Advertisement
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

যেতে পারি, তাই যাব

এত বিপদ, দুর্ঘটনা, তবু কেন পাহাড়ে যাও— প্রশ্নটা শুনেছেন অনেকেই, এমনকী আমার মতো ছোটখাটো পর্বতারোহীও। উত্তর এটাই।খু ব একটা জেনে-বুঝে পাহাড় চড়া শুরু হয়নি। আলাদা করে অ্যাডভেঞ্চারপ্রীতি ছিল, তা-ও নয়। পড়াশোনা করব বলেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। গোল পাকাল ফার্স্ট ইয়ারের একদম গোড়ার দিকেই। এক দিন ভুল করে ওই ঘরটায় ঢুকে পড়লাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসি ক্যান্টিনের দোতলায় উঠে ডান হাতের প্রথম ঘর। মোটা মোটা দেওয়াল। ঠান্ডা। একটু আলো কম।

ছবি: মণীশ মৈত্র

ছবি: মণীশ মৈত্র

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

খু ব একটা জেনে-বুঝে পাহাড় চড়া শুরু হয়নি। আলাদা করে অ্যাডভেঞ্চারপ্রীতি ছিল, তা-ও নয়। পড়াশোনা করব বলেই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম। গোল পাকাল ফার্স্ট ইয়ারের একদম গোড়ার দিকেই। এক দিন ভুল করে ওই ঘরটায় ঢুকে পড়লাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসি ক্যান্টিনের দোতলায় উঠে ডান হাতের প্রথম ঘর। মোটা মোটা দেওয়াল। ঠান্ডা। একটু আলো কম। আর দেওয়াল-জোড়া কতগুলো ছবি। কোনওটায় খাড়া পাথর বেয়ে একটা মানুষ দড়িতে ঝুলছে, কোনওটায় জংলি পথের বাঁকে উঁকি দিচ্ছে একটা রাকস্যাকের কোণ, কোনওটায় ধু-ধু বরফে একটা রঙিন টেন্ট একলা দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই মনে হল, এ সব জায়গায় যায় নাকি এই ঘরের লোকগুলো! ওই ঘরটাই যাদবপুর ইউনিভার্সিটি মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড হাইকিং ক্লাব।

ভেবেছিলাম দেখিই না গিয়ে কী হয়। অন্তত হইহই করে বেড়ানো তো হবে! শুরু হল রক ক্লাইম্বিং। কোমরে দড়ি, পায়ে বিশেষ জুতো। খাড়া দেওয়াল বেয়ে ওপরে ওঠা। তার পর এক দিন পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের সব চেয়ে উঁচু চুড়ো মাঠাবুরুর মাথায় বড় পাথরটায় বসে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে, ক্লাবের সিনিয়র দাদাদের মুখে শুনে ফেললাম সিকিমের জোংরি পাহাড়ে সূর্যাস্তের খুনখারাপি রঙের গল্পটা। ওই দাদারাই তখন সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা পর্বতারোহী। পড়াশোনা করতে করতেই হাজার অসুবিধা সামলে টিউশনের পয়সা জমিয়ে নেশা করছে পাহাড় চড়ার। ওদের মুখে গল্প শুনেই মনে হল, আরও একটু দেখি না! ব্যস, ওই আরও একটু দেখা আর শেষ হল না।

প্রথম প্রথম একটা ভীষণ ভাল লাগা। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারার আরাম। অপার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাওয়া। তবে বড্ড টানত পর্বতারোহণের গল্প-ছবি-সিনেমাগুলো। ট্রেকিং করতে করতে দূরের বরফচুড়ো দেখে নিজেই বুঝতে পারতাম, দূর থেকে দেখে যেন আর পোষাচ্ছে না। আরও আরও অন্তরঙ্গতা দাবি করছে পাহাড়। ক্যামেরার লেন্স জুম করে ধরে ফেলা দৃশ্যগুলো চর্মচক্ষুর সামনে আসতে চাইছে। সোজা কথায়, শুধু আরাম আর ভাল-লাগা পেরিয়ে ঝুঁকির বাঁকগুলোও চিনে নিতে চাইছিলাম একটু করে। ভালবেসে ফেলছিলাম পাহাড়কে। বিরাট কোহালি যখন প্রথম হাত রাখতেন ব্যাটের গ্রিপে, এমনটাই হত কি তাঁর? আমার হল। মদ-পুরুষমানুষের মোহ নেই, কিন্তু পাহাড়ে জড়িয়ে গেলাম।

একই কথা অনেক দিন পরে শুনেছিলাম সুনীতাদির মুখে। সুনীতাদি তখনও সুনীতা ‘মিরাক্‌ল’ হাজরা হয়নি। ২০১২ সালের জুলাই মাস, হিমাচলের মনিরাং শৃঙ্গ অভিযান। পশ্চিমবঙ্গের দশটা মেয়ের একটা দল গিয়েছে প্রায় তেইশ হাজার ফুটের একটা শৃঙ্গ ছোঁবে বলে। সেই অভিযানটা ছিল ওর কামব্যাক। দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু। তার আগে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে পাহাড়ে। রক ক্লাইম্বিং, ট্রেকিং, বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে একের পর এক প্রশিক্ষণ। একাধিক শৃঙ্গজয়ের পালকও জমেছে টুপিতে। তার পর এক সময় বিয়ে। ২০০৩ সালে অভিযানের পাট চুকিয়ে দিয়ে আর্যর জন্ম দিল, দিব্যি কাজকর্ম করল এতগুলো বছর। নিজেকে পাহাড় থেকে দূরে রেখে মন দিয়ে সংসার করল। কিন্তু ‘সুখ’ সইল না। পাহাড়ের ভূত ফের কিলোল।

—আবার নেশা চাপল কেন সুনীতাদি?

—কেন আবার কী? নেশার কারণ থাকে নাকি?

—কী পাবে?

—কেউই কিছু পায় না রে, শুধু হারায়। কিন্তু চুম্বকের মতো টান যে! এড়াতে পারলাম না।

হারানোর গল্প তো শুনেছি অনেক। পাহাড়ের টানেই তো হারিয়ে যায় কত মানুষ। নিজের ভালবাসার টানে নিজেকেই শেষ করে দিয়ে আসে পাহাড়ে। কত কত হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাঁচে ওই মানুষদের ঘিরে থাকা সমতল। মানুষ হারানোর খাতায় নাম ওঠে না কত হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের।

কোনও কোনও প্রেম তো আত্মধ্বংসী হয়। নিজেকে পুড়িয়ে ফেলাটাই যেন নেশা। শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন উপন্যাসে কিরণময়ী যেমন। কোনও কিছু পাবে বলে নয়, বরং সব হারাবে জেনেই ভালবেসেছিল সে। পাহাড়কে বোধ হয় অনেকটা সে রকম ভাবেই ভালবাসেন অভিযাত্রীরা। পাওয়াগুলো নেহাতই বাড়তি। পড়ে-পাওয়া।

এই ভালবাসা এড়াতে পারব না, বুঝেছিলাম আমিও। আরও কিছু দিন আগেই। তত দিনে অযোধ্যা পাহাড়ের মাঠাবুরু-শুশুনিয়া-গজাবুরুর পাথুরে দেওয়াল থেকে পশ্চিমবঙ্গের সব চেয়ে উঁচু পাহাড় সান্দাকফুর চুড়ো ছুঁয়ে সিকিমের একটু কঠিন ট্রেকিং পথে গোচালা গিরিপথ পার করে একটা এক্সপিডিশনও করা হয়ে গিয়েছে। শৃঙ্গ ছোঁয়ার এক্সপিডিশন। মাউন্ট ফ্লুটেড। ২০০৯ সালের জুন মাস। হিমাচলের স্পিতি উপত্যকার ৬১২২ মিটারের শৃঙ্গটা সে বার ছোঁয়া হয়নি, কিন্তু বেসক্যাম্পের পাথরের ওপর প্রচণ্ড অলটিটিউড সিকনেস নিয়ে ঝিম হয়ে বসে বুঝেছিলাম, এ ভালবাসা এত সহজ নয়। আর বুঝেছিলাম, কঠিন বলেই টানটাও বেশি।

সেই বছরই অক্টোবর মাসে ‘বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স’টা করে ফেলেছিলাম। দার্জিলিঙের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে। অনেক পড়াশোনা, সিনেমা দেখা, পর্বতারোহণের খুঁটিনাটি বুঝে নেওয়া। অনেক তথ্য জেনে নেওয়া। রোজ সকালের পাহাড়ি পথে লম্বা দৌড়, রক ক্লাইম্বিং, তিন-চার দিনের ট্রেকিং পেরিয়ে চৌরিখাং বেসক্যাম্পে পৌঁছনো। তার পর বেসক্যাম্প থেকে রোজ রোজ হিমবাহ-যাত্রা। ক্র্যাম্পন অর্থাৎ স্নো-বুটের তলায় কাঁটা লাগিয়ে হাঁটার অভ্যেস, তুষার গাঁইতি বা আইস অ্যাক্স গেঁথে বরফ দেওয়াল বেয়ে ওঠা-নামা। কোনও এক ঢালে মিছিমিছি পড়ে গিয়ে শিখে নেওয়া, সত্যি করে পড়ে গেলে নিজেকে আটকাতে হবে কেমন করে। কখনও আবার নামিয়ে দেওয়া হত বরফের ফাটলে অর্থাৎ ক্রিভাস-এ। মিছিমিছিই। সত্যিই পড়ে গেলে কী ভাবে উদ্ধার করতে হবে, তা শেখার জন্য।

এক মাসের এই টানটান প্রশিক্ষণের পালিশ এত দিনের ভাল লাগা-ভালবাসার নরম খোলসটা ছিঁড়ে দিয়েছিল। কান ধরে শিখিয়েছিল, একটা ‘এক্সট্রিম স্পোর্টস’-এ ঢুকে পড়েছ বাবা। হয় নিজেকে তৈরি করো, নয় ঘরে বসে থাকো। হালকা করে পাহাড়ি পথে হেঁটে, মাথায় স্কার্ফ বেঁধে ছবি তুলে, ফেসবুকে পোস্ট করে লাইক কুড়োনোর দিন শেষ।

সেই কোর্সেই বরফের ঢালে দিনভর আইস অ্যাক্স আর ক্র্যাম্পন গাঁথা অভ্যাস করতে করতে বুঝে গিয়েছিলাম, এই অভ্যাস শুধু প্রশিক্ষণের খাতায় থেকে যাওয়ার নয়। এই অভ্যাস আরও বিপজ্জনক বরফ ঢাল খুঁজে নিয়ে নিজেকে পরীক্ষার মুখে ফেলতে চাইছে বারবার। অ্যাডভেঞ্চার নামের আগুনের ফুলকিটা ছিটকে এসে জীবনে একটা দাগ ধরিয়ে দিয়েছে তত দিনে।

আরও একটা জিনিস হয়েছিল এই কোর্সেই। উচ্চতা মাপার নেশা ধরে গেল। কোর্সেরই অংশ হিসেবে রিনক পাহাড়ের চুড়ো যে দিন ছুঁয়ে ফেললাম, ভারী আনন্দ হয়েছিল। আর পাঁচটা শৃঙ্গের তুলনায় অনেক কম, মাত্র সতেরো হাজার ফিট, তবু শীর্ষে দাঁড়ানোর অনুভূতিটা ভোলার নয়। এই নেশা বড় সাংঘাতিক। ওপর থেকে নীচটাকে দেখার নেশা।

আরও অনেক পরে এক জন প্রিয় পর্বতারোহী বলেছিলেন, আসলে উচ্চতা মাপার নেশা নয়। নেশা, নিজেকে মেপে নেওয়ার। বার বার চ্যালেঞ্জের মুখে নিজেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বুঝে নেওয়া, কতটা শক্তি ধরে আমার মধ্যেকার আমিটা। যে শক্তিগুলো সমতলের জীবনে হাজার প্রতিকূলতার মুখেও কোনও দিন আলোর মুখ দেখেনি, তারাই হইহই করে বেরিয়ে আসে চূড়ান্ত পরীক্ষার মুখে। ঝুঁকির পরীক্ষা।

ঝুঁকি হাড়ে হাড়ে বুঝলাম কিছু দিন পরেই। দ্বিতীয় অভিযান। ২০১১-র জুন। হিমাচল প্রদেশের লাহুল উপত্যকায় কোয়া রাং-২ শৃঙ্গ। সামিট ক্যাম্প থেকে নীচে নামার সময় এক কাণ্ড হল। ঢালাও ঝুরো বরফের প্রান্তরে স্নো-বুটের গোড়ালি ঠুকে ঠুকে নামছি। বাকি দল অনেকটা পেছনে। আমার সঙ্গে সিধুদা আছে কেবল। বয়সে অনেকটা বড়, অভিজ্ঞ। হঠাৎ বলল, তিয়াষ, বসে পড়।

কেন?

যা বলছি শোন, বসে পড় শিগগির।

আর এক বার প্রশ্ন করার আগেই আমার শরীরের অর্ধেকটা ভুস করে ডুবে গেল বরফে। বুক পর্যন্ত ফ্রিজ! ‘এই জন্যই বলছিলাম বসতে। তলায় ক্রিভাস আছে’— বলে তাড়াতাড়ি আমার দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে সিধুদাও ভুস! হাত তিনেক দূরত্বে দুজনে অর্ধসমাহিত অবস্থায় আটকে রয়েছি। আইস অ্যাক্স দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ির চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম, যত নড়ছি ততই শরীর কামড়ে ধরছে ঝুরো বরফের বাঁধন।

শুধু তা-ই নয়, কুলকুল করে ঠান্ডা জল ঢুকছে স্নো-বুটের ভেতর। পায়ে সাড় নেই। ‘আমি এই জলের শব্দটাই শুনতে পেয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, তলায় ক্রিভাস আছে। বসে বসে নামলে এমনটা হত না।’— ওই অবস্থাতেও হাঁচোড়পাঁচোড় করতে করতে আমার কেনগুলোর উত্তর দিয়ে দিয়েছিল সিধুদা। অনেক কষ্টে, পিঠের রাকস্যাক খুলে, পাশে কাত করে শুইয়ে তাতে ভর দিয়ে নিজেকে বার করতে পেরেছিলাম সে যাত্রা। তার পর আইস অ্যাক্স দিয়ে বরফ খুঁড়ে বেরোল সিধুদাও।

এক বার একটা রক ক্লাইম্বিং কোর্স করাতে গিয়ে সম্রাটদার সঙ্গে গল্প করছিলাম একটা পাথরে বসে। সম্রাট বসু। ইছাপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির তরফে দীর্ঘদিন ধরে পর্বতারোহণ করছেন। একাধিক সাত-হাজারি শৃঙ্গ ছোঁয়া হয়ে গিয়েছে। সম্রাটদা ক্লাইম্বিংয়ের জন্য জুতো বদলাচ্ছিল তখন। চোখে পড়েছিল পায়ের আঙুলের আধখাওয়া মাথাগুলো। এত দিনের পাহাড় জীবনের পাকাপাকি চিহ্ন এঁকেছে ফ্রস্ট বাইট। তুষার-ক্ষত। সম্রাটদা সে দিন বলেছিল, ‘একটু চামড়া-মাংস হয়তো পাহাড় নিয়ে নিয়েছে, তা-ও আমার নিজেরই ভুলে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তো আমাকে তৈরি করেছে এই পাহাড়ই।’

এই নানা রকম শেখা আর জানার মধ্যে দিয়ে আরও দুটো অভিযান হয়ে গিয়েছে আমার। শৃঙ্গ ছোঁয়ার স্বাদ পেতে শুরু করেছি। নিজের মতো করে খানিক বুঝে নিয়েছি, এ খেলায় জয়-পরাজয় বলতে যদি কিছু থাকে, তা হল শৃঙ্গ ছুঁতে পারা আর না-পারা। মিথ্যে বলব না, ‘হিরোইজম’-এরও একটা নেশা আছে।

এ রকমই একটা ‘জয়’-এর পর এক বার ক্যাম্পে ফিরে খুব হইহল্লা করছি। গলা ছেড়ে গান, মেস্টিন পিটিয়ে বাজনা, নিচু তাঁবুর ভেতরেই হাঁটু গেড়ে নাচ... কী নয়! হঠাৎ রিঅ্যাক্ট করেছিল আপাত-শান্ত ছন্দাদি। ছন্দা গায়েন। যে পরে কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। ছন্দাদি সে-দিন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে বলেছিল, ‘পাহাড় মানে প্রকৃতি। প্রকৃতি মানে মায়ের কোলের মতো শান্তি। সেখানে জয়ের চিৎকার মানায় না। আর তোরা যে জন্য চিৎকার করছিস, সেটা খুব তুচ্ছ ব্যাপার। একটা শৃঙ্গ ছোঁয়া হল-কি-হল-না, তাতে পাহাড়ের কিছু এসে যায় না। কিছু যদি জয় করতেই হয়, তা হলে আগে নিজেকে জয় করতে শেখ। প্রকৃতির কাছে কতটা মাথা নিচু করে আসতে হয়, সেটা শেখ।’

জয়ের আস্ফালন যে কতটা তুচ্ছ, তা ওই অভিযানেই টের পেয়ে গিয়েছিলাম। আলগা পাথর সাজানো খাড়া দেওয়াল বেয়ে সটান র‌্যাপলিং (দড়ির সাহায্যে, পাথরে পা রেখে রেখে নামা) করতে করতে একটা বিশাল পাথরের চাঁই এসে পড়েছিল মাথায়। হেলমেট দু’ফালা। প্রচণ্ড ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম, মরেই গিয়েছি। শেরপা দাজুদের চেষ্টায় জ্ঞান ফেরার পরে বাকি পথটা নেমেছিলাম একটাও কথা না বলে। সেটা কতটা যন্ত্রণায় আর কতটা আতঙ্কে তা জানি না। মনে হয়েছিল, ‘জয়’-এর আনন্দ ফিকে করে দেওয়ার জন্য প্রকৃতির একটা টোকাই যথেষ্ট।

তবে যত বেশি অভিযান করতে শুরু করলাম, অভিজ্ঞতা যত বাড়ল, ‘কেন যাই’-এর দর্শনও বদলাতে শুরু করল। কখনও কখনও মাঝরাতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে যখন মুখের ওপর নেমে আসা তারা ভর্তি আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়ে থেকেছি, চার পাশ ঘিরে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল বরফ-পাহাড়গুলোকে ঘাড় উঁচু করে দেখেছি, মনে হয়েছে এই বিশালতার সামনে তো একটা পিঁপড়ের মতোই ক্ষুদ্র মানুষের জীবন। যে জীবনটার চাওয়াপাওয়া নিয়ে আমরা সমতলের দৈনন্দিন তোলপাড় করে ফেলি, সেই জীবনটাই পাহাড়ের কাছে এসে নতজানু হতে শেখে বার বার।

তাঁবু ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ঢালটায় যখন গুড়গুড় করে তুষারধস নামতে দেখেছি, মনে হয়েছে একটু এ-দিক ও-দিক হলেই আর ফিরে যাওয়া হবে না। বার বার নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি, বেঁচে থাকাই আসলে যথেষ্ট। প্রতি দিন সকালে নতুন সূর্য দেখতে পাওয়ার চেয়ে সুন্দর আসলেই আর কিছু নেই।

এই বেঁচে নিতেই বোধ হয় বার বার মৃত্যুর মুখে ফিরে যাওয়া।

শুধু মৃত্যুমুখের ভয় নয়, সপাট মৃত্যুও চেনাল পাহাড়। ২০১৩-য় হনুমান টিব্বা অভিযানের বেসক্যাম্প। পাশেই ছিল একটা অন্য অভিযাত্রী দল। সিতিধর শৃঙ্গ অভিযানে এসেছে। সিতিধরের উচ্চতা তুলনায় কম, ৫২৫০ মিটার। দলের সব চেয়ে অভিজ্ঞ মানুষটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সে দিন বিকেলে। প্রাণখোলা হাসি আর ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে বিনিময় হয়েছিল পাহাড়িয়া অভিজ্ঞতা। পরের দিন বিকেলে ওই মানুষটাই পাহাড় থেকে নেমেছিলেন চার জনের কাঁধে শুয়ে। প্রাণহীন। মুহূর্তের অসাবধানতার হিসেব বুঝে নিয়েছে পাহাড়। একটু অন্যমনস্কতার দাম দিতে হয়েছে পাথরের আঘাতে। নীচে নামাতে নামাতে রক্তপাতেই শেষ। প্রয়োজনীয় ফার্স্ট এড ছিল না সঙ্গে।

সে দিন সাবধানতা মাপতে শিখেছিলাম বলেই তার ফল পেয়েছিলাম ঠিক এক বছর পরে। ২০১৪-র মেন্থসা শৃঙ্গ অভিযানে। সব পরিকল্পনা সফল করে শেষের মুখে পৌঁছেছি প্রায়। শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে, বড়জোর একশো মিটার চড়াই ভাঙা বাকি। প্রবল তুষারঝড় শুরু হল হঠাৎ। ঝ়ড় ঠেলে এগোচ্ছি আমরা। প্রচণ্ড হাওয়ায় ছিটকে আসা বরফের নুনে বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সানগ্লাসের কাচ। নাকের ডগায় সাড় নেই। এত হাওয়া, সোজা পথে হাঁটা পর্যন্ত যাচ্ছে না। হাতের আঙুল জমতে শুরু করেছে। ও ভাবেই এগোলাম আরও খানিক ক্ষণ। আরও কাছে শৃঙ্গ। এক সময় মনে হল, ফেরা উচিত। শেরপা দাজুরাও তাই বললেন, এই ঝড় খুব মারাত্মক। এই বরফিলি হাওয়ায় কামড় বসে হাত-পায়ের আঙুলে। এক দিকে পায়ের নাগালে শৃঙ্গ, অন্য দিকে তুষার ঝড়ের চোখরাঙানি। এই দোটানা অতিক্রম করে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম আমরা। বুঝেছিলাম, পাহাড় পাহাড়ের জায়গাতেই থাকবে। কিন্তু আমাদের অভিযানে কোনও ক্ষতির ছাপ পড়লে তা আর মুছবে না। ফেরার পথে আরও খারাপ হয় আবহাওয়া। এগোলে বিপদ বাড়তে পারত সে দিন।

কিন্তু সাবধান হওয়াই কি বিপদ এড়ানোর একমাত্র উপায়? সাতাশ বছর বয়সেই একটা সাত-হাজারি শৃঙ্গ ছুঁয়ে ফেলার অভিজ্ঞতা থেকে কৃষ্ণনগরের রোহিত বলছিল, মাউন্টেনিয়ারিংয়ের সব চেয়ে বড় মজাটা লুকিয়ে আছে ‘ক্যালকুলেটিভ রিস্ক’-এর মধ্যে। ঝুঁকি তো পথে বেরোলেই আছে, কলকাতা শহরে ব্রিজের তলা দিয়ে হাঁটলেও আছে। কিন্তু সেই ঝুঁকি আগে থেকে মাপতে পারি না আমরা। পাহাড়ে কিন্তু পারি। মৃত্যুর মতো চরম বিপদের ঝুঁকিটা আছে বলেই হয়তো পারি। পাহাড়ে কোন পরিস্থিতিতে ঠিক কতটা ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে, অভিজ্ঞতা দিয়ে সে হিসেব কষে নেওয়া যায়। আর সেই হিসেব ঠিক হলেই বিপদ আসার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। তবে সমস্ত রকম নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোর পরেও যেমন দুর্ঘটনা হতে পারে, তেমনি একশো শতাংশ সাবধানতা অবলম্বন করলেও বিপদ হতে পারে পাহাড়ে। প্রকৃতির খামখেয়ালের সামনে তো কোনও হিসেবই কাজ করে না।

তবু ঝুঁকির নেশা তোলপাড় করে বাঙালির রক্ত। সেনাবাহিনীর লোকেদের কথা বাদ দিলে, হিমালয়ের শৃঙ্গ অভিযানে সারা দেশে সব চেয়ে এগিয়ে আছেন বাঙালিরাই। পরিসংখ্যান বলছে, শৃঙ্গ ছোঁয়ার সাফল্যও সব চেয়ে বেশি আনেন তাঁরাই। এই পরম্পরা ধরেই এক দিন অসামরিক উদ্যোগে এভারেস্টের চূড়ায় পতাকা উড়িয়ে দেন দুই বঙ্গসন্তান। বসন্ত সিংহরায় ও দেবাশিস বিশ্বাস। কৃষ্ণনগরের ক্লাবে বসে যাঁরা ৮৮৪৮ মিটার উঁচু স্বপ্ন বেঁধেছিলেন ২০১০ সালে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালি এভারেস্ট মেপে নেওয়ারও দুঃসাহস দেখায়।

এই দুঃসাহসের নেশাতেই শীতের সকালের লেপের ওম উপেক্ষা করে মাঠে দৌড়ঝাঁপ করেন একদল ‘অলস’ বাঙালি। পাহাড়ে গিয়ে দিনের পর দিন অনায়াসে ম্যাগির সুপ খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন একদল ‘ভেতো’ বাঙালি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মন্দির দেখলে কপালে হাত ছুঁইয়ে নেওয়া একদল ‘ভিতু’ বাঙালি বেসক্যাম্পের পুজোয় গেয়ে উঠতে পারেন, বিপদে আমি না যেন করি ভয়। একদল ‘নাছোড়’ বাঙালি তুষাররাজ্যে গিয়ে ক্লান্তির কাছে হার মেনে জীবন বাঁধা দেন। কেউ হয়তো ঘরে ফেরেন কফিনে, কেউ তা-ও নয়। ছ’টা আঙুলে ফ্রস্ট বাইট নিয়ে হাসপাতালে বসে বেঁচে ফেরার গল্প বলেন বারাসতের সুনীতা।

অভিযান থামে না। শৃঙ্গ ছুঁয়ে এলে দু’চারটে বাহবা জোটে, না ছুঁয়ে এলে অভিযোগ। পয়সা নষ্ট করার অভিযোগ, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর অভিযোগ। আর যদি বিপদ আসে? যদি না-ই হয় ঘরে ফেরা... তা হলেও কয়েক মুঠো সহানুভূতির পাশাপাশি পড়ে থাকে অজস্র উপদেশ, জ্ঞান, তাচ্ছিল্য। বড় সহজেই তখন ঠিক-ভুলের হিসেব কষেন এক পা-ও পাহাড় না ভাঙা আর এক দল বাঙালি। ছয়-সাত-আট হাজারি বরফ ঢালের অঙ্কগুলো বড় সহজেই মিলে যায় সমতলের তুফানি চায়ের কাপে। এই সমতলের কাছে জবাবদিহির কোনও দায় তাই রাখে না সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় দামালের দল। আমিও রাখিনি। যেতে পারি, তাই যাই। অন্য কারণ খুঁজি না।

জর্জ ম্যালরির বলে যাওয়া সেই বস্তাপচা আর সহজ বাক্যটার বাইরে নতুন কিছু খুঁজেও পাইনি আমরা।

...বিকজ, ইট’স দেয়ার।

tiyashmukhopadhyay@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE