তি ফেলে রেখে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। মূর্তিটি দেখে মনে করা হয়, সেটি পাল-সেন যুগে নির্মিত হয়েছিল। আগে এই মন্দিরে পুজো করতেন সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য। বর্তমানে তাঁর বংশধরেরা রাজবল্লভীর নিত্য পুজো করেন।

আগে রাজবল্লভীর পুজোর ভোগ রান্না হত পাশের পুকুরের জলে। পুকুরে জল না থাকলে সঙ্কটে পড়তে হত। এই সমস্যা সমাধানের জন্য রামানন্দ নামের এক সাধু মন্দির প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে একটি কুয়ো খনন করে দেন। সে কুয়ো থেকে জল তুলে এখনও ভোগ রান্না হয় এখানে। এই এলাকার মানুষের বিশ্বাস, রাজবল্লভীর ভোগ খেলে রোগব্যাধি নিরাময় হয়, বিপদ-আপদ কেটে যায়।

দেবী নস্করী আর রাজবল্লভীর উপর আন্তরিক বিশ্বাসেই এখনও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন। দুর্গা আর নদী, পুজোয় মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

Nadia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy