মাত্র তিন ঘণ্টার ঘুম! তাও অসুস্থ শরীরে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে দিবানিদ্রা! সেই ঘুমের মধ্যে দেখলেন স্বপ্ন, স্বপ্নের মধ্যেই লিখে চললেন কবিতা। স্বপ্নেই প্রায় তিনশো লাইন লেখা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ঘুম থেকে জেগে উঠে কবি দেখলেন, মনে আছে সবটাই। তড়িঘড়ি বসে লিখতে শুরু করেছিলেন। দ্রুত লেখা এগোচ্ছিলও, কিন্তু বিধি বাম। পঞ্চাশ-বাহান্ন লাইন মতো লেখার পরই বাড়িতে এক আগন্তুকের আগমন। কথা বলতে বলতে কেটে গেল ঘণ্টাখানেক। পরে অতিথি চলে গেলে যখন কবি ফের বসলেন অসমাপ্ত কবিতার বাকি অংশের কায়া নির্মাণে, ঘটে গেল ছন্দপতন। অসহায় কবি আবিষ্কার করলেন, স্বপ্নের খুঁটিনাটি মিলিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতিতে! তিনি আর সেই সুন্দর স্বপ্নদৃষ্ট কবিতার অবয়ব কিছুতেই মনে আনতে পারলেন না।
অসমাপ্ত সেই কবিতাটি ‘কুবলা খান’। আর স্বপ্নদ্রষ্টা কবি, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ! ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম রোম্যান্টিক কবি। ১৭৯৭ সালে রচিত সেই কবিতার এ বছর ২২৫ বছর। পরবর্তী কালে বিশিষ্ট আমেরিকান অধ্যাপক ও সাহিত্য সমালোচক, এক বার ‘কুবলা খান’ পড়াতে গিয়ে ছাত্রদের বলেছিলেন, সাহিত্যের ক্ষতি করার জন্য যদি কখনও কাউকে ফাঁসি দেওয়ার আইন হয়, তা হলে প্রথমেই আসবে পোরলকের সেই আগন্তুকটির নাম, যাঁর আকস্মিক আগমনে একটি অনবদ্য কবিতার অঙ্গহানি হয়েছিল। পরবর্তী কালেও, ‘ম্যান ফ্রম পোরলক’ শব্দবন্ধ দিয়ে বোঝানো হয় এমন কোনও অবাঞ্ছিত অতিথির কথা, যার অনুপ্রবেশে সৃজনশীল কাজকর্মের সর্বনাশ হয়।
১৭৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে কোলরিজ ছিলেন ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে। সে সময় তিনি কাছাকাছি কোয়ান্টক পাহাড়ে বন্ধু কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের বোন ডরোথির সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে দীর্ঘ সময় কাটাতেন। তাঁর এই ভ্রমণপথটির নাম বর্তমানে ‘কোলরিজ ওয়ে’। ১৭৯৭ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি তিনি চলে গিয়েছিলেন পোরলক এবং লিনটনের মধ্যবর্তী এক নির্জন স্থানে। সেখানে কোলরিজ তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন, তাঁর শরীর খুব একটা সুস্থ নয়। খুব ভুগতেন গলার সমস্যায়। ডাক্তাররা নির্ভেজাল বিশ্রামের জন্য আফিমের দাওয়াই দেন। সে দিন দুপুরে আফিম সেবনের পর একটি চেয়ারে বসে কোলরিজ, স্যামুয়েল পারচ্যাস-এর ‘পারচ্যাস হিজ় পিলগ্রিমেজ’ বলে একটি বইয়ে কুবলা খান সম্পর্কে পড়ছিলেন। পড়তে পড়তেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সেই ঘুমেই স্বপ্ন, ঘুম থেকে উঠেই স্বপ্নস্মৃতি থেকে লেখা ‘কুবলা খান’। মাঝে অতিথির উপদ্রবে অনেকটাই বিস্মরণ। ১৮১৬ সালে প্রকাশিত কাব্যসংগ্রহ ‘ক্রিস্টাবেল, কুবলা খান: আ ভিশন, দ্য পেনস অব স্লিপ’-এর ভূমিকায় কোলরিজ লিখেছেন কবিতাটি রচনার ইতিবৃত্ত। রচনাকালেই অনেকটা হারিয়ে গেল স্বপ্নের কবিতা। বিশ্ববাসী পেল শুধু ওই বাকি অংশটুকুই। সমালোচকেরা অবশ্য ওটুকু পেয়েই উচ্ছ্বসিত! কবিতাটি বিশ্বসাহিত্যের একটি মাইলফলক। কিন্তু সেটুকুও তো পাওয়া যেত না! কবিতা অসম্পূর্ণ বলে কোলরিজ সেটি প্রকাশও করতে চাননি। কী মনে হতে এক বার কবিতাটি পড়ে শোনাতে ইচ্ছে হয় আর এক বিশিষ্ট কবি লর্ড বায়রনকে। তারিখটা ছিল ১৮১৬ সালের ১০ এপ্রিল। কবিতাটি শুনে মুগ্ধ বায়রন প্রকাশের জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করেন। তাঁর আগ্রহেই ১৮১৬ সালের ১২ এপ্রিল জন মুর নামে এক প্রকাশকের সঙ্গে কবিতাটি প্রকাশের ব্যাপারে ৮০ পাউন্ডের বিনিময়ে চুক্তি করেন কোলরিজ। রচনার প্রায় দু’দশক পর কবিতাটি প্রকাশিত হয়।
ইংরেজি সাহিত্যে রোম্যান্টিক যুগকে যে ক’জন কবি অমর করে গিয়েছেন, কোলরিজ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ‘ক্রিস্টাবেল’, ‘দ্য রাইম অব দ্য এনশিয়েন্ট মেরিনার’, ‘কুবলা খান’-এর মতো কবিতা তাঁকে বিশ্বসাহিত্যে অমরত্ব দিয়েছে।
তবে কোলরিজ স্বভাবে ছিলেন অলস প্রকৃতির। করছি, করব— এই ছিল তাঁর মানসিকতা। সব কিছুই আগামী কালের জন্য রেখে দিতে ভালবাসতেন, নিজেকেই নিজে বলতেন ‘টুমরোয়ার’। সাংসারিক জীবনেও খুব যে সুখী ছিলেন তা নয়। এক সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করেন, যাঁর সঙ্গে তাঁর মনের মিল হয়নি। জানা যায়, পুত্র হার্টলেকে কোলরিজ খুব ভালবাসতেন, তাই মুখ বুজে সংসার করে গিয়েছেন। এ সবের প্রতিফলন মেলে কোলরিজের লেখা ‘ডিজেকশন: অ্যান ওড’ কবিতায়।
কোলরিজ খুব সুন্দর কথা বলতে পারতেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থের বোন ডরোথি এক বার বলেছিলেন, কোলরিজের কথা শুনলে মনে হয় যেন তাঁর আত্মা ও মন এক সঙ্গে কথা বলছে! এই ডরোথি এবং তাঁর দাদা ওয়ার্ডসওয়ার্থের সান্নিধ্য কোলরিজের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দু’জনের বন্ধুত্বের সুপ্রভাবে কোলরিজ তাঁর আলস্য ত্যাগ করে সাহিত্য ও কর্মের মধ্যে জীবনের স্বাদ খুঁজে ফিরেছিলেন। সে সময়ে কোলরিজ কাগজে লিখেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। আজ থেকে ২০৫ বছর আগে প্রকাশিত তাঁর সাহিত্য-সমালোচনাগ্রন্থ ‘বায়োগ্রাফিয়া লিটারারিয়া’ গ্রন্থ থেকে তাঁর সাহিত্য ভাবনা ও দর্শনের খোঁজ মেলে।
স্বপ্নদ্রষ্টা এই কবি মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে আরও বড় এক স্বপ্নের জগতে পাড়ি দেন, তারিখটি ছিল ১৮৩৪ সালের ২৫ জুলাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy