অজয় কর পরিচালিত ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১) ছবির সেই চিরপরিচিত দৃশ্যে সুচিত্রা সেন ও উত্তমকুমার।
কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘সপ্তপদী’ বড় গল্পের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায়। উপন্যাসের বিষয় প্রেম। দুটি ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন সামাজিক পরিবেশে মানুষ হওয়া নায়ক-নায়িকার মধ্যে যে গভীর প্রেম গড়ে উঠেছিল, তা শেষ হয়েছিল বিয়োগান্ত নাটকে।
প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক অজয় কর ‘সপ্তপদী’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে তা থেকে ছবি করার পরিকল্পনা করেন। মহানায়ক উত্তমকুমারকে জানালেন তাঁর ভাবনার কথা। উত্তমকুমার গল্পটি পড়লেন এবং চরিত্রগুলি তাঁর মন ছুঁয়ে গেল। তিনি অজয় করকে উৎসাহ দিলেন এই ছবি করার ব্যাপারে।
অজয় কর উত্তমকুমারকে সঙ্গে নিয়ে লেখক তারাশঙ্করের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলেন। পরিচালক লেখককে ‘সপ্তপদী’ কাহিনিটি থেকে ছবি তৈরির ভাবনার কথা জানালেন এবং তাঁর অনুমোদন চাইলেন।
লেখকের সংশয় ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসটির চিত্ররূপ দেওয়া কি সম্ভব? এখানে নায়ক-নায়িকার মিলন তিনি ঘটাননি। রিনা ব্রাউন, উপন্যাসের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নায়িকা বাংলা উপন্যাসে একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র। দর্শক কি এমন নায়িকাকে মেনে নেবে?
পরিচালক অজয় কর জানালেন, চিত্রনাট্য তৈরি করে তিনি আগে লেখককে শোনাবেন।
সাহিত্যের চিত্ররূপ দিতে গেলে অনেক অদলবদল করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। কৃষ্ণেন্দুর ভূমিকায় উত্তমকুমার এবং রিনা ব্রাউন চরিত্রে সুচিত্রা সেন যে ছবিতে অভিনয় করবেন, তা মিলনান্তক না হলে কি চলে? উপন্যাসের মূল আখ্যান বজায় রেখে নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটিয়েই চিত্রনাট্য লেখা হল। কিন্তু লেখক উপন্যাসটির এই পরিণতি মেনে নেবেন কি না তা নিয়ে পরিচালক দুশ্চিন্তায় রইলেন। ‘সপ্তপদী’-র মূল কাহিনিতে ছিল মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে এসে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসন্তান কৃষ্ণেন্দু মুখার্জির পরিচয় হয় এক শ্বেতাঙ্গিনী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবতীর সঙ্গে। নাম রিনা ব্রাউন। প্রথম দিকে দু’জনের মধ্যে নানা ঘাত-প্রতিঘাত চললেও ছাত্রসংসদ আয়োজিত ‘ওথেলো’ নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে ‘ওথেলো’ কৃষ্ণেন্দু এবং ‘ডেসডিমোনা’ রিনা ব্রাউন পরস্পরের প্রেমে পড়েন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। কৃষ্ণেন্দু খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে কৃষ্ণস্বামী হয়ে কুষ্ঠরোগীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কৃষ্ণেন্দু ধর্ম ত্যাগ করলেও রিনা ব্রাউন নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন কৃষ্ণেন্দুর জীবন থেকে।
মূল কাহিনিরও কিছু বদল ঘটিয়ে মিলনান্তক নাটকে ছবিটি শেষ হবে, চিত্রনাট্য সে ভাবে লেখা হল। লেখক এই পরিবর্তন মেনে নিলেন। তিনি চিত্রপরিচালককে বলেছিলেন, “আমার গল্পের অবিশ্বাসী নায়ক কৃষ্ণেন্দু নানা ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত হয়ে ঈশ্বরের সাধনায়, আর্তের সেবায় আত্মবলি দিয়েছিল এবং গল্পটি বিয়োগান্ত নাটকে শেষ হয়েছিল। কিন্তু আপনারা সেটা মিলনান্ত নাটকে, নায়ক নায়িকার ঈশ্বরে বিশ্বাস ফিরিয়ে এনে এবং শেষ দৃশ্যে গীর্জার ঘণ্টাধ্বনির দিকে নিয়ে যাবার পথে ছবি শেষ করেছেন। এই পরিবর্তন মেনে নিয়ে আমি সম্মতি দিলাম।”
পরিচালকের পরিচালনার গুণে এবং উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেনের অনবদ্য অভিনয়ে ছবিটি বাংলা ছবির সম্ভারে অমূল্য সংযোজন হয়ে রইল। ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটি ব্যবসায়িক দিক থেকে প্রভূত সাফল্য লাভ করেছিল।
উপন্যাসের নায়িকা রিনা ব্রাউনের চরিত্রটি নিয়ে অনেক দর্শক ও পাঠকের কৌতূহল ছিল। অনেকে লেখককে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই চরিত্রটি কি লেখক পুরোপুরি কল্পনা করে লিখেছেন, নাকি লেখকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল কখনও?
রিনা ব্রাউনের চরিত্র নিয়ে লিখতে বসে লেখক বেশ ভাবনায় পড়েছিলেন। চরিত্রটি কাল্পনিক, রিনা নামটিও কাল্পনিক। অথচ লিখতে বসে লেখকের মনে হয়েছিল চরিত্রটি পুরো কাল্পনিক নয়। তিনি এই মেয়েটিকে দেখেছেন। তাঁর মনে পড়েছিল মাত্র কয়েকবার কয়েক ঝলক দেখা একটি ইংরেজ বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এক বিচিত্র বিদেশিনি যুবতীর মুখ। তার কিছু কথা, তার চেহারা লেখকের মনের মধ্যে ভাসতে লাগল। লেখক তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানেন না। তার ভঙ্গি ছিল দৃপ্ত, অথচ তার মুখে একটা বিষাদের
ছায়া খেলা করত। আখ্যানটি লেখার সময় রিনা এসেছিল কিছুটা কল্পনায়, কিছুটা বাস্তবে।
এই বিদেশিনিকে লেখক প্রথম দেখেছিলেন পুরীর সমুদ্রতটে। ১৯৪৪ সালে তারাশঙ্কর বেড়াতে গিয়েছিলেন পুরী। তখন যুদ্ধের সময়। পথে, ঘাটে, সমুদ্রতীরে অনেক সৈনিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে এক বিদেশিনি লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দীর্ঘাঙ্গী, চোখের পাতাগুলো ঘন কালো এবং ফুলের কেশরের মতো দীর্ঘ। মাথার চুলের ঘন বর্ণাঢ্যতা এবং সমৃদ্ধি তার রক্তের ইতিহাসে একটি সাক্ষ্য বহন করেছিল। তার পরনে ছিল স্ল্যাক্স, গায়ে ফুলহাতা ব্লাউজ়, মাথায় বাঁধা গাঢ় লাল রঙের রুমাল। পুরীর সমুদ্রতটের সমস্ত মানুষ সবিস্ময়ে তাকে দেখত। তার সঙ্গে থাকত যুদ্ধের পোশাক পরা এক সৈনিক সঙ্গী।
এক দিন সমুদ্রতীরে বিকেলবেলায় সেই সৈনিক বন্ধুর সঙ্গে সে ঘুরছিল। বোঝা যাচ্ছিল, দু’জনেই বেশ নেশাগ্রস্ত। পুরুষটির সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পর মেয়েটা তীব্র কণ্ঠে বলেছিল— “হোয়াট ডু আই ক্যান ফর গড? মাই ফাদার ডিড নট ব্যাপটাইজ় মি। হি ওয়াজ় অ্যাশেমড অব মি। আই হেট ইউ। ইয়োর হেভেন ইজ় নট মাই হেভেন। মাই হেভেন ইজ় হেল। মাই গড ইজ় দ্য গড অব হেল।”
বর্বর মাতাল সৈনিকটা মেয়েটাকে খুব জোরে মারল মুখের উপর। লেখক বা অন্য কোনও লোক সেই সৈনিককে কিছু বলতে বা বাধা দিতে সাহস পায়নি।
পরদিন লেখক আবার দেখলেন মেয়েটি সমুদ্রতীরে একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুখে তার স্পষ্ট কালশিটের দাগ। ঠোঁটটা ফুলে গেছে। তবুও সমান উৎসাহে, প্রমত্ত পদক্ষেপে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন সে সর্বনাশের পথের এক যাত্রিণী।
বছর দেড়েক পর মেয়েটিকে আবার লেখক দেখেছিলেন লেখক, শিলং যাওয়ার পথে। লেখক বাসে করে গৌহাটি থেকে শিলং যাচ্ছিলেন। সেই বাসে মেয়েটাও যাচ্ছিল শিলং। সে বারে তার সঙ্গী ছিল আর এক জন অল্পবয়সি সৈনিক। বাসে হঠাৎ মেয়েটির শরীর খারাপ করল। মেয়েটি বমি করতে লাগল। লেখক তাকে কয়েকটা কমলালেবু খেতে দিলেন। মেয়েটা দাম দিতে চাইলে লেখক বলেছিলেন, “দাম লাগবে না। তুমি অসুস্থ। তোমাকে খেতে দিলাম।”
এর কিছু দিন পর মেয়েটাকে এক দিন কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলে লেখক দেখতে পেলেন। ময়দানে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল নিশ্চল প্রতিমার মতো। কী ভাবছিল কে জানে? তার স্বর্গের কথা? তার জীবনের কথা? তার ঈশ্বরের কথা? তার একাকিত্বের কথা?
গল্পে মেয়েটির কয়েকটি কথা নায়কের মনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। রিনা ব্রাউন কৃষ্ণেন্দুকে বলেছিল— “আমার মোহে তুমি যখন তোমার এত দিনের ধর্ম, এত দিনের বিশ্বাসের ভগবানকে ত্যাগ করেছ, তখন কে বলবে আমার থেকে সুন্দরী কাউকে দেখলে আমাকে পরিত্যাগ করবে না?”
কথাগুলো নায়ককে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল। নায়ক ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না। সে বেরোল ঈশ্বরকে খুঁজতে, ঈশ্বরকে জানতে। রিনাই আঘাতের মধ্য দিয়ে চিনিয়ে দিল তার ঈশ্বরকে। কিন্তু সে পেল কী? বৃহত্তর ঈশ্বর— বিশ্বাস, দৃঢ়তর বোধ। সে রিক্ত হল। ঈশ্বরের জন্য প্রিয়তম মানুষকে বর্জন করার পর রিক্ততাই তো স্বাভাবিক।
লেখক বুঝেছিলেন, যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটিকে বিভিন্ন পরিবেশে তিনি দেখেছিলেন, তার রক্তে পাপ-পুণ্য না মানার, ঈশ্বর না মানার বীজ নিহিত ছিল। হয়তো সে স্বৈরিণী। কিন্তু তার কয়েকটা প্রমত্ত কথার মধ্যে— “মাই হেভেন ইজ় হেল। মাই গড ইজ় দ্য গড অব হেল”— লেখক গভীর বেদনার আভাস পেয়েছিলেন। লেখক তাকে ভুলতে পারেননি। তাই সমবেদনার তর্পণে উপন্যাসে তাকে মনের মতো করে এঁকেছেন আর বলেছেন— “আমি লেখক, তুমি আমার কাছে এই তর্পণের তর্পণীয়া। তুমি আমার অনাত্মীয়, অবান্ধব; হয়তো বা অপঘাতই তোমার নিয়তি, তোমাকে তবু দিতে হবে আমার শ্রদ্ধার নির্মল জল।”
লেখকের অসামান্য লেখনীতে রিনা ব্রাউন পাঠকের মনে ভাল লাগায় ভালবাসায় এক জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy