চিরকালীন: ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ আজও বাঙালি দর্শকের নস্ট্যালজিয়া
এ-বৃদ্ধ বয়সে গান শুনে হয় যৌবন!
অথচ যৌবনে তোমরা ছিলে কাছাকাছি,
সেদিনের সেই গান আজও লক্ষ্য করে
মহামানবের তীর, সাগরসঙ্গম।
এ-বৃদ্ধ বয়সে গান শুনে হয় আক্রান্ত যৌবন!
আবৃত্তিকার হিসেবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই লাইনগুলো লিখেই শুরু করছি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এ নিবন্ধ। চার প্রজন্মকে শুনিয়ে গেলেন তাঁর যুগসৃষ্টিকারী কণ্ঠ। রেখে গেলেন অজস্র রেকর্ড, বাঙালি জীবনে সুচিত্রা-উত্তম আর হেমন্ত-সন্ধ্যার সার্থক রসায়নের কাহিনি ধরা আছে সেলুলয়েড মাধ্যমে।
এক দিন কলামন্দিরে আমি আর ঊর্মিমালা শ্রুতিনাটক পরিবেশনের পরেই ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে উইংসের ধারে বসে গান শুনলাম। অবাক হয়ে লক্ষ করছিলাম, ভাব থেকে ভাবান্তরে ওঁর অনায়াস যাতায়াত। ‘জয়জয়ন্তী’ ছবির ‘আমাদের ছুটি ছুটি’ যখন গাইছেন, তখন মুখমণ্ডলে শিশুর সারল্য আর উল্লাস। তার ঠিক পরেই ‘কোন পথে গেল শ্যাম’ গানে উপচে পড়ল প্রেম। তাঁর নিবেদনে যা দেখেছি, তা অভিনয়েরই দ্যুতি! মনে হচ্ছিল, আমরাও শ্রুতিনাটকের সংলাপ বলার সময়ে তো চোখমুখে তার ছাপ পড়ে। সেটাই স্বাভাবিক! আবার চোখ বুজে সন্ধ্যাদির গান শুনলেও তাঁর কণ্ঠে লিরিকের সেই অনুভব বুঝতে পারা যায়। এটাই কণ্ঠ দিয়ে ছবি আঁকা। গানের মর্মকথা এতটা গভীরে আত্তীকরণ করেছিলেন বলেই সে গান এমন রসোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে।
আজও যখন ‘পথে হল দেরি’র ‘এ শুধু গানের দিন’ বা ‘সবার উপরে’ ছবির ‘ঘুম ঘুম চাঁদ’ শুনি, তখন গানের মধ্যে নিহিত সুচিত্রা সেনের এক্সপ্রেশন সন্ধ্যাদির গলা শুনেই স্পষ্ট দেখতে পাই।
১৯৬১। আমি তখন বোধহয় ক্লাস এইট কি নাইন! স্কুল থেকে ফেরার সময়ে বা অন্য কোনও ছুতোয় সবে টুকটাক সিনেমা হলে ঢুঁ মারা জীবনে শুরু হয়েছে। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-এর আবেশে তখন তো সব বাঙালিই বিভোর। নিশ্চিত বলতে পারব না, হাতিবাগানের উত্তরা না রূপবাণী কোথায় ছবিটা দেখেছিলুম।
উত্তম না সুচিত্রা কার দিকে তাকিয়ে থাকব, উঠতি বয়সের সেটাও সমস্যা। সুচিত্রা সেনের উচ্ছল অভিব্যক্তির প্রতিটি ভঙ্গি ও সন্ধ্যার কণ্ঠ যেন মিলেমিশে একাকার! সুচিত্রা পর্দায় রিনা ব্রাউন হয়ে উঠতে চোখেমুখে লাগাম-ছাড়া খুশি মিশিয়েছিলেন। সেই বয়সে বুঝিনি, আজ মনে হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের আর্টিস্টিক ইকনমির বোধ কতটা প্রখর! তা হলেই কণ্ঠ দিয়ে ওই সব এক্সপ্রেশনের রাশ বেঁধে রাখা যায়। ৬০ বছর বয়স হল গানটির। আমরাও প্রবীণ হলাম। গানটি বুড়ো হল না! আমাদের মায়েরা সন্ধ্যার গান গাইতেন! আমার মায়ের বোধহয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ ঘিরে আজকের ভাষায় একটু ক্রাশই ছিল। বাপি তাই হেমন্তের গান চললেই রেডিয়ো বন্ধ করতে ব্যস্ত হতেন। সেই চোরা খুনসুটি আমরা ভাইবোনেরা উপভোগ করতাম।
আসলে সবটাই একটা আস্ত সময়, যা জুড়ে আছেন কয়েক জন মানুষ! তখনও কংক্রিটের টালা ব্রিজ তৈরি হয়নি। ‘অপুর সংসার’ ছবিতে যে পলকা ব্রিজের উপরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হেঁটে যাচ্ছেন, তা ভেঙে নতুন ব্রিজ হচ্ছিল। তখন আমাদের টালাপার্কের বাড়ি থেকে বেলগাছিয়া ব্রিজ পেরিয়েই কোথাও যেতে হত। মনে আছে, দত্তবাগানের মুখে প্রায়ই চোখে পড়ত, বড় বড় হরফে লেখা ‘সুচিত্রা সেলুন’! তলায় সংযোজন, ‘এখানে উত্তম রূপে চুল কাটা হয়’! তবে আমাদের সেই সময়ে সিনেমা দেখা মোটেই হাতের মোয়া ছিল না। আমি উত্তম-সুচিত্রা জুটির বহু স্মরণীয় ছবিই কিছুটা পরে দেখেছি। তখন টিভি ছিল না। কিন্তু মাঝেমধ্যেই উত্তমকুমারের সিনেমা দেখানো হত হয়তো পর পর সাত দিন, সাতটা আলাদা ছবি! ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, বা ‘পথে হল দেরি’ ইত্যাদি। আমি টালায় থাকলেও কিন্তু উত্তম, সুচিত্রার বেশির ভাগ ছবি দেখেছি বাগমারি খালের ধারে ‘সুরশ্রী’ কিংবা একেবারে বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে ‘আলেয়া’য়! সেই হলগুলোরও বোধহয় আজ কোনও চিহ্ন নেই।
তবে হেমন্ত, সন্ধ্যা, উত্তম, সুচিত্রার কথা বলে লেখা শুরু হলেও আরও অনেকে এই লেখায় আছেন। যেমন, ‘মায়ামৃগ’ দেখেছিলাম রাধা-য়। সেখানেও সন্ধ্যা রায়ের লিপে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অনবদ্য! ‘ও বক বক বকম বকম পায়রা’য়!
এক সরস্বতী পুজোর দিনে উর্মির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি ওদের আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে। তখন আমাদের প্রেমটা হব-হব করছে। ওদের উঠোন মালতী লতার গন্ধে ম-ম করছিল। ওই গাছটা দেখলে আমার সন্ধ্যার ‘মধুমালতী ডাকে আয়’ মনে পড়ত। মনে হয়, আমাদের থেকে যারা অনেক ছোট, তাদের জন্যও ওই গান গত জনমের ইশারা বয়ে আনে।
‘আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ যে কবে থেকে আমার নিজের গান হয়ে উঠেছে, তা মনে পড়ে না! আমাদের সময়ের অনেকেরই নির্ঘাত তেমন অবস্থা! সুর সঞ্চারে নিতান্তই বদকণ্ঠ লোকবাসী হয়েও গানটা গুনগুনিয়ে গাইবার চেষ্টা পর্যন্ত করে বসেছি। এর অনেক পরে একবার মালদহের একটি কলেজের অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করতে গিয়ে মানবদার (মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলাম। তখনও তাঁর কণ্ঠে গানটি যেন আবার ফিরে পেলাম। গাড়িতে কলকাতায় ফেরার পথে এই গানের আচ্ছন্নতার কথা মানবদাকে বলতেই উনি একটি রোমাঞ্চকর স্মৃতি আমার সঙ্গে ভাগ করে নিলেন। তখনকার দিনে আকাশবাণীতে লাইভ অনুষ্ঠান তিনটি অধিবেশনে সম্প্রচার করা হত। শিল্পীরা অনেকেই বাড়ি না-ফিরে ক্যান্টিনে খেয়ে নিতেন। সকালের অনুষ্ঠানের পরে বিকেল বা সন্ধের অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতেন। এমনই এক বিকেলে মানবদা সন্ধ্যাদির স্বামী, প্রখ্যাত গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। আর একটু পরেই ফের মানবদার লাইভ শুরু হবে। তখনও শ্যামল-সন্ধ্যার বিয়ে হয়নি। শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম জপের মতো শ্যামলবাবুর মুখে তখন শুধুই সন্ধ্যা আর সন্ধ্যার কথা। সন্ধ্যার গলার কাজ, নিয়মশৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ, সুচারু সাজগোজ ইত্যাদি আর ইত্যাদি! কথা যেন থামছেই না! হঠাৎই সিগারেটের প্যাকেট থেকে রাংতা সাঁটা সাদা কাগজটা বের করে কী-সব লিখলেন। তারপর কলম বন্ধ করে মানবেন্দ্রকে শ্যামল গুপ্ত বলছেন, শোন তো লাইনগুলো কেমন হল! মানবদার বলা কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজছে! শীতের বিধুর সন্ধ্যা নামছিল কলকাতায়! আর শ্যামল গুপ্ত তাঁর সদ্য লেখা লিরিক শোনাচ্ছেন। সেই জন্ম মুহূর্ত, মানবদার কালজয়ী গানটির। পরে তাতে তিনি সুর বসান। আসলে কিন্তু এই গান জুড়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ই রয়েছেন। এখনও কারও কারও মোবাইলের রিংটোনেও এ গান শুনতে পাই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল গুপ্তের প্রেমের চিরন্তন সৌধ।
মনে আছে কোনও একটি অনুষ্ঠানে যখন আমি সন্ধ্যাদির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়েছি, তিনি আমাকে বললেন “আপনাদের নাটক আমি শুনি! আমার ভাল লাগে। আপনাদেরও তো কণ্ঠ নিয়ে খুব চর্চা করতে হয়। কোনও শিল্পই কঠিন চর্চা ছাড়া আয়ত্ত করা যায় না। চর্চায় কিন্তু আনন্দও আছে।” আমি তাঁর সঙ্গে একটু বেশি ক্ষণ কথা বলার ফন্দিফিকির করছিলাম! তাই একটু পাকামি করে আমাদের দেওয়া শম্ভু মিত্রের উপদেশের কথা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে বললাম— “হারমোনিয়মে থাকে ক্রোম্যাটিক স্কেল। সা-সা-রে-গা অর্থাৎ পর পর পর্দার উপরে গলা চালিয়ে ব্যায়াম করার মিড়। অভিনেতা, আবৃত্তিকারদেরও এ ভাবে কণ্ঠচর্চা করতে হয়।” মন দিয়ে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যাদি আমার কথাগুলো শুনলেন। যুগসৃষ্টিকারী মানুষ কেমন নম্র, ভদ্র হয় তা কাছ থেকে দেখলাম। ওঁর মৃত্যুর খবর শোনার পর এমন সব দৃশ্যই ভেতরে তোলপাড় করছিল।
শুনেছি তিনি সুরকারদের বলতেন, কবে আপনি গান শেখাতে আসবেন! কখনও বলতেন না, কবে আপনি গান তোলাতে আসবেন! এই সশ্রদ্ধ মনোভাব আজকের দিনে শিক্ষণীয়। বহু দশক আগে থেকেই মাসে দুটোর বেশি অনুষ্ঠান করতেন না, কিন্তু চর্চা তো রোজকার উপাসনা। সন্ধ্যাদির অন্তরঙ্গ বলয়ের মানুষ স্বপন মুখোপাধ্যায়ের কাছে শুনছিলাম, শেষ বার অসুস্থ হয়ে পড়ার কিছু দিন আগেও তিনি রেওয়াজ করেছেন।
আজও আমাদের শহরে উৎসব আসে পুজোর গানে, লাউডস্পিকারে! পুজো প্যান্ডেলের গান এক একটা পাড়ার রুচির মানও নির্ধারণ করে দেয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ বার পুজোতেও আকাশবাতাস ভরে থাকবে সন্ধ্যা বা লতারই গান। বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতায় আছে, ‘তিনি এলেন, কিছু দিন থাকলেন, তার পর ফিরে গেলেন, তিনি তো বেড়াতে এসেছিলেন’! সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়েরা চিরকালীন। তাঁর ক্ষেত্রে এ কথা বলা যাবে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy