Advertisement
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ছিলেন এয়ারফোর্সে, সেখান থেকেই সুযোগ পেলেন নাসায়। যুদ্ধবিমানের পরই হাতে এল কম্যান্ড মডিউল কলম্বিয়া। আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন যখন চাঁদের মাটিতে, তখন তিনি প্রদক্ষিণ করছেন চাঁদের কক্ষপথ। চাঁদে নামা যাবে না জেনেই ইতিহাসের সঙ্গী হয়েছিলেন মাইকেল কলিন্স।
Bengali Story

চন্দ্রযানের সারথি ছুঁতে পারেননি চাঁদ

অ্যাপোলো-১১-এর ঐতিহাসিক পাইলট মাইকেল কলিন্স সে সময় চাঁদের কক্ষপথ থেকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন অসংখ্য দুর্মূল্য ছবি।

অভিযাত্রী: পাইলট মাইকেল কলিন্স।

অভিযাত্রী: পাইলট মাইকেল কলিন্স। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমন্স

শুভজিৎ বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২২ ০৫:১১
Share: Save:

তারিখটি ছিল ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। চাঁদের মাটিতে নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ় অলড্রিন হেঁটে বেড়াচ্ছেন। তখন ‘কমান্ড মডিউল কলম্বিয়া’-কে চাঁদের কক্ষপথে চালাচ্ছেন পাইলট মাইকেল কলিন্স। চাঁদের কাছে গিয়েও চাঁদকে ছোঁয়া হয়নি তাঁর। মহাকাশে তখন তিনি একেবারেই একা, নিঃসঙ্গ।

‘ইগল’ নামক স্পেসক্র্যাফ্ট-এ চেপে আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন কলম্বিয়ায় ফিরে আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত চাঁদকে ১২ বার প্রদক্ষিণ করেন মাইকেল। তখন শুধু কানে আসছিল মৃদু একঘেয়ে যান্ত্রিক শব্দ, আর কিছু নয়। ওই সময়ের অনুভূতি মাইকেল কলিন্স বর্ণনা করেছিলেন তাঁর ‘ক্যারিয়িং দ্য ফায়ার’ নামের আত্মজীবনীতে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি স্মৃতিচারণা করেছেন, প্রতি বার তিনি যখন চাঁদের উল্টো পিঠে যাচ্ছিলেন, তখন পৃথিবীর সঙ্গে সব যোগাযোগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল— ‘আমি তখন প্রকৃত অর্থেই একা। যে কোনও জীবন্ত সত্তার সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন।’ সে সময় মাইকেল কলিন্স বুঝেছিলেন যে, তাঁকে এ রকমই নিঃসঙ্গ থাকতে হবে চাঁদের এই ঐতিহাসিক অভিযানে। যখন তিনি অ্যাপোলো-১১-এর অভিযাত্রী নির্বাচিত হলেন, কলিন্সকে বলা হয়েছিল, তাঁর দুই সঙ্গী যখন ঘুরে বেড়াবে চাঁদের মাটিতে, তখন তাঁকে একাই ঘুরতে হবে চাঁদের কক্ষপথে। তিনি কি তাতে হতাশ? কলিন্স অকপটে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি যদি বলি যে তিনটি সিটের মধ্যে আমার সিটটাই সবচেয়ে ভাল, তা হলে সেটা হয় মিথ্যে বলা হবে, নয়তো নেহাতই বোকার মতো কথা হবে। কিন্তু এই অভিযানে তিনটি সিটই গুরুত্বপূর্ণ। আমিও চাঁদের মাটিতে নামতে চাই, কে না চায়? কিন্তু এই সমন্বিত অভিযানের একটি অংশ আমি। সব কিছু সত্ত্বেও এ অভিযানে যেতে পেরে আমি খুশি। অভিযানের ৯৯.৯ শতাংশ পথ আমি যাব, পুরোটা নয়, তাতে আমি একটুও হতাশ নই।’

অ্যাপোলো-১১-এর ঐতিহাসিক পাইলট মাইকেল কলিন্স সে সময় চাঁদের কক্ষপথ থেকে ক্যামেরাবন্দি করেছেন অসংখ্য দুর্মূল্য ছবি। পরে সেগুলি নিয়ে নানা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছিল।

মাইকেল কলিন্সকে এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নাসার ঐতিহাসিক চন্দ্র অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য এক জন নভশ্চরের বিশেষ যোগ্যতা কী। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সব কিছুর আগে, আপনাকে সঠিক সময়ে জন্ম নিতে হবে।’ তিনি বলেন, চন্দ্র অভিযানের জন্য তাঁর বেশির ভাগ সহকর্মীর জন্ম ১৯৩০ সালের দুই বা তিন বছরের মধ্যে। ফলে রকেট যুগে তাঁরা একদম ঠিক বয়সে পৌঁছাতে পেরেছেন।

১৯৩০ সালের ৩১ অক্টোবর মাইকেল কলিন্সের জন্ম। জন্মস্থান ইটালির রোম। মার্কিন সেনা কর্মকর্তা জেমস লটন কলিন্সের চার সন্তানের মধ্যে মাইকেল কলিন্স ছিলেন দ্বিতীয়। মা ভার্জিনিয়া স্টুয়ার্ট। জন্মের পর থেকে ১৭ বছর বাবার চাকরির জন্য বিভিন্ন দেশ ঘুরতে হয়েছিল মাইকেল কলিন্সকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁরা সকলে ওয়াশিংটন ডিসি-তে চলে যান। সেখানেই ১৯৪৮ সালে স্কুল শেষ করেন কলিন্স।

১৯৫২ সালে তিনি মিলিটারি সায়েন্সে ব্যাচেলর’স ডিগ্রি নিয়ে বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। উন্নত ফাইটার বিমান চালনার প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে নেভাদা এয়ারফোর্সের ঘাঁটিতে পাঠানো হয়। পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। এর পর ১৯৫৪ সালে এফ-৮৬ ফাইটার স্কোয়াড্রনের দায়িত্বে পাঠানো হয় তাঁকে ফ্রান্সের ন্যাটো ঘাঁটিতে। সেখানে কাজ করতে করতে প্যাট্রিসিয়া ফিনেগান নামে অসামরিক মহিলাকর্মীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ও প্রণয় ঘটে। দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫৭ সালের ২৮ এপ্রিল। বিয়ের পর তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন।

কলিন্সকে এ বার প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিছু দিন পরই ১৯৬০ সালে তিনি এডওয়ার্ড এয়ারফোর্সের বেসে এক্সপেরিমেন্টাল টেস্ট পাইলট স্কুলে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে নাসা থেকে নভশ্চরের খোঁজ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আবেদন করেন কলিন্স। কিন্তু তাঁর আবেদন নাকচ হয়। পরবর্তী দফার বিজ্ঞপ্তি আবার প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে, ১৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে এ বার জায়গা পেলেন মাইকেল কলিন্সে। কলিন্সের বাড়ি ছিল অলড্রিনের বাড়ির কাছেই। তাই অলড্রিনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল কিছুটা নিবিড়। চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে ফিরে এসে যখন অলড্রিনের সঙ্গেদেখা হল কলিন্সের, গভীর আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। অলড্রিনের কপালে একটি চুম্বনও দিয়েছিলেন তিনি। আলিঙ্গন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন আর্মস্ট্রংকেও।

চাঁদের একেবারে কাছে গিয়েও চাঁদের মাটি ছুঁতে না পারার যন্ত্রণা ও আক্ষেপ তিনি ভুলতে পারেননি কোনও দিন। সেই কষ্ট বুকে নিয়েই তিনি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ২৮ এপ্রিল ২০২১। ক্যানসারের সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের পর ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন মাইকেল কলিন্স। টুইটারে মাইকেল কলিন্সের অফিশিয়াল অ্যাকাউন্টে এক বিবৃতিতে কলিন্সের পরিবার জানিয়েছেন, ‘মাইক সব সময়ই নম্র ও শান্ত ভাবে জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করেছিলেন। তিনি একই ভাবে তাঁর জীবনের শেষ চ্যালেঞ্জটিরও মোকাবিলা করেছেন।’

তথ্যসূত্র: ১. অ্যাপোলো-১১, ডেভিড হোয়াইট হাউস, আইকন বুকস, যুক্তরাজ্য (২০১৯),

২. ১৯৬৯: দ্য ইয়ার এভরিথিং চেঞ্জড, রব কার্কপ্যাট্রিক, স্কাইহর্স পাবলিশিং,যুক্তরাষ্ট্র (২০০৯), ৩. ক্যারিয়িং দ্য ফায়ার: অ্যান অ্যাস্ট্রোনটস জার্নি, মাইকেল কলিন্স, এফএসজি, যুক্তরাষ্ট্র (২০১৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Story
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE