ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক
কেমন আছ? জন্ম নিয়েছ আবার?’’
কালো জল আর জল পার করে দৃশ্যমান ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল রতন। আগে থেকে কিছু ভেবে আসেনি। হঠাৎ এমনিই বলল।
‘‘মাঝে মাঝেই তোমার কথা খুব মনে পড়ে।’’ হাতে ধরা দু’টো লুচি আর মিষ্টি সহ শালপাতার থালাটা নদীর ধারে নামিয়ে রেখে সিঁড়িতে বসে পড়ল সে। রতন সরকার। তার পর আচমকাই ডুকরে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতেই মনে পড়ল সেই জিনিসটার কথা।
আজ থেকে বছর তিন আগে যখন মা মারা গিয়েছিল, তখন চুল্লিতে ঢোকানোর আগে মায়ের শরীর থেকে জিনিসটা খুলে নিয়েছিল। ভেবেছিল স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রেখে দেবে। মায়ের শরীরে সেই জিনিসটা ছাড়া আর কিছু ছিল না নেওয়ার মতো।
রোগা, শুকিয়ে যাওয়া, অযত্ন লালিত একটা মরে যাওয়া শরীর নিয়ে শুয়ে ছিল মা। স্নান করিয়ে ঘি মাখিয়ে যখন তাকে আগুনে সঁপে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে, তখনও তার শরীরে জিনিসটা ছিল। শেষ মুহূর্তে খুলে নিয়েছিল রতন। তার পর মিনিট চল্লিশ। সব শেষ।
অগ্নিময় যাত্রাপথ পার করে মা যখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, যত ক্ষণ না পর্যন্ত অস্থিটুকু সংগ্রহ করার ডাক এসেছিল, জিনিসটা হাতে নিয়ে বসে ছিল রতন। উঠে আসার আগে একটা ঘেন্না এসে একেবারে জাপটে ধরল। মনে হল, এই আদিখ্যেতাটুকু সে না করলেই পারত।
তাই বলে কি জিনিসটাকে একেবারে ছুড়ে ফেলে দেবে! হাতের মুঠোয় ধরে থাকা জিনিসটা নদীতে ফেলতে গিয়েও এক বার থমকেছিল সে। তার চেয়ে বরং ওই যে প্রাচীন পাকুড় গাছের ডালে একটা অন্ধকার কোটর, একটু উঁচুর দিকের ডালে কষ্ট করে হাত বাড়িয়ে তার মধ্যে জিনিসটা রেখে দিয়েছিল। গাছের কোটরে কাক পাখিতে কত জিনিস এনে জমা করে, না হয় এটাও থাকল। আজ জিনিসটার কথা খুব মনে পড়ছে, আসলে মায়ের কথা মনে পড়ছে তো। মোবাইলের সামান্য আলোয় চারপাশ দেখে রতন।
সেই অন্ধকার গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিল। এত দিন পর জিনিসটা কি আর আছে? অল্প ভয়ও করছে। গাছের কোটরে সাপ থাকতে পারে। তবে এঁটোকাঁটা, হাড়, প্লাস্টিকের টুকরোর মাঝে আঙুল যখন স্পর্শ করল সেই জিনিসটাকে, তখন রতনের চিনতে অসুবিধা হল না।
দামি কিছু না। একটা মলিন হয়ে যাওয়া কালো ফ্রেমের চশমা। অনেক বেশি পাওয়ার। ইয়া মোটা মোটা দুটো কাচ লাগানো। চিরকাল মা’কে এই চশমা পরেই দেখে এসেছে সে। চশমাটার দিকে তাকালেই যেন মায়ের মুখটা স্পষ্ট দেখা যায়।
মা জীবনে রতনের কাছ থেকে কিছু চাননি। কেবল চশমার ডাঁিট ঢিলে হয়ে গেলে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘‘চশমাটা একটু টাইট করে এনে দিবি বাবা, নিচু হতে গেলেই খুলে পড়ে।’’ রতন দোকানে নিয়ে গিয়ে টাইট করে নিয়ে আসত। শেষ বার যখন ডাঁিটটা খুলে গেল, দোকানদার বলল, আর কিছু করার নেই। এ বারে চশমাটা পালটাতেই হবে। রতন একটা নিমের কাঠি দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে শেষ দিন অবধি এ ভাবেই চলেছিল। আজ কি মনে করে চোখ মুছে রতন এক বার চশমাটা
চোখে দিল।
এমনিতেই সামনেটা আলো-আঁধারিতে অস্পষ্ট হয়ে ছিল। হাই পাওয়ার-এর চশমা পরে একেবারে ঘোলাটে হয়ে উঠল। তবে সে ঘোলাটে ভাব বেশি ক্ষণ থাকল না। একটু পরেই তার মধ্যে কিছু মানুষ আর তাদের চলাফেরা ফুটে উঠল। তারা সবাই রতনের চেনা।
******
‘‘এ বার আর এখানে থাকা যাবে না মা, তুমি বরং দাদার ওখানে চলে যাও। জানোই তো এখানে ঘরের কত সমস্যা। বাবান আর টুয়া বড় হচ্ছে। ওদের পড়াশোনার জন্য তো একটা ঘর ছাড়তে হবে। তুমি যদি সারা দিন ওদের সঙ্গে এক ঘরে থাকো, গল্প করো, তা হলে ওরা পড়বে কী ভাবে?’’ এ রকম একটা কথা যে শুনতে হতে পারে তার আভাস মাঝেমধ্যেই পাচ্ছিলেন প্রভাবতী। মানে রতনের মা। এর আগে অনেক বার তাকে নিয়ে লোফালুফি হয়েছে। তিনি শুধু বললেন, ‘‘দাদার ওখানে তো চলে যেতে বলছিস, কিন্তু তোর তো তবু দু’টো ঘর। ওর তো একটাই ঘর আর বারান্দা। ওর তো অসুবিধা আরও।’’ ব্যস, এতেই যেন আগুনে ঘি পড়ল, ‘‘শোনো মা, তোমার বয়স হচ্ছে, আজ নয় কাল অসুখে পড়বে, বিছানা ধরবে। তখন তোমাকে দেখবে কে, টানবে কে শুনি! গায়ে-গতরে নাহয় আমি একা টানলাম, কিন্তু তুমি এখানে থাকলে তোমার বড় ছেলে একটা নয়া পয়সাও দেবে না। সব খরচা কি আমি একা করব! দায় কি খালি আমার একার?’’
‘‘আমি তো এখনও কোনও অসুখে পড়িনি রে।’’
‘‘শোনো, সময় থাকতে থাকতে দাদার সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করো। নয়তো এক দিন নিয়ে গিয়ে স্টেশনে রেখে দিয়ে আসব, তখন ভিক্ষা করে খেও।’’
বিভিন্ন ধরনের কটু কথা রতনের মা মাঝে মাঝেই শোনেন। তবে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার এ রকম সরাসরি... এই প্রথম। কপাল খারাপ, কী করবেন, শুনতেই হবে। অবশ্য কপাল তার আজকে নতুন করে খারাপ নয়। ভারতবর্ষ যে বছর স্বাধীন হল সে বছর তাকে জন্ম দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই মারা গেল প্রভাবতীর মা। বাবাও আবার বিয়ে করলেন। নতুন মায়ের লাথিঝাঁটা আর ঈর্ষা পেয়ে বড় হতে হতে বিয়েও হয়ে গেল এক দিন। যার সঙ্গে বিয়ে হল সে লোকও বলিহারি। কাজের ঠিক নেই, রোজগারের ঠিক নেই, চালচুলোহীন হাঘরে একটা লোক। দারুণ টানাটানির মধ্যেই দু’টো ছেলেকে বড় করছিলেন প্রভাবতী। তার পর যখন দারিদ্রের চাপে শরীর ভেঙে যাচ্ছে, তখনই এক দিন দুম করে পেটে এল রতন। তার অবশ্য বাপের মুখ দেখা হয়নি। রতন পেটে আসার মাস ছয়েকের মাথায় এক দিন মদ খেয়ে মরে গেল বাপটা। তার পর কী কষ্ট করেই না লোকের বাড়িতে কাজ করে রতনকে বড় করতে লাগলেন প্রভাবতী। তবে রতন যেন রতনই বটে। সে আর পাঁচটা হাঘরে ছেলের মতো নয়।
পড়াশোনায় তার মতি আছে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে চলে গেল কলকাতায়। নিজে টিউশন পড়ায় আর নিজের খরচ নিজেই চালায়। কলেজে পড়তে পড়তে চাকরির পরীক্ষাও দেয়।
‘‘এখানে কোথায় থাকবে! না না, অসম্ভব। আমি রাখতে পারব না,’’ একটা টিনের ট্রাঙ্ক আর প্লাস্টিকের ঢাকনা দেওয়া কাপড় রাখার ঝুড়ি— সম্পত্তি বলতে এটুকু নিয়ে যখন বড় ছেলের দরজায় এলেন প্রভাবতী, তখন তার প্রতিক্রিয়া এ রকম হল।
দুই ছেলের মধ্যে অনেক ঝগড়া বিবাদ, তর্কাতর্কির পর তিনি ঠাঁই পেলেন বটে, তবে মেজ ছেলের বাড়িতে কান্নার জন্য যে ছাদের নিভৃত কোণ তিনি খুঁজে নিতেন, এখানে আর তার কোনও প্রয়োজন রইল না। এখানে তার আসন পড়লই এক নিভৃত কোণে। জীর্ণ হয়ে যাওয়া খড়ের চাল আর মুচমুচে হয়ে যাওয়া চাটাই এখনও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের পিছনে। এক কালে সেখানে গরু থাকত। এখন
সে শূন্যস্থান তিনি পূরণ করলেন। তবু কোনও অভিযোগ নেই। শুধু দুই ছেলের প্রতি তার একটিমাত্র দাবি। ‘‘রতনকে তোরা এ সবের মধ্যে জড়াস না। ও পড়ছে, ওকে শুধু পড়তে দিস।’’
যখন তিনি সোজা হয়ে শুতেন, শতচ্ছিন্ন খড়ের চালের মধ্যে দিয়ে অনন্ত মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাত, রতন এক দিন নিশ্চয়ই চাকরি পাবে। ভাল চাকরি। তার পর যখন কিছুতেই ঘুম আসত না, তখন সেই মহাকাশের নক্ষত্ররাশির থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ত একটা বিশ্বাস। তিনি কিছুতেই কাছে আসতে দিতে চাইতেন না, তবুও সেই বিশ্বাস তাঁর সর্বাঙ্গ জড়িয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিত। রতন চাকরি পেয়ে এক দিন তাঁকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। রতন আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়।
******
চোখ থেকে চশমাটা খুলে রাখল রতন। সে এখন আর কলকাতায় থাকে না। প্রায় দু’বছর হতে চলল সরকারি অফিসে কেরানির চাকরি জুটিয়েছে। পোস্টিং পেয়েছে তার নিজের জেলাতেই। সেই অফিসেরই বড়বাবুর বাবা মারা যাওয়াতে অনেক লোকের সঙ্গে রতনও এসেছে শ্মশানে।
এমনিতেই আসতে রাত হয়ে গিয়েছিল, তার উপর মড়া পোড়ানোর লাইন বেশি থাকায় বেশ খানিক ক্ষণ অপেক্ষাও করতে হল। এখন মধ্যরাত। পোড়ানোর পর শ্মশানযাত্রীরা যখন সব লুচি-মিষ্টি খাচ্ছে, তখন বয়স্ক মতো এক জন শালপাতার থালায় দু’টো লুচি আর মিষ্টি দিয়ে রতনকে বললেন, ‘‘এটা নিয়ে গিয়ে নদীর ধারে রেখে এস। এটা দিতে হয় প্রেতকে উদ্দেশ্য করে। মরে যাওয়া মানুষের আত্মাকে উদ্দেশ্য করে।’’ সেই মতো নদীর ধারে আসতেই রতনের হঠাৎ করে চশমাটার কথা মনে পড়ল। মায়ের চশমা। মৃত মায়ের শরীর থেকে
খুলে নিয়েও যা রেখে এসেছিল গাছের কোটরে।
একটা ঘেন্না এসেছিল নিজের উপর। মায়ের অবস্থার কথা যে তার অজানা ছিল তা নয়। যখন যে দাদার কাছে মা থাকত, সেই দাদা মাঝেমধ্যেই ফোন করত রতনকে। সেবার বড়দা ফোন করে বলল, ‘‘এ বার মাকে তোর কাছে নিয়ে যা। তুই কলকাতায় বসে বসে ফুটানি মারবি আর আমরা এখানে মায়ের পিছনে খরচা করতে করতে মরব, ওটা হবে না। দায়টা কি আমার একার! হয় নিয়ে যা, না তো আমি কলকাতার ট্রেনে উঠিয়ে দিচ্ছি। ইচ্ছে হয় নিয়ে যাবি, নয় শিয়ালদায় পড়ে থাকবে।’’
তখন রতনের পরীক্ষার আর দু’মাস মতো বাকি। নিজে বেশি ক্ষণ পড়াশনা করবে বলে দু-তিনটে টিউশন ছেড়ে দিয়েছে। কেবল মেস খরচা চালানোর জন্য যে ক’টা না করলেই নয় সেটা করে। সে দাদার থেকে কিছু দিন সময় চেয়ে নিয়েছিল। ভেবেছিল, চাকরি পেলে মেস ছেড়ে দেবে। তার পর একটা ঘর ভাড়া নিয়ে মা’কে এনে রাখবে। এক দিন খবর এল, মায়ের খুব জ্বর। এক সপ্তাহ হতে চলল তবুও কমছে না। রতন মা’কে দেখতে গেল। জীর্ণ ঘরে মা শুয়ে ছিলেন। রুগ্ন শরীর বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা। জ্বর দেখবে বলে রতন কপালে হাত দিল।
জ্বর কোথায়! জ্বর ছেড়ে গিয়েছে। কপাল বরফের মতো ঠান্ডা। সেই থেকে একটা কাঁটা বিঁধে রইল রতনের মনের মধ্যে। থেকে থেকেই খচখচ করে। চোখ থেকে জল ঝরায়।
আজ এই শ্মশানে যেমন হচ্ছে। রতন কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। অথচ এখানে বসে সময় নষ্ট করলে ও দিকে সবাই তাকে খুঁজবে। সে উঠে দাঁড়াল। সিঁড়ি বেয়ে এক পা দু’পা করে নেমে কোমর সমান জলে এসে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। ছোটবেলায় মহালয়ার দিনে মা তাকে পাঠাত তর্পণ করতে। এ ভাবেই কোমর সমান জলে নেমে মরে যাওয়া বাবাকে তিল অঞ্জলি দিত সে। ছেলে তর্পণ না করলে মৃত বাবার আত্মা নাকি স্বর্গে পৌছতে পারে না। মা শিখিয়েছিল। স্বর্গ এবং মর্তের মাঝে যে পিতৃলোক সেখানে অবস্থান করে।
তবে মৃত মায়ের আত্মার কী হয়? রতন জানে না। কেউ বলেনি। হাতের পাতায় জল নিয়ে সে আকাশের দিকে তুলে ধরল। আজ সে মায়ের উদ্দেশ্যে তর্পণ করবে। কিন্তু মন্ত্র কোথায় পাবে! সে তো কোনও মন্ত্র জানে না। থাক, তার মন্ত্রের দরকার নেই। সে বলল, ‘‘কেমন আছ মা? জন্ম নিয়েছ আবার?’’ ভোরের আলো এখনও ফোটেনি। কোনও এক নিশাচর পাখি রাতের নিস্তব্ধতাকে ফালাফালা করে ডেকে উঠল দূরে কোথাও। চোখ বন্ধ। হাতের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে গঙ্গার বুকে। রতন বলছে, ‘‘যদি জন্ম নাও আবার, তবে যেন এমন মা-বাবার কাছে তোমার জন্ম হয় যারা তোমাকে অনেক আদর দেবে, স্নেহ দেবে, না চাইতেই এনে দেবে সব। ভাল ঘর পেও মা। সুসন্তান হোক তোমার। যে মুখ ফুটে না বলতেই বুঝে যাবে সব। তোমাকে কাছে রাখবে। তোমার রতনের মতো হবে না।’’
হাতের পাতায় মিশে গেল রতনের চোখের জল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy