সাহিত্যস্রষ্টা: ছোটগল্প ছাড়াও নাটক, প্রবন্ধ ও ব্যঙ্গ কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন বনফুল
রবীন্দ্রনাথকে তিনি সরাসরি ‘আক্রমণ’ করেছিলেন কবিতা লিখে। আনন্দবাজার পত্রিকার দোল সংখ্যার পৃষ্ঠায়। এই দাবি স্বয়ং বনফুলের। বলাই বাহুল্য, ‘বনফুল’ ওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তত দিনে বাংলা সাহিত্য-জগতে নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ব্যঙ্গ কবিতা রচনায় তাঁর সিদ্ধি তখন ঈর্ষণীয়। রবি-লক্ষিত ‘সরস অথচ তীক্ষ্ণ’ সেই কবিতা রচনার একটি ‘ধর্মীয়’ প্রেক্ষাপট আছে। কী সেটা?
রাজস্থানের এক পুরোহিত, রামচন্দ্র শর্মা, কালীঘাটের মন্দিরের সামনে বলিপ্রথার বিরুদ্ধে অনশন শুরু করেছিলেন। এই নিয়ে সে কালে আলোড়ন পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ সেই অনশনের উদ্যোগকে সমর্থন জানালেন। রামচন্দ্রকে বিষয় করে একটি কবিতাও রচনা করেন। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৪২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় ‘পণ্ডিত রামচন্দ্র শর্মা’ শিরোনামে সেই কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল। কবিকুলপতি রবীন্দ্রনাথের এই অহেতুক উদ্যম বনফুলের পছন্দ হয়নি। ওই রবীন্দ্র-কবিতাকে কটাক্ষ করে একটি কবিতা লেখেন। কী নাম ছিল সেই কটাক্ষ-পদ্যের?
বনফুল সেই কবিতার নাম কোথাও লিখে যাননি। কোনও কাব্যগ্রন্থে সেটির স্থানও হয়নি। অথচ নিজে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কের সেতু রচনায় ওই কবিতাটি অনুঘটকের কাজ করেছে। সেই কবিতা আনন্দবাজার পত্রিকার যে সংখ্যায় মুদ্রণের কথা ও প্রকাশের তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন, দেখা যাচ্ছে সেখানে ওই বছর তাঁর প্রকাশিত কবিতার নাম ‘স্বপ্ন-চূর্ণ সার’; রচনাটি কোনও মতেই রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখিত নয়। বস্তুত ১৩৪২ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু করে কমপক্ষে তিন বছরে নানা পত্রিকায় প্রকাশিত বনফুলের কবিতাবলি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অমন রবীন্দ্র-বিরোধী কবিতার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ বনফুল লিখিত ভাবে ও মৌখিক ভাবে নানা স্থানে দাবি করেছেন: “কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার কিছু পরে কলকাতায় একদিন আমার এক প্রাক্তন কলেজী বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল। সে বলল, তুমি আনন্দবাজারে যে কবিতাটি লিখেছ তা পড়ে গুরুদেব খুব খুশী হয়েছেন। জিগ্যেস করছিলেন— ‘বনফুল’ লোকটি কে, কোথায় থাকে। আমার কাছে কখনও আসেনি তো।” বনফুল এও বলেছেন রবীন্দ্রনাথ এর পর শান্তিনিকেতনে আসার জন্য চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানান তাঁকে। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বন্ধুত্ব যে নিবিড়তা পেয়েছে, যে ভাবে ডালপালা মেলেছে, তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে তাঁর ‘রবীন্দ্র-স্মৃতি’ গ্রন্থে। কিন্তু তাঁর কথায় উল্লিখিত, সেই রবীন্দ্র-বিরোধী কবিতাটির অস্তিত্ব আজও রহস্যের আড়ালেই থেকে গিয়েছে।
খাদ্যরসিক ছিলেন বনফুল। খেতেনও মাত্রাতিরিক্ত। ভাল ইলিশের খোঁজে কলকাতার সব ক’টি বাজার তোলপাড় করে তোলা তাঁর পক্ষে নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করতেন আত্মীয়স্বজনরা। স্বপাকেও পিছপা ছিলেন না। রান্নার বিষয়ে অনুসন্ধানী পরীক্ষাতেও বেশ মনোযোগী ছিলেন। এক বার আলুর দম করছেন, কী খেয়াল হল, জলের বদলে দুধ ঢেলে দিলেন। “আহা, কী স্বাদ হল গো!”— এই ভাবে অভিজ্ঞতার স্বাদ বনফুল ভাগ করে নিয়েছিলেন অনুজ কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাছে। উৎপল দত্ত কলকাতায় তাঁর যে কোনও নাটকের প্রথম শোয়ের নিমন্ত্রণ করতে নিজে কার্ড হাতে উপস্থিত হতেন বনফুলের কাছে; সঙ্গে থাকত টিফিন-বাক্স, তাতে থাকত খাসির সুস্বাদু কষা মাংস। এটা ‘নিয়ম’ হয়ে গিয়েছিল বনফুলের গল্প আর মৃণাল সেনের ছবির নায়ক ‘ভুবন সোম’-এর মধুর সম্পর্কে। উৎকৃষ্ট রন্ধনশিল্পী ছিলেন অভিনেতা অশোক কুমার। তিনিই ছিলেন তপন সিংহ পরিচালিত ‘হাটেবাজারে’ ছবির ‘সদাশিব ডাক্তার’। বনফুলের লেখা বিখ্যাত উপন্যাসের রূপান্তর এই ছায়াছবি। অশোক কুমারের সঙ্গে বনফুলের অসাধারণ বন্ধুত্বের প্রমাণ লুকিয়ে আছে নিজে হাতে অভিনেতার মাংস রান্না করে খাওয়ানোর ঘটনায়। ১৯৭১-এর ২৯ জুনে লেখা দিনলিপিতে আম প্রসঙ্গে বনফুলের মন্তব্য: “রাজাবাজার থেকে চৌথা নামক আম কিনলাম কয়েকটা। চৌথা লক্ষ্ণৌ শহরের ‘রইস’ আম। হঠাৎ মনে হল, চৌথা নাম কেন। মারাঠারা এককালে ওই অঞ্চলে আধিপত্য করে ‘চৌথা’ আদায় করত। সেই স্মৃতিটাই কি আমের মধ্যে অমর হয়ে আছে? খেয়ে দেখলাম, খুব মিষ্টি আম। অনেকটা ফজলির মত। প্রসঙ্গত বলি, ফজলি নামের মধ্যে বিখ্যাত গায়িকা ফজলি বাঈ অমর হয়েছেন। তিনি শুধু যে সুকণ্ঠী ছিলেন তা নয়, গায়ে গতরেও বেশ ভারিক্কি ছিলেন।”
এর ঠিক মাসখানেক আগের রোজনামচা থেকে জানা যায়, সে দিন কয়েক জন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবেন জানিয়েও আসেননি। ফলে হঠাৎ পাওয়া অবসরে মনের খেয়ালে লিখে ফেলেছেন একটি ছড়া— “পাজি আর বদমাশ/ এদের তফাত কোথা/ জানা নেই-/ হাসিয়া কহিনু তারে,/ একটি তফাৎ আছে/ সে তফাৎ বানানেই।” ডায়েরিতে আছে নানা ছায়াছবির প্রসঙ্গ। সপরিবার ছোট ভাই ঢুলুর (অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়) নতুন ছবি ‘ধন্যি মেয়ে’ দেখে এসে লিখেছিলেন, প্রথম অর্ধ তেমন জমেনি, কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ জমজমাট। এই ছবি ‘হিট’ হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছেন সেখানে। বড়দাদা হিসেবে তাঁর আনন্দও গোপন করেননি। এ ছাড়া আছে নিউ এম্পায়ারে ‘হোয়েন ডায়নোসরস রুলড দ্য আর্থ’ ছবি দেখতে যাওয়ার কথা। ব্যঙ্গের চাবুক চালিয়েছেন এখানে, স্বমহিমায়: “প্রাগৈতিহাসিক নেতাদের ছবি। আধুনিক নেতাদের প্রাগৈতিহাসিক চেহারা দেখা যাবে। তখন অবশ্য গণতন্ত্র ছিল না। ছিল খোলাখুলি শক্তিতন্ত্র, উলঙ্গ ফ্যাসিবাদ। আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি— এখনও সেই শক্তিতন্ত্র চলছে, গণতন্ত্রটা মুখোশ। ওই শক্তিতন্ত্রের আড়ালে আছে তদ্বিরতন্ত্র, গুণ্ডাতন্ত্র, ঘুষ-তন্ত্র, ভণ্ডামি-তন্ত্র, নেপোতন্ত্র।”
গত শতকের একটা দীর্ঘ পর্ব জুড়ে বাংলা কবিতার কেন্দ্রে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ— প্রথা ছিল, হয় তাঁকে বরণ, না-হয় বিরোধিতা। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাবলি প্রমাণ করে তিনি এই দুই পথের কোনওটারই পথিক ছিলেন না। তিনি সম্পূর্ণ পৃথক এক ভাবপ্রবাহের টানে কবিতা রচনা করে গিয়েছেন। ‘অঙ্গারপর্ণী’, ‘করকমলেষু’, ‘ব্যঙ্গকবিতা’, ‘নূতন বাঁকে’-র মতো কবিতা সঙ্কলনের প্রণেতা তিনি। তিনি ছিলেন সরস কবিতার শিল্পী। আত্মজিজ্ঞাসা ও জীবনজিজ্ঞাসার মন্থনে রচিত হয়েছে হাস্যরসে উজ্জ্বল কবিতা সমূহ। “বাংলা দেশে মরাই ভালো/ পার তো ভাই পটল তোলো।/ মরলে পরে চোখ থাকে তো দেখতে পাবে অনেক লোকে/ কাঁদছে ভায়া তোমার শোকে!/ বেঁচে থাকতে যারা তোমায় গাল না দিয়ে জল খেত না/ তোমার কোনো গুণই যাদের হৃদয়কোণে ঠাঁই পেত না/ (দেখবে তারাই— হ্যাঁগো, তারাই)/ টাঙিয়ে তোমার মস্ত ছবি দুলিয়ে তাতে দিচ্ছে মালা/ উচ্ছ্বসিত বক্তৃতাতে দিচ্ছে কানে ধরিয়ে তালা”— নিশ্চিত করে বলা যায় জীবন অভিজ্ঞতার সত্য অনুভব কৌতুকের ছদ্মবেশে ব্যঙ্গের চূড়ান্ত অভিঘাত তৈরি করেছে এখানে। বনফুলের কাব্যভুবন গড়ে উঠেছে এই বক্র দৃষ্টিভঙ্গির সুষম ছন্দোময় অনুপানে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ‘নূতন বাঁকে’ কাব্যগ্রন্থটি। এই গ্রন্থের একাধিক কবিতায় কবি ‘প্রণাম’ জানিয়েছেন শ্রীশ্রীমা সারদা, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বদের।
অভিজ্ঞতা ও সহৃদয়তা ছাড়াও বনফুলের বহু পাঠের অভ্যাস তাঁর উপন্যাস ও প্রবন্ধকে অমূল্য করেছে। ‘ডানা’ উপন্যাসে লেখক ১৩৬ রকম পাখির নাম, কয়েকটির ক্ষেত্রে অপ্রচলিত অথবা ইংরেজি নাম, পাখিদের ডিমের আকার ও রঙের বৈচিত্রের কথা কাহিনির বুননে খুব স্বাভাবিক ছন্দে বিবৃত করেছেন। এর জন্য গদ্যপ্রবাহ কোথাও আড়ষ্ট হয়ে পড়েনি। তবে প্রবন্ধে লেখকের মৌলিক ভাবনার পরিচয় থাকলেও বহু কথনের প্রতি তাঁর আসক্তি, বক্তব্যকে সংহত ও একাগ্র করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং তাঁর নাটক আঙ্গিকে, সংলাপে, নিরপেক্ষতায়, দার্শনিক উৎকর্ষে তুলনারহিত। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বা মধুসূদন দত্তকে নিয়ে লেখা নাটক নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে মাইলফলক। ‘শ্রীমধুসূদন’ নাটক পড়ে কবিবর রবীন্দ্রনাথ অনুজ-বন্ধু বনফুলের কাছে তাঁকে নিয়ে নাট্যরচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। নাট্যকার সেই ইচ্ছা পূরণে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু তার আগেই কবি প্রয়াত হন।
১৯ জুলাই ১৯২৪-এ জন্ম বনফুলের। ১২৫ পূর্ণ হল গত পরশু। তাঁর ছোটগল্প আরও কিছু দিন বাংলা গল্পের বাণিজ্যমেলায় ছড়ি ঘোরাবে সন্দেহ নেই। পুণ্য জন্মমাসে বরং বনফুলের কবিতা এবং নাট্যগুলি নিয়ে চর্চা শুরু হোক, কেননা সেগুলির প্রাসঙ্গিকতা এই মূল্যবোধহীন সময়ে আরও বেড়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy