টালমাটাল বাংলার শতফুলের সঙ্গে বিকশিত আমরা তখন ইলেভেনে। স্কুলে ‘দাদা’। অশোকদা আগের বছর স্টেনসিলের ওপর আলকাতরা দিয়ে টুপি-পরা মাও-এর ছবিতে শুধু স্কুলই ভরায়নি, আমাদের মগজগুলোও ধোলাই করে গেছে। মুক্তির দশকের স্বপ্নে বিভোর আমি পুজোয় ছেঁড়া জামা পরে বড়লোকের বেটির সামনে ডেঁটে হেঁটে গেছি: যতই বৈভব দেখাও, দেশের বেশির ভাগ লোকেরই ছেঁড়া জামাটুকুও জোটে না।
বিনয়দা ইতিহাস পড়ায়, ‘দেশব্রতী’র নিয়মিত লেখক। তিনটে উঁচু ক্লাসেই ওঁর স্পেশাল ক্লাস চলত। আশেপাশের সব স্কুলেই ‘অ্যাকশন’ হয়ে গেছে, আমরা কী করছি? গোপন মিটিংয়ে ঠিক হল, সোমবার নাইন টেন ইলেভেন, তিনটে ক্লাসে অ্যাকশন হবে। সব টেবিল চেয়ার, বোর্ড, ফ্যান ভাঙচুর করে, ক্লাস ভন্ডুল করতে হবে। কেউ বাধা দিতে এলে ছাড় নেই। আমাদের প্রোটেকশনে থাকবে কমল আর বাচ্চুদা।
আমার দায়িত্ব ব্ল্যাকবোর্ড। সারা রাত ঘুম নেই। ক্লাসের ফার্স্ট বয়, যদি ধরা পড়ে যাই? কোনও স্যর যদি সামনে এসে যান? বিনয়দা যতই বলুক, কোনও স্যরকে আমি কিছু বলতে পারব না। অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা, আবার আশংকায় বুক ঢিপঢিপ। পর দিন প্ল্যানমাফিক গোপীই শুরু করল, ‘জিন্দাবাদ...’ দুমদাম ভাঙচুর চলছে, আমি হতভম্ব স্থাণু। সামনে গোস্বামী স্যর, কী করে বোর্ডটা ফেলব! অমিতাভ ধাক্কা দিল: তুই এখনও দাঁড়িয়ে? সম্বিৎ ফিরে পেলাম, স্যর বোধহয় হাত বাড়িয়ে থামতে বললেন, আমি একছুটে স্ট্যান্ড-সুদ্ধু ব্ল্যাকবোর্ডটা ফেলে দিয়েই, ‘জিন্দাবাদ...’ বিকেলে বিনয়দার কোচিংয়ে আমার খুব পিঠ চাপড়ানো হল।
বাড়িতে মেজদা আর শঙ্কুদাকে সঙ্গে পেলাম। তিনজনে মিলে শুধু বই পড়ি, আর গোপন মিটিংয়ে মুক্তির স্বপ্ন ফেরি করি। আমাদের হিরো তখন কাজল। কখনও দেখিনি ওকে। ওর নামে বেশ ক’টা খুনের মামলা ঝুলছে। একই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন পুলিশ অফিসার, ওসি কাকু। ছোটবেলা কোলেপিঠে করে ওকে মানুষ করেছেন। এক দিকে চাকরি, অন্য দিকে অপত্যস্নেহ। অনেক বুঝিয়েছেন, কাজ হয়নি।
বাবলাদা— মাসতুতো দাদা— নিখোঁজ হয়ে গেল। পুলিশ এক দিন মেসোকে ধরে নিয়ে গেল, ছেলের খোঁজ চাই। জানলে তো দেবেন খোঁজ! খবর এল, আরও একটা খুন হয়েছে বেনেপুকুরে। ওসি কাকুকে চাপ দেওয়া হল, কড়া নির্দেশ: কাজলকে ধরতেই হবে, জীবিত বা মৃত। পর দিন পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে কাজল মারা যায়। শুনেছি, ওসি কাকু বাড়ি ফিরে অঝোরে কেঁদেছিলেন।
জেঠার শরীর খারাপ, টালিগঞ্জ যাচ্ছি শঙ্কুদাকে নিয়ে। অঝোর বৃষ্টি। দাঁড়িয়ে আছি, বাস ধরব। ছাতা মাথায় এক জন পাশে এসে দাঁড়াল, মাপছে আমাদের। বাস এল, আমাদের পেছন পেছন উঠল। স্টপেজে নামতেই কর্কশ গলায় প্রশ্ন: ‘কোথায় যাবেন?’ আজাদগড়। ‘আমিও ও-দিকেই যাব, চলুন আমার সঙ্গে।’ হাঁটছি, সে-ও জেরা করেই চলেছে। শেষে: ‘অ্যাঁ, তুমি মানাদের বাড়ি যাবে! সে তো আমার ছোটবেলার বন্ধু! ইস, একটা কেলেংকারির হাত থেকে বাঁচলাম। আমি ভেবেছি তোমরা অ্যাকশন স্কোয়াডের ছেলে, তাই তোমাদের জবাই করব বলে আমাদের ডেরায় নিয়ে যাচ্ছিলাম।’ আমার হাত-পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। এ বার ধমক: ‘জানো না এখানে কী চলছে! মানা কিছু বলেনি?’ না আমরা তো বলে আসিনি! জেঠার শরীর খারাপ, তাই দেখতে যাচ্ছি। একটা রিকশায় তুলে দিল, বলে দিল কোথায় নামতে হবে। দুর্গানাম জপতে জপতে চললাম।
জলিদি হইহই করে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। তিনটে বাজে, খুব লজ্জা পেলাম, এই অসময়ে বিরক্ত করা! রান্না হল আমাদের জন্য। অসুস্থ জেঠামশাই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এখানে প্রায়ই ছেলেরা পালা করে খেতে আসে, উনি আমাদের সেই অনাহূত অতিথি মনে করেছেন! দিন সাতেক আগে এ বাড়ির ছাদ দিয়ে পালাতে গিয়ে সিআরপির গুলিতে এক জন মারা যায়। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বললাম। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল: শিবঠাকুরের দয়ায় বেঁচে গেছিস! ও-বাড়ির বড়দার শালা আর্মির ক্যাপ্টেন। ফেরার সময় দুটো রিকশা করা হল। একটায় আমি-বড়দা, অন্যটায় শঙ্কুদা আর ক্যাপ্টেন। এক-একটা পাড়ার মধ্য দিয়ে রিকশা যাচ্ছে, আর কখনও নেমে গিয়ে, কখনও বা চেঁচিয়ে ওঁরা বলছেন: ‘অমুক বাড়িতে লোক এসেছিল, অমুক লোক তাদের পৌঁছতে যাচ্ছে...’ এইট-বি বাসের ড্রাইভারকে সে দিন মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিরো।
বিপ্লবের গতি কমে আসছিল। চার দিকে ধরপাকড়, এনকাউন্টার। আমাদের তিন জনকে দেওয়াল লিখনের দায়িত্ব নিতে হল। আমাদের পাড়াটা প্রতিক্রিয়াশীল পার্টির দুর্গ। অনেক ফন্দি খাটিয়ে এক রাতে চারটে দেওয়াল ভরলাম। পর দিন হইহই: সরষের মধ্যে ভূত! মা টের পেয়েছিল, আমরা কিছু একটা করছি। বড়দাকে বলে দিল। বড়দা কিছু বলেনি। এক দিন আমার পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকনো সব বিপ্লবী বই পাওয়া গেল। আমি দাদার খুব আদরের। এ-সব করি, ও ভাবতেও পারেনি। দাদাই খুব বকুনি খেল, ওরাই আমার মাথাটা খেয়েছে! পাড়ায় পুলিশের আনাগোনা বেড়ে গেল, যখন-তখন থানায় ডেকে হুমকি-ধমকি। এক বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখি, ঘরের চার দিকে কাগজ-পোড়ানো ছাই। দেওয়ালে তাকে আমার বই থাকত, তাকিয়েই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। গলার কাছে কান্না। দাদা এ কাজ করল! দেশব্রতীর কপি, আরও সব বইগুলো, পুড়ে ছাই! হাউ হাউ কাঁদলাম। রাতে কিছু খাইনি। পর দিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল। সারা ঘরে সেন্টের গন্ধ, নেমন্তন্নবাড়ি যাওয়ার জামাকাপড় বার করা হয়েছে। দাদা এসে বলল, ‘উঠে পড়, আজ স্বাধীনদার ছেলের মুখেভাত, আমরা সবাই এখুনি বেরোব।’ একটু বাদেই দরজায় টোকা। পুলিশ ঢুকে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। সারা বাড়ি সার্চ করে, ‘দুঃখিত’ বলে বেরিয়েও গেল। দেওয়ালে শ্রীকৃষ্ণের ক্যালেন্ডারে মনে হল দাদার মুখ বসানো!
মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিকতলা, কলকাতা
mklbanerjee@yahoo.co.in
সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
টাইম মেশিন
অবশেষে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যের সব ক’টি বাংলা মিডিয়াম স্কুলকে ইংলিশ মিডিয়াম করে দেওয়া হচ্ছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই পরিবর্তন চালু হবে। গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন বাংলা মিডিয়াম সরকারি ও বেসরকারি স্কুলগুলি এই বদলের জন্য আবেদন জানিয়ে আসছিল। কারণ ২০৫০ সালের পর থেকেই বাংলা মাধ্যমে পড়ুয়ার ভর্তির সংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে। মূলত প্রান্তিক শহরতলি এবং গ্রামের কোনও কোনও স্কুলে এত দিন বাংলা মিডিয়াম চালু ছিল। কিন্তু গত দু’-এক বছরে, সেখানেও মাঠঘাট ও পুকুরের পাড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গড়ে উঠেছে। অনেক দিন আগেই, কলকাতা শহরের শেষ বাংলা মিডিয়াম স্কুলটির প্রবেশপথের প্রস্তরফলকটি মিউজিয়ামে বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইংরাজিতে পঠনপাঠনের নতুন নিয়মাবলি অনুসারে, স্কুলের বার্ষিক সিলেবাস শেষ করানোর পাশাপাশি ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, ব্যাডমিন্টন, রাগবি, ফরাসি শেখা, সালসা ইত্যাদির প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই নির্দেশিকা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিকেল সাড়ে চারটের পরে সমস্ত খেলার মাঠ, পার্ক প্রভৃতি বন্ধ রাখার বিলটিও পাশ হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজ্য জুড়ে অন্তত তিন কোটি অভিভাবক এই সব ক্লাব ও মাঠ বন্ধ রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন। এই আইন হলে, পড়ুয়ারা দিনের প্রায় ১২ ঘণ্টা সময় স্কুলে ও বাকি ১২ ঘণ্টার মধ্যে ৬ ঘণ্টা প্রাইভেট কোচিং-এ দিতে পারবে বলে শিক্ষাবিদদের অভিমত। অভিভাবকরাও এই সময়টা ‘মি-টাইম’ উপভোগ করতে পারবেন, জিম ও বিউটি পার্লারেও যেতে পারবেন। ‘বাংলা বাঁচাও’ ও ‘ছেলেবেলা হোক রবি ঠাকুরের মতো’ সংস্থার লোকজন এই চাহিদাগুলির কথা শুনে বিরক্ত। কিন্তু তাঁরা ইংরেজিতে নিজেদের মতবাদ প্রকাশ করতে পারছেন না বলে, কোনও চ্যানেল ও সংবাদপত্র তাঁদের কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছে না।
মৈনাক মালাকারƒ বেলেঘাটা, কলকাতা
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy