Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস  পর্ব ১৮
Rabibasoriyo Novel

দৈবাদিষ্ট

কয়েক মুহূর্ত অতিবাহনের পর কণ্ঠস্বর শ্লেষ্মামুক্ত করে আবার বলতে শুরু করেছিলেন দ্রোণ। কাহিনির এই অংশটিই তো সবচেয়ে তিক্ত, অসহনীয়। স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে, মুষ্টি কঠিন হয়, ললাটের শিরা তপ্ত।

ছবি: রৌদ্র মিত্র

ছবি: রৌদ্র মিত্র

সৌরভ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:০০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: বিদুর স্পষ্ট করে জানান, তাঁর সন্দেহ বসুষেণ আসলে কুন্তীর গর্ভে উৎপন্ন মহাতেজা দুর্বাসারই সন্তান। অন্য দিকে দেখা যায়, একলব্যের অঙ্গুষ্ঠ প্রতিস্থাপিত হলেও সে ফিরে পায়নি তার শরসন্ধানের ক্ষিপ্রতা। বদলে সে অবলম্বন করেছে খড়্গ। মগধেশ জরাসন্ধের কাছে সে স্বীকার করে, কপট দ্রোণাচার্যকে শাস্তি দেওয়াই হবে তার বাকি জীবনের উদ্দেশ্য। সে সময় দ্রোণাচার্য কুরুকুমারদের পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে বন্দি করতে আদেশ দিলেন। বন্দি দ্রুপদই হবে তাঁর গুরুদক্ষিণা।

আশ্চর্য নয়? নির্ধন ব্রাহ্মণ দ্রোণ আর কিছু পেতে চাননি এত কাল ধরে, কিচ্ছু না! এই বৃহৎ বিশ্বে কেবল একটি ব্যক্তিকে নিজের সম্মুখে হতমান, নতশির, বদ্ধ অবস্থায় দেখতে চান— শুধু এই অদ্ভুত কামনা সঞ্চিত রেখেছেন? কত কী চাওয়ার ছিল গরিমাময় কুরুসাম্রাজ্যের বংশপ্রদীপদের গুরুদক্ষিণা হিসেবে... অথচ!

এই অভীষ্ট-যজ্ঞের সমিধই সংগ্রহ করেছেন তিনি এত দিন, তিল তিল করে। এই একটি বাসনার সিদ্ধি, এই ছিল ধানুকী দ্রোণের কাছে ভাসপক্ষীর চক্ষু! একটিমাত্র লক্ষ্যের জন্যই বহু ভাবনা, বহু বৌদ্ধিক শ্রম, নিগূঢ় পরিকল্পনা। পাঞ্চাল থেকে হস্তিনায় চলে আসা, কুরুকুমারদের ক্রীড়াভূমির কাছে উপস্থিত হয়ে তাদের সামনে অস্ত্রকৌশল প্রদর্শন, কুরুপ্রধান ভীষ্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পাঠানো— সমস্তই অতি নিপুণ ভাবে নির্মিত প্রকল্প।

সাহায্য অবশ্যই করেছিলেন শ্যালক কৃপ। পূর্বাহ্ণেই গঙ্গাপুত্রকে প্রভাবিত করে তিনি তাঁর গুপ্তজ্ঞানী ভগ্নীপতিটি সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন। ফলে দ্রোণের আবির্ভাবমাত্রই হস্তিনার অস্ত্রগুরু হিসেবে নিয়োগের পথ মসৃণ হয়। যজ্ঞভূমিটি প্রস্তুত!

তার পর, এত বৎসর ধরে সেই যজ্ঞাগ্নিতে ঘৃত ঢাললেন আচার্য দ্রোণ। সর্বশক্তিতে, নিজেকে নিঃশেষিত করে প্রস্তুত করলেন এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধার দল। যারা তাঁর আদেশমাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর অঙ্গুলিনির্দিষ্ট যে কোনও লক্ষ্যবস্তুর উপর। আর, অভিপ্রায় ছিল— এই সমষ্টির মধ্যে অন্তত এক জনকে, এমন এক আধারকে খুঁজে নেবেন তিনি, যাকে উজাড় করে দিতে পারবেন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানগুলি, করে তুলতে পারবেন অজেয়, দুর্মর ধনুর্ধর! হ্যাঁ, সে স্বপ্নও সাধিত হয়েছে আশাতীত সাফল্যে। ওই যে, তূণীর-স্কন্ধে দণ্ডায়মান, ধনুর্ধারী ফাল্গুনি অর্জুন। দ্রুপদ কেন, বিশ্বের যে-কোনও পরাক্রান্ত বীর বা দুর্ধর্ষ নরপতিকে সসৈন্য পরাস্ত করতে পারবে একাকী, এমন বিদ্যা অধিগত হয়েছে ওই প্রতিভাবান তরুণের!

অর্জুনকে হাতে পাওয়ামাত্র দ্রোণ বুঝে নিয়েছিলেন, তাঁর দীর্ঘ আহুতির শ্রেষ্ঠ প্রসাদপ্রাপ্তি হবে এই বালক। তাই সেই হোমাগ্নির চার পাশ থেকে যজ্ঞবিনাশক সব সম্ভাব্য বাধা-বিপত্তি-দুর্দৈবকে তিনি ছলে-কৌশলে অপসারিত করেছেন। নির্দ্বিধায় সম্পন্ন করেছেন নীতিবহির্ভূত কর্মও। পক্ষপাত, কাপট্য, নির্মমতা, অমানবিকতা! না, তিনি সৎ থাকতে পারেননি নিজের বৃত্তির প্রতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলকাম হতে পেরেছেন। ওই তৃতীয় কৌন্তেয়, দ্রোণের সর্বোত্তম যজ্ঞফল!

শুধু অর্জুন নয়। তার পাশে ওই যে শক্তিধর পর্বতপ্রমাণ যুবা ভীম, বিপরীত দিকে গদাধারী কঠিনানন দুর্যোধন, উলঙ্গ তরবারি নিয়ে প্রতীক্ষায়-থাকা নকুল, শাণিত বর্শাধারী দুঃশাসন— এই সমাবেশের মধ্যে শত্রু-শাতনক্ষম এমন যোদ্ধা অজস্র। এরা যদি সম্মিলিত শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে, ইন্দ্রলোকেও ত্রাস সঞ্চারিত হতে বাধ্য।

কিন্তু, না। ইন্দ্র-টিন্দ্র নন! দ্রোণের প্রয়োজন কেবল দ্রুপদকে। বন্দি দ্রুপদ! দরিদ্র বিপ্র দ্রোণের সামনে অবনতশির, সম্পদশালী দর্পিত দ্রুপদ।

দ্রোণ জানেন, আদেশ পালনে দ্বিধা করবে না এই সমবেত শিষ্যমণ্ডলী। কিন্তু, বিস্মিত তারা। তাদের মধ্যে এখন যে অনুচ্চারিত প্রশ্নটি ধূমায়িত হয়েই চলেছে, তা হল : ‘কেন?’

“কেন, আচার্য? পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের সঙ্গে কিসের বৈর আপনার?”

গত রাত্রে দেবব্রতও সবিস্ময়ে এই প্রশ্নটিই করেছিলেন, যখন দ্রোণ তাঁকে জানান— আগামী কাল প্রাতে তিনি গুরুদক্ষিণা চাইবেন, এবং যা চাইবেন তা হল...

কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম গতকাল এসেছিলেন দ্রোণের মনোবাঞ্ছার ইঙ্গিত নিতে। অভিভাবক হিসাবে তিনি জানতেন, লগ্ন আগত। গুরুদক্ষিণা হিসেবে দ্রোণ যা চাইবেন, কুমারদের হয়ে সে সবের আয়োজন তো আগে থেকে প্রস্তুত রাখতে হবে তাঁকেই, তথা হস্তিনা-রাজসভাকেই! স্বর্ণমুদ্রা প্রয়োজন হলে, রাজকোষে যেতে হবে। অলঙ্কার হলে, স্বর্ণকার ডাকা চাই। ভূখণ্ড অট্টালিকা গোধন দাসদাসী বিলাসসামগ্রী ইত্যাদির ব্যবস্থাও মুহূর্তের মধ্যে হয় না, উদ্যোগ ও সময় লাগে। অগ্রিম জেনে

নেওয়া প্রয়োজন, কী ধরনের দক্ষিণার ইচ্ছা পোষণ করেন আচার্য।

উত্তর শুনে বিস্মিত শান্তনুনন্দনের মুখ থেকে কারণ-জিজ্ঞাসা-সূচক বাক্যই স্বাভাবিক ছিল।

দ্রোণ তখন প্রকাশ করেছিলেন সুদীর্ঘ কাহিনি। উন্মুক্ত করেছিলেন তাঁর এত দিনের ঢেকে-রাখা ক্ষত। যে ক্ষত তাঁকে এতগুলি বৎসর ধরে তাড়িত করে এসেছে, যার যন্ত্রণা উপশমের জন্যই এত দিনের সুপরিকল্পিত পরিশ্রম তিনি ব্যয় করেছেন হস্তিনার শিক্ষাকেন্দ্রে, যে তীব্র ক্ষোভের আবেগ এই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁকে ক্লান্তিহীন ও উদ্দীপিত রাখে নিরন্তর— সেই পূর্বগ্লানির ইতিবৃত্ত এত দিন পরে প্রথম বললেন দ্রোণ, কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের সকাশে!

৩০

এ কাহিনির শুরু মহর্ষি অগ্নিবেশের আশ্রমে, যেখানে অস্ত্রশিক্ষা করত দুই বালক। দরিদ্র বিপ্রসন্তান দ্রোণ আর পাঞ্চাল-রাজকুমার দ্রুপদ। দীর্ঘ সতীর্থ-জীবনে অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল দু’জন। শিক্ষা সমাপনান্তে, বিদায়কালে রাজপুত্র কথা দেয় ব্রাহ্মণসন্তানকে, “যখন ভবিষ্যতে আমি কাম্পিল্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হব, সখা, মনে রেখো কিন্তু— সে-রাজ্য হবে তোমারও!”

তার পর কালস্রোত বয়ে যায় অনর্গল। অনেক বৎসর অতিক্রান্ত। ইতিমধ্যে বিবাহিত অস্ত্রবিদ দ্রোণ, সংসারী—কিন্তু যজন-যাজনে অদক্ষ, এ দিকে অস্ত্রশিক্ষার তেমন সমাদর ব্রাহ্মণসমাজে নেই— তাই তিনি দারিদ্রভারজর্জরিত। এক দিন দেখতে পান, তাঁর নাবালক পুত্র অশ্বত্থামা ধনীপুত্রদের দুধ খেতে দেখছে সতৃষ্ণনয়নে। কাঁদছে, সেও দুধ খাবে। কিন্তু দুধ কোথা? একটিও পয়স্বিনী গাভী সংগ্রহ করতে পারলেন না দরিদ্র, সম্বলহীন পিতা। তার পর এক ঝলমলে প্রভাতে দেখলেন, পুত্রের সঙ্গী নিষ্ঠুর বালকেরা পিটুলিগোলা খাইয়ে প্রতারিত করছে তাকে, প্রবঞ্চিত শিশু ‘বাঃ দুধ কী সুন্দর!’ বলে আনন্দে লম্ফঝম্প করছে আঙিনা জুড়ে! সে দিন পুত্রের মুখে সেই অবোধ হাসি দেখে পিতার চোখের জল রোধ মানেনি। আর ধনীর সন্তানেরা দ্রোণের নামে ব্যঙ্গ করে সুরেলা পদ জুড়ে জুড়ে চিৎকার করছিল— অর্থ উপার্জন করতে পারে না যে দরিদ্র দ্রোণ, তাকে ধিক্কার!

সারা রাত বিনিদ্র পিতার কানে বাজল সেই ছড়া— ‘পারে না উপায় করতে ধন/ ধিক্‌ রে তোকে, অ-ধনী দ্রোণ!’ সরল নির্বোধ অশ্বত্থামাকে নিয়েও উপহাসের ছড়া কেটেছিল ওরা, ‘গোয়ালে নেই গাই/ কড়ি কোথায় পাই/ (তবু) দুধের জন্যে খাঁই/ (আহা) পিটুলি গেল্‌ তাই!’ সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই সব অমার্জিত রঙ্গকাব্য।

কী করণীয়? কী ভাবে দারিদ্র-জ্বালা শমিত হয়? ধন অর্জনের পথ কোথায়? নিদ্রাহীন রাতের শেষে, প্রত্যূষের তন্দ্রাবেশের মধ্যে দ্রোণ অকস্মাৎ খুঁজে পেলেন পথের রেখা। এক সুকুমার তরুণ মুখাবয়ব উদ্ভাসিত হল মানসচক্ষে। তার শিরে রাজমুকুট!

আশায়-আনন্দে রোমাঞ্চিত দ্রোণ শয্যায় উঠে বসলেন। তাই তো! এত সহজ সমাধান, অথচ এত দিন তিনি বিস্মৃত হয়ে...

প্রভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুত্র-কলত্র-সহ ব্রাহ্মণ চললেন পাঞ্চাল-রাজধানীর উদ্দেশে। দীর্ঘ পথ, বিশ্রাম নিতে নিতে যাওয়া। বিলম্ব হল। রাজসভার অধিবেশন শেষের মুখে— এহেন সময়ে দ্বারপ্রান্তে উপনীত হলেন দ্রোণ। একেবারে সরাসরি সাক্ষাৎ চাইলেন রাজা দ্রুপদের।

রাজা দ্রুপদ! হ্যাঁ, দ্রোণ জেনেছেন, পিতা পৃষতের প্রয়াণের পর সম্প্রতি সিংহাসন অধিকারে এসেছে তাঁর বাল্যসখার। রাজা এখন তিনিই! দ্রোণের বন্ধু, দ্রুপদ— পাঞ্চালরাজ! অর্থাৎ অভাগা বিপ্র দ্রোণ, কুটিরবাসী দরিদ্র দ্রোণ, সন্তানকে দুধ সংগ্রহ করে দিতে অক্ষম দ্রোণ— তিনি রাজ-মিত্র! এই দ্রুপদই তো নিজে কথা দিয়েছিলেন, তিনি রাজপদে অধিষ্ঠিত হলে সে-রাজ্যে সমাধিকার হবে মিত্র দ্রোণেরও! কথাটার অর্থ কী, কাম্পিল্যাভিমুখী সমস্ত পথটুকু ভাবতে ভাবতে এসেছেন দ্রোণ। পাঞ্চালরাজ্যের অর্ধভাগেই তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে এখন থেকে? না কি, সমগ্র রাজ্যটিই তিনি আর বন্ধু দ্রুপদ মিলে সমান প্রভুত্বে পরিচালনা তথা ভোগ করবেন? না, না— দ্রোণ রাজ্যশাসন-টাসন করতে পারবেন না, ও কর্ম বরং মিত্রেরই থাক, দ্রোণ কর্তৃত্বকামী নন। তাঁর প্রয়োজন ধন। শাসক দ্রুপদই থাকুন, শুধু রাজকরের অংশ আসুক দ্রোণের কোষাগারে— এমন হলে চমৎকার! আচ্ছা, অর্ধরাজ্যই যদি দিতে চান দ্রুপদ, দ্রোণ কোন অংশটি নেবেন? উত্তর, না দক্ষিণ? তাঁর নিজের গ্রাম যে-অংশে পড়ে, সেইটি হলেই ভাল হয়। আজ যে ধনী গ্রামবাসী তাঁকে নিয়ে বিদ্রুপ-কাব্য রচে, আগামী কাল থেকে দ্রোণ তার প্রভু হয়ে বসলে কেমন দাঁড়াবে বিষয়টি...

প্রহরীরা যখন তাঁর পথ রুদ্ধ করল, দ্রোণ মনে মনে অর্ধরাজ্যের অধীশ্বর হয়েই গিয়েছেন তত ক্ষণে। গর্বিত তাচ্ছিল্য-মিশ্রিত স্বরে তিনি তাদের জানালেন, তিনি রাজার একান্ত বান্ধব— এক রকম দর্পভরেই তাদের উপেক্ষা করে সটান প্রবেশ করলেন সভায়। স্ত্রী-পুত্রকে সঙ্গে নিয়েই দৃপ্ত পদক্ষেপে অগ্রসর হলেন, কারও দিকে দৃকপাত না করে একেবারে সিংহাসন-পীঠিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, দু’টি হাত প্রসারিত করে আলিঙ্গনের ডাক দিলেন সখাকে। মনে করালেন সেই বাল্যপ্রীতি, সেই স্নেহের শপথ।

...ভীষ্মের সকাশে এই পর্যন্ত বিবৃত করে সহসা নীরব হয়ে গিয়েছিলেন আচার্য দ্রোণ। মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন অন্য দিকে। কিন্তু গঙ্গাপুত্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল ব্রাহ্মণের চক্ষুতে যুগপৎ অশ্রু ও অগ্নির কণিকা! বাড়বানল যেন! শ্মশ্রুময় মুখের রেখাগুলি কোনও গ্লানিতে ভঙ্গুর হতে গিয়েও পরমুহূর্তেই প্রতিজ্ঞায় কঠোর হয়ে উঠছে।

এই ভাবে কয়েক মুহূর্ত অতিবাহনের পর কণ্ঠস্বর শ্লেষ্মামুক্ত করে আবার বলতে শুরু করেছিলেন দ্রোণ। কাহিনির এই অংশটিই তো সবচেয়ে তিক্ত, অসহনীয়। স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে, মুষ্টি কঠিন হয়, ললাটের শিরা তপ্ত। তবু, বলতে তো হবেই। প্রতিটি বর্ণ ভীষ্মকে বলতে থাকেন দ্রোণ, তাঁর মিত্রসম্ভাষণের উত্তরে দ্রুপদের সেই অবিস্মরণীয় প্রত্যুত্তর! যা ব্রাহ্মণ সেই ভরা সভায় দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে শুনেছিলেন, দারা-পুত্রের সামনে— একটিও শব্দ আর স্ফুরিত হয়নি তাঁর মুখ থেকে। ছেদ-যতি-সহ রাজার সমস্ত বাক্যগুলি আজও স্মৃতির পটে অগ্নিশলাকায় খোদিত আছে অবিকল...

“ব্রাহ্মণ, তুমি কি বাস্তবিকই ঋষিগৃহে পাঠ সমাপন করেছিলে? তোমার অমার্জিত বুদ্ধি-বিবেচনা দেখে মনে হয়, অস্ত্রনিক্ষেপের জ্ঞানটুকু অর্জন করলেও তুমি বস্তুত অশিক্ষিত। কারণ, শিক্ষিত তথা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা তো জানেন, বন্ধুত্ব হয় একমাত্র সমানে সমানে। সমাজে যে অবস্থানগত ভেদরেখাগুলি মান্য হয়, তা লঙ্ঘন করতে চায় একমাত্র মূর্খরাই। ব্রাহ্মণে-শূদ্রে, রথীতে-অরথীতে, রাজায়-কাঙালে বন্ধুত্ব কদাপি হয় না। তুমি বাল্যপ্রীতির দোহাই দিয়ে একেবারে অর্ধরাজ্য দাবি করতে এসেছ? কৌপীন-সর্বস্ব ভিক্ষুক ব্রাহ্মণ, তুমি রাতারাতি রাজার মিত্র হতে চাও, এমনকি অর্ধরাজ্যের অধিপতিও?”

এইখানে অট্টহাস্য করেছিল চাটুকার পাঞ্চাল-পারিষদেরা। দ্রোণ কাম্পিল্য-সভার সেই স্ফটিক-কুট্টিমে মর্মরমূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিলেন। শুধু দু’টি কর্ণকুহর, এ ছাড়া সব ইন্দ্রিয় অবশ হয়ে গিয়েছিল তাঁর তত ক্ষণে। শ্রবণে আসছিল পত্নী কৃপীর রুদ্ধ ক্রন্দনের ধ্বনি। বালক অশ্বত্থামাও কি রোরুদ্যমান? দ্রোণের যেন সামর্থ্য ছিল না আর, তাদের দিকে ফিরে তাকানোর। তাঁর পেশিগুলি জড় পদার্থে রূপান্তরিত বুঝি!

দ্রুপদের পরবর্তী বাক্যগুলিও তিনি সেই প্রস্তরীভূত ভঙ্গিতেই শুনছিলেন, প্রায় অপলক।

“বাল্যপ্রীতি, সতীর্থস্নেহ খুবই ভাল জিনিস হে ধানুকী বিপ্র; কিন্তু বাল্য যেমন চিরকাল থাকে না, গুরুগৃহবাস যেমন এক দিন সমাপ্ত হয়, কালের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব অনুভূতিরও বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। মৃতদেহের কাছে প্রণয়-ভিক্ষা যেমন বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক, দূর অতীতের বাল্যশপথের ভিত্তিতে রাজ্যখণ্ড চাইতে আসাও তেমনই। তবে রাজা দ্রুপদ হৃদয়হীন নয়, প্রার্থীকে সে শূন্যহস্তে ফেরায় না। এত পথ তুমি স্ত্রীপুত্র নিয়ে পদব্রজে এসেছ, নিশ্চয়ই ক্ষুধা অনুভব করছ। আজ সন্ধ্যায় তুমি সপরিবার উপযুক্ত আহার্য পাবে। একটি বেলা ইচ্ছামতো ভোজন করো, যাও; আমি আদেশ দিয়ে দিলাম!”

...সমবেত কুরুকুমারদের সামনে গুরু দ্রোণ পুনর্বার তাঁর কিণাঙ্ক-কঠিন তালু মুষ্টিবদ্ধ করলেন।

বড় করে একটি শ্বাস নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ! যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে যুদ্ধের কারণটি জানা আবশ্যক। নতুবা, যুদ্ধের অভিপ্রায় নিয়েই মনে সংশয় রয়ে গেলে, মনোবল যথেষ্ট দৃঢ়বদ্ধ হয় না। তোমাদের পিতামহকে বলেছি, তোমরাও শ্রবণ করো, কুমারগণ! সংক্ষেপে বলছি, কী কারণে এই আদেশ! আজ তোমাদের গুরু-অপমান অপনোদনে প্রেরণ করা হচ্ছে, জেনে রেখো।”

শিষ্যমণ্ডলী উৎসুক ভঙ্গিতে প্রতীক্ষা করছে। দ্রোণ দুই মুহূর্ত থেমে, শুরু করলেন আবার।

“তোমাদের মনে পড়ে, সেই প্রথম যে দিন তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেদিন বীটা-উত্তোলনের পারিশ্রমিক হিসাবে আমি এক সন্ধ্যার আহার্য চেয়েছিলাম? মাত্র এক বেলার খাদ্য! এই কাহিনিরই সূত্র ছিল সেখানে। আজ তা আমি উন্মোচন করছি...”

৩১

পশ্চিমগিরিশিখরান্তরালে অস্ত-তপন বিলয়োন্মুখ, আর কয়েক দণ্ড পরেই দিনের আলো নিভে আসবে। নগরদুর্গ দ্বারাবতী এখনও কিছু দূরে। সন্ধ্যাগমের আগে নগরে প্রবেশ করতেই হবে।

কৃষ্ণ অতি দ্রুতবেগে রথচালনা করছিলেন।

ক্রমশ

অন্য বিষয়গুলি:

Rabibasoriyo Novel rabibasariyo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy