ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
অনুপমাকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পেরেছে মৃদুলা। পরনে জলপাইরঙা শাড়ি, কালো চশমা, হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে মন্থর ভাবে হেঁটে আসছেন। অনুপমা মৃদুলাকে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেননি এখনও।
আর একটু এগোতেই মৃদুলার নজরে পড়ল, অনুপমার সিঁথিতে সিঁদুর নেই। প্রবীরকাকু তবে...এতে অবশ্য খুব একটা অবাক হল না মৃদুলা। মৃদুলা আর অঞ্জন যখন অনুপমার বাড়ি ছেড়ে চলে আসে তখনই প্রবীরবাবু বেশ অসুস্থ ছিলেন। অ্যাজমা পেশেন্ট। যখন-তখন হাঁপের টান উঠত আর বাড়িসুদ্ধ লোকের খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। অবশ্য লোক বলতে প্রবীরবাবু, অনুপমা দেবী আর ওদের সারা দিনের কাজের লোক মালতীদি। ওদের একমাত্র সন্তান রূপঙ্কর চাকরিসূত্রে বিদেশবাসী।
বছর সাতেক আগে মৃদুলা আর অঞ্জন যখন বাড়ির অমতে পালিয়ে বিয়ে করে, তখন মৃদুলা সদ্য কলেজ শেষ করেছে আর অঞ্জন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করেছে। এই গান্ধর্ব রীতি অনুসরণের শাস্তিস্বরূপ উভয়েই শ্বশুরবাড়ির সুখ-সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়। তখন অনেক খোঁজাখুঁজির পর অঞ্জনের এক বন্ধুর বিশেষ আনুকূল্যে একটু সস্তা দরে ভাড়া পাওয়া যায় অনুপমা দেবীর বাড়িটায়।
বাড়িওয়ালা ও বাড়িওয়ালি দু’জনেই ছিলেন মাটির মানুষ। ওদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেননি কখনও। অনুপমা ঠাকুর-দেবতা নিয়ে একটু বাতিকগ্রস্তা ছিলেন বটে, কিন্তু সেটা মৃদুলা বা অঞ্জনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেনি কোনও দিনই।
বিয়ের বছর দুই পর মৃদুলা আর অঞ্জনের একটা ছেলে হয়, ঋদ্ধি। অনুপমা দেবী ঋদ্ধিকেও খুব ভালোবাসতেন। মাঝে-মাঝেই ওপরতলা থেকে নেমে এসে কখনও প্রসাদি ফুল ছুঁইয়ে নিয়ে যেতেন ঋদ্ধির কপালে, কখনও মানত করা তাগা বেঁধে দিতেন ওর হাতে। মৃদুলাও সময় পেলেই উপরে গিয়ে গল্প করে আসত, কখনও আবার এটা-ওটা রান্নাও শিখে নিত অনুপমা কাছ থেকে।
এভাবেই চলছিল। হঠাৎ এক দিন অঞ্জন খবর পেল ওর অফিসের কাছাকাছি একটা বাড়ি ফাঁকা আছে। তার পর ওরা অনুপমার বাড়ি ছেড়ে দেয়। চলে আসার সময় অনুপমা ওদের শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, ‘‘তোরাও চলে যাচ্ছিস? যা।”
ও-বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর মৃদুলা বা অঞ্জন কারও সঙ্গেই আর কখনও দেখা হয়নি অনুপমা বা প্রবীরবাবুর। তবে মৃদুলা বেশ কয়েক বার অনুপমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই ফোন পরিষেবা সীমার বাইরে।
তার পর ভাগ্যদেবীর সহায়তায় অঞ্জন আর মৃদুলার ‘ভাড়াটে’ নামটা ঘুচতে বেশি সময় লাগেনি। কারণ নতুন বাড়িতে ভাড়া যাওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই অঞ্জন একটা ছোটখাটো বাড়ি কিনে ফেলে।
আজ এত বছর পর তাই অনুপমাকে দেখে খুব ভাল লাগল মৃদুলার। হনহনিয়ে এগিয়ে যেতেই এ বার অনুপমাও দেখতে পেলেন মৃদুলাকে। মৃদুলাকে দেখেই অনুপমার কপালে ভাঁজ পড়ল। বোধ হয় এখনও চিনে উঠতে পারেননি সে ভাবে।
“ভাল আছ, অনু আন্টি?” একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল মৃদুলা।
“ঠিক চিনতে পারলাম না তো!” ভারী গলায় উত্তর দিলেন অনুপমা। “চিনতে পারলে না! আমি মৃদুলা, অঞ্জুর বৌ। তোমার একতলার পুরনো ভাড়াটে,” একটু হতাশ হয়ে মৃদুলা বলল।
বেশ কিছুক্ষণ মৃদুলাকে আপাদমস্তক জরিপ করার পর অনুপমার অলস দৃষ্টি একটু একটু করে উজ্জ্বল হল। বললেন, ‘‘মৃদুলা! কেমন আছিস তুই? অঞ্জু কেমন আছে? আর আমার দাদুভাই? আসলে আজকাল চেনা মানুষগুলোকেও আর চিনতে পারি না রে। সব কিছু কেমন গুলিয়ে যায়।”
“তুমি জানো, তোমাকে কত বার ফোনে ট্রাই করেছি? কিন্তু এক বারও পাইনি,” অভিযোগের সুরে বলল মৃদুলা।
“তা ফোনে যখন পাসনি, এক দিন তো চলে আসতে পারতিস দাদুভাইকে নিয়ে?”
“সেটা যে একদমই ভাবিনি, তা নয়। কিন্তু সংসার সামলে শেষমেশ আর হয়ে ওঠেনি। তবে আজ কিন্তু তোমায় আর ছাড়ছি না। আজ তোমাকে আমার বাড়ি যেতেই হবে।”
“বাড়ি করেছিস বুঝি! তা বেশ তো, আর এক দিন না হয় যাব’খন তোর বাড়ি।”
“না, তোমাকে আজই আমার সঙ্গে যেতে হবে। চলো চলো।”
অগত্যা অনুপমাকে আসতেই হল মৃদুলার সঙ্গে, ওর ছোট্ট বাড়িতে।
চা-এর পর্বটা শেষ করে কিচেন থেকে ছাদ অবধি অনুপমাকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাল মৃদুলা। এত কিছুর মধ্যে অনুপমার সবচেয়ে মনে ধরল মৃদুলার ঠাকুরঘর। ছোট্ট সিংহাসনের ওপর গোপালের বিগ্রহখানা দেখে মুগ্ধ হলেন অনুপমা। আর মনে মনে ভক্তিমতী, সতীসাধ্বী ইত্যাদি বিশেষণ আওড়ে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন মৃদুলাকে।
“সত্যি রে, খুব ভাল লাগল তোর বাড়িটা দেখে। আর সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিসও খুব সুন্দর করে। তবে আজ অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে রে। এ বার আমাকে যেতে হবে,” বললেন অনুপমা।
“ঠিক আছে এস। তুমি এসেছ বলে সত্যিই খুব ভাল লাগল। আবার এস কিন্তু।”
“আসব।”
******
আজ সকাল থেকেই মৃদুলা খুব ব্যস্ত। কাজের মাসি ডুব মেরেছে। অঞ্জনকে প্রতিদিনই সাড়ে ন’টার মধ্যে বেরোতে হয়। এখন ন’টা। তার মধ্যে আজ আবার ঋদ্ধির পরীক্ষা আছে। তাই ওকে নিয়েও আজ ন’টা পঁয়তাল্লিশের মধ্যে বেরোতেই হবে মৃদুলাকে।
অঞ্জনকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে ঋদ্ধিকে খাওয়াতে বসবে, এমন সময় ডোরবেলটা বেজে উঠল। মৃদুলা যাওয়ার আগেই ঋদ্ধি ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল।
সময় দরজার বাইরে অনুপমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অঞ্জন আর মৃদুলা দু’জনেই একটু অবাক হল। কিন্তু সেই অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে অনুপমাকে ভিতরে ডাকল মৃদুলা।
অনুপমার চেহারা দেখে খটকা লাগল ওদের। চোখেমুখে কেমন দুশ্চিন্তার ছাপ। দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়াহুড়োয় এসেছেন এখানে।
খুব শান্ত পায়ে বাড়িতে ঢুকলেন অনুপমা। তার পর বাড়িটার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন।
“কী হয়েছে, অনুআন্টি? তোমাকে এ রকম দেখাচ্ছে কেন?” জিজ্ঞেস করল মৃদুলা।
মৃদুলার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন অনুপমা। তার পর আচমকা অঞ্জনের দিকে ছুটে গিয়ে, “অঞ্জু, তুই আমাকে বাঁচা, তোরা আমাকে বাঁচা। তোরা ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই...” বলতে বলতে অঞ্জনের হাতদুটো ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
“আরে তুমি আগে শান্ত হয়ে বোসো। সবটা খুলে বলো আমাদের, কী হয়েছে? না হলে আমরা তোমাকে বাঁচাব কী করে?” অনুপমার দিকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে শান্ত ভাবে বলল অঞ্জন।
এক চুমুকে গ্লাসের জলটা শেষ করে অনুপমা বলতে শুরু করলেন, ‘‘তোদের কাকু মারা যাওয়ার পরে মাত্র সতেরো দিনের জন্য দেশে এসেছিল রূপ, মানে আমার ছেলে রূপঙ্কর। তার পর থেকে এই দু’বছরের মধ্যে আর এক বারের জন্যও এমুখো হয়নি। আমি আসতে বললেই শুধু বলে, ‘মা তুমি তো জানো, আমার ছুটি নেই। তোমার বৌমারও ছুটি নেই। তার চেয়ে বরং তুমিই আমাদের এখানে এসে ঘুরে যাও না ক’দিনের জন্য।’ ওই এক কথা বলে দেখে আমিও ওদেরকে এখানে আসার কথা বলা বন্ধ করে দিই। তার পর থেকে সপ্তাহে এক দিন করে ফোন করে আমার খোঁজখবর নেয়। কিন্তু মাস ছয়েক আগে এক দিন ফোন করে হঠাৎই আমায় বলে বসল, ‘মা, তুমি আমাদের এখানে চলে আসো পার্মানেন্টলি। দেখো, তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া ওখানে তোমার দেখাশোনা করবে কে? তাই আমি ভাবছি বাড়িটা বিক্রি করে দেব। তোমার মতামতটা জানিয়ো, অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল।’ ”
“কিন্তু উনি চাইলেই তো তোমার জীবদ্দশায় বাড়িটা বিক্রি করে দিতে পারবেন না!” বলল অঞ্জন।
“পারে। কারণ তোদের কাকু বাড়িটা ওর নামেই লিখে দিয়ে গিয়েছেন। তাই ও চাইলেই বাড়িটা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে।”
“ওহ্ গড!” অস্ফুটে শব্দগুলো বেরিয়ে এল অঞ্জনের মুখ থেকে। মাথায় হাত দিল মৃদুলা।
“এত দিন আমি রূপের কথায় তেমন একটা গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম এটা হয়তো ওর সাময়িক খেয়াল। কিন্তু গত সপ্তাহে ও আমাকে ফোন করে বলল, কোনও এক প্রোমোটারের সঙ্গে ওর কথা হয়ে গিয়েছে। দামও বেশ ভালই দেবে। সব ঠিক থাকলে আগামী সাত দিনের মধ্যেই বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাবে। তাই আমার কাছে এখন দুটো রাস্তা খোলা। এক, রূপ এলে ওর সঙ্গে আমেরিকা চলে যাওয়া, আর নয়তো নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেওয়া। রূপ স্পষ্ট বলে দিয়েছে, আমি যদি ওর সঙ্গে না যাই, তা হলে ও আর আমার কোনও দায়িত্ব নিতে পারবে না। এ বার তোরাই বল, নিজের স্বামীর ভিটে থাকতে, এখানকার সব মায়ামমতা ত্যাগ করে আমি কি ভাবে ওই পাষণ্ডটার সঙ্গে বিদেশে চলে যাব? না, আমি তা কিছুতেই হতে দেব না। স্বামীর ভিটেটা না বাঁচাতে পারলেও এই দেশ ছেড়ে কোত্থাও যাব না আমি,” কান্না জড়ানো গলায় এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন অনুপমা। গলা শুকিয়ে গিয়েছে সেটা অনুমান করে আরও এক গ্লাস জল এনে দিল মৃদুলা। অনুপমার পিঠে হাত বোলাতে বোলোতে মৃদুলা তাকাল স্বামীর দিকে। ওর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
“তুমি আমাদের কী করতে বলছ অনুআন্টি?’’ জিজ্ঞেস করল অঞ্জন।
“দেখ, ব্যাঙ্কে আমার যা আছে, তাতে আমার খাওয়া-পরার কোনও অসুবিধে হবে না। শুধু দরকার একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই। তাই ভাবলাম অন্য কারও কাছে যাওয়ার আগে এক বার তোদের কাছেই এসে দেখি।”
“আমাদের কাছে! প্লিজ় অনুআন্টি, একটু ক্লিয়ারলি বলো,” বলল মৃদুলা।
“তোদের একতলার ওই ঘরটা আমাকে ভাড়া দিবি, অঞ্জু? তোরা যা ভাড়া নিবি, আমি তাই দেব। কথা দিচ্ছি, তোদের কখনও কোনও রকম ঝঞ্ঝাটে ফেলব না। শুধু আমাকে তোরা ফিরিয়ে দিস না, ফিরিয়ে দিস না। বাকি জীবনটা না হয় তোদের ভাড়াটে হয়েই কাটিয়ে দেব...”
অনুপমার কথাগুলো শেষ হতেই এক অদ্ভুত স্তব্ধতা ঘিরে ধরেছিল সারা বাড়িটাকে। সেই নিঃশব্দ খানখান করে দেওয়ালের কোণ থেকে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল, টিক...টিক... টিক। তাও মৃদুলা বা অঞ্জন কারওই চোখে পড়ল না, ঘড়ির কাঁটায় এখন দশটা বেজে দশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy