ছবি: সুমন চৌধুরী
মাত্র চার বছর আগেই এ থাকত পাড়ার পূর্ব প্রান্তে মুদি দোকানের চাতালে, লোক এলেই প্রথমে হালকা গররর্। তারপর লেজ নাড়ত, বিস্কুট জুটলে সামনের দুই পা বাড়িয়ে শরীর ঝুঁকিয়ে আঁউউ বলতে বলতে গড়-ই করে ফেলত।
ও থাকত পাড়ার পশ্চিম দিকে চা-দোকানের সামনে। গরগর করতে হত না। চা খেতে যারা আসে, তারা বেশ গপ্পবাজ, আড্ডা জমাবেই। বয়াম থেকে দু’খানা লেড়ে বের করে প্রথমে একটি কামড়, আর একটি ভেঙে ছুড়ে দেওয়া প্রত্যাশা মাখানো চোখে চেয়ে থাকা ওকে। কাঙালের চেয়ে থাকা স্বভাবজাত। পাবে নিশ্চিত জানে। তবু আর্তি যায় না। লেজ নাড়ে অল্প অল্প। একেবারেই শিশু তখন। গররর্ বেরোয়। কিন্তু ঘেউঘেউ বলতে গেলে সরু কেঁউকেঁউ বেরোত মাত্র।
ওর কেঁউ ডাক, ওর ক্ষুদ্র লেজ নাড়া, ওর কাতর আবেদন মাখানো চক্ষু চা-দোকানি বুম্বাকে স্নেহাতুর করে তুলত। এক দিন গাড়ি-চাপা পড়তে পড়তেও বেঁচে গেল। ওর সারা শরীর থিরিথিরি কাঁপছিল আর ছোট্ট বুকে হৃৎপিণ্ড থকাস থকাস করছিল। সেই থেকে ছোট্ট ও-কে বুম্বা ডাকতে শুরু করেছিল রুস্তম বলে। রুস্তম সুখী ছিল।
মুদি দোকানের চাতালে থাকা এ-ও দিব্যি সুখী ছিল। সে-ও ছিল ছোট্ট। একই মায়ের পেটের কিনা কে জানে। না হলেও বলার কিছু ছিল না। এই সুন্দর দেশ ভারতবর্ষের রাস্তায় রাস্তায় জন্ম দেওয়ার মতো মায়ের অভাব নেই। শিশু জন্ম, শিশু মৃত্যু। গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে কতক মরতে মরতে বাঁচে। কতক বাঁচতে বাঁচতে মরে যায়।
মুদি দোকানের চাতালের এ বাইসাইকেল চাপা পড়েছিল, মরেনি। লোকে পা মাড়িয়ে দিয়েছে, খোঁড়া হয়নি। নর্দমায় পড়ে গিয়েছিল, ঠিক কাদা মেখে বেরিয়ে এসেছে। ডোবেওনি, ভেসেও যায়নি।
সব দেখেশুনে মুদিদোকানের মালিক কাঞ্চন এ-র নাম দিল মস্তান।
এ নাম পেয়ে মোহিত হয়ে গেল। রাস্তায় জন্ম-কর্ম, মায়ের ঠিকানা নেই, বাঁচলেও কারও কিছু যায় আসে না, মরলেও না, সে পেল একখানা আস্ত নাম! প্রাণে আবেগ একেবারে উথলে উঠল। যাকে বলে প্রভুভক্তি!
কাঞ্চনের দোকান তার বাড়িতেই। টালির চালের বাড়ি ছিল। ছোট আঙিনা। আঙিনায় শিউলি গাছ। বেকার কাঞ্চন পাড়ার মেয়ে মউয়ের প্রেমে পড়ে ঘরের বউ করে আনল। তার পর খরচ চালাবার জন্য বাড়ির সামনে, রাস্তার খানিকটা দখল করে মুদি দোকান দিল। টাকা দিল মউয়ের বাপ। সরকারি চাকরি করে। সেল্স ট্যাক্স আপিসের পিওন। টাকার অভাব নেই।
কাঞ্চন মস্তানকে ভালবাসত। মউ দুপুরে ভাত, কাঁটা, হাড়, বাসি রুটি বা ছাতা-পড়া পাউরুটি দিত।
একটু বড় হতেই মস্তান ও রুস্তম দুজনেরই পাড়া বেড়ানোর শখ হল। মস্তান পুব থেকে পশ্চিমে এল, রুস্তম পশ্চিম থেকে পুবে রওনা দিয়েছিল। পাড়ার মাঝ বরাবর দুজনের দেখা।
প্রথমে তারা পরস্পরকে সন্দেহ করল। সামান্য গরগর, মৃদু ঔ-ঔ, সঙ্গে তীক্ষ্ম দাঁতের সারি দেখিয়ে তেজোদ্দীপনার প্রকাশ। কিন্তু কেউ কাউকে আক্রমণ করছে না। গলা ছেড়ে দু’-চার বার চিল্লিয়ে যে যার আস্তানায় ফিরে গেল।
পর দিন ঠিক একই সময়, একই জায়গায় দুজনে ফের মুখোমুখি। চেঁচামেচি না করে মুখ-শোঁকাশুঁকি করল। মস্তান রুস্তমকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। রুস্তম চার হাত-পা তুলে পথের ধুলোয় গড়িয়ে নিল। মস্তান তার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গড়াগড়ি, মারামারি, কামড়াকামড়ি! সবটাই ভান। আসলে খেলা। নকল যুদ্ধ, আসল খেলা।
বেশ কিছু ক্ষণ খেলে দুজনে রাস্তার ঠিক মাঝখানে, পরিষ্কার জায়গায় ছড়িয়ে বসে, পাতলা লম্বা জিভ বার করে হাঁপাতে লাগল।
মস্তান বলল, ‘দুপুরে কী খাস?’
রুস্তম বলল, ‘প্রভু বুম্বার বউ বুঁচকি একটু ভাত দেয়।’
আমাকেও।
সকালে লেড়ে বিস্কুট, পাঁউরুটি, দুপুরে ভাত, রাতেও জুটে যায় যা হোক। আর কী চাই!
দিব্য জীবন!
আহা! এই রোদ্দুর পোহানো কী আরামের।
দুপুরের ভাতঘুমটা বল।
আমার না প্রভুর ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে।
আমারও। কিন্তু ঢুকতেই দেয় না। খেতেও দেয় রাস্তায়।
দুপুরটায় ও বাড়ির দুয়ারে বসে থাকি। যদি ডাকে।
আমিও।
চায়ের দোকানের গায়েই বাড়ি।
প্রভু কাঞ্চনের বাড়িও।
রাতে তো দুয়ার ছেড়ে নড়িই না।
আমিও না।
সারা রাত পাহারা দিই। চোর ঢুকুক দেখি! কামড়ে পায়ের ডিম ছিঁড়ে নেব!
আমিও।
খেতে দেয়। বিনিময়ে এইটুকু কৃতজ্ঞতা...
এ তো আমাদের পরম কর্তব্য। আমাদের আদর্শ।
রুস্তমের চোখে আবেগে জল এসে গেল। মস্তান একটু চাপা। তবু দুজনের হৃদয়ের এই মিল তাদের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় করে তুলল।
সম্পর্ক আরও সুন্দর বন্ধনে ধরা দিয়েছিল যখন তারা আবিষ্কার করল বুম্বা আর কাঞ্চন মাঝে-মধ্যে এ-ওর গৃহে যায়, অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেরে। প্রভুকুলে ভাব-ভালবাসা থাকলে তার বিকিরণ অনুগত ভক্তকুলে পড়বেই।
যে-সময় কাঞ্চন-বুম্বা একত্রিত, মস্তান আর রুস্তমও তখন একসঙ্গে থাকত। কিছুই নয়। প্রভুরা ভিতরে, কী করছে কোনও কৌতূহল নেই, তারা বাইরে। দাঁত দিয়ে নিজের গা কামড়ে, গোল করে ঘুরে মশামাছি তাড়ায়। এঁটুলি পোকা ছাড়ায়। রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে খানিক ডাকাডাকি করে ভয় দেখায়। চাঁদ উঠলে ঔ-ঔ গেয়ে অভিবাদন জানায় অপরের আলোকে আলোকিত হওয়ার মহিমাকে। যার যা ধর্ম।
দিব্যি চলছিল। কিন্তু কাঞ্চনের দোকান বন্ধ হয়ে গেল। বুম্বাও চা-দোকান খোলে না। সময় পায় না আসলে। এক জন বাজপাখির ছবিওয়ালা পতাকা নিয়ে বিস্তর লোক জুটিয়ে সকালে মিছিল করে যায়। বলে, চলবে না চলবে না।
আর এক জন কুমিরের ছবিওয়ালা পতাকার মিছিল করে বিকেলে। বলে, চলবে না চলবে না।
সব দেখেশুনে এ আরও হতবুদ্ধি। কী হল?
মস্তান বলল, ‘বন্ধুত্ব ভেঙে গেছে।’
রুস্তম বলল, ‘আলাদা দল করছে।’
সে জন্যই তো এর বাজপাখি, ওর কুমির।
বাজপাখি খুব কুটিল দেখতে।
কুমির হিংস্র।
তোর আমার ছবি লাগাতে পারত পতাকায়।
যাঃ! তুই আর আমি তো এক দেখতে।
কেন বল তো? আমি তো পাটকিলে। তুই পাটকিলে আর সাদায়।
ধুর! ছবিতে এক দেখাবে।
কেন বল তো?
দুনিয়ার সব অনুগত প্রভুভক্তদের এক রকম দেখায়।
কথাগুলো বলে মস্তান দার্শনিকের মতো সামনের দুটি পায়ে মুখ রেখে উদাসীন বসে রইল।
তার দেখাদেখি রুস্তমও বসল, তবে একটু তফাতে। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে বলল, ‘ভাই মস্তান।’
বল।
দু’দলই তো বলছে চলবে না চলবে না। তা হলে আলাদা হল কীসে?
এরা যা চালাবে, ওরা তা বন্ধ করে দেবে। সোজা ব্যাপার।
আমি আর তুই তা হলে শত্রু না মিত্র?
এখুনি বোঝা যাচ্ছে না।
সন্ধ্যাবেলা বাজপাখির দল আর কুমিরেরা এলাকায় খুব একচোট হল্লা মারামারি করল। বোমার আওয়াজে এ আর ও যে যার প্রভুর বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে বসে থরথর করে কাঁপতে লাগল। দুজনেই ভাবল, হায় হায়, এই বোমাবাজিতে প্রভুর না কোনও ক্ষতি হয়!
অনেক রাতে, প্রায় রাত্রি চতুর্থ প্রহরের শেষ ভাগে রুস্তম ও মস্তান পাড়ার মাঝখানে দেখা করল।
মস্তান বলল, ‘ভেবে দেখলাম, আমাদের বিবাদ করা উচিত।’
রুস্তম বলল, ‘কেন?’
আমরা প্রভুর অনুগত। আনুগত্যই আমাদের ধর্ম।
তা ঠিক। কিন্তু আমাদের মধ্যে তো কোনও মতানৈক্য নেই। বাজপাখি, কুমির, প্রভুকুল, মাংসের দোকান, পায়রা ভক্ষণ, কোনও ব্যাপারেই আমরা দ্বিমত পোষণ করিনি।
কারণ আমাদের আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তি, আমাদের বিশ্বাস ও জীবনযাপন একই রকম।
একটু খেতে পাওয়া, একটু নিরুপদ্রব ঘুম, একটু বিনোদন।
তা বললে তো চলবে না। প্রভুরা বিবাদ করছে।
অন্তত প্রতীকী কলহ একটা করি। প্রভুভক্তির প্রমাণ।
খবরদার!
তফাত যাও।
আর এক পা এগোলে কান ছিঁড়ে নেব।
আমার দাঁত নেই? তোর কান ছিঁড়তে পারি না?
ছিঁড়েই দ্যাখ!
তুইও দ্যাখ!
ব্যাটা পাজি!
ব্যাটা বদমাশ!
শুধু আস্ফালন। শুধু মুখোমুখি দংষ্ট্রা প্রদর্শন!
তাদের চিৎকারে পাড়ার লোকের ঘুম মাথায় উঠেছিল। তারা এমনিই সন্ধ্যার বোমাবাজির জন্য ত্রস্ত। অবশ্য কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু হতে কত ক্ষণ? সে বারের কথা মনে নেই? বিছানায় গেরস্ত দম্পতির সংলাপ।
কোনটা বলো তো?
আরে কালীতলায় সেই দুই ভাই? নেবু আর ছেবু?
হ্যাঁ হ্যাঁ! আবছা মনে পড়ছে যেন। বলো তো আর এক বার!
এই তোমাদের মেয়েছেলেদের দোষ। পলিটিক্স কিচ্ছু বোজো না। শুধু শপিং, আর সিরিয়াল!
হ্যাঁ! চার বেলা যে চর্ব্য-চুষ্য গিলছ, সে-সব তো সুমুন্দির পুত এসে রাঁধছে! মেয়েছেলে পলিটিক্স বোঝে না এ কথা বলো কোন লজ্জায়, শুনি? নাম করব?
না না না! মধ্যরাতে আর তেনাদের স্মরণ করার দরকার কী! এমনিতে কুকুরগুলো ঘুমের দফারফা করে দিল।
হবে না? একটা কাঞ্চনের কুকুর, একটা বুম্বার! কী যেন ঘটনা বলছিলে?
সেই যে সে বার, বোমাবাজি করতে গিয়ে কালীতলার ছেবুটা মারা গেল! ওঃ! কী দৃশ্য! বোমা ফেটে রক্ত-মাংস-ঘিলু একেবারে ছড়িয়ে ছত্রখান! শালা! মুদ্দোফরাস ডেকে, ঝেঁটিয়ে টুকরোগুলো গামলায় তুলল, নাকি মর্গে নেবে। শালার শরীরই নেই, তার আবার পোস্টমর্টেম! প্রি থাকলে তো পোস্ট। হেঃ হেঃ! কে আবার দেখেছে নাকি, কানটা পড়ে ছিল, কাক মুখে করে নিয়ে গেছে!
হ্যাট! তাই আবার হয় নাকি?
হবে না? কাকের কাছে তো ওটা মাংসের টুকরো। ছেবুরই হোক আর ছাগলের। বড় ভাইটা, নেবু, কী কান্না, যদি দেখতে!
হ্যাঁ। এই বারে মনে পড়েছে। কাজের মাসির পাড়ার ছেলে। বলছিল, মাত্র সতেরো বছর না ছেলেটার?
সব মাংস নাকি তুলতে পারেনি। পর দিন পিঁপড়ে থিকথিক করছিল। মাসি দেখেছে।
তার পর? তার পর কী হল? সে তো বডি পেল। একটা থলের মধ্যে। নেবু গেল শ্মশানে। দাহ-টাহ করে ঘরে ফিরেছে। মাত্র দু’বছরের ছোট ভাই! সোজা দরজা বন্ধ করে সিলিং ফ্যান থেকে গলায় দড়ি!
ইশ্শ্শ্! কী যে হয় এসব করে! দাঁড়াও তো! কুকুরগুলোর গায়ে জল দিই। না হলে ঘুমোতে দেবে না।
পারবে?
দেখো না। ব্যালকনি থেকে ছুড়ব।
গায়ে জল পড়তেই সম্বিৎ ফিরল। যথেষ্ট ধর্মপালন হয়েছে। দুজনে গলা নামাল। গগনবিদারী ঘেউঘেউ থেকে চাপা গররর্! তার পর নৈঃশব্দ্য। দুজনে একটু মুখ-শোঁকাশুঁকি করল। রুস্তম একটু ডন-বৈঠক দিয়ে বলল, ‘গ্লাঁউ!’
মস্তান বলল, ‘দিনের বেলায় বেশি মেলামেশা না করাই ভাল।’
দুজনের বেশ সময় কাটত। এখন একলা একলা। বৈরিতা যদি ভানও হয়, তবুও তা একাই করে দেয় শেষ পর্যন্ত। দুজনেরই মনমেজাজ খারাপ।
এক সন্ধ্যায় বাজপাখির মিছিল আবির মেখে নাচতে নাচতে কাঞ্চনের বাড়ির সামনে এল। কাঞ্চনের গলায় গাঁদার মালা। মুখে হাসি।
ও দিকে বুম্বার বাড়িতে বিষাদের আঁধার। কাঞ্চন-পত্নী মউ ঝলমলে বেনারসি পরে মা কালীর প্রসাদ বিলোচ্ছে। বুম্বার বউ বুঁচকি তার পুঁচকি মেয়ে নিয়ে জাস্ট একটা বুটিকের সুতির সালোয়ার-কামিজ পরে রিকশা চেপে বাপের বাড়ি রওনা হল। রুস্তমের দিকে চেয়েও দেখল না।
তখন ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে মস্তান এসে বলল, ‘জিতে গেছে!’
রুস্তম মন খারাপ করে পেটে মুখ ঢুকিয়ে বসে ছিল। মুখ তুলে বলল, ‘ভুক!’
জিতে গেছে! কী আনন্দ! মস্তান এদিক-ওদিক ছুটল। গড়াগড়ি খেল। আদিখ্যেতা করে আলতো কামড় দিল রুস্তমকে। রুস্তম বুঝল, তার প্রভুর গৃহে কেন এই বিষাদের আবহ। হেরে গেছে।
সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। বলল, ‘রাতে কোথায় খাই বল তো।’
আমি থাকতে ভাবনা কী! চলে আসিস।
নাঃ! থাক!
রুস্তম আবার কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। মস্তান একা একাই আরও কিছু ক্ষণ ছোটাছুটি করল। বিড়াল তাড়াল। ল্যাম্পপোস্টের ছায়াকে শাসানি দিল। এক মাতালকে দেখে গর্জন করছিল। কাঁকালে লাথি খেয়ে কেঁউ কেঁউ করতে করতে কাঞ্চনের বন্ধ মুদি দোকানের সামনে গিয়ে ধুলোয় শুয়ে রইল। বিজয় উৎসব তখনও চলছে। দলের ছেলেরা ধরে বসেছে, কাল মাংস-ভাত চাই। স্বয়ং মউবউদির হাতের রান্না।
সকালবেলায় বিজেতা কাঞ্চন বুক ফুলিয়ে মাংসের দোকানের দিকে চলল। সে আর এখন জনসাধারণ নেই। ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছে। লোকে সমীহ করে তাকাচ্ছে। আগে যারা কাঞ্চনমুদির বাটখারার সততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত, তারাও পেল্লায় হেসে বলছে, সুপ্রভাত!
কাঞ্চনের দিনগুলো ভোজবাজির মতো পালটে যাচ্ছিল।
কেজি দশেক মাংস কিনবে। ভূতে টাকা জোগাচ্ছে।
মস্তান প্রভুর পিছন পিছন চলল। বাজারে যেতে গেলে বুম্বার বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে হয়। অন্য রাস্তাও আছে, একটু ঘোরা পড়ে। কাঞ্চন বুম্বার বাড়ির সামনে গিয়ে অকারণে চেঁচিয়ে কথা বলতে লাগল। যে যায়, তাকেই পাকড়ে কুশল জিজ্ঞেস করে। কী হাঁকডাক!
অবশেষে সে আবার চলতে লাগল। পিছু পিছু মস্তান। মস্তানের পিছনে একটু দূরত্ব রেখে রুস্তম। কেউ কোনও কথা বলছে না। কিন্তু দুজনেই জানে তারা মাংসের দোকানে যাচ্ছে। মস্তান প্রভু কাঞ্চনের সঙ্গে যাচ্ছে। মনে মনে কাঁচা মাংসের ছাঁট পাবার লোভ। একই লোভে রুস্তম যাচ্ছে মস্তানের সঙ্গে।
মাংসের দোকানি কষাই দিলদার কাঞ্চনকে অভিবাদন করে মস্তানের দিকে মাংস ছুড়ে দিল। হেসে হেসে বলল, ‘আপনি কষ্ট করে এলেন কেন? বললেই হত। কেউ খবর দিলেই বাড়ি পৌঁছে দিতাম। আপনি চলে যান। এক ঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে ফাস ক্লাস মাংস পৌঁছে যাবে।’
কাঞ্চন গম্ভীর মুখে টাকা বের করে দিল।
দিলদার বলল, ‘আপনার কুকুরটা বেশ। আপনি যখনই আসেন, সঙ্গে আসে। আমি তো ওকে সব সময়ই কিছু হাড্ডিগাড্ডি দিই। লেঃ লেঃ! হাড্ডি খা!’
রুস্তমও খেতে চাইছিল। কিন্তু কাঞ্চন বলল, ‘ওটাকে দিস না। ওই কুত্তাটা আমার না।’
অন্য একজন ক্রেতা বলল, ‘বুম্বাদার।’
দিলদার রুস্তমকে হঠাবার চেষ্টা করল। রুস্তমের মাংস জুটল না। সে আবার মস্তানের পিছু পিছু ফিরে আসছিল। পথে বুম্বার সঙ্গে দেখা। কাঞ্চন দরাজ গলায় বলল, ‘কী রে? কোথায়?’
বুম্বা মিনমিন করে বলল, ‘এই মাংস কিনতে।’
হাঃ হাঃ! যা! বুঁচকি তো দারুণ মাংস বানায়।
এ বার রুস্তম প্রভু বুম্বাকে অনুসরণ করল। মস্তান আরও মাংসের লোভে, চুপচাপ, একটু দূরত্ব রেখে রুস্তমের সঙ্গে যাচ্ছিল।
বুম্বা হেরে গেলেও দলের ছেলেরা মাংস খেতে চায়। তারা বিস্তর খেটেছে। তা ছাড়া, এ বার হেরেছে। পরের বার কী হয় কে বলতে পারে!
কষাই দিলদার এবার রুস্তম কুকুরের প্রশংসা করে মাংস ছুড়ে দিল। বুম্বাকেও সেই সব কথাই বলল যা কাঞ্চনকে বলেছে। বুম্বা রুস্তমকে দেখতে গিয়ে মস্তানকে দেখে ফেলল। বলল, ‘ওটা আমার কুত্তা নয়।’
হ্যাঁ জানি। ওটা কাঞ্চনদার।
দিলদার এ বার মস্তানকে খাতির করল না।
এ আর ও রোজ মধ্যরাতে কলহের নাটক চালিয়ে যাচ্ছিল। সেই রাতে মস্তান বলল, ‘দিনের বেলাও কিছুটা মারামারি করা দরকার। তবে মাংসের দোকানে গেলে তুই আমাকে ডাকবি, আমি তোকে ডাকব।’
এ ভাবেই চার বছর কাটল।
কাঞ্চনের দেখার মতো তিন তলা বাড়ি। বুম্বার দোতলা। কাঞ্চনের দামি গাড়ি। বুম্বার গাড়ির দাম কম। রুস্তম আর মস্তান দুই নেড়ি, পথের কুকুর, পথেই থাকে। প্রভুভক্তি ও আনুগত্য প্রদর্শনের পথ থেকে তারা এতটুকু বিচ্যুত হয়নি। ধর্ম, আদর্শ, নীতি তাদের সম্বল। আর প্রভুর প্রতি ভালবাসা!
এক দিন রুস্তম বলল, ‘আবার কুমিরের মিছিল বেরোচ্ছে। চলবে না চলবে না।’
মস্তান বলল, ‘বাজপাখিরাও বেরোচ্ছে। গোট দিন গোট দিন। আবার গোট-মিট খাবে বোধ হয়।’
ওরাও বলছে গোট দিন।
খুব মাংস খেয়েছি যা হোক।
এ বার প্রভু বুম্বা জিতে যাবে।
কেন? কেন? প্রভু কাঞ্চন নয় কেন?
আমার প্রভু হাল, তোর প্রভুর চাল।
যা যা! তোর প্রভু তো ঘণ্টা!
তোর প্রভু তো ঘ্যাঁক্কোস!
ঝগড়া চলতে লাগল। ক্রমে বাড়ছে। এ বার এ ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আঁচড়াআঁচড়ি কামড়াকামড়ি। এই লড়াইটা ভীষণ আন্তরিক। বিশুদ্ধ প্রভুভক্তি থেকে উদ্ভূত আসল লড়াই। আসল যুদ্ধ দুর্দান্ত বিষয়। সেখানে নেশা লেগে যায়। লড়াইটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
মস্তান ও রুস্তম সব ভুলে লড়তে লাগল। সারা শরীরে কামড়। যন্ত্রণা। রক্ত। এ ওর ঘাড়ে মরণ-কামড়ানি দিল। ও এর গলায়। দুজনেই প্রাণপণ শক্তিতে নাছোড় দাঁত বিঁধিয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনড় হয়ে।
পথচারী লোক প্রথমে ভেবেছিল নকল যুদ্ধ, আসলে খেলা। একটু পরেই বুঝল, এ হল মরণখেলা! তারা ঢিল মারল, জল ছুড়ল, সাহস করে লাঠির বাড়ি। তবু কেউ কাউকে ছাড়াতে পারল না।
মরবে। দুটোই মরবে। কার কত দম দেখা যাক। লোকে ভিড় করে তাৎপর্যহীন হত্যা দেখতে লাগল।
দৃশ্যটিকে পাশ কাটিয়ে গেল কাঞ্চনের দামি গাড়ি। ভিতরে কাঞ্চনের পাশে বুম্বা। তৃতীয় একটি শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে। তাকে রুখতে এদের জোট হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক আলোচনারত দুজন নগণ্য কুকুর দুটিকে লক্ষই করল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy