আত্মঘাতী বাঙালি স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে গিয়েছে তাঁকে। বয়সে হেমন্তকুমারী মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর চেয়ে এক বছরের বড়, ১৮৬৮ সালে জন্মেছেন লাহৌরে। তাঁর বাবা নবীনচন্দ্র রায় সেখানে ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ। শিবনাথ শাস্ত্রীর বন্ধু ও ব্রাহ্মসমাজ প্রচারক।
এ-হেন লাহৌরকন্যার পরিচয় একটি তকমায় আঁটানো সম্ভব নয়। এই বাঙালি মেয়ে ১৮৮৫ সালে লাহৌরে তৈরি করেছেন ‘বনিতা-বুদ্ধি-বিকাশিনী সভা’। ওই বছর মুম্বইয়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তৈরি হয়েছিল, ইতিহাস জানে। কিন্তু ১৭ বছরের এক বঙ্গতনয়া যে লাহৌরে নারীমুক্তির ডাক দিয়েছিলেন, ইতিহাস ভুলে গিয়েছে।
ইতিহাসের বিভ্রম কী আর একটা! কুড়ি বছর বয়সে হেমন্তকুমারীর সম্পাদনায় বেরোয় হিন্দি মাসিক পত্রিকা ‘সুগৃহিণী’। পত্রিকার প্রথম সম্পাদকীয়তে তিনি যা লিখেছিলেন, বাংলায় তার মর্মার্থ, ‘প্রিয় বোনেরা, দেখো কে এসেছে। সুগৃহিণী, তোমাদের বোন। তোমাদের দুঃখ, অজ্ঞানতা ও পরাধীনতা দূর করতে এই বোন তোমাদের কাছে এসেছে।’ কূপমণ্ডূক বাঙালি নিজের ভাষা ছাড়া হিন্দি প্রেমচন্দ, উর্দু কুরাতুলিন হায়দার বা মলয়ালম সাহিত্যের ভৈকম মহম্মদ বশিরের খবর রাখে না। ফলে নারী স্বাধীনতা নিয়ে হাজার বক্তৃতা দিয়েও তারা হেমন্তকুমারীকে ভুলে গিয়েছে।
সুগৃহিণীর সন্দেশ ছড়ানো এই নারী আবার ১৯০১ সাল থেকে টানা সাড়ে তিন বছর বাংলা মাসিক ‘অন্তঃপুর’-এর সম্পাদক। ভারতের দু’টো মুখ্য ভাষার সাহিত্যে নারীর এমন উজ্জ্বল উপস্থিতি হেমন্তকুমারীর আগে কখনও ঘটেনি।
সাহিত্যচর্চাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর চেষ্টাতেই ১৯০৩ সালে তৈরি হয়েছিল শ্রীহট্টের প্রথম মহাবিদ্যালয়, তিনিই সেখানে প্রধান শিক্ষিকা। শ্রীহট্ট ও বাংলার মানচিত্র ছাড়িয়ে তাঁর শিক্ষাবিস্তারের প্রয়াস ক্রমশ উজ্জ্বল হয়েছে ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও। পাটিয়ালায় টানা কুড়ি বছর ভিক্টোরিয়া গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ, অতঃপর ১৯২৮ সালে দেহরাদূন পুরসভার কমিশনার। নিজের জীবনকে উদাহরণ হিসেবে খাড়া করে হিন্দি বলয়েও মেয়েদের স্বাভিমানের সন্দেশ বা বার্তা দিয়েছিলেন হেমন্তকুমারী।
হেমন্তকালে জন্ম, বাবা নবীনচন্দ্র রায় তাই মেয়ের নাম রেখেছিলেন হেমন্তকুমারী। নবীনচন্দ্র তখন লাহৌরের ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যক্ষ, তাঁর সম্পাদনাতেই বেরোত ব্রাহ্মসমাজের হিন্দি ও উর্দু মাসিক পত্রিকা ‘জ্ঞানপ্রদায়িনী’। হিন্দি ভাষার ব্যাকরণ, হিন্দিতে প্রযুক্তিবিজ্ঞান এবং স্ত্রীশিক্ষা-বিষয়ক কিছু বইও লিখেছিলেন তিনি। হেমন্তকুমারী এ দিক থেকে আক্ষরিক অর্থেই ‘বাপ কী বেটি’।
১৮৮৬-এ অবসর নিয়ে নবীনচন্দ্র চলে এসেছিলেন তৎকালীন ‘সেন্ট্রাল প্রভিন্স’, আজকের মধ্যপ্রদেশে। সেখানে খাণ্ডোয়ার রাজার মন্ত্রী তিনি। খাণ্ডোয়াকে এখন আমরা অশোককুমার, কিশোরকুমারদের আদি বাড়ির সূত্রে চিনি। কিন্তু বাঙালির প্রথম খাণ্ডোয়া-জয় নবীনচন্দ্রের হাত ধরেই। ওই রাজ্যের রতলাম এলাকায় ব্রাহ্মদের বসতির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। তার আগে আর একটি কাজ করেছিলেন। ১৮৮৫-এ শিলং শহরে কন্যা হেমন্তকুমারীর বিয়ে দেন। পাত্র শ্রীহট্টের রাজচন্দ্র চৌধুরী।
লাহৌরের মেয়ের কৃতিত্ব অন্যত্র। রেনেসাঁ, ইংরেজ শাসকের উৎসাহ, ইয়ং বেঙ্গল, ব্রাহ্ম আন্দোলন বাংলায় স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে যে ভূমিকা নিয়েছিল, মধ্য ও পশ্চিম ভারতে তেমনটা ঘটেনি। তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তি থেকে সেই সব এলাকা তখনও দূরে।
কে বলে, বিয়ের পর নারীরা আর নতুন পথে নামতে চান না? বিয়ের তিন বছর পর ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হেমন্তকুমারীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হল মেয়েদের জন্য প্রথম হিন্দি মাসিক পত্রিকা ‘সুগৃহিণী’। প্রথম প্রকাশ হেমন্তকুমারীর পিতৃগৃহ রতলাম থেকে। পরের বছরই ১৮৮৯ সালে রতলাম ছেড়ে হেমন্তকুমারী স্বামীর সঙ্গে চলে আসেন শিলংয়ে। পত্রিকার প্রকাশস্থান তাই বদলে গেল। শিলং থেকে প্রকাশিত হল ‘সুগৃহিণী’। প্রথমে কাগজ বের হত লাহৌর, পরে ইলাহাবাদ থেকে। বার্ষিক মূল্য এক টাকা। শুধু সম্পাদনা বা লেখালিখির দিকেই নয়, পত্রিকার সদস্যবৃদ্ধি ও আর্থিক উন্নতির প্রতিও তাঁর ছিল কড়া নজর।
কী থাকত বঙ্গতনয়া সম্পাদিত প্রথম হিন্দি কাগজে? থাকত প্রাচীন ভারতের বিদুষী নারীদের কথা। পাশাপাশি ঘরোয়া চিকিৎসা, রান্নার পরামর্শ, মেয়েদের ফোটোগ্রাফি চর্চা এবং সমাজ সংস্কার নিয়ে নানা লেখা। সমাজের অসাম্য ও মেয়েদের প্রতি অন্যায় ব্যবহারের ছবিও তুলে ধরা হত। অনেক সময় পাঠিকাদের উদ্দেশে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোর ডাকও দিতেন সম্পাদক।
বাল্যবিবাহের সমালোচনা করে প্রবন্ধ লেখা হত ‘সুগৃহিণী’তে। ‘সহবাস বিল’ সম্পর্কে হেমন্তকুমারীর দৃষ্টিভঙ্গি চমকে দিয়েছিল তৎকালীন সমাজকে। তাঁর বক্তব্য, অহেতুক চেঁচামেচি ছেড়ে ছেলে ও মেয়ে উভয়কে সংযমী হতে হবে।
একটা তুলনামূলক আলোচনায় আসা যাক। হিন্দি ভাষায় সাহিত্য, সমাজ সংস্কার ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রের অবদান আজও অনস্বীকার্য। এ-হেন ভারতেন্দুর ‘বালাবোধিনী’ ও হেমন্তকুমারীর ‘সুগৃহিণী’ প্রায় সমসাময়িক। কিন্তু সুগৃহিণী বেশি দৃপ্ত। ভারতেন্দু প্রথম নারী-পুরুষের সমমর্যাদার কথা বলেন। ‘সুগৃহিণী’ আবার বলে, স্ত্রী-পুরুষ তখনই সমান হবে, যখন নারীরা পুরুষের সমান ‘উপাধি’ গ্রহণ করবে। মানে, সমান শিক্ষা লাভ করবে। মেয়েরা যখন সমাজে তাঁদের অবস্থান, প্রাপ্য সম্মান নিয়ে সরাসরি ভাবতে শুরু করেননি, হেমন্তকুমারী তখন এই বিষয়গুলি অক্লেশে তুলে ধরেন তাঁর ‘সুগৃহিণী’তে।
পরে বাংলা ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েও তিনি এই প্রসঙ্গগুলিই তুলে আনেন। মাত্র তিন বছর তিন মাস এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন হেমন্তকুমারী। জানুয়ারি ১৯০১ থেকে মে ১৯০৪। তার মধ্যেই মেয়েদের পোশাক, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে সেখানে প্রায় ৩৬টি নিবন্ধ লিখেছিলেন তিনি।
তিন বছরেরও বেশি সময় ‘অন্তঃপুর’-এর সম্পাদক ছিলেন হেমন্তকুমারী। ‘বঙ্গমহিলার গ্রন্থ প্রচার’, ‘শুশ্রূষাকারিণী’, ‘হিন্দু অনাথ আশ্রম’, ‘মহিলার পরিচ্ছদ’, ‘জাতীয় শিক্ষা ও ভারত মহিলা’, ‘ভারত মহিলা স্বাস্থ্য’, ‘সূতিকাগৃহ’ ইত্যাদি প্রায় ৩৬টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। নিজের সম্পাদিত পত্রিকার বাইরে লেখালিখি করেছেন ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’-তেও। সেখানে তাঁর দুটি দীর্ঘ প্রবন্ধ বেরিয়েছিল— ‘স্ত্রীর কর্তব্য: গার্হস্থ্য’ ও ‘স্ত্রীর কর্তব্য: মিতব্যয়িতা’।
ঘটনাচক্রে স্ত্রীর অন্তঃপুরপর্বেই ১৯০৩ সালে রাজচন্দ্র বদলি হয়ে গেলেন শ্রীহট্টে, স্বামীর সঙ্গে গেলেন সহধর্মিণীও। এখানে এসে হেমন্তকুমারী কেবল অন্তঃপুরেই সীমাবদ্ধ রাখলেন না নিজেকে। সমাজপতিদের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে সেই বছরেই তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হল শ্রীহট্টের প্রথম মহিলা বিদ্যালয়। শিক্ষিকা, সমাজসেবী হেমন্তকুমারী ছিলেন সুবক্তাও। মঙ্গলা অনুজা তাঁর হিন্দি গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ‘হেমন্তকুমারী দেবী বহুত অচ্ছা ভাষণ দিয়া করতি থি।’ বড় বড় সভাতেও প্রভাব ফেলত তাঁর ভাষণশৈলী।
স্বামীর মৃত্যুর পর পাটিয়ালায় চলে আসেন হেমন্তকুমারী। সেখানকার ভিক্টোরিয়া কন্যা মহাবিদ্যালয়ে টানা কুড়ি বছর শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। পঞ্জাব সরকার হেমন্তকুমারীকে সেই আমলে দুশো টাকা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন।
পাটিয়ালা থেকে দেহরাদূন। সেখানেও তিনি নিজেকে যুক্ত রাখেন সমাজ সংস্কােরর নানা কাজে। পরবর্তীকালে দেহরাদূনের মিউনিসিপ্যাল কমিশনারও হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে ৮৫
বছর বয়সে সেখানেই মারা যান তিনি। পাটিয়ালা ও দেহরাদূন থাকার সময় ‘আদর্শমাতা’, ‘মাতা অউর কন্যা’, ‘নারীপুষ্পাবলী’, ‘হিন্দী-বাংলা প্রথম শিক্ষা’ এবং ‘সচিত্র-নবীন-শিল্পমালা’ নামে পাঁচটি হিন্দি বইও লিখেছিলেন। বাঙালি তাঁকে চেনে না ঠিকই, কিন্তু ১৯২১ সালেই হিন্দি ভাষায় বেরিয়েছিল শ্যামসুন্দর দাসের ‘হিন্দী কোবিদ গ্রন্থমালা’র দ্বিতীয় সংস্করণ। চল্লিশ জন বরেণ্য ব্যক্তির জীবনকথা, সেখানে এক এবং একমাত্র নারী বাংলার হেমন্তকুমারী চৌধুরী।
হেমন্তকুমারীর ঐতিহাসিক অবস্থানটি তা হলে কোথায়? সময়ের নিয়মেই আগুনখেকো নারীবাদী তিনি নন, বিশ শতকের শুরুতে তা হওয়ার কথাও ছিল না তাঁর। সম্পাদক-কর্মী পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি এগারোটি সন্তানের জননীও, পারিবারিক মর্যাদা ও ব্যক্তির সম্মানকে নিয়ত চর্যার মধ্যে এনে সুস্থ সমাজের স্বপ্ন দেখেন। প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন বিরোধ নয়, পরিবারে নারী বা জননী বা গৃহিণীর যে মর্যাদা পুরুষশাসিত সমাজ প্রায় ভুলতে বসেছিল, তাকেই বারংবার মনে করিয়ে দেন।
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন ১৭ অক্টোবর। তাঁর সার্ধশতবর্ষে সেই দিনটিতেই মহাষ্টমী। দশভুজার মতো যিনি একই সঙ্গে স্বামী, সংসার সামলেছেন, বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতেই লেখালেখি করেছেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা থেকে সুদূর দেহরাদূনে পুর কমিশনারের দায়িত্ব সামলেছেন, তাঁর ক্ষেত্রে বোধ হয় এটাই ঘটার কথা ছিল। বাঙালির যাবতীয় বিস্মৃতি সত্ত্বেও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy