সপরিবার: স্ত্রী দেবিকা এবং সন্তানদের সঙ্গে বিস্কফার্মের কর্ণধার অর্পণ পাল। ডান দিকে স্ত্রী মিতাক্ষরা ও দুই সন্তান-সহ লক্ষ্মী টি কোম্পানির মালিক রুদ্র চট্টোপাধ্যায়।
নিজেকে কখনওই ঠিক ক্ষুদ্র অর্থে বাঙালি পরিচয়ের নিরিখে দেখেননি তিনি। তবু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার দুপুরটায় ছ’বছর আগের এক গ্রীষ্ম-সন্ধ্যার কথা মনে পড়ছিল তাঁর। রুদ্র চট্টোপাধ্যায় ভাবছিলেন, ফেলুদার এক বিখ্যাত খুঁতখুঁতেমি, মকাইবাড়ির চায়ের সঙ্গে তাঁর জীবনটাও কী ভাবে জড়িয়ে পড়ল!
টুইটার সাক্ষী সেই উচাটনের। তাঁর অন্যতম সাম্প্রতিক স্বপ্ন, মকাইবাড়ি টি এস্টেটের হ্যান্ডল থেকে রুদ্রের রিটুইট, ‘অদ্বিতীয় ফেলুদার স্মৃতিতে প্রার্থনা, শুভ কামনা!’ মকাইবাড়ি যে আদতে সত্যজিতের ফেলুদার প্রিয়তম চা, তা কখনওই বলতে ভোলেন না লক্ষ্মী টি গ্রুপের ম্যানেজিং
ডিরেক্টর। মকাইবাড়ি সমেত দার্জিলিং, অসম, আফ্রিকার রোয়ান্ডায় ২৫টি চা-বাগিচার মালিক রুদ্রবাবু। বয়স ৪৩ বছর। তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম সুহৃদ অর্পণ পাল মশাইও সে দিন সৌমিত্র-স্মৃতিতেই বিধুর। বর্ধমানের অখ্যাত কামারকিতা গ্রাম থেকে উঠে এসে বিস্কুট-সাম্রাজ্যের অধীশ্বর পিতৃদেব কৃষ্ণদাস পালের স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বেটন ৪২ বছরের অর্পণেরই হাতে।
পুব ভারতের বাজারে দাপট বেশি হলেও কসমোপলিটান ভারতীয়ত্বের সত্তাটাই ক্রমশ আঁকড়ে ধরছেন বছরে ১৫০০ কোটি টাকা কারবারের বিস্কফার্ম ব্র্যান্ডের উত্তরাধিকারী। টুইটারেই চোখে পড়ল জনৈক তেলুগুভাষী বিস্কুট-অনুরাগীও বিস্কফার্মের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। লিখেছেন, ‘এমন চোস্ত তেলুগু ভাষার বিজ্ঞাপনের জন্য ধন্যবাদ! এখন থেকে শুধু বিস্কফার্মই খাব।’ বিস্কুটে বাঙালি আবেগ উস্কে বিপণন কৌশল থেকে ধীরে ধীরে সর্বভারতীয় মূল্যবোধের ব্র্যান্ড ইমেজের দিকে ঝুঁকছেন তাঁরা। তবু বিস্কফার্মের ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল জুড়ে সে দিন সৌমিত্ররই ছায়া। বিস্কফার্মের তুরুপের তাস, শুগার-ফ্রি ক্রিম ক্র্যাকারের বিজ্ঞাপনের মুখ ছিলেন সত্যজিতের ‘চারুলতা’-র চারু-অমল, মাধবী ও সৌমিত্র। পিয়ানোয় বসে ‘আমি চিনি গো, চিনি তোমারে’-র সেই দৃশ্যের স্মৃতিটানে প্রচারিত চিনিবিহীন বিস্কুটের মর্মকথা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসে হ্যাশট্যাগ দিয়ে কয়েক বছরের পুরনো এই বিজ্ঞাপনই হয়ে ওঠে বিস্কফার্মের প্রণতি।
যাঁর মৃত্যুতে সর্বভারতীয় ব্র্যান্ড জগতে শোক আছড়ে পড়বে, এমন বাঙালি এবং সারা দেশের বাজার ছেয়ে ফেলা বাঙালি-ব্র্যান্ড— কোনওটাই বিশেষ সুলভ নয় এ কালে। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম, উদ্ভাবনী চিন্তায় অর্জিত চা-বিস্কুটের সাফল্য বহু বছর বাদে বাঙালির কপালেই জয়টিকা পরাচ্ছে। ছ’ফুটিয়া দুই যুবকই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল-কলেজের প্রাক্তনী। মাঝে এক ব্যাচের ফারাক। চায়ের রূপকার দেশপ্রিয় পার্কবাসী। বিস্কুটের সওদাগর মিন্টো পার্কে থাকেন।
সাফল্য ও বাঙালিয়ানা নিয়ে রসায়ন খুঁজলে রুদ্র চাটুজ্জের ঠোঁটের কোণে ট্রেডমার্ক ফিচেল হাসিটা অবধারিত ফুটে উঠবে। প্রধানত চা, কার্পেট ও আসবাব ব্যবসাকে সামনে রেখে রুদ্ররা এখন হেসেখেলে বছরে ১০০০ কোটি টাকার ব্যবসা করছেন। স্কটিশ সাহেবের থেকে কেনা ওবিটি সংস্থার শতাব্দী-প্রাচীন কার্পেট ব্যবসা তাঁর হাত ধরেই ২০ কোটি থেকে ৫০০ কোটির চুড়োয়। তবু এই সাফল্যকে ঘিরে মাত্রাছাড়া বাঙালি গরিমার স্রোতে ভাসতে তিনি রাজি নন। রুদ্রের স্ত্রী মিতাক্ষরা ঝরঝরে বাংলা বললেও আদতে রাজস্থানি। কুমিল্লা থেকে কলকাতায় আসা বাপ-ঠাকুরদার থিতু ব্যবসা আঁকড়ে পড়ে থাকেননি এই বাঙাল। নতুন কিছু গড়ার নেশা বরং তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছে উত্তরপ্রদেশের মফস্সলি মির্জাপুর বা রোয়ান্ডার ধূ-ধূ বিজন মাঠেও। তবু এই চাটুজ্জেবাবুর স্বপ্নের দিগন্ত আরও দূরে খুলে যাওয়ার নেপথ্যে কিছু ‘বং-কানেকশন’ কাজ করেছে। সেই গল্পে না-হয় পরে আসা যাবে!
মার্গো থেকে ক্রিম ক্র্যাকার
বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্ন, একান্তই প্রিয় কত ব্র্যান্ডই কালে-কালে হাতছাড়া হয়েছে। বর্ধমানের কামারকিতা গ্রাম থেকে এসে বাণিজ্যলক্ষ্মীর সাধনায় কৃষ্ণদাস ওরফে কেডি পালও বাঙালিকে নিজের কিছু দিতে চেয়েছিলেন। ব্রিটানিয়া, নেসলে, ডাবর, হরলিক্স-এর মতো সংস্থার ডিস্ট্রিবিউশন কারবারের পসার জাঁকিয়ে বসলে পালমশাই চেয়েছিলেন ক্যালকাটা কেমিক্যালস-এর বেশির ভাগ শেয়ার কিনতে। মার্গো সাবান, নিম টুথপেস্টের মতো বঙ্গজীবনে মিশে থাকা বিভিন্ন পণ্য তখন ক্যালকাটা কেমিক্যালস-এর প্রডাক্ট। কর্ণধার দাশগুপ্ত পরিবারের সঙ্গে যথেষ্ট সৌহার্দ্য ছিল কেডি-র। কিন্তু সংস্থার শেয়ার কেনায় শ ওয়ালেসের ছাবারিয়াদের সঙ্গে তাঁকে টক্কর দিতে হয়। সেই যুদ্ধ জেতেননি। শেষমেশ ২৭ শতাংশের বেশি শেয়ার হাতে আসেনি পালবাবুদের। অগত্যা জার্মান সংস্থা হেঙ্কেলসকে তা বিক্রি করে ক্যালকাটা কেমিক্যালস থেকে রণে ভঙ্গই দিলেন তিনি।
প্রাণপুরুষ: সস্ত্রীক বিস্কফার্ম-প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত কৃষ্ণদাস পাল। ডান দিকে, বাবা দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রুদ্র।
হতাশার পটভূমিতেই খেই মিলল নতুন আশার! শেয়ার বিক্রির পুঁজি হাতে কেডি এ বার নতুন স্বপ্নের পিছনে ছুটলেন। গড়ে উঠল, ‘সাজ ফুড প্রডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড’। সেটা ২০০০ সাল। কেডি পাল, তত দিনে ষাটের সীমানা ছুঁয়েছেন। যখন গড়পড়তা লোকে অবসর নেয়, তখনই ফের জীবন শুরু হল। সাজ-এর বিস্কফার্মের পথ চলা শুরু হয় উলুবেড়িয়ার কারখানায়। অর্পণ তখন বি কম পাশ করে স্নাতকোত্তর পর্বে। দেশের বাইরে ম্যানেজমেন্ট পড়ার ইচ্ছে। কিন্তু নতুন সংস্থা ‘সাজ’ চালু করে বাবা নিজেই অর্পণের জীবনের রোড-ম্যাপ ঠিক করে দিলেন। কৃষ্ণদাসের তিন সন্তান শর্মিষ্ঠা, জয়িতা, অর্পণের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে গড়া সংস্থা সাজ-এর লোগোয় সব থেকে বড় হরফে ‘এ’ অক্ষরটিই। বাবা চেয়েইছিলেন, কনিষ্ঠতম অর্পণ ভবিষ্যতে ব্যবসায় নেতৃত্ব দিক।
ডিস্ট্রিবিউশন থেকে উৎপাদনে ঢুকে প্রথম তিন বছর কেডিকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিল। স্বপ্নের ব্যবসা বেচে দেওয়ার কথাও ভেবেছেন। অর্পণকে ডেকে নেওয়াও তেমনই এক দেওয়ালে পিঠ-ঠেকা মুহূর্তে। উলুবেড়িয়ার কারখানায় তখন প্রোডাকশনের হাল টিমটিমে। বাধ্য হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটানিয়ার বিস্কুট ও নেসলের নুডলস তৈরিও শুরু করতে হয়েছে। বাবার ডাকে বিস্কুট-স্বপ্নের দৌড়ে ঝাঁপানোর মধ্যে পুত্রের কর্তব্যবোধ ছিল। অর্পণ বলেন, “বাবা ছোটবেলায় আমাদের বিএম ডব্লিউ চড়ার শখটাও বাকি রাখেননি। কিন্তু কাজের সময়ে অন্য মানুষ! নিজে ১০০ লোকের কাজ করতেন! জীবনকে উপভোগ করেও প্রাণপণে কাজ করাটা শিখিয়ে গিয়েছেন।” রোলমডেল বাবার সামনে নিজেকে প্রমাণ করার থেকে কিছুই বেশি ছিল না অর্পণের কাছে।
জীবনে গুছিয়ে প্রেম করার সময় পাননি ব্যবসায়ীপুত্র। কাগজ দেখে বিবাহ ম্যাডক্স স্কোয়ারের পুজোর সাবেক কর্তা ধ্রুব দাসের নাতনি দেবিকার সঙ্গে। ভগ্নিপতি বিজয় সিংহের সঙ্গী হয়ে বাবার স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার ব্রতে অর্পণের আকছার রাত আটটা বেজে যায় উলুবেড়ে বা ধুলাগড়ের কারখানায়। কিছু দিন অন্তর শিলিগুড়ি বা বেঙ্গালুরুর কারখানায় ছুটতে হয়। দক্ষিণ ভারতেও বাঙালির বিস্কুট উৎপাদন শুরু হবে ২০২১-এই। গুয়াহাটির নতুন কারখানাও এ বছরই শুরুর কথা। বেঙ্গালুরুতে রাত কাটিয়ে অর্পণ প্রায়ই নাগপুরের কারখানায় পৌঁছে যান পরের দিন। ঠিক যে ভাবে বাবা যেতেন। ২০১৭-য় নাগপুরে নিতিন গডকড়ী-ফডণবীসদের পাশে বাবার স্বপ্নের দিকচিহ্ন স্থাপনের ছবিটা বাঁধানো অর্পণের চেম্বারে। বাবার সব অফিসের ঘরেই পাশাপাশি চেয়ারে বসতে হত পুত্রকে। এখনও দু’টো চেয়ার রাখা। কিন্তু বাবার শুভ স্পর্শ অনুভব করতে তাঁর শূন্য চেয়ারেই বসছেন অর্পণ।
পুব ভারতে ব্রিটানিয়ার পরেই উঠে এসেছে বিস্কফার্ম। ভারতজয়ের স্বপ্নে ১৭টা রাজ্যে পা রাখা হয়ে গেল। দেশের চার নম্বর বিস্কুট ব্র্যান্ড। বাবাই শিখিয়েছিলেন, লক্ষ্যটা ছোট পদক্ষেপে ভাগ করে নিলে পথ চলা সোজা হয়ে যায়। বিস্কুট যে একটা সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা, তাও বোঝেন অর্পণ। একদা ‘টপ বিস্কুট’কে ফিরিয়ে আনাই বিস্কফার্মের খেলাটা ঘুরিয়েছিল। নিরন্তর কাটাছেঁড়া চলে, দামি কফিশপে যদি ঘরোয়া ইটালিয়ান বিসকটি থাকতে পারে, প্রজাপতি বিস্কুটটাই বা কী দোষ করল! পাড়ায় চায়ের দোকানে সাবেক বেকারি ঘরানা, করাচি বেকারির ফলখচিত কুড়মুড়ে স্বাদ থেকে সাহেবি কুকিজ়ের আদল নিয়ে লেগেই আছে বিস্কফার্মের নানা কিসিমের নিরীক্ষা।
অর্পণ বলেন, “১৪০ রকমের বিস্কুট, কুকি, ওয়েফার, মুখরোচক চিঁড়েমুড়ি মিক্সচার, কেক-পাফ চলে এসেছে। আরও কয়েকটা নতুন আইটেম-ভাবনা এল বলে!” নিজেদের বিপুল বিস্কুট সম্ভার কোথাও একটা মেলে ধরতেই নিজস্ব বিপণির ভাবনাও উঠে এসেছিল। অতএব দু’দণ্ড যাপনের মধ্যবিত্তোপযোগী ‘জাস্ট বেকড’ আউটলেট সমূহের সূচনা। তা ইতিমধ্যে কলকাতাময় ছড়িয়ে পড়েছে।
এই সব ছেড়েছুড়ে সপ্তাহান্তে অর্পণ পারলেই চলে যান কামারকিতায়। সপ্তদশ শতক থেকে সেখানে বসত পাল পরিবারের। বাবার প্রাণের গ্রাম, নিজেদের আর একটি সহোদরা বলে মনে হয় অর্পণের। রাস্তা, আলো, ইস্কুল, কম্পিউটার সেন্টার, ডাক্তারখানা, ঘরে ঘরে জলের কল, দুগ্গাপুজোর বাদ্যি... সবখানেই যে বাবার উত্তাপ মাখামাখি।
ওমেগা ঘড়ি, পেলিক্যান কলম
ছোটবেলায় ঠাকুরদা পরেশচন্দ্রর পাশে ঘুমোতেন রুদ্র চাটুজ্জে। আজব মানুষ তিনি! কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জমিদার বিশ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যম পুত্র পরেশচন্দ্র সিল্কের পাঞ্জাবি পরবেন, বিলিতি ব্রেকফাস্ট খাবেন। কিন্তু নরম গদিতে শোবেন না। ঘরে পাখা চালাতে দেবেন না। অনেক পরে স্কটিশ সাহেব ডেভিড ওকলের কাছ থেকে কেনা মির্জাপুরের কারখানায় কর্মজীবন শুরু হলে রুদ্র এর সুফল টের পেয়েছিলেন। অচিন শহরে তখন ফ্যাক্টরিতেই ঘুমোতে হত তাঁকে। দাদুকে খুব মনে পড়ছিল তাঁর।
পরেশচন্দ্রের ভাই শৈলেশচন্দ্র স্বদেশি করে ১৯ বছর বয়সে দেওলি জেলে মারা গিয়েছিলেন। তাঁদের বড়দা যোগেশ চাটুজ্জে কাকোরি ট্রেন ডাকাতির মামলায় দীর্ঘ দিন জেল খেটেছেন। পরে ইন্দিরা গাঁধীর শ্রদ্ধাভাজন, স্বাধীনোত্তর দেশে রাজ্যসভার সদস্য। অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য পরেশচন্দ্রর চা-ব্যবসায় আসাও নাকি পালিয়ে গা-ঢাকা দেওয়ার ডেরার লোভে। ১০০ বছর আগে ত্রিপুরারাজের প্রশ্রয়ে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে সেই বন্দোবস্ত হল। উনকোটি জেলার পিয়ারাছোড়ায় চাটুজ্জেদের প্রথম বাগান। পরেশচন্দ্রের ইন্ডিয়ান টি অ্যান্ড প্রভিশন্স কোম্পানির প্রথম ম্যানেজার অখিল নন্দীও মার্কামারা বিপ্লবী। কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স হত্যায় দণ্ডিতা দুঃসাহসী শান্তি-সুনীতিকে যিনি তালিম দিয়েছিলেন। অখিলবাবুকেও রুদ্র দেখেছেন। ছোটবেলা থেকে শোনা এই সব গল্প আর মানুষের সংস্পর্শ বিশ শতকের শেষে গড়ে দিচ্ছিল ব্যবসায়ী ঘরের বাঙালি ছেলেটির জীবনদর্শন।
বাবা দীপঙ্কর চাটুজ্জের থেকেও পাঠ নিয়েছেন নাছোড় জেদের। নতুন নতুন চা-বাগিচার দখল কায়েম রাখতে একটা পর্যায়ে কত মগনলাল মেঘরাজের সঙ্গে যে তাঁকে লড়তে হয়েছে! নানা প্রলোভন, হুমকি, হাইকোর্টে মামলা-মোকদ্দমা। কৈশোরে বাড়ির ল্যান্ডফোনে এমন বহু উত্তপ্ত ফোনালাপের সাক্ষী রুদ্র। নানা কাঠখড় পুড়িয়ে অসমে লক্ষ্মী টি সংস্থার নারায়ণপুর টি এস্টেটের মালিকানা বাবার আমলেই দখলে আসে। সেটিও ১০০ বছর আগে বাঙালি সাহা পরিবারের ছিল। ইন্ডিয়ান টি অ্যান্ড প্রভিশন্স সংস্থার সঙ্গে মিলেজুলে লক্ষ্মী টি গ্রুপের নামটাই এ বার কায়েম হয়।
পরেশচন্দ্রর কাছে ব্যবসার চেয়ে দেশপ্রেম কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সুভাষচন্দ্রর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। কুমিল্লার ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের বটু দত্ত, হোমিয়োপ্যাথির দিকপাল মহেশ ভটচাজরা পরেশবাবুর হিতৈষী, পথপ্রদর্শক। মিশন রোয়ে লক্ষ্মী গ্রুপের প্রকাণ্ড অফিসবাড়িটা স্বাধীনতার আগেই তিনি কিনে ফেলেছিলেন। ‘৬২-তে চিনের হামলার সময়ে বর্মি চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে কলকাতা ছেড়ে ত্রিপুরার বাগানেই পড়ে ছিলেন পরেশচন্দ্র। কারণ শত্রুরা ঢুকলে তাদের কক্ষনও ফাঁকা মাঠে গোল দিতে ছাড়া যাবে না।
রুদ্রের ধমনিতে এই দাদুরও রক্ত। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি, নিউ ইয়র্কের চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসার রোমাঞ্চের ভুবনেই তিনি স্বচ্ছন্দ। ওবিটি সংস্থার সূত্রে উত্তরপ্রদেশের অজগাঁয়ে কার্পেট-তাঁতিদের জীবন বদলাতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্য নিয়েছিলেন। অভিজিৎদের পভার্টি রিসার্চ ল্যাবরেটরি মির্জাপুরের কারখানায় দীর্ঘ গবেষণা চালায়। জগদ্বিখ্যাত ভারতীয় ফ্যাশন-শিল্পী সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়, তরুণ তাহিলিয়ানি, রাঘবেন্দ্র রাঠৌরদের ডেকে এনে কার্পেটের দেশীয় নকশার বিপণনে আমেরিকায় ‘প্রাউড টু বি ইন্ডিয়ান’-প্রচারও শুরু করেছেন রুদ্র। হোম ফার্নিশিং বা ঘর সাজানোর শিল্পে পূর্ণাঙ্গ মহিমায় আত্মপ্রকাশ করতে আইরিশ ম্যানেজার এডওয়ার্ড ক্যারির নেতৃত্বে চালু হয়েছে আসবাব ব্যবসা। তাতেও বিলিতি শৈলীর সঙ্গে দেশি কাঠের প্রয়োগ, বিদেশকে নকল না করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্পর্ধা। দেশাত্মবোধের ভাবনার মতো শখ-আহ্লাদেও ঠাকুরদাকে নকল করার কথা লাজুক হেসে কবুল করেন রুদ্র। তাঁর বুকপকেটের পেলিক্যান কলম, কব্জির ওমেগা ঘড়িতে পরেশচন্দ্রর ছায়া। স্বদেশি-করা দাদুর শৌখিনতার চিহ্ন নাতি গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন।
চায়ের কাপে ঝড়-তুফান
কাজের চাপে দম ফেলার ফুরসত পেতে রুদ্রের খানিক ট্রেকিংয়েরও শখ রয়েছে। আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো বা পেরুর মাচুপিচু পাহাড়ে চড়া হয়ে দিয়েছে তাঁর। ২০১৪-র গ্রীষ্মে লক্ষ্য ছিল সান্দাকফু আরোহণ। তার আগের রাতটুকু তাঁর ‘রাজাকাকা’র কাছে মকাইবাড়ি বাংলোয় আতিথ্য গ্রহণ করলেন। মকাইবাড়ি চা-বাগানের মালিকদের চতুর্থ প্রজন্ম, রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একদা নিজের ভাবনা-চিন্তার বেশ কিছু মিল খুঁজে পেতেন রুদ্র। দু’জনেরই পাহাড়ে চড়ার শখ। রাজাকাকার কাছেও ব্যবসা মানে স্রেফ মুনাফাবৃত্তি নয়। যাঁরা ব্যবসার শরিক, সেই প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষজনের সুরক্ষা, ভাল থাকাও অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে। তরুণ রুদ্র স্নাতক হওয়ার পাট চুকিয়ে বাবার নতুন কেনা কার্পেট ব্যবসা সামলাতে গিয়ে এইটেই সার বুঝেছিলেন। যে কার্পেট বোনার কাজে একদা মেয়েদের ত্রিসীমানায় দেখা যেত না, তাতে মেয়েদের কাজে লাগিয়েই কর্মসংস্কৃতির শৃঙ্খলা ফেরান। ছোটদের স্কুলশিক্ষার সুবন্দোবস্ত করেও কাজের পরিবেশ শুধরোতে সফল তিনি।
মকাইবাড়িও নিছক সুরভিত চায়ের আঁতুড় নয়। পাহাড়, জঙ্গলে প্রকৃতির কোলে স্থানীয় মানুষ, বনের বাঘ, প্যান্থার, পাখি, প্রজাপতিদের নিয়ে এক আশ্চর্য জগৎ। সবার সঙ্গে তালমিলে জীবনে জীবন জুড়ে সিম্ফনির ফসল সেই চা। মকাইবাড়িতে সান্দাকফু পাড়ি দেওয়ার আগের রাতে ‘রাজাকাকা’ রুদ্রকে বাগান কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন।
চায়ের উৎকর্ষের হাঁকডাক থাকলেও মকাইবাড়ির রাজস্বের থেকে ঋণের বোঝা তখন বেশি হয়ে যাচ্ছিল। চা-বিশারদ রাজাবাবু চেয়েছিলেন, যোগ্য কারও হাতে বাগানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হোক। না, ঐতিহ্য বাঙালির কুক্ষিগত রাখা নিয়ে ঠিক মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু চা-বাগান সংস্কৃতির সঙ্গে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের তিন পুরুষের সম্পর্ক মাথায় রেখেছিলেন রাজা। রুদ্র সান্দাকফু থেকে ফিরতেই ‘ডিল’ চূড়ান্ত হয়। মকাইবাড়ির ভার গ্রহণে পিছিয়ে যাননি স্বপ্ন দেখতে জানা যুবক।
গত পাঁচ বছরে দুনিয়ার তাবড় সব চা-বাগানের মালিকানা কিনে লক্ষ্মী টি এখন তিন কোটি কেজি চা উৎপাদন করে বছরে। অসমের সুবিখ্যাত মোরান থেকে আফ্রিকার সেরা চা, রোয়ান্ডার গিসোভুও এই পর্বে রুদ্র লক্ষ্মীর সাম্রাজ্যে জুড়েছেন। মোরানের সিটিসি বিশ্বসেরা খেতাব পেয়েছে। জাপান, আমেরিকা, বিলেতের সমঝদারের কাছ থেকে কেজি পিছু এক লাখ বিশ হাজারি দরে (কেজিতে ১৮৫০ ডলার) দুনিয়ার মহার্ঘতম চায়ের স্বীকৃতিও পায় মকাইবাড়ি। চা উৎপাদনের নিরিখে দেশের তিন নম্বর লক্ষ্মী গ্রুপের দাবি, চায়ের সব সেরা সম্ভারই তাদের দখলে। মকাইবাড়ির চায়ের মান বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ ঘাড়ে নিয়ে রুদ্র উৎপাদন একটু কমিয়েছেন। একেবারে জৈব পদ্ধতির চা তৈরির সময়ে কয়লার বদলে প্রাকৃতিক গ্যাসের জ্বালানির পথ নিয়েছেন তিনি। মজার ব্যাপার শুধু চালু চা-বাগিচা নয়, রোয়ান্ডায় একেবারে ফাঁকা সবুজ মাঠ রুগাবানোয় চায়ের বীজ রোপণও তাঁরই হাতে। কেন? রুদ্র প্রত্যয়ী, এই চা-বাগিচা অচিরেই বছরে এক কোটি কেজি চায়ের ফলন দিতে থাকবে। তিনি অবশ্য এখনও অস্বস্তিতে, ব্যবসায় দুনিয়ার সেরা চা-সংস্থাগুলির থেকে ভারতীয় কোম্পানিরা ঢের পিছিয়ে। তবে বাঙালি বন্ধুদের মস্করা শুনতে হচ্ছে, তুই তো চা-ভুবনের নকুড়, ভীমনাগ, নবীন ময়রা সক্কলকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এলি।
দুই হুজুরের গল্প
ফিট থাকতে রুদ্র আর অর্পণ দু’জনেই কলকাতার কয়েকটি ক্লাবে টেনিস খেলেন। অর্পণকে ভাইয়ের মতোই দেখেন রুদ্র। তরুণ বিস্কফার্ম কর্তার চোখেও চট্টোপাধ্যায়রা ‘ফ্রেন্ড, ফিলসফার’! ম্যাডক্স স্কোয়ারের ব্যবসায়ী সুব্রত দাসের কন্যা দেবিকার সঙ্গে অর্পণের বিয়ের সূত্রেই দু’টি পরিবারের অন্তরঙ্গতা বেড়েছে।
জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থ কেডি পাল এই বৌমার যত্নে পরম নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছিলেন। নিউক্লিয়ার পরিবারে বড় হয়েও দেবিকা মানিয়ে নিয়েছেন বিস্কফার্মের সংসারে। রুদ্রর স্ত্রী মিতাক্ষরা একদা ইউরোপীয় ইউনিয়নে চাকরি করেছেন। দু’জনের বিদেশে আলাপ। অবাঙালি গিন্নি ‘শুদ্ধ শাকাহারী’ হলে কিন্তু সমস্যা হতেও পারত চাটুজ্জেবাবুর। তবে বৌয়ের কথ্য বাংলা ও রাজস্থানি ‘লাল মাস’ রান্নার পটুত্ব— দু’টোতেই এখনও চমৎকৃত রুদ্র। এই লকডাউনে তাঁদের ন’বছরের কন্যেকে পিৎজ়ার ঠিক স্বাদ চেনাতে রুদ্র নিজেও রাঁধতে শিখেছেন। অর্পণও ছোট দুই ছেলেকে সময় দিতে সদা মুখিয়ে। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দু’টি পরিবারেই। কেডি পালের বাড়ির জাগ্রত রামকৃষ্ণ মন্দির বেলুড়ের সাধুদের প্রতিষ্ঠিত। দীপঙ্করবাবু মিশনের বিভিন্ন শাখায় যুক্ত।
দুই ব্যবসার তরুণ কর্ণধারদের হাবভাবে মিল-অমিল দু’টোই স্পষ্ট। ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সদ্য প্রাক্তন সভাপতি বা বাংলা, উত্তর-পুবে ফিকি-র চেয়ারম্যান রুদ্র টুইটারে উচ্চকিত ভাবে উপস্থিত। কেন্দ্র, রাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে নানা মঞ্চে তাঁর ছবি। অর্পণ টুইটারেই নেই। সবিনয়ে বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্কুট ব্র্যান্ডের প্রচার ঠিকঠাকই চলছে। তবে টুইটার আমার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ঠিক মেলে না।”
কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রকের আসবাব ব্যবসা সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান রুদ্র। চিন, ভিয়েতনামকে টক্কর দিয়ে আসবাব ব্যবসায় এগোনোর রাস্তা খুঁজছেন হোম ফার্নিশিং শিল্পে দেশের অগ্রণী শিল্পপতি। কয়েক মাস আগে বাবাকে হারিয়ে তাঁর দেখানো পথে সাম্রাজ্য টেনে নিয়ে যাওয়াই অর্পণের ধ্যানজ্ঞান। বাবার ছোটবেলার গ্রামকে আগলে রাখতে চান। সংস্থার ৫৫ শয্যার হাসপাতালের বিস্তার, ৩০০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল তৈরির ভাবনাও সদ্য পিতৃহারাকে ঘিরে থাকে। মাথার উপর থেকে ছাদ সরে যাওয়ায় ব্যবসায় আরও বেশি একনিষ্ঠ তিনি।
দরকারে রূঢ় সিদ্ধান্তে নিতেও পিছপা হন না রুদ্র। লকডাউনে দু’মাস ওবিটির ৫০ হাজারি কর্মচারীদের মাইনে বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যাঁরা রাজি হয়েছিলেন, কালীপুজোর পরের দিন তাঁদের বোনাস-সহ সব ফিরিয়ে দেন। দেশের অর্থনীতির হাল নিয়ে কখনওই হা-হুতাশ করেন না, তবে কিসে ভাল হয়, জোর গলায় বলাটাও শিল্পপতির দায়বদ্ধতা বলে মনে করেন রুদ্র। মনে রাখেন, বাঙালি শিল্পপতিদের পথিকৃৎ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-সহ কলকাতার বহু সৌধ নির্মাতা, ইস্কো-র স্রষ্টা মার্টিন বার্নের রাজেন মুখোপাধ্যায়কেও বিস্তর বাধা ঠেলে এগোতে হয়েছিল। বিস্কফার্ম-কর্ণধার অর্পণও হাসেন, “সেই যে বৈষ্ণোদেবীতে পুজো দিলে পুরোহিত বলেন না, সবার ভাল হোক! ব্যবসায় এই সবার ভালটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
সবাইকে নিয়ে চলার বাঙালিয়ানা ও ব্যবসার ধর্ম এই বোধের কাছে একাকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy