Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ১১

শেষ নাহি যে

পূর্বানুবৃত্তি: স্টেশনে পৌঁছলেও চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা বেরিয়ে গেল। দৌড়ে চলন্ত ট্রেনের হাতল ধরতে গিেয় পড়ে গেল বিতান। অন্য দিকে হাসপাতালে বেড পাওয়ার জন্য নিরুপায় হয়ে জীবনে প্রথম বার ঘুষ দিলেন সাম্যব্রত। পূর্বানুবৃত্তি: স্টেশনে পৌঁছলেও চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা বেরিয়ে গেল। দৌড়ে চলন্ত ট্রেনের হাতল ধরতে গিেয় পড়ে গেল বিতান। অন্য দিকে হাসপাতালে বেড পাওয়ার জন্য নিরুপায় হয়ে জীবনে প্রথম বার ঘুষ দিলেন সাম্যব্রত।

ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

ইন্দ্রনীল সান্যাল
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সাম্যব্রত সেই সময়ে কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রোগীর নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর... এই সব তথ্য জুগিয়ে বেড হেড টিকিট বা বিএইচটি রেডি করছিলেন। সাম্যব্রত বললেন, “পেশেন্টের পায়ে ও হাতে চোট লেগেছে।”

প্রিন্টার থেকে ফড়ফড় করে টিকিট বেরোচ্ছে। সেগুলো টেনে নিয়ে স্টেপলার দিয়ে আটকে ছেলেটি বলল, “কী করে লাগল?”

“পায়ে বোমার টুকরো লেগেছে। হাতে লাঠির আঘাত,” বললেন সাম্যব্রত।

ছেলেটা অবাক হয়ে সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, “লেবার পেশেন্টের মারামারি কেস? জীবনে শুনিনি।” তার পর টিকিটের কোণে রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে ধপাস করে একটা ছাপ্পা দিল। টিকিট হাতে নিয়ে সাম্যব্রত দেখলেন, ছাপ্পায় লেখা রয়েছে, ‘পুলিশ কেস’। দরিয়াকে পরীক্ষা করে ডক্টর ঘোষ এগজামিনেশন রুম থেকে ফেরত এসেছেন। সাম্যব্রত টিকিট তুলে দিলেন ডক্টর ঘোষের হাতে।

টিকিট দেখে ডাক্তার ঘোষের মুখচোখ বদলে গিয়েছে। খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “পুলিশ কেসের স্ট্যাম্প মারা কেন?”

“ফিজ়িকাল অ্যাসল্ট হয়েছে স্যর,” বিনীত ভাবে বললেন সাম্যব্রত। “মেয়েকে নিয়ে নার্সিং হোমে যাব বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, এমন সময়ে বোমাবাজি হয়েছে। পায়ে বোমার টুকরো লেগেছে। হাতে লাঠির আঘাত।”

ডক্টর ঘোষ নিদানপত্র লিখছেন। সাম্যব্রত চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যে ডাক্তার হাসপাতালের বেড বিক্রি করে কাট-মানি নেন, তিনিই আবার বিভূতিভূষণ আর তারাশঙ্কর পড়েন। কী বিচিত্র জীবন!

নিদানপত্র লেখা শেষ করে ড্রয়ার থেকে মোটকা প্যাড বার করে ডক্টর ঘোষ বললেন, “ইনজুরি রিপোর্ট লেখা মানেই অশান্তি। কয়েক দিন বাদে কোর্ট থেকে সমন আসবে সাক্ষী দিতে যাওয়ার জন্য।” তার পর দরিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কে মেরেছে? কী দিয়ে মেরেছে? কোথায় মেরেছে? যা জিজ্ঞেস করছি, তার স্পেসিফিক উত্তর দেবে। একটাও বেশি কথা বলবে না।”

দরিয়া ঘাবড়ে গিয়ে সাম্যব্রতর দিকে তাকাল। সে তো জানেই না কে তাকে মেরেছে! সাম্যব্রত ইশারায় দরিয়াকে চুপ থাকতে বললেন। নিজে বললেন, “কে মেরেছে দেখতে পাইনি।”

ইনজুরি রিপোর্ট লেখা শেষ করে ডক্টর ঘোষ বললেন, “পায়ের চোটটা দেখাও।”

দরিয়া শাড়ি সরিয়ে পায়ের চোট দেখাল। পুঁচকে একটা টর্চ জ্বেলে দরিয়ার চোখে আলো ফেললেন। কী দেখলেন কে জানে! মুহূর্তের মধ্যে তাঁর শরীরের ভাষা বদলে গেল।

দরিয়ার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “খিঁচুনি হয়েছিল?”

“না।”

“বমি করেছিলে না কি?”

“না। তবে কিছু ক্ষণ আগে থেকে গা গুলোচ্ছে,” বলল দরিয়া। তার পর সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিকট জোরে ওয়াক তুলল।

ডক্টর ঘোষ মন্টুকে বললেন, “তাড়াতাড়ি একে লেবার রুমে নিয়ে যাও। ওখানে গাইনির ডাক্তার দেখে ডিসিশন নেবে। আমাকে অন্য পেশেন্ট দেখতে দাও।”

সিস্টারের পাশে দাঁড়িয়ে মন্টু দরিয়াকে দেখছিল। ডক্টর ঘোষের কথা শুনে বলল, “ইয়েস স্যর।” তার পর ট্রলি ঠেলতে লাগল। দরিয়া শুয়ে শুয়ে দেখল, সিস্টার সাম্যব্রতকে বলছে, “আপনি ইমার্জেন্সির বাইরে অপেক্ষা করুন। দরকার হলে আমরা ডেকে নেব।”

ট্রলিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় ঘাড় উঁচু করে দরিয়া দেখল, সাম্যব্রত চাতক পাখির মতো তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। একটা সুইং ডোর হঠাৎ দু’দিকে খুলে গিয়ে ট্রলি সমেত দরিয়াকে গপ করে গিলে দু’পাটি চোয়াল বন্ধ করে দিল।

বিশাল বড় করিডোর দিয়ে ট্রলি চলেছে ঘড়ঘড় করে। দরিয়া ভাবছে, বিহান কত দূর এল কে জানে! তার মনে পড়ে যাচ্ছে বিহানের সঙ্গে প্রথম আলাপের দিনটার কথা...

সরল সাদাসিধে ছেলেটাকে এক পলক দেখেই ভাল লেগেছিল। ওই রকম ভাললাগা অনেককে দেখে তৈরি হয়। মেসি আছেন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আছেন। উত্তমকুমারকেও ভাল লাগে! ওই নিয়ে মাথা ঘামায়নি দরিয়া।

ঝামেলা পাকিয়েছিল মণিদীপা। ছোট্টবেলা থেকে বাংলা আর হিন্দি সিনেমা দেখে দেখে মেয়েটা খুব পাকা। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ে অঙ্ক খাতায় ছবি এঁকে বুঝিয়েছিল, কী করে বাচ্চা হয়। কী অসভ্য! ইস!

মণিদীপাই দরিয়াকে বলেছিল, “অ্যাই! তোর চোখমুখ অন্য রকম লাগছে কেন রে?”

“কী রকম আবার লাগবে?” ফুল বিলোতে বিলোতে বলেছিল দরিয়া।

“ওই বিহানটা ছেলেটার সঙ্গে ইশারায় কী সব কথা হল দেখলাম! কী ব্যাপার?” কনুই দিয়ে দরিয়ার কোমরে ধাক্কা মেরে মণিদীপা গেয়ে উঠল, “চোখে চোখে কথা বলো, মুখে কিছু বলো না, হায় রে!” ‘হায় রে’ বলার সময়ে ফিল্মি কায়দায় ডান হাতের মণিবন্ধ দিয়ে কপালে ধাক্কা মারল।

“তুই চুপ কর,” লজ্জায় লাল হয়ে দরিয়া বলেছিল, “বিদ্যার আরাধনার দিনও তোর অসভ্যতা গেল না।”

অঞ্জলি দেওয়ার সময়ে বিহানের দিকে তাকানোর ফুরসত পায়নি দরিয়া। পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পরে যখন তপন স্যরের বৌয়ের সঙ্গে বসে সবার জন্যে ভোগের প্রসাদ ভাগ করছে, তখন মণিদীপা উড়তে উড়তে এসে দরিয়ার কানে ফিসফিস করে বলল, “ছোকরা এখনও লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। ওকে বলে দিই যে আজ সন্ধেবেলা শরৎ সদনে ফাংশন দেখতে যাচ্ছি।”

“কী ফাংশন?” আকাশ থেকে পড়েছিল দরিয়া।

“আমি কী করে জানব?” মুখ বেঁকিয়ে চলে গিয়েছিল মণিদীপা।

অঞ্জলি দিয়ে সনৎ চলে গিয়েছিল। ভোগ খাওয়ার জন্য রয়ে গিয়েছিল বিহান। ভোগ খাওয়াটা অছিলা। আসলে সে দরিয়ার জন্য ফিল্ডিং কাটছিল। মণিদীপা তার কাছে গিয়ে বলল, “আজ বিকেল চারটের সময়ে শরৎ সদনে ফাংশন আছে। আমি যাচ্ছি!”

“দরিয়া আসবে না?” উতলা হয়ে জিজ্ঞেস

করে বিহান।

“হাঁদা গঙ্গারাম!” ভোগের খিচুড়ির হাতা নেড়ে, জিভ কেটে পালিয়ে গেল মণিদীপা।

মণিদীপা যায়নি। দরিয়া এসেছিল আকাশি রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। বিহান পরেছিল সাদা টি-শার্ট আর নীল ডেনিম। দু’জনে মিলে শরৎ সদনে ঢুকতে গিয়ে দেখে, গেটের বাইরে ফুচকা বিক্রি করছে বুধনকাকা। পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে লেডিস পিন্টু।

ওদের দেখে দরিয়া এক ছুটে পালিয়ে গেল। পিছন পিছন বিহান। দু’জনে মিলে উঠে বসল ফাঁকা একাত্তর নম্বর বাসে। এই বাসটা স্লো সাইকেল রেসে নাম দিলে ফার্স্ট হত। হাওড়া ময়দান থেকে শিয়ালদা যেতে ছুটির দিনেও একটি ঘণ্টা সময় নেয়।

ফাঁকা বাসে বসে দু’জনের সে কী কলকল করে গল্প! কে কোথায় থাকে, কার বাড়িতে কে আছে, কোন স্কুলে পড়ে, বারো ক্লাস পাশ করার পরে কী প্ল্যান... সব আলোচনা হয়ে গেল। বিহানের মোবাইল থাকলেও দরিয়ার কোনও মোবাইল ফোন নেই। সে সীমার ফোন নম্বর দিয়ে বিহানকে প্রমিস করিয়ে নিল, কখনও ফোন করবে বা। সীমা যখন স্নান করতে যাবে বা ঘুমোবে, তখন দরিয়া মিসড কল দেবে। তৎক্ষণাৎ বিহানকে ফোন করতে হবে।

গল্পে গল্পে এক দিকের ট্রিপ শেষ। শিয়ালদার বাসস্ট্যান্ডে নেমে চা, ফুচকা, চুরমুর আর এগরোল খেয়ে ফেরার জন্য অন্য একটা একাত্তর নম্বর বাসে উঠল দু’জনে। সন্ধে নেমেছে। ফাঁকা বাস। চোরের লজ্জা নিয়ে বিহান টুক করে ছুঁয়ে দিল দরিয়ার আঙুল। দরিয়া ভীষণ রেগে গিয়ে বিহানের হাতে চিমটি কেটে দিল।

বিহানের খুব জোরে লেগেছে। সে দরিয়ার ঝুঁটি ধরে দিল এক টান!

চুলে হাত দেওয়া! দরিয়া তো রেগে আগুন! সে বিহানের গাল টিপে দিয়ে বলল, “পুচু পুচু! বাচ্চা ছেলের সাহস কত!”

“কী? আমাকে বাচ্চা বলা? দাঁড়াও। মজা দেখাচ্ছি।” পিছনের সিটের কোনার দিকে দরিয়াকে ঠেসে ধরে টুক করে গালে চুমু খেয়ে নিল বিহান। ওমনি দরিয়া সিঁটিয়ে গেল। সেই যে মাথা নিচু করে, জড়োসড়ো হয়ে, গায়ে ওড়না জড়িয়ে লেডিস সিটে গিয়ে বসল, আর ঘুরেও দেখল না।

পিছনের সিটে বসে বিহান তখন অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছে। এ কী করল সে? একটা মেয়েকে চুমু খেল? এখন যদি কোনও গন্ডগোল হয়ে যায়? কী জাতীয় গন্ডগোল হতে পারে, এই নিয়ে কোনও ধারণা নেই বিহানের। কিন্তু সে লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

হাওড়া স্টেশনে বাস থেকে নেমে গেল দরিয়া। সে লিলুয়ার ট্রেন ধরবে। এক বারও ঘুরে তাকাল না। দরিয়া অনেক পরে বিহানের মুখে শুনেছিল, হাওড়া ময়দানে বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে মরমে মরে যাচ্ছিল বিহান। সে এ কী করল! সে তো সনতের থেকেও খারাপ ছেলে! ও শুধু মুখে মেয়েদের নিয়ে খারাপ কথা বলে। আর সে? আলাপের প্রথম দিনই চুমু খেয়ে ফেলল? ছি!

দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মায়ের কাছে প্রচণ্ড বকুনি খেয়েছিল বিহান। শ্রীরূপার ধমক মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল। রাতে স্বপ্নে এল বাসন্তী রঙের প্রজাপতি। সে ফড়ফড় করে খাটের চারিদিকে উড়ছে আর বলছে, “তপনার টোলে, পুচু পুচু দোলে।” তাই শুনে তপন স্যরের বৌ বলল, “বাচ্চা ছেলের সাহস কত!” বিহান দেখল একটা একাত্তর নম্বর বাস ফুল স্পিডে আসছে। তার চালকের আসনে বসে সনৎ বলছে, “নিজ মাল নিজ দায়িত্বে রাখিবেন। হাওড়া শিয়ালদা! হাওড়া শিয়ালদা! বজবজ... বজবজ...”

ভোর রাতে বারমুডা ভিজে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে গেল বিহানের। সে বাথরুমে গিয়ে বারমুডা ধুয়ে এল।

সারা দিন কেটে গেল ফোনের অপেক্ষায়। দরিয়ার মায়ের মোবাইল থেকে কখন মিসড কল আসবে সেই আশায় বসে থেকে পড়াশুনো ডকে উঠল। টিউশনি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। দরিয়ার স্কুলের সামনে সাইকেল নিয়ে ঘোরাঘুরি করে সারাটা দিন কাটিয়ে দিল বিহান।

ফোন এল রাত আটটার সময়ে। বিহান তখন ত্রিকোণমিতির প্রবলেম খুলে বসে রয়েছে। ‘মনে করো ক-খ-গ একটি বিষমবাহু ত্রিভুজ।’ একবার রিং হয়ে কেটে গেল ফোন। বাঘের মতো লাফিয়ে নিজের মোবাইল থেকে রিং ব্যাক করল বিহান।

ও পাশ থেকে দরিয়া বলল, “স্কুলের বাইরে বোকার মতো দাঁড়িয়েছিলে কেন? কেবলুশ কোথাকার!”

রাগেনি! রাগেনি! ‘কেবলুশ’ বলেছে মানে রাগেনি! সারা দিনের সব টেনশন চলে গেছে বিহানের। সে বলল, “তুমি কাল কথা বললে না কেন? আমার বুঝি কষ্ট হয় না? আমি সারা দিন পড়াশুনো করতে পারিনি। টিউশনি যাইনি। মা আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে! মনে হয় সব বুঝতে পেরে গেছে!”

“মন দিয়ে পড়াশুনো করো। দু’মাস বাদে পরীক্ষা। ভাল রেজ়াল্ট করতে হবে,” টুক করে ফোন কেটে দিয়েছে দরিয়া।

ক্রমশ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy