এই গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে শরীর আড়াল করতে বা ঝমঝমে বৃষ্টিতে মাথা বাঁচিয়ে পথ চলতে ছাতার মতো সঙ্গী আর নেই। ছাতা মানেই ভরসা, নিশ্চিন্তি আর আগলানোর অনুষঙ্গ। অভিভাবকস্থানীয় কেউ মারা গেলে আমরা বলি, ‘আহা, মানুষটা বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছিলেন,’ অথবা ‘মাথার উপর থেকে ছাত সরে গেল!’ এই ছাত, বা ছাদ প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃত বা তৎসম ‘ছত্র’ শব্দ থেকেই উদ্ভূত, ছাতা-র উৎসও একই। ছাতার মতো গোল ঘেরের ছায়া দেয় বলেই গাছটার নাম ছাতিম। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, “তোমার পথে বিছায় ছায়া ছাতিম ডালের ছাতা।”
আমাদের বঙ্গদেশে এখনও কয়েকটি প্রাচীন উৎসব প্রথা রয়ে গেছে, যার প্রধান উপকরণ ছাতা। প্রাচীনকালে মানভূম অঞ্চলের রাজারা ইন্দ্রদেবের আরাধনায় ছাতা-পরবের আয়োজন করতেন, যার সঙ্গে ভারতীয় পুরাণ, লোককথা, ফসলি সন ও আঞ্চলিক ইতিহাস ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। বিগত প্রায় ৫০০ বছর যাবৎ প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ দিন, ৩১ ভাদ্র, অনুষ্ঠিত হয় ছাতা-পরব। প্রাচীন প্রথা মেনে পঞ্চকোট রাজপরিবারের সদস্যদের হাতে এক বিশাল সাদা ছাতা খোলার মধ্যে দিয়ে আজও এই উৎসবের সূচনা হয়। ছাতাপরবে যে ছাতাটি রাজা উত্তোলন করেন, তা ইন্দ্রদেবের ছাতা। একটা বড় শালকাঠকে চেঁছে পরিষ্কার করে তার মাথায় বাঁশের গোলাকার ছাতা তৈরি করে কাপড় দিয়ে ছাতাটি মুড়ে দেওয়া হয়। যেখানে ছাতা উত্তোলন করা হবে, সেই স্থানকে ছাতাটাঁড় বলে। এই দিন রাজা ঘোড়ার পিঠে চড়ে, রাজবেশে সপার্ষদ ছাতাটাঁড়ে আসেন। তার পর পুরোহিত ইন্দ্রদেবের পুজো করেন। এর পর রাজা আনুষ্ঠানিক ভাবে ছাতা উত্তোলন করেন। পরদিন ছাতা নামানো হয়। প্রচলিত লোকবিশ্বাস অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখে রোহিণী নক্ষত্র উদয়ে বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রদেবের মর্ত্যে আগমন। পৃথিবীকে সুজলা-সুফলা করে ভাদ্রপূর্ণিমার দিন তিনি স্বর্গে ফিরে যান। তার ন’দিন পর কৃষ্ণা অষ্টমীতে ইন্দ্রদেবের সম্মানে ছাতা তোলা হয়। ছাতা-পরব আসলে শস্যের উৎসব।
শৈশবে দাদার সাইকেলের সামনের রডে বসে ঘুরতে যাওয়ার বায়না করতাম, বট-অশ্বত্থের কোলে ছোট্ট ছোট্ট ছাতা দেখে কী আহ্লাদই না হত, দাদা বলত, ওগুলো ব্যাঙমশাইয়ের ছাতা। তার পর তো পড়ে ফেলেছি সুকুমার রায়ের ‘ছাতার মালিক’— “গালফোলা কোলা ব্যাঙ, পালতোলা রাঙা ছাতা/ মেঠো ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ, ছেঁড়া ছাতা, ভাঙা ছাতা।...” কত ব্যাঙের কত ছাতা! ভেবে অধীর হতাম, ব্যাঙমশাই কখন এসে বসবে ছাতার নীচে? ছাতার মালিক, ব্যাঙবাবুকে দেখার আশায় কত দুপুরবেলায় জানলার গরাদ ধরে অপলকে চেয়ে থেকেছি!
ছাতা নিয়ে কত যে কাহিনি! রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠেও বর্ষার সঙ্গে ছাতার সখ্য— “ঘন মেঘ বলে ঋ/ দিন বড় বিশ্রী।/ শ ষ স বাদল দিনে/ ঘরে যায় ছাতা কিনে।” আবার জুতো কিংবা ঝাঁটার মতো ছাতাও ব্যবহৃত হয়েছে অস্ত্র হিসেবে। পাঠশালের দুষ্টু পড়ুয়ার উদ্দেশে লম্বা লাঠির মতো কালো ছাতা হাতে শিক্ষকমশাইয়ের হুমকি, “আজ পিঠে ছাতার বাঁট ভাঙব!” আঁকশির মতো বাঁকানো সেই সব ছাতার বাঁট দিয়ে গাছের ডাল নুইয়ে ফুল তোলা চলত, পলায়মান ছাত্রের ঘাড় ধরে টেনে আনা যেত, এবড়ো-খেবড়ো মেঠো পথে হাঁটার ছড়ির কাজও চলত।
‘ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে বসে আছে ভোরের দোয়েল পাখি’ দেখে জীবনানন্দ যতটা আহ্লাদিত, ঘনঘোর বর্ষা উপেক্ষা করে আগত গৃহশিক্ষকের কালো ছাতা রবীন্দ্রনাথের মন ততটাই খারাপ করে দিত— “সন্ধ্যা হইয়াছে; মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে; রাস্তায় একহাঁটু জল দাঁড়াইয়াছে। আমাদের পুকুর ভরতি হইয়া গিয়াছে; বাগানের বেলগাছের ঝাঁকড়া মাথাগুলা জলের উপরে জাগিয়া আছে; বর্ষাসন্ধ্যার পুলকে মনের ভিতরটা কদম্বফুলের মতো রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছে। মাস্টারমহাশয়ের আসিবার সময় দু’চার মিনিট অতিক্রম করিয়াছে। তবু এখনো বলা যায় না। রাস্তার সম্মুখের বারান্দাটাতে চৌকি লইয়া গলির মোড়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছি। ... এমন সময় বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা যেন হঠাৎ আছাড় খাইয়া হা হতোস্মি করিয়া পড়িয়া গেল। দৈবদুর্যোগে-অপরাহত সেই কালো ছাতাটি দেখা দিয়াছে।... ভবভূতির সমানধর্মা বিপুল পৃথিবীতে মিলিতেও পারে কিন্তু সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আমাদেরই গলিতে মাস্টারমহাশয়ের সমানধর্মা দ্বিতীয় আর কাহারো অভ্যুদয় একেবারেই অসম্ভব।”
ছাতার ব্যবহার যে কত প্রাচীন, তা বলা কঠিন। ছাতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘আমব্রেলা’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষার মূল শব্দ ‘আমব্রা’ থেকে, যার অর্থ ‘ছায়া’। প্রায় চার হাজার বছর আগের গ্রিস ও চিন দেশের চিত্রকর্মে ছাতার দেখা মিলেছে। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-২৪০০ অব্দের মিশরীয় চিত্রলিপি, সমাধি ও মন্দিরে আঁকা ছবিতে রাজা ও দেবতাদের মাথার উপরে চারকোনা সমতল ছাতার ব্যবহার দেখা গিয়েছে।
এর কয়েক শতক পর মেসোপটেমিয়া (বর্তমানে ইরাক) অঞ্চলে রাজছত্র আবিষ্কার হয়। টাইগ্রিস নদীর তীরে প্রাচীন আসিরিয়া নগরের নানিভে এক খোদাইচিত্রে দেখা যায়, রাজার মাথার উপর গোলাকার একটি ছাতা ধরে রাখা হয়েছে।
এক সময় চিনা রাজদরবারগুলোতে অসংখ্য ছাতার ছবি আঁকা থাকত। ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে পরিব্রাজক মার্কো পোলো গিয়েছিলেন কুবলাই খানের দরবারে। সেখানে তিনি দেখেছেন, সেনাপতির মাথার উপর সম্মানসূচক ছাতা মেলে ধরা হয়েছে। চিন থেকেই রাজছত্রের ব্যবহার জাপান এবং কোরিয়ায় চালু হয়। জাপানে ও কোরিয়ায় কয়েক শতক ধরে কেবল রাজারাই ছাতা ব্যবহার করতে পারতেন। রাজার ছবি আঁকাও ছিল নিষিদ্ধ। ঘোড়ার উপর রাজছত্রের ছায়া এঁকে রাজার উপস্থিতি বোঝানো হত। চিনে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে ছেলের বাড়ি থেকে তত্ত্বে যেত লাল টুকটুকে একটি ছাতা। সম্মত হলে কনেপক্ষ সেই ছাতাকে উঁচু জায়গায় টাঙিয়ে দিত, যাতে দূর থেকে চোখে পড়ে।
আফ্রিকা মহাদেশেও ছিল রাজছত্রের প্রচলন। ইথিয়োপিয়ার দ্বাদশ শতকে আঁকা ছবি ও প্রাচীন গ্রন্থে, বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতার রচনাতেও আছে রাজছত্র ব্যবহারের কথা। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে রচিত বৌদ্ধদের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষে ছাতার প্রচলন সম্বন্ধে জানা যায়। ভারতীয় রাজাদের মধ্যে রাজছত্র ব্যবহার ছিল ঐতিহ্যের অংশ। খ্রিস্টীয় নবম শতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজছত্রের প্রসার ঘটে। কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং জাভার অভিজাত সম্প্রদায় রাজছত্র ব্যবহার শুরু করেন।
পারস্যের পর্যটক ও লেখক জোনাস হ্যানওয়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগাল থেকে প্রথম ইংল্যান্ডে ছাতা নিয়ে আসেন। তিনি ছাতাকে নিত্যসঙ্গী করে নিয়েছিলেন। লোকে ঠাট্টা করত। কিন্তু তিনি তাদের বোঝাতেন যে, বাদলা দিনে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করার চেয়ে একটি ছাতা ব্যবহার করা অনেক সাশ্রয়ী। মানুষ ক্রমে ছাতার উপকারিতা বুঝল ও নারীপুরুষ নির্বিশেষে ছাতা জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ইউরোপে ছাতার ব্যবহার শুরু হয় ফ্যাশন হিসেবে। অভিজাত মহিলারা প্যারিস থেকে সিল্ক ও দামি ঝালর বসানো লেসের ছাতা আনতেন, যার হাতলে ব্যবহৃত হত এনামেল। চিনারা অবশ্য প্রথম দিকে ছাতা বানিয়েছিল কাগজ দিয়ে। ছাতার গায়ে মোম বা বার্নিশ মাখিয়ে জল-নিরোধক করেছিল।
বিশ্বের প্রথম ছাতার দোকান ‘জেমস স্মিথ অ্যান্ড সন্স’ চালু হয় ১৮৩০ সালে। লন্ডনের ৫৩ নিউ অক্সফোর্ড স্ট্রিটে এই দোকান আজও চালু আছে। ছাতা আবিষ্কারের কাহিনি অনেক পুরনো হলেও অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ছাতার আকৃতি ছিল অনেক বড়। কাঠের বা তিমি মাছের কাঁটা দিয়ে তৈরি রড ও সোনা, রুপা, চামড়া, বিভিন্ন প্রাণীর শিং, বেত ও হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি প্রায় দেড় মিটার লম্বা হাতলওয়ালা একটি ছাতার গড় ওজন হত আনুমানিক চার-পাঁচ কেজি। ১৮৫২ সালে স্যামুয়েল ফক্স স্টিলের হালকা রড দিয়ে রানি ভিক্টোরিয়ার জন্য ছাতা তৈরি করেন। ইংল্যান্ড, বিশেষ করে লন্ডনে খুব বৃষ্টি হয়। এ জন্য লন্ডনকে ছাতার শহর বলা হয়। এক সময় বিশ্বের অনেক দেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে অনেক কম খরচে ছাতা তৈরি করত।
১৮৫২ সালে স্বয়ংক্রিয় সুইচের সাহায্যে ছাতা খোলার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন গেজ। ১৯২০ সালে প্রথম ফোল্ডিং ছাতা তৈরি করেন জার্মানির হ্যানস হাপট। ১৯৬০ সালে বানানো হয় পলিয়েস্টার কাপড়ের ছাতা। এ ভাবে সময়ের হাত ধরে রং ও নকশার বৈচিত্রে ও প্রযুক্তিগত সুবিধা-সহ ছাতায় এসেছে নানা উৎকর্ষ। ‘দি আমব্রেলা স্কাই’ প্রকল্পের আওতায় রোদ-বৃষ্টি বা যে কোনও প্রতিকূল আবহাওয়ায় মানুষের পথ-চলাকে আরামদায়ক করে তুলতে ২০১২ সালে পর্তুগালের অ্যাগুয়েডা শহরের পথে পথে শত শত রঙিন ছাতা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। রঙবেরঙের ছাতায় ঢাকা আলো-ছায়াময় সে সব রাস্তায় হাঁটতে সমগ্র বিশ্বের বহু পর্যটক আসেন।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ছাতা তৈরি হয় ‘ছাতার রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত চিনের সোংজিয়া শহরে। এখানে এক হাজারেরও বেশি ছাতার কারখানায় এক জন কারিগর দিনে ৩০০টির বেশি ছাতা তৈরি করেন। বিদেশি ছাতার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় চাইনিজ় ছাতা ছাড়াও বার্মা, তাইল্যান্ড, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ান ছাতারও চাহিদা আছে। কেবল বৃষ্টি বা রোদ থেকে বাঁচতে নয়, ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে নানা রং, নকশা ও কাপড়ের ছাতা। বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারের উপর নির্ভর করে ছাতার দাম।
কয়েক বছর আগে কুমিরের চামড়া দিয়ে জল-নিরোধক ছাতা বানিয়ে সারা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ইটালির একটি সংস্থা ‘বিলিয়নেয়ার কুচার’। অ্যাঞ্জেলো গালাসো-র নকশা করা এই ছাতার দাম ধার্য করা হয়েছিল ৪০ লক্ষ টাকা। তবে এর অনেক আগেই, খ্রিস্টপূর্ব ১১ শতকে চিনে জলনিরোধক চামড়ার ছাতার জন্ম হয়েছিল। অত্যন্ত দামি সেই ছাতা ব্যবহার করার অধিকার ছিল কেবল রাজপরিবার ও অভিজাত মানুষদের।
পৃথিবী যতই জেটগতিতে ছুটুক না, কিছু কিছু বস্তুর থাকে এক সাবেকি আবেদন, ছাতা যার অন্যতম। আজও অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর নেওয়ার সময় বিদায়ী-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে উপহার দেওয়া হয় একটি ছাতা। উপহারটি প্রতীকী। তুমি এত দিন প্রতিষ্ঠানকে তোমার শ্রম দিয়ে লালন করেছ, প্রতিষ্ঠানও তোমাকে দিয়েছে জীবনযাত্রা নির্বাহের নিশ্চিন্তি ও নিরাপত্তা। ছাতাটি সেই পারস্পরিক নির্ভরতা ও পরিপোষণের প্রতীক। যোগনিদ্রায় অনন্তশায়ী নারায়ণেরও নিশ্চিন্ত বিশ্রামের জন্য প্রয়োজন হয় একটি ছত্রছায়ার। তাই পালনকর্তার মাথায় বিকশিত পদ্মের মতো পঞ্চফণা বিস্তার করে ছায়া দেন শেষনাগ বাসুকী। ভালবাসায় আগলে রাখা এ-হেন ছাতাকে ভাল না বেসে কি পারা যায়? “পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া হ্যায়, পেয়ার সে ফির কিউ ডরতা হ্যায় দিল?”— রাজ-নার্গিসের এই বিখ্যাত প্রেমের গানের দৃশ্যায়নে ছাতাও যে অন্যতম চরিত্র, সে কথা কি অস্বীকার করা সম্ভব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy