Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব ১৭

শেষ নাহি যে

শীতের রোদে পিঠ দিয়ে গাদাগাদা প্রেমিক যুগল বসে রয়েছে সামনের চত্বরে। দরিয়া এক বার ভাবল, চেনা কেউ যদি এখানে তাকে দেখে ফেলে? তার পরে মনে হল, দেখলে কী অসুবিধে? সে তো কোনও অন্যায় করছে না।

ছবি: শুভম দে সরকার

ছবি: শুভম দে সরকার

ইন্দ্রনীল সান্যাল
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঝামেলায় ট্রেন অবরোধ হয়। ট্রেন চালানোর অনুরোধ করলে গন্ডগোল শুরু হয়। পাথরের আঘাতে আহত হয় বিহান। পালাতে পালাতে তার মনে পড়ে দরিয়ার কথা। সে জানে, সন্তানের জন্মের সময় সে পৌঁছতে না পারলে দরিয়া অভিমান করবে।

বিরক্ত হয়ে এই নিয়ে সীমার সঙ্গে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে দরিয়া। শুধু সাম্যব্রতর জন্য খারাপ লাগে। দিনরাত ওষুধ আর অসুখের কথা শুনেও লোকটা মুখ বুজে থাকে। কতখানি ভালবাসা থাকলে এই জিনিস সম্ভব! বিহান এই রকম হয়ে গেলে সে তো দু’দিনও টলারেট করতে পারবে না!

সকালের শোয়ের টিকিটের দাম কম। দরিয়া ভেবেছিল স্কুল-কলেজ কাটা ছেলেমেয়েদের জন্য এই শো রাখা হয়েছে। রিভারসাইড মলের পাঁচতলায়, মাল্টিপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে তার ভুল ভাঙল। বয়স্ক লোকজন, ফ্যামিলিম্যান, কলেজ কাটা যুগল... সব রকমই মজুত। বেলা এগারোটার শোতে টিকিটের দাম একশো কুড়ি টাকা। দুশো চল্লিশ টাকা দিয়ে সিনেমার টিকিট কাটতে গা কড়কড় করছে। কিন্তু কী আর করা! টিকিট সে কাটবে আর বিহান পিৎজ়া খাওয়াবে, এই রকম চুক্তি হয়ে আছে।

টিকিট কেটে নীচে নেমে রিভারসাইড মলের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে দরিয়া। সাড়ে দশটা বাজে। বিহান এলে দু’জনে মিলে ঢুকবে। ও বেচারি কখনও এখানে আসেনি। ওকে ছাড়া একা একা ভিতরে ঘুরতে ইচ্ছে করছে না। ওই সব আলো-ঝলমলে দোকান, দামি জামা-জুতো-ড্রেস, ইলেকট্রনিক গুডস চিরকাল তাদের সামর্থ্যের বাইরে থেকে যাবে। দৃষ্টিসুখটা অন্তত দু’জনে মিলে করা যাক।

শীতের রোদে পিঠ দিয়ে গাদাগাদা প্রেমিক যুগল বসে রয়েছে সামনের চত্বরে। দরিয়া এক বার ভাবল, চেনা কেউ যদি এখানে তাকে দেখে ফেলে? তার পরে মনে হল, দেখলে কী অসুবিধে? সে তো কোনও অন্যায় করছে না।

চত্বরের এক কোণে বসে সে নিজের সাদাকালো মোবাইল বার করল। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে সাম্যব্রত মোবাইলটা কিনে দিয়েছেন। সবার হাতে দামি স্মার্টফোন। সবাই সেল্‌ফি, ডুয়াল্‌ফি বা গ্রুপ্‌ফি তুলছে। ওদের সামনে গাবদা ফোন হাতে নিতে লজ্জা করছে দরিয়ার। কিন্তু কী আর করা! বিহানকে ফোন করা জরুরি। ছেলেটা কত দূর এল কে জানে!

বিহানকে মিস্‌ড কল দিল দরিয়া। তাদের মধ্যে চুক্তি করা আছে। বিহান চায় না, দিনের বেলায় দরিয়া তাকে ফোন করে টাকা নষ্ট করুক। রাতে আনলিমিটেড ফ্রি কলের অপশন আছে। তখন দরিয়া ফোন করে।

মিস্‌ড কল দেওয়ার পাঁচ মিনিট পরেও বিহান ফিরতি ফোন না করায় অবাক হল দরিয়া। দশটা পঁয়ত্রিশ বাজে। হাতে এখনও অনেক সময় আছে। শিবপুর থেকে এখানে আসতে মিনিট দশ লাগে। বিহান বোধ হয় বাসে আছে। শুনতে পায়নি।

পৌনে এগারোটা। এ বার একটু চিন্তা হচ্ছে দরিয়ার। আবার মিস্‌ড কল দিল। এ বার বিহানের ফোন করা উচিত। কাছাকাছি চলে আসার কথা। হাওড়াগামী বাস আর মিনিবাসের দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে দরিয়া। দেখছে কে কে নামল।

এগারোটা বাজতে পাঁচ। আর মিস্‌ড কল দেওয়ার রিস্ক নেওয়া যাচ্ছে না। দরিয়া রিং হতে দিল। বিহানের রিংটোন হল, ‘হয়তো তোমারই জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য, আশার হাত বাড়াই।’ এই সব গানকে কী করে রিংটোন করে কে জানে বাবা! ওর মা ফোন করে এই গানই শুনতে পায়। ছিঃ!

চার লাইন গান দু’বার বেজে থেমে গেল। বিহান ফোন ধরল না। দরিয়া আবার ফোন করল। আবার বিহান ফোন ধরল না। দরিয়া আবার ফোন করল। বিহান আবার ফোন ধরল না। দরিয়া আবার ফোন করল। বিহান এ বার লাইন কেটে দিল।

দরিয়া আবার ফোন করল। ও প্রান্ত থেকে যন্ত্রমানবী বলল, “আপনি যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন তাঁর মোবাইল এখন বন্ধ আছে।’’ যন্ত্রমানবী ‘বন্ধ’ শব্দটা বলার সময়ে জোর দিল। দরিয়ার মনে হল, মোবাইলের ভিতরে বসে থাকা মেয়েটা তাকে ব্যঙ্গ করছে।

আশা ছাড়ল না দরিয়া। ফোন করে যেতেই লাগল। তিনবার, চারবার, আটবার, একুশবার, একশোবার...

এগারোটা, সাড়ে এগারোটা, বারোটা, একটা, দুটো...

শপিং মলের সিকিয়োরিটির ছেলেটি দরিয়াকে জিজ্ঞেস করে গেল, “কারও জন্য অপেক্ষা করছেন?”

দরিয়ার রাগ হচ্ছে, ভয় করছে, কান্না পাচ্ছে। বিহান কেন এই রকম করল তার সঙ্গে? কেন? ও কি তাকে ডাম্প করল? নতুন কোনও গার্লফ্রেন্ড হয়েছে? বিহানের মায়ের শরীর খারাপ নয় তো?

বুকে পাথর বেঁধে দরিয়া বাড়ি চলে গেল। এবং, ‘বসবাস’-এ ঢোকার আগে মায়ের জন্য অম্বলের ওষুধ কিনল। বাবা-মা ছাড়া আর কেউ কাছের মানুষ হয় না। সে আর কোনও দিনও বিহানকে ফোন করবে না। এ বার থেকে তার মোবাইল সুইচ্‌ড অফ থাকবে।

বিকেল সাড়ে চারটের সময়ে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে মাথা খারাপ হয়ে গেল বিহানের। প্ল্যাটফর্মে লোক থিকথিক করছে। ট্রেন অবরোধের ফলে প্রতি মূহূর্তে লোক বাড়ছে। যে সব ট্রেনের হাওড়া ছেড়ে যাওয়ার কথা, সেগুলো যাত্রীতে ফাটো ফাটো অবস্থা। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বার বার ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘অবরোধের কারণে সমস্ত আপ ও ডাউন ট্রেনের চলাচল বন্ধ আছে।’ পুরো স্টেশন চত্বর যাত্রীদের টেনশন আর উত্তেজনায় দপদপ করছে। এই উত্তেজনা যে কোনও মুহূর্তে মব ভায়োলেন্সের চেহারা নিতে পারে।

আট নম্বর প্ল্যাটফর্মের গায়ে যে ক্যাব রোড আছে, সেই জায়গাটা একটু ফাঁকা। সেখানে দাঁড়িয়ে বিহান বলল, “সুদামদা, আমি এ বার চলি। তুমি তো এই ট্রেনেই বকুলতলা ফিরবে।”

সুদাম বলল, “আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তোমার পক্ষে আজকের দিনটা ভাল নয়। একের পর এক গন্ডগোল হচ্ছে।”

“আমার সঙ্গে তুমি কোথায় যাবে? তা ছাড়া মিনুদি চিন্তা করবে।”

“ওকে আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। আর, আমার ইচ্ছে থাকলেও ফেরার উপায় নেই। ট্রেন তো চলছে না।”

“তা ঠিক।’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্টেশনের পুরনো কমপ্লেক্স থেকে বেরোল দু’জনে। এখন আর বাসের চিন্তা করে লাভ নেই। রেল মিউজ়িয়ামের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে বঙ্গবাসী হাসপাতাল যেতে দশ মিনিট লাগবে।

রেল মিউজ়িয়ামের সামনের সেই রাস্তা! বিহানের মনে পড়ে যাচ্ছে চুম্বনের স্মৃতি। দরিয়া এখন কেমন আছে কে জানে! সাম্যব্রতকে ফোন করা যাক। শেষ ফোনের পরে এত ঘটনা ঘটল যে বিহান আর এক বার ফোন করার কথা ভুলে গিয়েছিল। সে ব্যাকপ্যাক থেকে মোবাইল বার করতেই সেটা বাজতে শুরু করল। কে ফোন করেছে? তাড়াতাড়ি মোবাইলে চোখ রাখে বিহান।

সনৎ! বিরক্তি চেপে বিহান বলল, “বল।”

“তুই এখন কোথায়?” সনতের গলার আওয়াজে জেরার আভাস।

বিহান বলল, “সবে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলাম। হাঁটতে হাঁটতে বঙ্গবাসী হাসপাতাল যাচ্ছি। তুই আমার ব্যাপারটা নিয়ে মিস্টার দাসের সঙ্গে কথা বলেছিস?”

উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল সনৎ।

১১

বোমা পড়ার পরে কোর্টের সামনের রাস্তা শুনশান। সাম্যব্রত উঁকি মেরে দেখলেন, একটা অটো আর দুটো রিকশার পোড়া কঙ্কাল রাস্তার মাঝখানে পড়ে রয়েছে। কয়েকটা টায়ার একা-একা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আর কালো ধোঁয়ায় চারিদিক ভরিয়ে দিচ্ছে। রাস্তায় লেগে রয়েছে শুকনো রক্তের দাগ। এটা সত্তরের দশক? না নতুন শতকের দ্বিতীয় দশক? মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে সাম্যব্রতর। কিছুই বদলাল না? কিছুই বদলায় না?

সীমা ফোন করেছেন। ভুজুংভাজুং দিয়ে তাঁকে চুপ করালেন সাম্যব্রত। সীমাকে সত্যি কথা বলে কোনও লাভ হবে না। অকারণে বাড়িতে বসে টেনশন করবে। ফোন কেটে মোবাইলে সময় দেখলেন তিনি। দুপুর সাড়ে তিনটে। ডক্টর ব্যানার্জি তিনটের সময় বলেছিলেন, গাইনির ডাক্তার ডলি সেনকে কলবুক দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি এখনও এলেন না তো!

ডক্টর সেনের কথা ভাবতে না ভাবতেই সার্জারি ওয়ার্ড থেকে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা শোনা গেল, “পেশেন্ট দরিয়া চ্যাটার্জির বাড়ির লোক অবিলম্বে যোগাযোগ করুন।”

ডাক্তারবিবি অনেক কাল বাঁচবেন। আধপোড়া সিগারেট ছুড়ে ফেলে, ইনহেলারে একটা টান দিয়ে ওয়ার্ডের দিকে দৌড়লেন সাম্যব্রত।

দরিয়া বাবাকে দেখে ম্লান হাসল। সাম্যব্রত দেখলেন, স্যালাইনের বদলে মেয়ের শরীরে এখন ব্লাড চলছে। বেডের পাশে দাঁড়িয়ে বছর পঞ্চাশের দুই ডাক্তার। এক জন মহিলা, অন্য জন পুরুষ।

ডক্টর ডলি সেন দরিয়ার টিকিটে লেখালিখি করছেন। অন্য ডাক্তারটি দরিয়াকে পরীক্ষা করছেন। ডক্টর সেন জিজ্ঞেস করলেন, “হৃষীকেশ, কী পেলি?” তার পর সাম্যব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি পেশেন্টের কে হন?”

সাম্যব্রত বললেন, “বাবা।”

নিদানপত্র লেখা শেষ করে টিকিট হৃষীকেশের হাতে ধরিয়ে ডক্টর সেন বললেন, “আমি ডলি সেন, এই হাসপাতালের সুপার ছুটিতে আছেন বলে ওঁর প্রশাসনিক কাজও সামলে দিচ্ছি। আর উনি ডক্টর হৃষীকেশ বক্‌সি। অ্যানাস্থেটিস্ট।”

ডক্টর বক্‌সি ডলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “পেশেন্টের হিমোগ্লোবিন নাইন। ব্লাড প্রেশার নব্বই বাই ষাট। আমি একে অজ্ঞান করার রিস্ক নিতে পারব না।”

সাম্যব্রত বেকুবের মতো বললেন, “বাচ্চা হওয়ার জন্য অজ্ঞান করতে হবে কেন?”

ডক্টর বক্‌সি বললেন, “লেবার পেন শুরু হয়েছে সকালে। এখন দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে। লেবার এক চুলও প্রগ্রেস করেনি। পেশেন্টের একগাদা কমপ্লিকেশন আছে। এই অবস্থায় সিজ়ারিয়ান সেকশন ছাড়া গতি নেই। এবং এটা খুব রিস্কি আর কমপ্লিকেটেড সার্জারি। বঙ্গবাসী হাসপাতালের সেট আপে সম্ভব নয়।”

মণিদীপা করুণ মুখ করে বলল, “বাবা বলেছে আপনার ক্লাস না করলে শিয়োর ব্যাক পাব।” তার পরে দরিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল। ভাবটা এই, “আজ আমি তোর পিছু ছাড়ছি না।”

সন্ধে সাতটায় ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কলেজ থেকে বেরোচ্ছে দরিয়া, উল্টো দিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিহান। সেও প্রবল ঠান্ডায় কাঁপছে। দরিয়াকে গেটের দারোয়ান বলল, “তোমার বন্ধু কাল থেকে কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার? ঝগড়া হয়েছে নাকি?”

“ও আমার বন্ধু নয়,” কঠিন গলায় বলল দরিয়া।

“হায় ভকোপান!” মণিদীপা আকাশ থেকে পড়েছে। “আমি ঠিক আন্দাজ করেছিলুম। তোরা ভেন্ন হয়ে গিচিস!”

“নিজের চরকায় তেল দে,” বান্ধবীকে বলল দরিয়া। দারোয়ান বলল, “ছেলেটা এখান থেকে সরে না গেলে আমি কিন্তু প্রিন্সি ম্যাডামের কাছে কেস খেয়ে যাব।”

“সরিয়ে দাও! তার জন্য আমার পারমিশন নেওয়ার কী আছে?” সালকিয়াগামী অটোতে ওঠার সময়ে দরিয়া দেখল, দারোয়ান লাঠি হাতে রাস্তা পেরোচ্ছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Novel Series Indranil Sanyal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy