চৈত্র মাসটা এলেই মন খারাপ হয়। বসন্তের ঝরাপাতা দেখে নয় অবশ্য। ওই যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে’ বলে এক দল অর্থসাহায্য চেয়ে বেড়ান, যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষের সঙ্গে শিশুদেরও দেখা যায়, তাদের দেখে। কেবলই মনে হয় এ যেন এক লোপ পেতে বসা পরম্পরা, গাজনের অবশেষটুকু—‘সন্ন্যাসী’ সেজে যারা ‘চত্তির’ মাস বাংলাদেশ দাপিয়ে বেড়াতেন। সবই তো আমরা খেয়ে মেরে দিলাম— এই একটু-আধটু যা পড়ে আছে৷
বর্ষশেষের উৎসব পালনেই বাঙালি অভ্যস্ত ছিল দীর্ঘ কাল। গ্রন্থকার দীনেন্দ্রকুমার রায় সঙ্গত কারণেই বলেছেন যে, বসন্ত আর গ্রীষ্মের সন্ধিস্থলে চৈত্র মাসে পল্লিজীবনে ‘নব আনন্দের হিল্লোল বহে’। গম, ছোলা, যব, অড়হর প্রভৃতি রবিশস্য পেকে উঠেছে, সুতরাং দীর্ঘ কালের ‘অনাহারে শীর্ণদেহ, ক্ষুধাতুর কৃষক পরিবারে যে হর্ষের উচ্ছ্বাস দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা সুদীর্ঘ হিমযামিনীর অবসানে বসন্তের মলয়ানিলের মতই সুখাবহ।’
শুধু কি আর গাজন-চড়ক? বছরভর পল্লিবাংলা মজে থাকত এই সব উৎসবে। ইউরোপেও তাই। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ পিটার বার্ক লিখেছেন, ক্রিসমাস থেকে পরের ছ’মাস চলত কার্নিভালের স্মৃতিচারণে ভেসে থাকা। আর পরবর্তী ছ’মাস পরেরটির প্রতীক্ষায় থাকা। কিন্তু এ দেশে পার্বণ বিরামহীন। দীনেন্দ্রকুমারের ‘পল্লীবৈচিত্র্য’ পড়লে দেখা যায় কালীপুজো, কার্তিকের লড়াই, নবান্ন, পৌষপার্বণ, দোল-চড়কে কেমন মুখর হয়ে উঠত ইংরেজের কাছে স্থবির বলে মনে হওয়া গ্রামজীবন। গাঁয়ের সকলের নিমন্ত্রণ থাকত জমিদার পরাণ চৌধুরীর বাড়ির কার্তিক পুজোয়।
নৈশভোজের পর তার বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপের সামনে, শামিয়ানার নীচে বৃদ্ধা ঢপওয়ালি যখন কার্তিকের জন্মকাহিনি গাইতে শুরু করতেন তখন সবাই আত্মহারা হয়ে পড়তেন। ঢপ চলাকালীন যখন খবর আসত, পাশের হালদারবাড়িতে ছায়াবাজির পুতুলনাচ শুরু হচ্ছে, তখন পাঠশালার ছুটি হলে ছাত্ররা যেমন ‘গোল করিতে করিতে’ ছুটে বেরোয়, ঢপের আসর থেকে মানুষ সে ভাবেই হালদারবাড়ির দিকে ছুটতেন। গ্রাম জুড়ে উৎসবের আবহ। আলো-আঁধারিতে দল বেঁধে লোকের মঞ্চ থেকে মঞ্চে আনন্দের সন্ধানে ছোটা— ভাবলে আজও শিহরন জাগে।
গ্রামের পর গ্রাম দাপিয়ে বেড়াত ম্যালেরিয়া। তা বলে কি আর উৎসব থেমে থাকে? দীনেন্দ্রকুমার লিখছেন, সকালে উঠেই যে ব্যক্তি ‘দু’রতি’ কুইনাইন না খায়, তার সেদিনকার মতো জ্বরের ভয় লেগেই থাকে। ও দিকে ‘প্লীহার আবির্ভাবে উদরটি ঢক্কাকার, তাহার উপর ব্লিষ্টারের পদাঙ্কলেখা’, শরীর ক্ষীণ, রক্তশূন্য। তাতেও গাজনের ‘ভক্তা’ (যাঁরা আচার পালন করেন) না হলেই নয়। শুধু কি তাই? জমিদারদের মধ্যে পর্যন্ত শ্রীপঞ্চমীর উৎসব নিয়ে দলাদলি শুরু হয়ে যেত। এক বার গোবিন্দপুরের বড়বাজারে সরস্বতী পুজোয় তেমন জাঁকজমক হয়নি বলে বৌবাজারের দল জন্মাষ্টমীর প্রতিমা বের করে বড়বাজারের পাণ্ডাদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক ছড়া কেটে ব্যঙ্গোক্তি বর্ষণ করেছিল। এর পর নাকি বড়বাজারের মাতব্বররা স্থানীয় রামচরণ দফাদারের দোকানে বৈঠক বসিয়ে ঠিক করেন যে, যদি এ বারে সরস্বতী পুজোয় তাঁরা অসাধারণ কিছু না করতে পারেন, তা হলে আর বারোয়ারি করবেন না, দড়ি-কলসির আশ্রয় নিতে হলেও বরং ভাল।
খোদ কলকাতা শহরে চড়কের ধুম তো হুতোমই লিখে গেছেন— চার দিকে ঢাকের বাদ্যি, পিঠে বাণ ফুঁড়বেন বলে ‘চড়্কীর’ পিঠ ‘সড়সড়্’ করছে, সারা শরীরে গয়না, পায়ে নূপুর, মাথায় জরির টুপি, কোমরে চন্দ্রহার, বেলপাতা বাঁধা সুতো ‘গলায় যত ছুতর, গয়লা, গন্ধবেনে ও কাঁশারির’ আনন্দের সীমা থাকত না— তাদের বাবুর বাড়ি গাজন। মেছুয়াবাজারের ‘হাঁড়ি হাঠা’, চোরবাগানের মোড়, জোঁড়াসাকো, নতুনবাজার, বটতলা, সোনাগাছি থেকে আহিরীটোলা চৌরাস্তা— লোকে লোকারণ্য। দু’-তিন দিন ধরে চলত উৎসব। হুতোমের মতে, কলকাতা শহরের ‘আমোদ সহজে ফুরোয় না, বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার ১২ দিনেও বিসর্জন হয় না। চড়কও ‘বাসী, পচা, গলা ও ধসা হয়ে থাকে’।
চৈত্রশেষে চড়ক তো বাংলার সর্বপ্রধান পরবই ছিল। অনেকে এর মধ্যে নিম্নশ্রেণি বা বর্ণের সংযোগ দেখেছেন। হুতোম ছুতোর, গয়লা আর গন্ধবণিকদের কথা লিখেছেন, দীনেন্দ্রকুমারও বলেছেন। প্রথম জন আরও লিখেছেন উনিশ শতকে টাকার জোরে ধনী হওয়া ‘কতকগুলি ছোট লোক’ই রামলীলা, স্নানযাত্রা আর চড়কের মতো অনুষ্ঠান ধরে রেখেছিলেন। ‘সমাচার দর্পণ’ (৩০ এপ্রিল, ১৮৩১) অবশ্য একটু অন্য ভাবে বলেছিল— ‘সন্ন্যাস’ ‘ছোট’লোকেরা করে তা ঠিক নয়। ‘ছোট’লোকের কি শিবালয় থাকে? এর পর লিখছে ‘ভাগ্যবান ভদ্রলোক’দেরই মন্দির থাকে, আর তারাই খরচপত্তর দিয়ে গাজনের ব্যবস্থা করেন।
গাজন বা চড়ক সম্পর্কে প্রধান আপত্তি ছিল সম্ভবত ওই পিঠ ফুঁড়িয়ে ঘোরানো বা নৃত্য সহযোগে মিছিল। ‘মরিয়া হয়ে নাস্তে নাস্তে’ সন্ন্যাসীদের কালীঘাট থেকে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা পড়ে বেশ কয়েক বার। ১৮৩৯ সালের ৩০ মার্চ ‘সমাচার দর্পণ’ জানিয়েছিল চড়কের সন্ন্যাসীদের কালীঘাট থেকে কলুটোলা ও মেছুয়াবাজারের রাজপথ দিয়ে আসার যে প্রথা আছে, সরকার তা নিষিদ্ধ করে বিকল্প পথের ব্যবস্থা করেছে। আর তা নাকি ‘প্রজারদিগের পক্ষে অতিশয় সুখজনক’ হয়েছে।
আইন করে সরকার গাজনের বাণফোঁড়া নিষিদ্ধ করে বটে, তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ১৮৬৮-র ৪ মে তারিখের ‘সোমপ্রকাশ’ লিখেছে, মেদিনীপুর শহরে পর্যন্ত গাজনে বাণফোঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। মালঞ্চার দু’টি গাজনে দু’জন এবং উটপাথরের একটি গাজনে কম করে ১০ জন চড়কগাছে ঘুরেছে। বিশ শতকের গোড়ায় দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখছেন কী ভাবে প্রধান সন্ন্যাসী অন্য সন্ন্যাসীদের চোখ পানের পাতা দিয়ে ঢেকে বাণের ‘তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ তাহাদের দুই পাঁজরের মাংসে বিঁধাইয়া দিল’।
আইন আর ব্যঙ্গবিদ্রুপ— কোনওটাই মানুষকে আটকাতে পারেনি। প্রথম থেকেই মিশনারিরা এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। উনিশ শতকের একেবারে প্রথমে, ১৮১৯-এর ২৪ এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ লিখছে চৈত্র সংক্রান্তির দিন কলকাতার বুকেই এমন এক চড়ক হয়েছে, যা শুনলে লোক কান চাপা দেবে। এক জন হিন্দু সহিস ও এক লোকের স্ত্রী, দু’জন এক সঙ্গে চড়কে ঘুরেছেন, লজ্জা বলে কোনও বস্তুই তাদের ছিল না। কারণ প্রায় ৩০ হাজার লোকের সামনে ‘জগৎপ্রদীপ-সূর্য্য জাজ্জ্বল্যমান থাকিতেও এই দুষ্কর্ম্ম’ করতে তাদের অস্বস্তি হয়নি! এর ৮১ বছর পর, ‘ইন্ডিয়ান মেথডিস্ট টাইমস’ (জুন, ১৯০০)-এ মিশনারিরা আক্ষেপ করে লিখেছেন, ৩৫ বছর আগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও বাঁকুড়ায় বাণফোঁড়া রমরমিয়ে চলেছে— লোকে বলেন এ তাদের দীর্ঘ দিনের পরম্পরা। তারা ঝুলবেন এবং কিছু ঘটলে তারা বুঝে নেবেন। আরও পরে, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে জন্ম নেওয়া ব্রাহ্মণ (পদবি ধামাৎকর্ণি) পরিবারের বৃদ্ধাকেও বাঁকুড়া শহর সংলগ্ন এক্তেশ্বরের গাজনে তাঁর পরিবারের অংশগ্রহণের কথা বলতে শুনেছিলাম। বর্ণ দিয়ে কি আর এমন বর্ণময় উৎসবকে আবদ্ধ রাখা যায়? বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাঁকুড়া শহরেই শ্রাবণ মাসের শেষে মনসাপুজোর সময় ঝাঁপান দেখতে যে ‘সহস্র-সহস্র নরনারী’-র সমবেত হওয়ার কথা ‘গন্ধবণিক’ পত্রিকায় (কার্তিক, ১৩৩৩) লিখেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অবিনাশ দাস, তখন তাদের জাতি-বর্ণ বিচার কে করেছিলেন? বা সি এ বেন্টলে সাহেব ১৯২১-এ ‘ফেয়ারস অ্যান্ড ফেস্টিভ্যালস ইন বেঙ্গল’-এ প্রতি থানাতেই চড়ক কতগুলো করে পালিত হত, তার যে হিসেব দিয়েছিলেন তার অংশগ্রহণকারীরা কেবলই কি নিম্ন শ্রেণি বা বর্ণের? সে কথা নাহয় তোলা থাক।
আসলে মিশনারি, ব্রাহ্ম এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা আর ভিক্টোরীয় নীতিবোধে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিদেরও একাংশ দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এই সব সাদামাটা পালাপার্বণ বা আমোদপ্রমোদের নিন্দায় সরব হয়ে উঠলেন। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার কাছে তো সবই অশ্লীল ঠেকত। পৌষ মাসে চার দিন ধরে চলা মাড়গ্রামে বুড়াপীরের মেলা সম্পর্কে ১৮৮৫ সালের ১১ জানুয়ারি তারা লিখছে, ওখানে নাকি অসভ্যতার চূড়ান্ত হয়। এবং উনিশ শতকে এ রকম ‘জঘন্য আমোদ’ বড়ই লজ্জার বিষয়। ‘আত্মচরিত’-এ কৃষ্ণকুমার মিত্র লিখছেন, সে কালে ময়মনসিংহ শহরে বাইখেমটা নাচ দেখা ভদ্রলোকেরা অশ্লীল বলে মনেই করতেন না। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াতসূত্রে অনেকের কাছেই এগুলো অসার আমোদ বলে বিবেচিত হতে শুরু করে। সবচেয়ে বড় ভিলেন রায়গুণাকর! স্বয়ং অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন মূল্যবোধের অবক্ষয়ে কৃষ্ণনগর রাজসভার নিম্নরুচিকে তৃপ্ত করতে ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ ভারতচন্দ্র প্রায় ‘পর্নোগ্রাফি’ লিখলেন।
এই শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্বে বাঙালি ভদ্রলোকের একাংশের কাছে জনসংস্কৃতির অনেক পালাপার্বণ ব্রাত্য হয়ে গেল। কবি, যাত্রা বা পাঁচালিকে তো ১৮৭৪ সালেই সে কালের আমোদ বলে চিহ্নিত করেছিলেন রাজনারায়ণ বসু, ‘সে কাল আর এ কাল’-এ। আরও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়। ১৩১৫ সালের ‘ঐতিহাসিক চিত্র’-তে লেখা ‘ভাদুপূজা’-য় বলছেন, আগে এই পরবটি ভদ্র-অভদ্র— উভয় সমাজেই চালু ছিল। কিন্তু ‘এক্ষণে’ কোথাও কোথাও ভদ্রসমাজ ‘সভ্যতালোক প্রাপ্ত’ হয়ে আর আগের মতো অসঙ্কোচে এতে যোগদান করতে ‘প্রস্তুত নহেন’।
আর্থিক পরিস্থিতি, বর্ধমান জ্বর বা ম্যালেরিয়া ছাড়াও পৃষ্ঠপোষকদের দুর্দশার কারণ ছিল। বিশ শতকের গোড়ায় দীনেন্দ্রকুমারও লিখেছেন, আগে চৈত্র মাসের মধ্যভাগেই চড়কের ঢাকের বাদ্যি শোনা যেত এবং পল্লিবাসী গাজনের আমোদে মেতে উঠত। কিন্তু জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে ওঠায় ‘আজকাল’ সংক্রান্তির এত আগে তাদের আর সেই মত্ত হওয়ার সুযোগ নেই। ন’-দশ দিন আগে আয়োজন শুরু হয়। তবু গোবিন্দপুরের চড়ক উৎসবের যে প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন তা যথেষ্টই আকর্ষক।
বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এই সব পালাপার্বণ, জনসংস্কৃতি ক্রমে দুর্বল হচ্ছিল, উনিশ শতকের শেষ বা বিশ শতকের শুরু থেকেই। ‘প্রতিভা’(অগ্রহায়ণ, ১৩২৭)-য় ‘ঠাকুরমা’র কথা’ নামে একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখক বলছেন রামগোপালপুর ভবানীপুরের দোল উৎসব, ধলার জগদ্ধাত্রী পুজো, ময়মনসিংহের রাসযাত্রায় দেশে প্রভূত আনন্দ বয়ে আনত। সে সব শেষ। ‘এখন যেন কেবলই ‘ত্রাহিমাম্ মধুসূদন’। দেশের রাজা জমিদাররা ‘নির্বিষ ভুজঙ্গমের মত সটান লম্বা পড়িয়া আছেন। কে দেশের এ সকল আমোদ উৎসব করে?’
১৯০৭ সালেও বহু আমোদ বিনোদন কেবলই স্মৃতি। ‘উপাসনা’ পত্রিকায় সমকালের বিশিষ্ট সাংবাদিক ক্ষেত্রমোহন সেনগুপ্ত তেমন ইঙ্গিতই করেছিলেন ‘সেকালের বারোয়ারি’-তে— কোথাও বদন অধিকারীর পদার্পণ না হলে যেন প্রতিমার ‘বদন বিমর্ষ হইত’। কোথাও মদন মাস্টারের দক্ষযজ্ঞ না হলে যজ্ঞ পণ্ড হত। বিদ্যাসুন্দরের যাত্রা না হলে অনেক গ্রামের বারোয়ারি ব্যর্থ পর্যন্ত হতে দেখেছেন তিনি। কোথাও আবার যুবকেরা বর্ধমানের বামাকে আনার জন্য আহার-নিদ্রা ছাড়তেন। জগা ময়রা চণ্ডীর গান না করলে গণ্ডগ্রামে ‘তাল বেতালের যুদ্ধ’ হত। জনসংস্কৃতির এই পরিমণ্ডল আজকের বঙ্গসন্তানের কাছে ভিনগ্রহের গল্প বলে মনে হওয়া বিস্ময়কর নয়। এর লেশমাত্রও তো খুঁজে পাই না। ওই সব মেলার নামে যে সব উৎসব চলে, তা তো সেই কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর মতো। মহাকাল কি সবই উদরস্থ করে? জানি না।
বদন অধিকারী, মদন মাস্টাররা অতীত হলেন অনেক কাল। তাই তো ক্ষেত্রমোহন হতাশ হয়ে লিখলেন— উৎসব নেই, উৎসাহ নেই, সুখ, সাহস, বল, স্বাস্থ্য— কিছুই নেই, আছে কেবল ‘প্রকাণ্ড প্লীহা ও বৃহৎ যকৃৎ, আর আছে মৃত্যু!’ জাঁকজমক হারালেও পরবগুলো টিকে ছিল। দক্ষিণারঞ্জন বসু-র ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’-এ বিশ শতকের শুরু থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে পল্লিসংস্কৃতির বহু নমুনা রয়েছে। বরিশালের নলচিড়াতে চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে সপ্তাহখানেক ধরে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসার কথা পাই। বছরের পয়লা সেখানে নাকি এক ‘বার্ষিক কর্ম’ ছিল। বছরের মশলাপাতি কেনা হত ও দিন। গানের বৈঠকও বসত। চট্টগ্রামের সারোয়াতলিতেও চৈত্র সংক্রান্তির দিন ‘লাওন’ (এক ধরনের নাড়ু) খাওয়ার উৎসবের মধ্য দিয়েই হত বর্ষবিদায় এবং হিন্দু-মুসলমানের নববর্ষ বরণের আন্তরিক শুভ কামনার বিনিময়।
এখানে যে বর্ষবরণের আভাস আছে, তার বয়স খুব বেশি নয়। চৈত্র সংক্রান্তিই ছিল প্রধান। হুতোমের খুব আক্ষেপ ছিল এ নিয়ে। লিখেছেন ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন৷ পানসুপুরি দিয়ে তারা বরণ করেন আগামীকে। ভাল বা খারাপ যে ভাবেই বছর শেষ হোক না কেন, ‘সজ্নে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়েই পুরনোকে বাঙালি বিদায় দেন’। কেবল মাতাল আর ‘নতুন খাতাওয়ালারাই’ নতুন বছরের মান রাখেন। ‘ইংরাজী নববর্ষ’ কবিতায় ঈশ্বর গুপ্তও তো লিখেছিলেন ‘নববর্ষ মহাহর্ষ ইংরাজটোলায়।’ আসলে পয়লা বৈশাখ তো ছিল ওই খাতাওয়ালা, মানে ব্যবসায়ীদের পরব— হালখাতা অনুষ্ঠান। এ ছাড়া তো কোনও গুরুত্বই ছিল না।
গ্রামদেশে এর নজরকাড়া বিবরণ দিয়েছিলেন দীনেন্দ্রকুমারই। পল্লিবাংলার কোনও কোনও জায়গায় অনুষ্ঠানটি ‘ভগবতী-যাত্রা’ হিসেবেও পালিত হত। ১৯০৪ সালে তিনি লিখছেন, পয়লা বৈশাখ নববর্ষের দিন গ্রামবাংলায় অভিনব সজ্জা দেখতে পাওয়া যায়। গ্রাম যেন নতুন জীবন লাভ করে ‘বেদনাপরিপ্লুত বিষাদস্মৃতিসমাকুল’ পুরনো বছরের দুঃখ দৈন্যের ‘জীর্ণ যবনিকা’ পেছনে রেখে নতুন বছরের উৎসব শুরু করে। ‘ভগবতী-যাত্রা’ তারই উদ্বোধন। পড়লে অবশ্য বোঝা যায়, তা কিন্তু প্রধানত হালখাতারই পার্বণ। লিখেছেন, কী ভাবে দোকানিরা সকাল সকাল নতুন খাতার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সে দিন।
আজকের মতো সে দিনও দোকানদাররা ফুল, আমপাতা দিয়ে দোকান সাজাতেন। যে দোকান-মালিক অন্য দিন তার দোকানে সামান্য একটি মাটির ‘ডেল্কো’ (প্রদীপবিশেষ) জ্বালতেও কষ্টবোধ করে, সে-ও নাকি এ দিন ‘লণ্ঠনের মধ্যে গ্লাসে ভরে তেলের বাতি জ্বালতে কার্পণ্য করে না’।
সন্ধে হতে না হতেই শুরু হয় হালখাতার ব্যস্ততা। খাবার মেনুও ছিল জিভে জল আনা— চন্দ্রবাবুর মতো বড় দোকানি বেলের শরবত, ভিজে মুগের ডাল, পেঁপে, ডাব থেকে লুচি, কচুরি, ছানা, ক্ষীর—কিছুই বাদ দিতেন না। ডাক্তারখানাও বাদ থাকেনি। হরিহরবাবুর ওষুধের দোকানে এই ‘খাতাসাইতে’-র ব্যাপার নিয়ে লোকজন হাসিঠাট্টাও করতেন। কিন্তু হরিহর ডাক্তারের সোজা কথা “দোকানদারী যখন করিতেই হইল, তখন আর্যমতে করাই ভাল কিছু টাকাও আসে, জাতীয় ভাবও বজায় থাকে।” মনে হয়, পরের দিকে নববর্ষের মধ্যে ওই ‘জাতীয় ভাব’-এর একটা গল্প বোধহয় ঢুকে পড়েছিল।
তবে পয়লা বৈশাখের মান ব্যবসায়ীরাই রেখেছিলেন দীর্ঘ কাল। আজও দেখি দোকানগুলোয় হালখাতার ভিড়, খদ্দেরের প্রবেশ ও হাসিমুখে মিষ্টির বাক্স নিয়ে প্রস্থান। বাঙালি কি নতুনে ভীত ছিলেন? হুতোম একটা ইঙ্গিত করেছিলেন কিন্তু। বলছেন বছরের শেষ দিনে ‘যুবত্ব কালের এক বৎসর গ্যাল দেখে যুবক যুবতীরা বিষণ্ণ হলেন’। আরও বলছেন, বর্তমান বছর ‘স্কুল মাষ্টারের মত গম্ভীরভাবে এসে পড়্লেন— আমরা ভয়ে হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত!’ পরবর্তী সংযোজন, ‘জেলার পুরাণ হাকিম বদলী হলে নীল প্রজাদের মন যেমন ধুক্পুক্ করে— স্কুলে নতুন ক্ল্যাসে উঠ্লে নতুন মাষ্টারের মুখ দেখে ছেলেদের বুক যেমন গুর্গুর্ করে— মড়ুঞ্চে পোয়াতীর বুড় বয়সে ছেলে হলে মনে যেমন মহান সংশয় উপস্থিত হয় পুরাণর যাওয়াতে নতুনের আসাতে আজ সংসার তেমনি অবস্থায় পড়্লেন।’ নিধুবাবুর গানের সেই কলি— ‘নূতনেতে হয় অনুরাগ/ পুরাতনে হেলা ফেলা’য় মজলেও এ ক্ষেত্রে বাঙালি পুরনোটাই সেলিব্রেট করে এসেছে দীর্ঘ কাল।
নববর্ষ পালন বা বরণ তা হলে এল কবে? ‘জাতীয় ভাবের’ কথা বললাম বটে, স্বদেশি ভাবনা থাকতে পারে এর মধ্যে, তবে ব্রাহ্ম অনুষঙ্গ ছিল। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে রীতি প্রকরণে এখন নববর্ষ পালিত হয়, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব অনস্বীকার্য। নববর্ষের এই চেতনাটা যে ওঁরই দান তা নিয়ে অনেকেই নিঃসংশয়। বিজয়ার আদলেই ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ গাজিপুর থেকে প্রিয়নাথ সেনকে লিখছেন— “নববর্ষের কোলাকুলি গ্রহণ কর।” গাজিপুরে পয়লা বৈশাখের ব্রহ্মোপাসনায় বলছেন “আইস এই নববর্ষের উৎসবে আমরা তাঁহারই মহিমা ঘোষণা করি...”। এই পবিত্র দিনে, পবিত্র সকালে ‘তাঁহারই কার্য্যে’ জীবন উৎসর্গ করে জীবনকে সার্থক করে তুলতে বলছেন কবি।
এরও দু’বছর আগের নববর্ষে মহর্ষিভবনের উপাসনা উপলক্ষে তিনটে গান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘নববর্ষের গান’ শিরোনামে— ‘আমারেও কর মার্জনা’, ‘বর্ষ গেল, বৃথা গেল, কিছুই করিনি হায়’ আর ‘ফিরোনা ফিরোনা আজি এসেছ দুয়ারে’। ‘তত্ত্ববোধিনী’-র বৈশাখ সংখ্যাতেই মুদ্রিত হয় গান তিনটে। শুধু কি গান? ১৩০৯-এর বৈশাখে লিখলেন ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধ। বলছেন, “প্রান্তরের মধ্যে পুণ্য নিকেতনে নববর্ষের প্রথম নির্মল আলোকের দ্বারা আমাদের অভিষেক হইল। আমাদের নবজীবনের অভিষেক।” মানবজীবনের যে মহোচ্চ সিংহাসনে বিশ্ববিধাতা আমাদের বসার জায়গা দিয়েছেন, তা আজ ‘আমরা নবগৌরবে অনুভব করিলাম।’
রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠির যে সঙ্কলনটি করেছিলেন গৌরচন্দ্র সাহা, (‘রবীন্দ্রপত্রপ্রবাহ ও তথ্যপঞ্জী’) তাতে দেখা যায় নববর্ষে নিয়ম করে কবি প্রিয়জনদের চিঠি লিখতেন। ব্রজেন্দ্রকিশোর দেববর্মা থেকে নির্মলকুমারী ও রাণী মহলানবিশ, প্রমথ চৌধুরী, অমিতা ঠাকুর— আরও কত জন। ১৯০২ থেকে ১৯৪১— ধারাবাহিক ভাবে। দীনেশচন্দ্র সেন, প্রিয়নাথ সেন, শৈলেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখকে আবার পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। ১৯১১-র ১৩ এপ্রিল মীরা দেবীকে লিখছেন, পয়লা বৈশাখের উৎসবের জন্য আশ্রম প্রস্তুত হচ্ছে। অনেকেই আসবেন বলে তাঁর ধারণা। ২৪ বছর পর, ১৯৩৫-এর ৮ এপ্রিল হেমলতা সেনকে লিখছেন পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে বিপুল জনসমাগম হবে বলে তাঁর ধারণা। এর সপ্তাহখানেক পর হেমন্তবালা দেবীকে লিখছেন নববর্ষ উৎসব ও অতিথিকৃত্য নিয়ে তিনি কতটা ব্যস্ত।
২৫ বৈশাখ গরমের ছুটির মধ্যে পড়ে বলে, ১৯৩৬ থেকে নববর্ষের দিন, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখই তাঁর জন্মোৎসবের ব্যবস্থা হয় বলে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন। আগ্রহ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে নববর্ষ পালন করতেন কবি। রোগক্লান্ত জীবনের শেষ নববর্ষে প্রদত্ত জন্মোৎসবের ভাষণই তো ‘সভ্যতার সংকট’।
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে প্রথম বছর নববর্ষ উৎসব মহা সমারোহে পালিত হয় ১৯০২-এর ১৪ এপ্রিল। জগদানন্দ রায় লিখছেন, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত-সহ কত লোক এসেছিলেন। কী অদ্ভুত যোগ! বর্ষশেষের হুল্লোড়ের পর গাজনের লোকজন, ‘চড়কী’-রা যখন ক্লান্ত শরীর ফেলে দিয়েছেন মাটিতে, পথে, তখন বর্ষশেষের রাতে কবির পরিকররা কেউ ঘুমোননি, এবার যে তাঁদের পালা। জগদানন্দ লিখছেন, কেউ ঘুমোতে চাইলেও তাকে জাগিয়ে রাখা হত। সমস্ত রাত মাঠে ঘুরে ‘গোলমালে কাটানো যাইত’। তার পর যখন রাত চারটের সময় মন্দির থেকে মৃদঙ্গের শব্দ এবং রাধিকা গোস্বামীর প্রভাতী রাগিণীর সুর কানে আসত, তখন তাঁরা মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হতেন। এর পর সূর্যোদয়ের সঙ্গে আরম্ভ হত গুরুদেবের উপদেশ। ও দিকে সন্ন্যাসীদের নেশার ঘোরও তখন বোধহয় প্রায় কেটে এসেছিল।
গাজন, চড়ক বা শীতলা ষষ্ঠীর মেলা আজও অনেক জায়গায় হয়। অনলাইন লটারি, রকমারি খাবার, রাইড্সও চলে সেখানে। কিন্তু মনের সেই টানটা আর আছে বলে মনে হয় না। আমাদের মনোজগৎটাই যে বদলে গেছে। তবু নিয়ম করে পয়লা বৈশাখ আসে। আমরা তাকে আবাহন করি। সম্বৎসরের গ্লানি মুছতে, জরা ঘোচাতে, আবর্জনা দূর করতে কচিকাঁচাদের সুরে সুর মিলিয়ে আমরাও তাকে ‘এসো হে বৈশাখ’ বলে আহ্বান করি। আর বেলের শরবত বা ছানা, ক্ষীর না থাক, বচ্ছরকার দিনে শপিং মলের ফুডকোর্টে গিয়ে কব্জি ডুবিয়ে লাঞ্চ বা ডিনারটা তো করা যায় রে বাবা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy