ছবি: মহেশ্বর মণ্ডল
অফিস ছুটি নিয়েছি আজ। অবসরের দেরি নেই, ফলে ছুটিও পাওনা আছে যথেষ্ট। কাল অফিস থেকে ফেরার সময় পদ্মার ইলিশ কিনে এনেছি। এ বছরের মতো ইলিশের দিন শেষ। কোল্ড স্টোরেজের ইলিশ। তাও লোভ সামলাতে পারলাম না। রান্নার লোভনীয় গন্ধ বাড়িময়, পাড়াতেও ছড়িয়েছে। আজ ঝোলে, কাল ভাপা খাওয়া হবে। আর তেলের সঙ্গে এক পিস করে ভাজা। বড় রহস্যময় মাছ। এক বার চোখে পড়লে মন ফেরানো মুশকিল। সকালের চা, জলখাবারের পর্ব সারা। লুচি দিয়ে আলুচচ্চড়ি। শরীর মনে আয়েসি ভাব।
শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজটা দেখছি। সাড়ে দশটা প্রায়, পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। কাগজটা সরিয়ে রেখে ফোন ধরলাম। অচেনা নম্বর।
“হ্যালো, কে বলছেন?”
“হ্যালো, আমি আপনার ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছি। আপনি বিজন দত্ত বলছেন তো?”
ও পারের লোকটা আমার নামটা ঠিকই বললেন। বললাম, “হ্যাঁ, আমি বিজন দত্তই বলছি। আপনি কোন ব্যাঙ্ক থেকে বলছেন, স্যর?”
“কোন ব্যাঙ্ক থেকে মানে!” একটু অবাক হয়ে ও পারের ভদ্রলোক বললেন, “এখানে তো আপনার সেভিংস অ্যাকাউন্ট, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সবই তো আছে। আপনার কেওয়াইসি আপডেট করার জন্য কিছু ইনফর্মেশন আমাদের দরকার। নয়তো আপনার সব কার্ড ব্লক হয়ে যাবে। অ্যাকাউন্টের পুরো টাকাটা ব্লক হয়ে যাবে।”
বুঝলাম, সক্কাল সক্কাল এক ফ্রডের পাল্লায় পড়েছি। এমন ফোন আগেও দু’বার পেয়েছি। অনেকেই পাচ্ছে। কেউ কেউ সাবধান হয়ে বেঁচে যাচ্ছে। অনেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সরল বিশ্বাসে টাকা খোয়াচ্ছে। এই তো গত সপ্তাহে আমার এক বন্ধু আশি হাজার টাকা খোয়াল। আরও বড় বড় অঙ্কের টাকা খুইয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত প্রায়। আমাদের কাজের মহিলা, সরলামাসি সে দিন এসে বলল, “ও দাদাবাবু, ব্যাঙ্কির লোক আমায় ফোন করিছিল। বললে, ‘তোমার ফিক্স ডিপোজিটগুনোর মেয়াদ ফুইরে গেছে। আর দেরি করলি ওই ট্যাকা আর পাবে নে। আমরা ব্যাঙ্কির লোক, কাগজপত্তর আর হাজার কুড়ি ট্যাকা নে চলি এসো, ঠিকানা বলি দিচ্চি, পুরো ট্যাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি দোব।’ আমি তো খুব ভয় পেয়ি গেলুম। এত ট্যাকাই বা আমি হুট বলতে কোথায় পাব। পরে ভাবলুম, মেয়াদ ফুইরেচে বলি কেন ট্যাকা মার যাবে! সন্দো হল। বড় ছেলিকে ব্যাঙ্কি পাটালুম। সে ফিরি এসি বললে, ‘ব্যাঙ্ক থিকি ওরম কোনও ফোন যায়নে। জোর বাঁচা বেঁচি গেছ।’”
বুঝলাম, ব্যাটা ভুজুংভাজুং দিয়ে সরলামাসির কুড়ি হাজার টাকা মেরে দিত। সরলামাসি একটু একটু করে টাকা জমিয়ে তিনটে ফিক্সড ডিপোজ়িট করেছে। কারণ সামনে ওর বড় মেয়ের বিয়ে।
এ দিকে আমার হাতে আজ অঢেল সময়। ঠিক করলাম, লোকটার সঙ্গে একটু খেলা করা যাক। বললাম, “আমার তো অনেকগুলো ব্যাঙ্কেই অ্যাকাউন্ট আর ও সব কার্ড আছে...” বলেই কতগুলো নাম গড়গড় করে বলে যেতে লাগলাম। যা মনে আসছে, থামছি আর না।
লোকটা বোধহয় শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। একটা নাম খপ করে লুফে নিয়ে বলল, “এসবিআই।”
“এসবিআইয়ের কোন ব্রাঞ্চ স্যর?” কণ্ঠস্বরে কৃত্রিম শঙ্কা মিশিয়ে প্রশ্ন করলাম। যেন আমি টাকা চোট হওয়ার ভয়ে ঘাবড়ে গিয়েছি।
লোকটা খানিক চুপ থেকে জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, “এসবিআইয়ের ক’টা ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট আছে আপনার?”
আমি লোকটাকে খেলার পরিসর দিতে দুটো ব্রাঞ্চের নাম বললাম, “যাদবপুর আর ঢাকুরিয়া ব্রাঞ্চে, স্যর। আপনি কোনটাতে...”
লোকটা চট করে প্রথম নামটা লুফে নিয়ে বলল, “যাদবপুর এইটবি ব্রাঞ্চ থেকে বলছি।”
আমি উচ্ছ্বাস দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ও! আপনি ম্যানেজার দিবাকর সামন্ত বলছেন, স্যর?” কেন যেন দিবাকর সামন্ত নামটা আমার মুখে চট করে খুব আসে।
ও প্রান্ত খানিক চুপ। মনে হল, হঠাৎ নতুন নাম-সহ ম্যানেজার পোস্ট পেয়ে লোকটা একটু ঘাবড়ে গেল। আমি তাড়া লাগালাম, “হ্যালো, দিবাকরবাবু!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি দিবাকর সামন্তই বলছি। লাইনটা খুব ডিস্টার্ব করছে, বুঝলেন। তা আপনার প্রবলেমের কথা তো শুনলেন। এখন চট করে ইনফর্মেশনগুলো...”
কী অধীর আগ্রহ!
আমি এক গাল হেসে রসিকতা করে বললাম, “এই সকালেই কাস্টমারের সেবায় লেগে পড়েছেন, স্যর? তা ভাল।”
“পড়তেই হয়। আপনারাই যে আমাদের লক্ষ্মী মশাই। হ্যাঁ, ইনফর্মেশনগুলো এ বার বলুন...” লোকটার অমায়িক কণ্ঠস্বর। বিনয়ের অবতার যেন।
আমি খেলায় নতুন স্ট্র্যাটেজি যোগ করতে কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বললাম, “আপনি যে আমার কত বড় উপকার করলেন স্যর! আমার ওই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আড়াই লাখ টাকা রয়েছে। বৌয়ের গয়না বিক্রির টাকা। একটা জমি দেখাশোনা চলছে। কথা ফাইনাল হলে টাকাটা অ্যাডভান্স করব। এক বছরের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন। ভাগ্যিস আপনি ফোনটা করলেন, নইলে পুরো টাকাটাই তো...” লোকটাকে আরও লোভাতুর করে তুলতেই পড়ে থাকা মাত্র আড়াই হাজার টাকাকে মুহূর্তে আড়াই লাখ বানিয়ে দিলাম। সেই সঙ্গে দু’জনের এই খেলার জন্য একটা জমির ব্যবস্থাও করে ফেললাম!
এমন সময় স্ত্রী শর্মিলা দ্বিতীয় দফার চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঘন ঘন লিকার চা খাওয়া আমার অভ্যেস। চোখের ইঙ্গিতে জানতে চাইল, এত ক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বলছি।
আমি ঠোঁটের বাঁকে ছোট্ট হাসি খেলিয়ে চোখমুখের ইশারায় বললাম, ‘একটা মজার খেলা চলছে, চা-টা রেখে চলে যাও, প্লিজ়!’
শর্মিলা কী বুঝে ব্যাপারটাকে আর ঘাঁটাল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি কথা এগোলাম, “বুঝলেন স্যর, দু’কাঠা জমি দশ লাখ চাইছে। নিজের একটা বাড়ি করার বহু দিনের শখ। এখন মুশকিল হয়েছে পুরো টাকাটা জোগাড় করতে। ক’দিন ধরেই ভাবছিলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করব। বাড়ির দলিলটা মর্টগেজ রেখে যদি কিছু পাওয়া যায়। বাকি টাকার ব্যবস্থা শ্বশুরমশাই করবেন বলেছেন। লজ্জার মাথা খেয়ে নিতেই হচ্ছে। সবই শোধ করে দেব...” আমি দিবাকর সামন্তকে আরও বড় জালে জড়িয়ে আপন করে নিতে বললাম, “আপনার মনে আছে কি না জানি না স্যর, আপনি আমার ছেলের এডুকেশন লোনটা পেতে খুব হেল্প করেছিলেন। ছেলের এ বছর লাস্ট ইয়ার। খুব ভাল রেজ়াল্ট করছে। সামনের বছর মেয়েও জয়েন্ট দিচ্ছে। পেলে ফের কিন্তু আপনার কাছে যাব, স্যর! আমার স্ত্রী শর্মিলা এখনও আপনার কথা খুব বলে!”
যেন আমাদের কত কাছের মানুষ ওই দিবাকর সামন্ত, এমনই সহৃদয় কণ্ঠ আমার।
লোকটা খানিক দেঁতো হেসে বলল, “সে হবে এখন। আগে তো এই বিপদ থেকে উদ্ধার হোন! ইনফর্মেশনগুলো তাড়াতাড়ি...”
আমি যেন সাঁতার না জানা একটা লোক। গভীর সমুদ্রে পড়ে বাঁচার জন্য খাবি খাচ্ছি। কিছুতেই আর মাথা তুলে শ্বাস নিতে পারছি না। ডুবছি আর ডুবছি! লোকটার কথায় একশো শতাংশ সম্মত হয়ে বললাম, “ঠিকই তো, ঠিকই তো। ঘরের বাইরে ডাকাত বসে আছে জেনেও কি দরজা খোলা রেখে ঘুমোনো যায় স্যর!”
লোকটার দেঁতো হাসি এ বার উচ্চকিত হল। বলল, “বেড়ে বললেন কিন্তু কথাটা বিজনবাবু। তা এ বার ইনফর্মেশনগুলো যদি... আসলে আজ আমি অনেকগুলো কাজের চাপে আছি। একটা একটা করে সারতে হবে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই অনেকটা সময়...”
বুঝলাম, লোকটা আজ অনেককেই মুরগি করার ব্রত নিয়ে সকাল সকাল মাঠে নেমে পড়েছে। হয়তো আমিই ওর প্রথম টার্গেট। গলায় অনুশোচনা ফুটিয়ে বললাম, “আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি, স্যর। প্লিজ় কিছু মনে করবেন না। আর সময় নষ্ট করব না আপনার। ও হ্যাঁ, শুনুন না, আজকে আমি অফিস ছুটি নিয়েছি। শালির মেয়ের জন্মদিন। সেই গুমো হাবরায়। বনগাঁ লাইন। চেনেন তো? বেলা চারটেয় বেরোব। ফিরতে ফিরতে রাত ক’টা হয় কে জানে...”
লোকটা আমার কথার সঙ্গে ‘হুঁ, হাঁ, ঠিকই, ঠিকই তো’ বলে সায় দিয়ে যেতে লাগল। ঘাপটি মেরে বসে থাকা এক ক্ষুধার্ত বাঘ যেন। ইনফর্মেশনগুলো পেলেই পুরো টাকাটা ঝাঁপিয়ে পড়ে গাপ করে নেবে। ইনফর্মেশন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকা উড়ে যাওয়ার এসএমএস মোবাইলে ঢুকবে আমার। টুক করে বললাম, “এখন ফ্রি আছি যখন, তখন ব্যাঙ্কে গিয়েই না হয় ইনফর্মেশনগুলো দিই, সঙ্গে করে দলিলপত্রগুলোও নিয়ে নিই। লোনের ইনিশিয়াল কথাবার্তাগুলো সেরে রাখি। কাজ এগিয়ে থাকবে, কী বলেন?”
লোকটা বলল, “আপনার তো তৈরি হয়ে আসতে সময় লাগবে। ইনফর্মেশনগুলো পেলে আমি এখনই প্রসেসিংটা শুরু করে দিতে পারি।”
বুঝলাম, লোকটা কিছুতেই মাঠ ছাড়বে না। মুহূর্তে আমার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল, সবেধন নীলমণি ওই টাকাটা কেমন জলবৎ তরলং হয়ে শয়তানটার রংচঙে পকেটে সুড়ুত করে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু আমি আশঙ্কায় আঁতকে উঠলাম না। শেষ হাসিটা যে আমিই হাসব। হাসতে হাসতে মাঠ ছাড়ব। বললাম, “কত ক্ষণ আর লাগবে, স্যর। এই মিনিট পনেরো ধরুন। পাজামাটা পরাই আছে। পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে ওয়ালেটটা পকেটে ঢুকিয়ে নিচ্ছি এই। আলমারি খুলে দলিলের ফাইলটা নিতে মিনিট খানেক। বাড়ির সামনেই বড় রাস্তা। বেলা হয়েছে, হুসহাস করে খালি অটো ছুটছে। ধরে নিয়ে টুক করে পৌঁছে যাব।”
তার পর গলার জোর বাড়িয়ে লোকটাকে শুনিয়ে শর্মিলার উদ্দেশ্যে বললাম, “এই শুনছ, আমি একটু যাদবপুর এসবিআই থেকে ঘুরে আসছি। ম্যানেজারবাবু কিছু ইনফর্মেশন চাইছেন, নয়তো অ্যাকাউন্টের টাকাটা মার যাবে বলছেন। একেবারে জমির টাকার জন্য লোনের কথাবার্তাটাও সেরে আসি। যাব আর আসব, কত ক্ষণ আর সময় লাগবে। তোমার সেই শ্রদ্ধেয় ম্যানেজার, সম্মাননীয় দিবাকরবাবুর কাছে যাচ্ছি।”
মুহূর্তের মধ্যে খেলা শেষের বাঁশি বেজে উঠল। ওই প্রান্ত থেকে তীব্র ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে চার অক্ষরের একটা অশ্লীল শব্দ আমার প্রতি বর্ষিত হয়েই লাইনটা দুম করে কেটে গেল।
আমি উচ্চ স্বরে হাসছি। হেসেই চলেছি। দেখে শর্মিলা অবাক। বিস্মিতও। হয়তো ভাবছে, পাগলই হয়ে গেলাম বুঝি। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “অমন করে হাসছ কেন, ব্যাঙ্কে যাবে বললে যে? ম্যানেজারবাবু ফোন করেছিলেন না?”
আমি হাসতে হাসতেই শর্মিলার হাত ধরে ওকে পাশে বসালাম। পুরোটা শুনে শর্মিলা বলল, “আবার ওই ফ্রড কল! অ্যাকাউন্টে আমার গয়না বিক্রির আড়াই লক্ষ টাকা! দলিল মর্টগেজ রেখে জমি কেনার টাকা জোগাড়! বাকিটা আমার বাবার কাছ থেকে! ছেলেমেয়েদের এডুকেশন লোন! বোনের মেয়ের জন্মদিন! এ সব কী? যত্ত সব আবোলতাবোল, তুমি পারোও বটে!”
আমি মুচকি হেসে বললাম, এ সব হল আমার টাইমপাস খেলার ঘুঁটি। একটার পর একটা দান চেলে লোকটার সঙ্গে দিব্যি সময় কাটালাম।
শর্মিলা কপট রেগে দু’চোখ বড় করে, ঠোঁট মুচড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বেশ উপভোগ্য দৃশ্য। দেওয়াল-ঘড়িতে সময় দেখি। বারোটা বেজে গেছে! আজ যে শুভ দিন। চট করে বিছানা থেকে নেমে পড়লাম। স্নানটা সেরে নিই। গরম ভাতের সঙ্গে পদ্মার ইলিশ ডাকছে!
বড় রহস্যময় মাছ এই ইলিশ। কখন কার ভাগ্যে আছে, কেউ বলতে পারে না। যে ফ্রডটা ফোন করেছিল, তার টার্গেট লিস্ট থেকে বেঁচে বেরোতে পেরেছি বলে আমি ইলিশ খাব। ফাঁদে পড়ে গেলে, ইলিশটা আর আমাকে খেতে হত না। চিটিংবাজটা কাল বাজার থেকে কিনত। তার পর দুপুরে আয়েস করে খেত। ইলিশ শুধু রহস্যময় নয় দার্শনিক মাছও— কারও কারও জোটে বলেই বাকিদের জোটে না, আবার বাকিদের জোটে না বলেই কারও কারও...
গামছা কাঁধে ফেলে নিজের মনে হাসতে হাসতে কলঘরের দিকে পা বাড়াই আমি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy