ছবি: প্রত্যয়ভাস্বর জানা
সোনারপুরের রিকশা-ভ্যানওয়ালা সুবল নস্কর।
রেল বাজারে এস ডি ফাইভ ব্যাসস্ট্যান্ড, এটা মালঞ্চ, ঘটকপুকুর, বাবুরহাট স্ট্যান্ড বলে পরিচিত। তখনও রেলের ফ্লাইওভার হয়নি। পাশেই পুরনো ঝাঁকড়া বটগাছের নীচে শনিতলায় ঘরের বউ চাঁপাকে লুকিয়ে এক শনিবারে পুজো দিয়েছিল, ছেলে মানতের পুজো। চার হাতের নীল শনি। পুজো হল, দিন গড়ানো জীবনের ধার ঘেঁষে বেরিয়ে যাওয়া বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা, যেটা চেনা যায় না, অথচ মনের ভিতরে শেকড়ের মতো চারিয়ে যায়।
মাধ্যমিক ফেল করা সুবল ভ্যান চালাতে চালাতে বেঁচে থাকার এই একান্ত জীবনদায়ী আদতকথার পাঠ নিয়ে কখন পাশ করে গিয়েছে, কেউ জানে না। শনিঠাকুরের কথকতা শোনে, প্রসাদ নিয়ে এবং অবশ্যই মনের মধ্যে উজিয়ে রাখা একটা মানত সঙ্গে করে ঘরে ফেরে। ঘরের উঠোনে হেলেদুলে চলবে একটা বাচ্চা। বউ চাঁপা বাচ্চা নিতে চায় না। চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় নানা যাত্রাপালায় অভিনয় করে নাম করেছে, সিজনে-সিজনে ডাক পায়। ছেলে হলে শরীর ভাঙবে, রূপ ভাঙবে। তার পর যা হয়, ডাক না পেয়ে এক দিন হারিয়ে যাবে যাত্রাপালা থেকে।
শনিঠাকুরের প্রসাদ নিয়ে ফেরার পথে ভ্যানে উঠেছিল রহমত মিঞা, পাশের গ্রামের বাসিন্দা। খাশিয়াড়া, শীতলা, মালির বাগান পেরিয়ে ঢালাই পোলের ওপারে আড়াপাঁচে খুলনার লোকজন ভরা। ওখানেই সুবলের বাড়ি। পোলের নীচে বাগজোলা। কেষ্টপুরের কাটাখাল আড়াপাঁচকে পাক খেয়ে আরও দক্ষিণে পিয়ালী, বিদ্যাধরীতে মিশেছে। এক সময় বেশ চওড়া ছিল খাল, বিদ্যাধরীতে পড়ে খালের জল জোয়ারের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলত, খালে তখন কত ছোট মহাজনি নৌকো, মেছো নৌকো। সে এক আনন্দের দিন ছিল!
নদীরও চলতে চলতে বয়স বাড়ে, বুড়ো হয়। স্রোত, জোয়ার ফুরিয়ে আসে। আর সেই নিয়মেই পিয়ালী মরে গেল, বিদ্যাধরীর স্রোতও আর এগিয়ে এল না, খালও মজে গেল। এখন দু’পারের ঢালু চর মানুষজনের ঘর-গেরস্থালির লোভে ধান্দাবাজিতে কবেই দখল হয়ে গিয়েছে। আগে ছিল কাঠপোল, এখন সেখানে ঢালাই পোল। খালে ঘোলাটে জল আর কচুরিপানা।
কত কাল আগে, কেউ তাদের কলোনিপাড়ার নাম রেখেছিল বসুধাখালি, বসুধা মানে তো ধরিত্তি। তা এই খালপাড়া, চাষিপাড়া, গায়েনপাড়া, নস্করপাড়া, মৃধাপাড়া, নাথপাড়া— সব মিলিয়ে শ’তিনেক ঘরের অগোছাল ধরিত্তি। তার মধ্যে সুবল নস্কর, তার কুড়ি-পঁচিশের সুন্দরী যুবতী বউ চাঁপা নস্করও ওই গুনতির মধ্যে এসে যায়।
রহমত মিঞার দুই বিবি। দুসরি বিবি সইদা, সে তার পরানের বিবি। রগড় গিলচ্ছিল সুবল ভ্যানের প্যাডেল মারতে মারতে, ‘‘রাতে কোন বিবির কাছে যাও গো রহমতদা?’’ রহমতের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন আছে তার হাসি, আনন্দ, দুঃখ। সব মিলিয়ে-গুছিয়ে একটা মিহি সম্পর্ক, এই নিয়ে দু’জনের মনের মিল। তখন শুধু দু’টো মানুষ মুখোমুখি, জাগতিক সুখে-দুখে পরস্পরের মন উজাড় করে দেওয়া। সেই বাতাবরণে উঠে আসে বউ-বিবি-বিল-জমিনের গল্পগাছা, সাঁঝবেলার আঁধারে গাঁ-ঘরের আজান আর শাঁখের আওয়াজ, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যায় একসঙ্গে হাত ধরে।
রহমতদা জরদাপানের খুশবু উড়িয়ে খোলা প্রাণের দরাজ হাসি হাসে, ‘‘শাদি মানে কি শুধু বিবি? তা নয়, জিন্দেগির সঙ্গে প্যার-মহব্বতের মিলেমিশে মিঠে কাওয়ালি। আমি ছোটোটার কাছে যাই, ওর কাছে গেলে বড়র গোঁসা। তা তুই পোলাপান নিচ্ছিস নে ক্যান? বউ বারণ করেছে? শালা গাড়োল, টাকা কামাছিস, ছাওয়াল নিবি নে?’’
সুবল হাসছিল, ঘটকপুকুরের বাসকে পাস দিয়ে বলল, ‘‘আজ শনিতলায় পুজো দিসি, পেসাদ নে বউরে দোব।’’
‘দিস’খন, ওতে কাজ না হলি ঘুটিয়ারি শরিফে চইলে যাস। শা’ পিরের মাজারে মানত করসি, তোর মুরিদ পুরি হবে। যদি পির শা’ কবুল করে।’
মনের আনন্দে ঘরদোর ভেসে যাচ্ছিল, বউকে বলেছিল সুবল, ‘‘শনিপুজোর পেসাদ নে আইচি তোমার জন্যি। পুজো দিয়েলাম, যাতে তোমার যাত্রাপালায় ঘনঘন ডাক আসে। আর বাচ্চা না হওনের দোষ কাটানির।’’
‘‘এ বার তোমার মতলব ধরসি, ও সব হবে-টবে না।’’ ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল চাঁপা।
তবু ছলাকলায় সেই রাত আঁধারে, ঘরের পিছনের কলাবাগানের একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকে, খয়াটে জোছনায়, সুবল ক্রমশ যাত্রাপালার প্রেমিক পুরুষ হয়ে উঠছিল। শুধু আদর আদর। আদর খেয়ে মেয়েরা গলবে না, তা কি হয়? চাঁপার জোড়া কদমফুলে মুখ রেখে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল খালের জলে, গাঢ় সুখের অনুভূতিতে, চাঁপাকে অবসর দিচ্ছিল না। শূন্য মাঠে ঝড়বাদলের মতো ভেঙেচুরে দিচ্ছিল, দখল নিচ্ছিল শরীরের, সুখের দখল।
****
মাস তিনেক যেতে না যেতে ধরা পড়েছিল সব কিছু । পেট ভারী, রাতের ফসল।
চাঁপা কেঁদে কুল পায় না। প্রথমে হাউহাউ করে কাঁদল, তার পর পাষাণ হয়ে গেল। খোলা চুল, এলোমেলো শাড়ি, পাগল-পাগল চেহারা। বিষাদমূর্তি। বুড়ি শাউড়ির মনে ধন্দ, ‘‘এইডা আবার কী? কোন পালা?’’
তার পর এক দিন চিৎপুরের গদিঘর থেকে লোক এল। মহিষাদল, তমলুক, নরঘাট, ময়নাতে টানা তিন দিনের বায়না, লোকজনের সাড়া ফেলা ‘হিজলদিঘীর কন্যা’। এসেছে দলের ম্যানেজার অখিলবরণ জানা, অধিকারীর পরের লোক। বলল, ‘‘আসছে পালায় চাঁপা নস্করকে সাইড হিরোইনের রোল দেওয়া হবে। অধিকারী চাইছে, চাঁপা হিরোইন হোক।’’ সুবল বলল, ‘‘হাঁ গো সত্যি। তোমার মাইনে বাড়বে। বায়নায় গেলে তুমি একটা আলাদা ঘর পাবে, এখন যেমন নটকিংকরী যমুনা দাস পাচ্ছে।’’
তাড়াতাড়ি ঝিমুনি ঝেড়ে ফেলে শাড়ি পরে, মুখে হালকা স্নো-পাউডার ঘষে মাথায় চিরুনি দিতেই আগের চাঁপা। উঠোনের গাছপালার ছায়াতে পা দিতে শাউড়ির মুখোমুখি। যাত্রাদলে চাঁপার কাজ কোনও দিন মেনে নিতে পারেনি। দিনরাত গা-জ্বলুনি খরখরে কথা। কম ঝামেলা পুইয়েছে চাঁপা! দাপুটে জিজ্ঞেস, ‘‘বউ কনে যাও?’’
‘‘খাশিয়াড়ার নার্সিংহোমে। তোমার ছেলের তো বাপ হওনের শখ। ওরম হলি, আমার যাত্রাদলের কাজ থাকপে না। তিন মাসের বাচ্চা, এরে পেলতি কষ্ট হবে না।’’ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ঢালাই পোলের মোড়ের মাথায় ভ্যান গুমটিতে। সুবলের ভ্যান এখান থেকেই ছাড়ে। সকালেই চলে গিয়েছে সে। একটা চলতি ভ্যানে বসবার জায়গা পেয়ে উঠে বসেছিল। মজা খাল পেরিয়ে ভ্যান শীতলার দিকে। ও দিকের ঘরবাড়ি, মাঠ, করাত-কল, মন্দির পেরোলেই খাশিয়াড়া মোড়।
নার্সিংহোমে সব জেনে এসেছিল চাঁপা। নামে নার্সিংহোম, মেটার্নিটির কাজ বেশি। তার কাজে বেশি সময় ভর্তি থাকতে হবে না। ঘণ্টা দুয়েকের ব্যাপার। ছেলে হওয়া তো ফুরোচ্ছে না, পরে হবে, তার আগে তাকে যমুনা দাস হতে হবে। তখন আর বসুধার কলোনিপাড়ায় থাকবে না। সোনারপুরের ঘোষপাড়ায়, উত্তরায়ণে, চাঁদমারিতে কিংবা স্টেশনের ও পারে মিলনপল্লিতে।
বাড়ি ফিরে ক’দিনেই সুস্থ হয়ে গেল চাঁপা। আজ সকালে ওদের যাত্রাপার্টি চলে গিয়েছে মহিষাদল, সঙ্গে চাঁপাও। ফিরবে চার দিন পরে, ব্যাগে তখন থোক টাকা, ঘরের জন্যে টুকিটাকি জিনিস, টাকাগুলো জমা পড়বে পোস্টাপিসে। এই চার দিন আলো, দর্শক, হাততালির মাঝে এক অন্য জগৎ, সেই আলোতে ময়ূরী হয়ে চাঁপা পেখম মেলবে, সবাইকে মোহিত করবে।
****
আজ পুন্নিমে।
মাঠ জমিন টপকিয়ে খালপাড়ের ঝাঁকড়া বটের ডগলার মাথায় হলুদ থালা চাঁদ। চাঁদের আলোর ফিনকি আর তাতেই নিত্যদিনের চেনা মাঠঘাটে জোছনার বাহারের বান ডেকেছে। সাদা জোছনায় খালপাড়, মেছো ভেড়ি, ফসলের জমিন একাকার, অপার্থিব পটের ছবি। খাশিয়াড়ার মোড়ে সওয়ারি নামিয়ে পাড়ার ভিতরে ভ্যান ঢোকাল সুবল। সকালে খোঁজ নিয়েছিল নার্সিংহোমে, মেটার্নিটি ওয়ার্ডের আয়া ছবিরানি সর্দার কোথায় থাকে। অনেকটা দূরে এ দিকের বোসবাগান পেরিয়ে ও দিকটায় মঞ্চতলায় তার ঘর।
একটু খোঁজাখুঁজি করে ঘরটা পেয়ে গেল সুবল। টালির চালের মাটির ঘর। চালে লাউ, কুমড়োর ডগা। পঁচিশের চেহারা, পরনে ছাপা শাড়ি। মাঝে মাঝে পোয়াতি বউয়ের বাড়ি এ রকম ভ্যান-ট্যান আসে রাতের বেলা। তাই একটু জোর দিয়ে বলল, ‘‘কনে যাতি হবে? রাত্তিরবেলা রেট কিন্তু আলাদা।’’ ছবিরানি পান খাচ্ছিল। উঠোনে চাপা আলোতে হালকা ফরসা চেহারায় ঠোঁট লাল।
‘‘কোনও ডেলিভারি কেস না। গত হপ্তা বসুধা কলোনির চাঁপা নস্কর, আমার বউ আইসিল নার্সিংহোমে বাচ্চা নষ্ট করতি।’’
‘‘হেই কাজ তো হয়ে গেস।’’
‘‘জানি। শুনিসি তুমি ভুনটুনগুলো এই খালধারে কোথায় পুঁইতে রাখো। আমারে জায়গাডা একবার দেখাবা?’’
এ রকম ইচ্ছে নিয়ে ছবিরানির দোরগোড়ায় কেউ আসেনি। গোপনে সে কাজ সারে, কাকপক্ষী টের পায় না। নার্সিংহোমে আজকাল এ রকম অনেক কেস আসে প্রতি মাসে, ছবিরানিকে ভার নিতে হয় খালপাড়ে ঘর বলে, ভাল টাকা পায় এর জন্য। খালবাঁধের নীচে একটা জায়গায় প্লাস্টিক-মোড়া ভুনগুলো মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেয় সে। পুঁততে গিয়ে মন ককিয়ে ওঠে, হাত চলতে চায় না, কোদাল বুঝি হাত থেকে পড়-পড়। আজকাল ফ্যাশন হয়েছে, কেউ একটাও ছেলে নিতে চায় না, একটা নেওয়ার পরে পাকাপাকি রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এখন জন্মশাসন মানেই সুখশাসন, ছড়িয়ে পড়ছে নানা পরিবারে, আর ছবিরানিদের মাটিতে ভুন পুঁততে হচ্ছে!
‘‘ওই জায়গাডা দেইকে আর কী করবা, চিনতি পারবা বউয়ের ভুনটারে? ও তো মাটিতে মিশে গেল লজ্জায়।’’
সুবল হাতজোড় করে অনুরোধ করল। ভ্যানে ছবিরানিকে তুলল, সঙ্গে ছোট কোদাল। রাস্তায় গাছপালার আলোছায়া। বউয়ের ফেলে যাওয়া ভুন দেখতে পুরুষ মানুষ আসে, জীবনে এই প্রথম জানল ছবিরানি। ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জা! সকলেই টাকা দিয়ে পালায়। সে ভুনগুলো মাটিতে পুঁতছে, না কি কুকুরকে খাওয়াচ্ছে, কেউ জানতে চায় না।
খালপাড়ের এ দিকটায় গাছপালা, ঝোপঝাড়, ঝিঁঝিঁর ডাক, জোনাকির আলো। আজ পুন্নিমে, জোছনার ঢল। টানা বাতাস বইছে। একটা বটগাছের ঢালুতে এসে দাঁড়াল ওরা। ভ্যান বাঁধল সুবল। ছবিরানি আঙুল তুলে জায়গাটা দেখিয়ে দিল। সুবল পাগলের মতো কোদাল চালাচ্ছে। ক’বছরে অনেক ভুন পুঁতেছে এখানে ছবিরানি। আজ সেই সব ভুন মাটির আঁধার, দমবন্ধ বাতাস ছেড়ে উপরে উঠে আসছে। কত মৃত সন্তান! এমন দৃশ্য দেখা বড় কষ্টকর। সুবলকে ডেকে বলল, ‘‘এই বার ছাড়ান দাও। তোমার বউয়ের ভুনডারে চিনতে পেরোস? ওগুলো মাটির মদ্যি থাকতি থাকতি নুনমাটি হয়ে নীচে নাইমে গেস, পাবা না ওদের।’’
‘‘শুনতি পাচ্ছ, কারা যেন একসঙ্গে কাঁদতেসে?’’ সুবলের কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।
‘‘হাঁ, যাদের পুঁইতি দিসিলাম,’’ ছবিরানির মেয়ে-মন কেঁদে উঠল। ‘‘আমি আর এ কাজ করব না। তুমি আমার পরান খুইলে দেসো। এ কাজ বড় পাপ গো।’’
সুবল জানে, আঁধারেই পুরুষ ও নারীর শরীরী খেলা চলে, সেই সুখের প্রয়োজনে মানুষের আবাদভূমিতে জন্ম হয়েছিল ভুনেদের। এখানে, খালধারের আবাদভূমি চিরকালই আঁধার। আলো পাবে না, জল পাবে না, বাতাস পাবে না। সে ঠিক করে ফেলল, আর একটা আবাদভূমি তৈরি করে ফেলবে। কেউ ওকে উসকে দিতে সে ঝট করে ছবিরানির হাত ধরে মাঠে নামাল। টেনে নিয়ে যেতে থাকল দূরে, আরও দূরে। ছবিরানি বাধা দিতে পারল না পাগল মানুষটাকে। অনেক দূরে মাঠের ধারে খালটা বাঁক নিয়েছে, গাছপালার বুনোজঙ্গল।
ওখানে ঝোপের আড়ালে, একটা গাছের নীচে ঘাসজমিতে আছড়ে ফেলল ছবিরানিকে। মরা ভুনটাকে আঁকড়ে ধরে এ সংসারে বেঁচে থাকা। আর একটা ভুন তৈরি করবে সে, নাই বা হল চাঁপা নস্কর, যুবতী ছবিরানি সর্দার ভুন নিতে পারবে। কোনও বাধাই দিতে পারল না ছবিরানি। এক সময় তার শরীর ছেড়ে সুবল উঠে দাঁড়াল, লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছে খালধারের দিকে, যেখান থেকে ছবিরানিকে এনেছিল, সেই ভুনধরা জমি, সেই খাল, পুন্নিমের জোছনায় নদী হয়ে গিয়েছে। চাঁপাও নদী, সে শুধু জোয়ারে ভাসতে চায়, বিশাল জলরাশি চায়, ভাটা চায় না, ছোট বাচ্চার হাত ধরে খেলতে চায় না।
ছবিরানি উঠে কাপড় গোছাল। দেখল, সামনে ধু-ধু মাঠ জোছনায় ঢাকা পড়েছে। যে লোকটা ওকে ভুন দিল, সে এই জোছনার ঘোর-লাগা নির্জন ফাঁকা মাঠে কোথাও নেই। অনেক দূরে, সেই খালপাড়ে রিকশাভ্যান খুব ছোট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অস্পষ্ট, মাঝে মাইলের পর মাইল ব্যবধান, হেঁটে এই রাতবেলায় একা পৌঁছনো সম্ভব নয়। কেউ কোথাও নেই, পুরোপুরি একা সে।
হাটতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, অঢেল জোছনায় ভিজে যাচ্ছে সে। এত ঘন জোছনা, হাত দিয়ে যেন ছোঁয়া যায়। মাঠে কীটপতঙ্গের ডাক। আর তখনই মনে হল, জোছনার মধ্যে সে খাশিয়াড়া নার্সিংহোমের আয়া নয়, ভুন পোঁতার মেয়ে নয়, আকাশের জোছনার নীচে এক গর্ভধারিণী, এ সুযোগ সুবল নস্কর তাকে দিয়েছে। ওর ভুনটা সে কোনও দিনই বের করে মাটিতে পুঁতবে না, তেমন ইচ্ছে বা সাহস কোনওটাই ওর নেই।
চারদিকে পুন্নিমের বিভ্রম জাগানো আলো। সুবল নস্কর এই পুন্নিমের রাতে সত্যিই এক নিঃসঙ্গ দরদি বাবা, কেউ এক জন থাকবে তার পিতৃপক্ষে জল দেওয়ার। তাকে আর পিপাসায় থাকতে হবে না। ছবিরানির মাঝে মাঝে রাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায়, অনেক বাচ্চার কান্নাকাটি শুনতে পায়, খালি বুক টনটন করে। একটা বাচ্চার না-জন্মের কান্নাকাটি, নিজেকে তার খুব দোষী লাগে।
জোছনাভরা আদিগন্ত মাঠ ভেঙে জোছনায় ছবিরানি নামে কে এক যুবতী এগিয়ে চলেছে। সে চাঁপা নস্করের মতো যাত্রাপালার নায়িকা হবে না, জীবনে উথালপাথাল হওয়া এক মা হবে। বেশ জোরে কেঁদে উঠল সে।
‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে ছোটগল্প পাঠান, অনধিক ১৫০০ শব্দে।
ইমেল: rabibasariya@abp.in
সাবজেক্ট: rabibasariya galpa
ডাকে পাঠানোর ঠিকানা:
‘রবিবাসরীয় গল্প’,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১
যে কোনও একটি মাধ্যমে গল্প পাঠান। একই গল্প ডাকে ও ইমেলে পাঠাবেন না। পাণ্ডুলিপিতে ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি জানাবেন। ইউনিকোড ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy