ছবি: সুব্রত চৌধুরী
একটি কথার দ্বিধাথরথর চূড়ে/ ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী,/ একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে/ থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি...’। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রখ্যাত পঙ্ক্তিটি একটু ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ধরা যাক। প্রেম থেকে গ্রন্থমুগ্ধতায়। হৃদয়সরণি থেকে বইয়ের রাজপথে।
এমন একটি বইয়ের কথা বলা হচ্ছে, যার চূড়ায় ভর করে আছে কমবেশি সাতটি উপমহাদেশ। যার সরণিতে থমকে রয়েছে একশো চল্লিশ বছর। কালের চিরচঞ্চল গতি বয়ে যেতে যেতে তাকে কুর্নিশ করে গিয়েছে বার বার, দেশ-কাল-ধর্মনিরপেক্ষ ভাবে। যার অনুবাদ হয়েছে অন্তত ৩৫টি ভাষায়।
একটি কবিতার বই! ব্ল্যাঙ্ক ভার্স-এ লেখা এক মহাকবিতা। স্যর এডউইন আর্নল্ড-এর ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’। তার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি, ঐতিহাসিক প্রভাব এতটাই যে, বইটি দাবি করেছে একটি আত্মজীবনী। হ্যাঁ, একটি বইয়ের আত্মজীবনী! এই বিরল এবং প্রায় অভূতপূর্ব কাজটি অতিমারির গৃহবন্দিত্বে সেরেছেন জয়রাম রমেশ, যিনি একাধারে সাংসদ, নেতা, লেখক, পরিবেশ-আন্দোলনকারী এবং সুপণ্ডিত। তাঁর লেখা, সদ্য প্রকাশিত ‘দ্য লাইট অব এশিয়া— দ্য পোয়েম দ্যাট ডিফাইন্ড দ্য বুদ্ধ’ নিছকই বুদ্ধজীবনের সারাৎসার নয়, একের পর এক মননবিশ্ব জয় করার সঙ্গে সঙ্গে বইটির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে সব টুকরো ইতিহাস, সমাজ, দেশ ও চেতনা— রমেশের বই তার এক বহুবর্ণ কোলাজ-ও বটে।
বইটির কেন্দ্রে রয়েছে ভারত তথা এই উপমহাদেশ। মুখবন্ধে দলাই লামা তাই লিখেছেন, ‘স্যর এডউইন আর্নল্ডের এই বইটিতে বুদ্ধ এবং তাঁর দর্শনের অতি বিশ্বস্ত প্রতিফলন ঘটেছে কি না, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এটা সত্য যে মহাত্মা গাঁধী, জওহরলাল নেহরু, বাবাসাহেব আম্বেডকরের মতো ভারতীয় নেতাদের জীবনে তা এক সুরের মতো বয়ে গিয়েছে। আবার অন্য দিকে ভারত বা এশিয়ার বাইরেও আন্তর্জাতিক স্তরে গৌতম বুদ্ধকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র অবদানকে আজ অস্বীকার করা অসম্ভব।’
স্থান, লন্ডন। কাল, ১৮৭৯। পাত্র, দ্য লাইট অব এশিয়া। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঝড় ওঠে ব্রিটেনে। ক্রমশ তার আঁচ পড়তে থাকে আমেরিকা এবং ইউরোপের অন্যান্য রাজ্যে। ছড়াতে থাকে গোটা বিশ্বেই। জয়রাম তাঁর গোড়ার কথায় জানাচ্ছেন কিছু চমকপ্রদ তথ্য। বলছেন, ‘এই কাব্যগ্রন্থ বিশ্বের ১১ জন বিখ্যাত সাহিত্যিককে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে, তাঁরা বার বার ফিরে এসেছেন বইটির কাছে। এই ১১ জনের মধ্যে আবার পাঁচ জন নোবেলজয়ী— রুডইয়ার্ড কিপলিং, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডব্লিউ বি ইয়েটস, ইভান বুনিন, টি এস এলিয়ট। বাকি ছ’জনের মধ্যে রয়েছেন লিয়ো টলস্টয়, ডি এইচ লরেন্স, হর্হে লুই বর্হেস, হেরম্যান মেলভিল-এর মতো নাম!’ বাঙালি থেকে ব্রিটিশ, রুশ, মার্কিন সাহিত্যিকরা মুগ্ধ এই জীবন-কবিতায়।
শুধু কবিতার জগৎই নয়। বিজ্ঞানের মানুষরাও প্রভাবিত হয়েছেন, তার প্রমাণ আমাদের দেশেই নথিবদ্ধ। মাদ্রাজের এক তরুণ পদার্থবিদ বুঁদ হয়ে থাকতেন ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’য়। তিনি পরবর্তী কালের প্রথম নোবেলজয়ী ভারতীয়, সি ভি রমন। পিরিয়োডিক টেবল-এর আবিষ্কর্তা, রাশিয়ার রসায়নবিদ দিমিত্রি মেন্ডেলভ ছিলেন ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র একনিষ্ঠ পাঠক। আলফ্রেড নোবেলের ব্যক্তিগত পাঠাগারে সযত্নে রাখা ছিল এই বই। বাবাসাহেব আম্বেডকরেরও। ভারত এবং জার্মানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি প্রথম দিককার নির্বাক ছবি, ‘প্রেম সন্ন্যাস’ ১৯২৫ সালে এই কবিতা থেকে নির্মিত। ছবিটি যুগ্ম ভাবে পরিচালনা করেছিলেন হিমাংশু রাই ও ফ্রান্জ অস্টেন। ছবিতে সিদ্ধার্থ গৌতমের ভূমিকায় অভিনয় করেন হিমাংশু রাই নিজে আর যশোধরা বা গোপা দেবীর ভূমিকায় ছিলেন সীতা দেবী। অবিভক্ত ভারতের লাহৌরে হয়েছিল এই ছবির শুটিং। সেট ডেকোরেশন করেছিলেন হিমাংশু রাইয়ের স্ত্রী এবং ভারতীয় ছবির কিংবদন্তি অভিনেত্রী দেবিকা রানি। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল আমেরিকায় ১৯২৮ সালে।
১৯৪৫ সালে তৈরি হলিউড কাঁপানো ‘পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’ ছবিতে রয়েছে এই কাব্যের প্রভাব। বইটির অনুবাদ হয়েছে ১৩টি ইউরোপীয়, ২২টি এশীয় ভাষায়। বিভিন্ন দেশে এই কবিতা থেকে তৈরি হয়েছে কাব্যনাট্য, নৃত্যনাট্য, পূর্ণাঙ্গ নাটক, অপেরা। আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি এবং ব্রিটেনে এই বই নিয়ে হয়ে চলেছে অসংখ্য গবেষণা। সম্প্রতি এ রকমই একটি গবেষণা হয়েছে জেমস জয়েসের কাজে ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র প্রভাব নিয়ে।
জয়রাম রমেশ কী ভাবে প্রথম সন্ধান পেয়েছিলেন আলোচ্য গ্রন্থটির? সে কাহিনিও চমকপ্রদ। জওহরলাল নেহরুকে লেখা চিঠিপত্রের একটি সঙ্কলনে ওল্টাতে গিয়ে তিনি দেখেন, ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যর উইনস্টন চার্চিল নেহরুকে একটি চিঠিতে এই কবিতার কথা উল্লেখ করছেন। চার্চিল লিখছেন, ‘আমি আশা করব দ্য লাইট অব এশিয়া-র কথা তোমার মনে আছে। আমার মনে হয় তুমিই হয়তো পারবে ভারতের হাতে এমন কিছু তুলে দিতে, যা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অন্তত চিন্তাজগতে।’
ভেবে দেখুন! চার্চিল লিখছেন এমন এক জনকে, যিনি ১৯২১ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে ন’টি আলাদা আলাদা সময়ে ব্রিটিশ কারাগারে থেকেছেন মোট দশ বছর। তাঁর কারাগারবাসের সবচেয়ে লম্বা মেয়াদ ১৯৪২ সালের অগস্ট থেকে ১৯৪৫ সালের জুন। সে সময় চার্চিলই ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী!
এহ বাহ্য। দেখা যাচ্ছে, ১৯৫৫ সালের ৩০ জুন চার্চিল আবার লিখছেন নেহরুকে। তখনকার একটি কমনওয়েলথ সম্মেলনে দু’জনের সাক্ষাতের কথা বর্ণনা করে নেহরুর ‘শান্তিকামী, তিক্ততাহীন মনের’ ভূয়সী প্রশংসা করে চার্চিল বলেছেন, ভারত এবং ব্রিটেনের মধ্যে জমে ওঠা দীর্ঘ দিনের উষ্মা কাটাতে নেহরুর দর্শন সাহায্য করবে। চিঠির শেষে বলেছেন, ‘মনে রাখবে দ্য লাইট অব এশিয়া-কে।’ আবার ১৯২২ সালে যখন নেহরু লখনউ জেলে বন্দি, তাঁর বাবা মতিলালকে লেখা চিঠিতে তাঁকে বারোটি গ্রন্থের প্রাপ্তি স্বীকার করতে দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, এডউইন আর্নল্ডের এই মহাগ্রন্থ।
গ্রিক, ল্যাটিন, আরবি, ফারসি, জার্মান, জাপানি, হিব্রু, সংস্কৃত এবং মরাঠি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন এডউইন। চল্লিশ বছর টানা বিশেষ কলাম লিখে গিয়েছেন ‘দ্য ডেলি টেলিগ্রাফ’-এ। জাতে ভিক্টোরিয়ান কিন্তু চেতনায় ভারতপ্রেমী আর্নল্ড এ দেশে কাটিয়েছেন ১৮৫৭ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত, পুণের ডেকান কলেজের প্রথম প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে। ভারতবাসীদের সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সময়ের তুলনায় ছিল অনেকটাই উদার ও আধুনিক। শুধু বৌদ্ধধর্ম নয়, ক্রমশ হিন্দুধর্ম, এবং ইসলাম সম্পর্কেও তাঁকে ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায়। জিশুখ্রিস্টকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘দ্য লাইট অব ওয়ার্ল্ড’। ভগবদ্গীতার ইংরেজি অনুবাদ করেন (‘দ্য সং সেলেস্টিয়াল’) যা মন কাড়ে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর। তবে আর্নল্ড-এর সমস্ত কাজের মধ্যে ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র মতো আয়ু পায়নি কেউ। জনপ্রিয়তা, খ্যাতি এবং সার্বিক অভিঘাতেও এটি তাঁর অন্যান্য কাজের তুলনায় বহু যোজন এগিয়ে।
খুব সংক্ষেপে এক বার দেখে নেওয়া যাক ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’ বইটির আকার। ৮টি খণ্ডে বিভক্ত এই গ্রন্থের প্রত্যেক খণ্ডে রয়েছে পাঁচ থেকে ছ’শো লাইন। প্রথম খণ্ডে সিদ্ধার্থর জন্ম, শৈশব, বালক জীবন। দ্বিতীয়টিতে তাঁর যৌবন এবং যশোধরাকে বিবাহ। তৃতীয় খণ্ডে রাজকীয় বিলাসবহুল যাপন। ধীরে ধীরে এক বৃদ্ধ, এক অসুস্থ এবং একটি মৃতদেহ দেখে মনে প্রশ্ন তৈরি হওয়ার পর্বান্তর। চতুর্থ খণ্ডে মানুষের দুর্দশামুক্তির জন্য তাঁর অন্বেষণ। পঞ্চম খণ্ডে তাঁর অনাহার এবং ধ্যান। ষষ্ঠ খণ্ডে বোধিবৃক্ষের তলায় বোধিলাভ পর্ব। সপ্তম খণ্ডে তাঁর গৃহত্যাগের কারণে পরিবারের বেদনা এবং তাঁর গৃহে ফেরা। অষ্টম খণ্ডে বুদ্ধের বাণী ও তার ব্যাখ্যা। মোট ৫,৩০০ লাইনের এই কাব্যগ্রন্থ। শব্দসংখ্যা ৪১ হাজার।
পঁচিশ বছরের ব্যবধানে আর্নল্ড ফের ভারতে আসেন ১৮৮৫-র নভেম্বরে। ছিলেন পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত। তখন আর তিনি পুণের ডেকান কলেজের ছাত্রদরদি প্রিন্সিপ্যাল নন, ইউরোপ এবং আমেরিকায় রীতিমতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ভারতেও তাঁর সম্মান যথেষ্ট। সে বার এসে এক বিস্ময়কর সফর করেছিলেন আর্নল্ড, যা নিয়ে তাঁর বই ‘ইন্ডিয়া রিভিজ়িটেড’। ১০০ দিনে ২০টি শহর ঘুরেছিলেন আর্নল্ড রেল, সড়কপথে। গিয়েছিলেন সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কায়। জয়পুর, আলওয়ার, দিল্লি, বারাণসী, পটনা হয়ে পৌঁছেছিলেন কলকাতায়। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারিতে। দক্ষিণেশ্বরকে কেন্দ্র করে তখন কলকাতায় কৌতূহল, বিশ্বাস-অবিশ্বাস এবং ভক্তির জোয়ার-ভাটা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তখন বেশ অসুস্থ।
সেবারই কলকাতায় এসে আর্নল্ড দেখেন স্টার থিয়েটারে ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’ অবলম্বনে গিরিশ ঘোষের নাটক, ‘বুদ্ধদেব চরিত’। নাটকের জন্য মূল কবিতাটি অনুবাদ করেছিলেন গিরিশ ঘোষ। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামের অগ্নিতুল্য তেজস্বী এক যুবক! ওই নাটকটি দেখে ভাষার তফাত সত্ত্বেও মুগ্ধ হন এডউইন সাহেব। তিনি লেখেন— ‘এক দারুণ অভিজ্ঞতা একটি দিশি কোম্পানির দ্য লাইট অব এশিয়া-র নাট্যরূপটি দেখা। কলকাতার বহু দর্শকের সঙ্গে বসে দেখলাম। দীর্ঘ সংলাপ সত্ত্বেও তারা যে ভাবে মনোযোগ দিয়ে পুরোটা শুনলেন এবং তারিফ করলেন, তাতে ওই হিন্দু জনসমাবেশের দার্শনিক বোধ এবং বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে উচ্চ ধারণাই হল।’ নাটকটি দেখে আর্নল্ড এতই খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি কলকাতা ছাড়ার আগে স্টার থিয়েটারের ম্যানেজারকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে বলেন, ‘আমার কবিতা দ্য লাইট অব এশিয়া অবলম্বনে আপনার কোম্পানির তৈরি বুদ্ধের জীবনভিত্তিক নাটকটি দেখে আমি এতই উচ্ছ্বসিত, যে সে কথা না জানিয়ে কলকাতা ছাড়তে পারি না! আমার ধন্যবাদ জানবেন এবং কলাকুশলীদের আমার মুগ্ধতা জানাবেন।’
আসলে গিরিশ ঘোষ তো আর্নল্ডের কবিতাটির সরাসরি অনুবাদ করেননি। গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে তিনি তার এক নাট্যরূপ দিয়েছিলেন, আর্নল্ড নাটকটি দেখার কয়েক মাস আগে ১৮৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় যার প্রথম শো হয়েছিল। অন্য দিকে দেখা যায়, আর্নল্ড কলকাতা থাকার সমসাময়িক একটি সন্ধ্যার কথা ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’-তে উল্লেখ রয়েছে। যেখানে ঠাকুরের সামনেই এই নাটকের একটি গান গেয়েছিলেন স্টার থিয়েটারের রামতারণ। তখন প্রশ্ন ওঠায়, ঠাকুরের সামনেই গিরিশবাবু জানান, এটি তাঁর লেখা ঠিকই, কিন্তু নেওয়া হয়েছে এডউইন আর্নল্ডের কবিতা থেকে। নাট্যগ্রন্থটির প্রকাশিত সংস্করণে প্রভাবঋণ স্বীকার করেন গিরিশচন্দ্র। সেই স্বীকৃতিপত্রে লেখা ছিল—
এডুইন্ আর্নল্ড
এম্ এ, এফ্ আর জি এস,
এফ আর এ এস্, সি এস্ আই,
মহাশয়েষু
কবিবর!
আপনার জগদ্বিখ্যাত “লাইট্ অফ্ এসিয়া” (LIGHT OF ASIA) নামক কাব্যখানি অবলম্বন করিয়া এই গ্রন্থ রচনা করিয়াছি। হে মহাশয়! আপনার করকমলে কৃতজ্ঞতা উপহার দিতেছি, নিজগুণে গ্রহণ করুণ।
ঋণী—
শ্রীগিরিশচন্দ্র ঘোষ
(কলিকাতা, বাগবাজার, ১লা বৈশাখ, ১২৯৪ সাল)
এর কয়েক মাস পরেই ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রয়াণ ঘটে। তারও কয়েক বছর পর শিকাগোয় প্রথম বিশ্ব ধর্মমহাসভা বসে ১৮৯৩-এর সেপ্টেম্বরে। সেখানে ঝড় তোলা তরুণ সন্ন্যাসী তার কয়েক বছর আগেই পড়ে ফেলেছিলেন ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’। গিরিশচন্দ্র ঘোষ একা নন, তাঁকে এই বইটি অনুবাদের কাছে বহুলাংশে সাহায্য করেছিলেন বিবেকানন্দ, সে কথা আগেই বলা হয়েছে। ১৮৮৫ সালে ‘বুদ্ধদেব চরিত’ নাটকটি মঞ্চস্থ করতেও বিবেকানন্দের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। শিকাগোয় আলোড়ন তৈরি করার কয়েক মাস পর, ১৮৯৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ডেট্রয়েটে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র প্রসঙ্গ তুলেছেন বিবেকানন্দ। তার পরের মাসে ওই ডেট্রয়েটেই একটি সম্মেলনে যোগ দেন তিনি, যার বিষয় ছিল ‘বুদ্ধিজ়ম, দ্য রিলিজিয়ন অব দ্য লাইট অব এশিয়া’। সেখানে তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ক্যাথলিক ধর্মের ভিত গড়েছে বৌদ্ধধর্ম। ক্যাথলিক চার্চ এসেছে বৌদ্ধধর্ম থেকে।’ কথাটা ভিত্তিহীন নয়। হাল আমলে আধুনিক ইতিহাসবিদরা কেউ কেউ দেখিয়েছেন, জর্ডন নদীর জলে যেখানে সাধু জোহনের কাছে দীক্ষাস্নাত হন জিশু, ইজ়রায়েলের মরুভুমিতে সেই জোহনের প্রচারিত ধর্মে বৌদ্ধ প্রভাব ছিল। এর সঙ্গে ভারতের ‘বিশ্বগুরু’ হওয়ার সম্পর্ক নেই। ছাপা বই না থাকলেও বণিকদের হাত ঘুরে এক দেশের ধর্মকথা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ত।
যা হোক, ডেট্রয়েটের পরের কয়েক বছরে বেদান্ত নিয়ে বহু বক্তৃতা দিয়েছেন বিবেকানন্দ। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর টান কমেনি। এমনকি ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতনের কারণগুলোও যখন ব্যাখ্যা করেছেন, তখনও নয়। আবার আর্নল্ডের বইটি সম্পর্কে তাঁকে এ কথাও বলতে শোনা গিয়েছে, ‘এডউইন আর্নল্ডের লাইট অব এশিয়া বৌদ্ধধর্মের চেয়েও বেশি বেদান্তবাদের প্রতিনিধিত্বকারী।’ ১৮৯৬-এ তাঁর লন্ডন সফর যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল। তাঁর সঙ্গে সে সময় ব্রিটেনের বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের সাক্ষাৎ নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, আর্নল্ডের সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি বৈঠকের কোনও নথি নেই। ১৯০০ সালে আমেরিকাতে বুদ্ধকে নিয়ে দুটি বক্তৃতা দিয়েছেন বিবেকানন্দ। সে দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রসার দেখে তিনি কিছুটা চিন্তিতও হয়েছিলেন এই ভেবে যে হিন্দু দর্শন এবং বেদান্তবাদ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে তা প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে। তবে ঘটনা হল, যত বারই তিনি বৌদ্ধধর্ম নিয়ে কথা বলছেন, ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-কে বাইরে রেখে বলছেন না।
মৃত্যুর দু’বছর আগে ১৯০০ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে ‘বিশ্বে বুদ্ধের বার্তা’ সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি এ কথাও বলেন, ‘আপনারা কি দেখেননি এক জন পরম ধর্মভীরু খ্রিস্টানও দ্য লাইট অব এশিয়া পড়ে, বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়ে ওঠেন? বুদ্ধ ঈশ্বরের বার্তা প্রচার করেননি, শুধুমাত্র আত্মোৎসর্গের বাণীই প্রচার করেছেন।’
নিঃসন্দেহে ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে শিকাগো ধর্মমহাসভায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। কিন্তু ওই সভায় বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ এবং আলোচনা কিছু কম ছিল না। জোর করে ওই সভায় নিজের নাম ঢুকিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ প্রচারক অনাগারিক ধর্মপাল। শ্রীলঙ্কা থেকে শিকাগোর সুদূর যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী ছিল ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’।
ধর্মসভার শেষে আমেরিকার মাটিতে বৌদ্ধধর্মের সূচনা হয় চার্ল থিয়োডর স্ট্রজ নামে এক ইহুদি বংশোদ্ভূত আমেরিকান ধনকুবেরের উদ্যোগে। অনেক পরে এমিলি সিগলো নাম্নী গবেষক, স্ট্রজ-এর জীবনের উপর কাজ করতে গিয়ে দেখান, ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র প্রভাব গোটা জীবন জুড়ে ছিল এই মার্কিন বৌদ্ধর, যার গোড়াপত্তন করে ওই ধর্মমহাসভা। আর্নল্ড নিজে ওই ধর্মমহাসভায় থাকতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু তিনি ধর্মমহাসভার চেয়ারম্যান জন হেনরি ব্যারোজ-কে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন, যেটি সেখানে পড়া হয়।
১৮৯০ সালের পর বইটির জনপ্রিয়তা ব্রিটেনে এতটাই বেড়ে ওঠে যে, তাকে ঘিরে টুকরো টুকরো ব্রিটিশ ড্রাই হিউমার জন্ম নেয়। সেগুলো ব্রিটেনের সামাজিক পরিসরেও স্থান করে নিয়েছিল। একটি উদাহরণ— এক গ্যাস সংস্থার মালিককে তাঁর সেক্রেটারি বলছে, ‘স্যর এডউইন আর্নল্ড তাঁর লাইট অব এশিয়া-র জন্য ৪ হাজার পাউন্ড কামিয়েছেন!’ মালিকের উত্তর, ‘আগে বলো, ওই আলো কী করে জ্বালানো হল? গ্যাসে না বিদ্যুতে?’
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৫৯ সালে শ্রীলঙ্কা যান। ফিরে আসেন বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে প্রভূত অধ্যয়ন এবং জ্ঞান অর্জন করে। এর ফলে বুদ্ধের জীবন এবং তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ গভীরতর হয়। ১৮৮২ সালে তিনি লেখেন, ‘শাক্যমুনি ও নির্বাণ তত্ত্ব’। রবীন্দ্রনাথের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরও দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন। তিনিও ১৯০১ সালে লিখছেন, ‘বুদ্ধ ধর্ম’ নামে একটি গ্রন্থ। ব্রাহ্মসমাজে বুদ্ধের দর্শন পড়ানো শুরু হয়ে তাঁদের উৎসাহে। ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধগয়ায় যান, সঙ্গে নিয়ে যান ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’। তাঁর সাহিত্যকর্মে বার বার বুদ্ধের দর্শনের আলো এসে পড়েছে। সেই সঙ্গে এই বইটিরও। শুধু রবীন্দ্রনাথই ঠাকুর পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি নন, যাঁর কাজে বইটির প্রভাব গভীর। তাঁর ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০২ সালে বিখ্যাত ছবিটি আঁকেন— বুদ্ধ এবং সুজাতা। ভারতীয় শিল্প সংক্রান্ত ইতিহাসবিদ পার্থ মিত্র লিখেছেন, ‘রবি বর্মার আঁকার থেকে অবনীন্দ্রনাথের বুদ্ধ ও সুজাতা অনেকটাই সরে গিয়েছে। এডউইন আর্নল্ডের কল্পনার সঙ্গে তাঁর আঁকা বরং অনেকটাই মিলে যায়।’ জয়রাম রমেশের গবেষণা বলছে, ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’-র সবচেয়ে প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিদায়’ কবিতাটিতে। ‘…হে মহাসুন্দর শেষ,/ হে বিদায় অনিমেষ,/ হে সৌম্য বিষাদ,/ ক্ষণেক দাঁড়াও স্থির,/ মুছায়ে নয়ননীর/ করো আশীর্বাদ।/ ক্ষণেক দাঁড়াও স্থির,/ পদতলে নমি শির/ তব যাত্রাপথে,/ নিষ্কম্প প্রদীপ ধরি/ নিঃশব্দে আরতি করি/ নিস্তব্ধ জগতে।’
গোটা বিশ্বে গৌতম বুদ্ধের যাত্রাপথে আজও ‘নিষ্কম্প প্রদীপ’ হয়ে রয়েছে এই বিস্ময়গ্রন্থটি। যার নাম, ‘দ্য লাইট অব এশিয়া’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy