খালেদ চৌধুরী।
এক দিন কথার চাপানউতোরে শম্ভু মিত্রকে বললেন, ‘‘এই যে ইলিশ মাছ খান না, সেটায় কোনও ক্ষতি হয়? কেউ বলে যে অন্যায় কাজ করছেন?’’ কথায় কথায় খালেদ চৌধুরী ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের কাজকর্ম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। খালেদ চৌধুরীর যুক্তি ছিল, তাঁর নাম ছাপার অক্ষরে না থাকলে ‘বহুরূপী’র কোনও ক্ষতি হয়? শম্ভু মিত্রের বক্তব্য ছিল, খালেদ চৌধুরীর নাম না থাকলে অন্য কেউ তো মাথায় উঠে যেতে পারে! তাঁর কথায়, ‘‘ব্যালান্সের জন্য তোমার নাম দরকার।’’ সেটা আর হয়ে ওঠেনি। এ সব শুনতে শুনতে তাঁর জেদের প্রসঙ্গ তুলতে, একটু উদাসী হয়ে অন্য দিকে চেয়ে রইলেন। চুরানব্বই বছর বয়স, কিন্তু স্মৃতি সতেজ। ডায়ালিসিসে দিনের পর দিনের যন্ত্রণার মধ্যেও অটুট নির্লিপ্তি। তাঁর জন্মশতবর্ষের কয়েক বছর আগেও জীবনচর্যার সেই নির্মোহ ভাব। অথচ কত টালমাটালের মধ্যেও বহুবর্ণী ছিল তাঁর জীবনের অন্বেষণ। পরিবার-পরিজন বেষ্টিত সমাজজীবনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তাঁর একক জীবনের যাত্রাপথ। স্বতোৎসারিত ও ব্যতিক্রমী ছিল তাঁর জীবন-পরিক্রমণ।
তৎকালীন অসমের গ্রাম থেকে সিলেট এবং পরে শিলং হয়ে শিল্পশিক্ষার আকুতিতে কলকাতায় ঠাঁই নিলেন যুবা বয়েসে। এর অনেক আগেই বাড়িছাড়া। ১৯১৯ থেকে ২০১৪-এর জীবনকালে তাঁর নামের পরিচয়ও ধাঁধার মতো। মা হেমনলিনীর মামা, প্রশাসক ও ব্রতচারীর পুরোধা গুরুসদয় দত্ত নাম রেখেছিলেন চিরকুমার। সে নাম তো বটেই, তার পর বাড়ির দেওয়া চিররঞ্জন দত্তচৌধুরী নামটাও পাল্টে ফেলেছেন। কৈশোরকালেই যে বাড়ি তাঁর ‘নিজের’ হয়ে ওঠেনি। মায়ের মৃত্যুর পর শেষ আশ্রয় বাড়ির কাজের মানুষ রমণীও বাড়ি ছেড়ে যাওয়াতে, বাড়ির প্রতি টানও নির্মূলপ্রায় হল। বাড়িতে তখন বৈমাত্রেয় দাদা-দিদিরা আর নিজের ভাইবোন। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় দেখা, তাঁর ছোট্ট বোন ফোকলা দাঁতের পারুলের জন্য মায়াটান শেষকালেও অন্তর ছুঁয়ে ছিল। তাঁর পালিয়ে বেড়ানো সেই কিশোর বয়সেই শুরু। নানা আশ্রয়ে নাম পাল্টে হল রহমান, করিম, ইউসুফ, আব্বাসউদ্দিন, এমন কত। মুসলমান পরিবারে থেকে আচার-আচরণে মিশে কৃতজ্ঞতা তখন মন জুড়ে। এক সময় দত্তচৌধুরী পদবিও পাল্টে ফেললেন। এক মৌলবির কাছ থেকে তখন জেনে নিয়েছেন, ‘খালেদ’ অর্থ চিরস্থায়ী। পরে পদবির ‘দত্ত’ ছেঁটে শুধু চৌধুরী রাখলেন। সেই প্রথম ১৯৪৩-এ কমিউনিস্ট পার্টির এক সংগঠকের অনুরোধে স্ট্যালিনের একটা ছবি এঁকে নীচে সই করলেন ‘খালেদ’।
টানাপড়েনের জীবন শৈশব থেকেই। ১৯৪৪-এ কলকাতায় প্রথম এসে মহম্মদ আলি পার্কে দেখেছিলেন ‘নবান্ন’। পরের বছর সিলেটের চা-ব্যবসায়ী অজিত সিংহের বদান্যতায় পাকাপাকি ভাবে যখন কলকাতায় পৌঁছলেন, পকেটে ৬৪ টাকা আর হাতে ফুল-আঁকা টিনের বাক্স। গোয়াবাগান কমিউন-এ মাসিক কুড়ি টাকা সুধী প্রধানের হাতে দিয়ে দিন গুজরান চলত। এমন নানা অনুভূতির কথা বলেছেন প্রদীপ দত্তকে। তাতে, জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘লোকায়ত থেকে রূপায়ত’ বইতে। তাঁর সম্পর্কে জানাতেও তিনি ছিলেন কৃপণ। তবুও, দু-এক ক্ষেত্রে উৎসাহীরা সফল হয়েছেন, তাতে তাঁর নিটোল স্মৃতির প্রখরতায় বিস্ময় জাগে!
মঞ্চশিল্প: শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’। মঞ্চ ও সঙ্গীত, দুয়েরই দায়িত্বে ছিলেন খালেদ চৌধুরী
বাবার নিষ্ঠুরতা, অস্তিত্বের দোদুল্যমান শৈশব-কৈশোরের কঠিন যাপনের মাঝেই নৌকা বাইচের গানের সুর ভিতরে তখন ঠাঁই নিচ্ছে— ‘ঘুম ঘুম করেলো ঘুমে মোরে ছাড়ে না’। নৌকাপুজো, পদ্মপুরাণের পালা, ধামাইল নাচ দেখতে ছুটছে খুদে বালকটি, কৌতূহল প্রবল। এই মাটি-হাওয়ার টানের তীব্র উৎসারে পরবর্তী কালে পৃথিবীর লোকসঙ্গীতের মধ্যে ঐক্যটা কোথায় তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন। গণনাট্য সংঘের সমবায়ী কর্মী হয়ে ঘুরেছেন বৃহত্তর বাংলার প্রত্যন্তে। নানা বিষয় প্রত্যক্ষ করেছেন, কত গান ক্যাসেটবন্দি হয়েছে। ক্ষেত্রসন্ধান আর অনুভবী চোখে দেখার তীক্ষ্ণতায় মৌলিকতা তৈরি হয়েছে। তাই বাউল কি লোকসঙ্গীত, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এই গুহ্য ধর্মচারণার জন্যই বাউলগান তার সব সাংগীতিক সম্পদ নিয়েও এক বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। এ গান একটা সম্প্রদায়ের। এ গানের আবেদন সর্বজনীন হলেও গ্রহণযোগ্যতার অভাবে লোকজীবনাশ্রয়ী অনেক উপাদান নিয়েও একে পুরোপুরি লোকসঙ্গীত বলা চলে না।’ ‘লোকসংগীতের প্রাসঙ্গিকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ বইয়ে তাঁর এই অভিমত প্রকাশ করেছেন। ‘থিয়েটারে শিল্পভাবনা’ ও ‘স্মৃতির সরণি’ তাঁর অন্যতম বই। আর পত্রপত্রিকায় লেখার বেশির ভাগই থিয়েটারের মঞ্চকাঠামো, আবহ, সঙ্গীত, দৃশ্যকল্প ও নাট্যব্যক্তিত্বদের নিয়ে। শম্ভু মিত্র যে ‘রক্তকরবী’ নাটকের সূত্রে তাঁকে বহুরূপী-তে টেনে নিলেন কারণ তিনি আঁকতে পারেন, যে কোনও বাজনা বাজাতে পারেন, গান বোঝেন আর তাঁর ভিতরে রয়েছে উদ্ভাবনী নিত্যনতুনের ক্ষমতা। ভারতীয় মঞ্চনাটকে তাঁর অবদান উজ্জ্বল হয়ে আছে। ‘পুতুলখেলা’, ‘ডাকঘর’, ‘কালের যাত্রা’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘কর্ণাবতী’, ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ ইত্যাদি প্রায় একশোটি নাটকে তাঁর মঞ্চবিন্যাস উল্লেখযোগ্য। হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তাপস সেন, ঋত্বিক ঘটক, কামরুল হাসান, নির্মলেন্দু চৌধুরী, চিত্তপ্রসাদ— এমন বহু উদীয়মান প্রতিভার সঙ্গে কাজের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন। দেখার চোখ আর নিজের মতো করে সৃষ্টি তাঁর সহজাত। কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক কাজকর্মেও মতবাদের আবেষ্টনে বন্দি হননি তিনি।
বিস্তীর্ণ বাংলায় ঘোরাঘুরিতে দেখেছেন, এঁকেছেন তাঁর চরিত্রদের। রেখাঙ্কনে তাঁর সিদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা অবশ্য শুরু আগেই। ১৯৪৬ থেকে পরবর্তী ষাট বছরে প্রায় চার হাজার প্রচ্ছদ তৈরি করেছেন। এগুলো যদিও তিনি জীবনধারণের কাজ বলে মনে করতেন। ১৯৬৫ থেকে ‘ফোক মিউজিক অ্যান্ড ফোকলোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ গঠন করলেন, আরও সংগঠিত ভাবে লোকায়ত জীবনের সুর অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কথা, সুর-তালের গভীর অনুসন্ধানে তিনি তখন ব্যস্ত। তীজন বাইয়ের গান রেকর্ড করতে ভিলাইতে যাচ্ছেন আবার খুঁজে খুঁজে রেকর্ড করছেন অনন্তবালা বৈষ্ণবীর গান। বলতেন, তাঁদের আগ্রহের কাজ তো সম্ভাব্য আদি রূপকে নথিবদ্ধ করা। খালেদ চৌধুরীর আগ্রহের ধরনই ছিল সংরক্ষণের কাজে, প্রসারের কাজে নয়। এ সব বোঝাতে কখনও সিলেটের শেখ ভানুর উনিশ শতকীয় দেহতত্ত্বের গানের কথা ও সুরের উপমা তুলে ধরতেন: ‘নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে রে ভ্রমরা/ নয় দরজা করি বন্ধ লইয়ো ফুলের গন্ধ হে।’
তাঁর এই বহুবিচিত্র আগ্রহের জগৎ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলে বলতেন, ‘‘আমার একটা শরীরের মধ্যে গোটা চারেক পকেট আছে— একটা ফোক পকেট, একটা প্রচ্ছদ পকেট, একটা নাটক পকেট, একটা হচ্ছে বিবিধ। পাবলিশারের লোক জানতই না আমি নাটকের কাজ করি, আবার নাটকের লোক জানতই না যে আমি অন্য কাজ করি। তখন ওই পকেটগুলো বন্ধ করে দিতাম। কোনও অসুবিধা হয় না।’’ নিজের মতো করে সরল যাপনের মধ্যে তাঁর অর্জন তাঁকে দৃঢ়চেতা করেছে। রসিকতা করে যদিও বলতেন, ‘‘আমি তো জোগাড়ে!’’ এই নির্মোহ দৃষ্টিতেই বর্তমানের প্রকট আত্মপ্রচার তাঁর চোখে বেশি করে ধরা পড়ত। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে সিনেমার শিল্পী ও পরিচালকের আলোচনা শুনে তাঁর বিস্ময় উক্তি ছিল, ‘‘ওঁরা তো নিজেরাই মুগ্ধ— যাঁরা তৈরি করেছেন!’’ চটজলদি, সহজলভ্য বা রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধাবাদী আশ্রয়ে আলোকিত হওয়ার বাসনা কোনও দিন তাঁর ভাবনায় আসেনি। সৃষ্টিশীল ভাবনাই জুড়ে ছিল জীবন।
শেষ দশ বছরে কলকাতার ফার্ন রোডের যে বাড়িতে তাঁর আশ্রয় ছিল, সেখানে তাঁরই আঁকা পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ের একটা রঙিন ছবি ঝুলত। রুক্ষ পাথুরে আবহে রঙিন আভাস প্রতীকী বলেই মনে হত। এই অপরিসর ঘরে বসেই গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ স্মারক। আগেই পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি লিট, সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, মধ্যপ্রদেশ সরকারের ‘কালিদাস সম্মান’। ‘শহিদের ডাক’ নিয়ে আইপিটিএ দলের সঙ্গে ১৯৪৭-এ গিয়েছেন অসম। তখন আস্তানা ছিল নৃবিজ্ঞানী ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের পাম প্লেস-এর বাড়িতে। সেপ্টেম্বরের বন্যার পরে এসে বন্ধ দরজা খুলে দেখলেন আগের সব সংগ্রহের ধ্বংসস্তূপ। তাঁর এই ঠাঁই বদলানো জীবনে, জন্মশতবর্ষ স্মরণে আমাদের কাছে
এক স্বতন্ত্র দিশা উঠে আসে। এক মরমিয়া জীবনচর্যার সাংস্কৃতিক পাঠক্রম তিনি উপহার দিয়ে গিয়েছেন আমাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy