কৌশলী: বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস)। ডান দিকে, মদনমোহন মন্দিরের যে ঘরে তিনি আত্মগোপন করেছিলেন বলে জানা যায়। (ছবি: লেখক)
ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে জাপানে চলে যান ১৯১৫ সালের ১২ মে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মীয় পি এন টেগোর, এই ছদ্মপরিচয়ে এবং ছদ্মবেশে ছ’নম্বর খিদিরপুর ডক থেকে ‘সানুকি মারু’ নামক জাহাজে চড়ে তিনি জাপানের উদ্দেশে রওনা হন।
অবশ্য ১৯১৪ সালেও তাঁর বিদেশ যাওয়ার সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তখন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। বড় বড় রেলস্টেশনে তাঁর ছবি টাঙানো হয়েছিল। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা টাকার পুরস্কার ঘোষণা হয়েছিল। তখন পুরস্কারের অঙ্কটা নেহাত কম ছিল না। রাসবিহারীর নিরাপত্তার জন্য তাঁর স্বদেশি বন্ধুরা তাঁকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু রাসবিহারী নিজেই শেষ মুহূর্তে জাহাজের টিকিট ছিঁড়ে ফেলেছিলেন সে বার।
১৯১৫ সালে রাসবিহারী জাপানে গেলেন, তার কারণ দু’টি। তিনি দেখেছিলেন, স্বদেশি আন্দোলনকারীদের হাতে যদি যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ না থাকে, তা হলে বিপ্লব সফল হবে না। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, টাকার ব্যবস্থা করা। কারণ চুরি-ডাকাতি করে বা দু’-চার জন ধনী ব্যক্তির বদান্যতায় বিপ্লবের টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়। বিপ্লবের সাফল্যের জন্য অন্য দেশ থেকে অর্থ আনার প্রয়োজনেও তাঁর বিদেশ পাড়ি।
তবে তার আগেও একটা পর্যায় ছিল। জাপান যাওয়ার আগে টাকার জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত যখন তাঁর জন্য সর্বত্র চিরুনি তল্লাশি করছে ব্রিটিশ সরকার, প্রতিটি পদক্ষেপে বিপদের করাল ছায়া, সর্বত্র অর্থলোভী বিশ্বাসঘাতক এবং বিদেশি শাসকের চরের আনাগোনা— তখন রাসবিহারী কোথায় নিরাপদে আত্মগোপন করবেন, তা এক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। রাসবিহারী লিখেছেন, “নবদ্বীপ একটি তীর্থস্থান। অথচ সাধারণতঃ সেখানে তত বেশী লোক যাওয়া আসা করে না। কিছু দিন সেখানে থাকাই ঠিক হইল। তাছাড়া সেই সময় আমাদেরই একজন লোক সেখানে ছিল, তাহার মতে নবদ্বীপ খুব নিরাপদ স্থান। এই সমস্ত ঠিক করিয়া… তখন একজন ভট্টাচার্য্য ব্রাহ্মণের মতন ছিলাম। পৈতে তো ছিলই, তার উপর একটি টিকিও ছিল… পশুপতি যেমন নির্ভীক তেমনি বুদ্ধিমান। তাহাকে সঙ্গে করিয়া বরাবর ট্রেনে নবদ্বীপ গিয়া হাজির। ঠাকুর (ত্রৈলোক্য মহারাজ) সেখানে ছিল। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া একটি বাড়ী ভাড়া করিবার জন্য খুঁজিতে বাহির হইলাম। নবদ্বীপের একপ্রান্তে এক বৈরাগীর এক বাড়ী ছিল। ২টি ঘর। সেটি ভাড়া করিলাম। সেখানে প্রায় একমাসের উপর ছিলাম।”
এখন প্রশ্ন হল, নবদ্বীপে বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ বেশে রাসবিহারী কোথায় মাসাধিক কাল কাটিয়ে গেলেন?
নবদ্বীপের ব্রজানন্দ গোস্বামী রোডে অবস্থিত শ্রীমদনমোহন মন্দির কর্তৃপক্ষ দাবি করেন যে, তাঁদের মন্দিরেই রাসবিহারী আত্মগোপন করেছিলেন। মন্দিরে ঢুকেই ডান হাতের প্রথম তালাবন্ধ কালো দরজার প্রাচীন ঘরটিতেই থাকতেন রাসবিহারী, তাঁরা বলেন। এমনকি তিনি যে টেবিল-চেয়ার ব্যবহার করতেন, যে টেমির আলোয় লিখতেন, সে সবও তাঁরা সংরক্ষিত রেখেছেন সেই ঘরে। তদানীন্তন মন্দির-প্রধান প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামীই তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন বলা হয়। সংশয়ের ব্যাপার হল, রাসবিহারীর আত্মকথায় বা তাঁর কোনও জীবনীগ্রন্থে মদনমোহন মন্দিরের নামোল্লেখ নেই! তা হলে মন্দির কর্তৃপক্ষের দাবিকে আমরা মানব কেন?
প্রসঙ্গত, প্রাণগোপাল গোস্বামী (১৮৭৬-১৯৪১) ছিলেন ভারতের অন্যতম প্রধান পণ্ডিত ব্যক্তি। কলকাতার বিদ্বজ্জনদের একটি বড় অংশ তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল। ভারতবর্ষের পণ্ডিতসমাজ তাঁকে যেমন ‘সিদ্ধান্তরত্ন’ উপাধি প্রদান করেছিলেন, তেমনই বাংলার বাংলার বাঘ স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ‘ভারতবিখ্যাত ভক্তিশাস্ত্র ব্যাখ্যাতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের তিনি ছিলেন হরিনাম উপদেষ্টা ও যুগল ভজনের অনুপ্রেরণাদাতা। দেশবন্ধুর ভাই পি আর দাস, যিনি পটনা হাইকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন— তাঁরও দীক্ষাগুরু ছিলেন প্রভুপাদ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রায়বাহাদুর সতীশচন্দ্র চৌধুরী, সলিসিটর অচল মিত্র প্রমুখ ছিলেন প্রাণগোপালের অত্যন্ত অনুরাগী। প্রাণগোপাল নিজেও ছিলেন একান্ত দেশভক্ত। তাঁর ভাগবত প্রবচনে দেশভক্তির শিক্ষা দিতেন শ্রোতাদের। অনেক বিপ্লবী, যেমন গিরিজাবাবু (নগেন্দ্রনাথ দত্ত), পশুপতি (জ্যোতিষচন্দ্র সিংহ), ঢাকার প্রতুল গঙ্গোপাধ্যায়দের আনাগোনা ছিল তাঁর কাছে। তাঁদের অর্থসাহায্যও করতেন তিনি। কাজেই প্রাণগোপাল গোস্বামীর সঙ্গে রাসবিহারীর সংযোগ অসম্ভব কিছু ছিল না।
প্রাণগোপাল গোস্বামীর জীবনীগ্রন্থে রাসবিহারীর সঙ্গে তাঁর মিলন প্রসঙ্গ, মদনমোহন মন্দিরে আত্মগোপনের কথা বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত। গ্রন্থটি লিখেছেন প্রাণগোপালের পৌত্র প্রভুপাদ মদনগোপাল গোস্বামী। সেখানে বলা হয়েছে— “শ্রীরাধামদনমোহন মন্দিরটি ছিল আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের আত্মগোপনের একটি নির্ভরযোগ্য ঘাঁটি। কারণ প্রভুপাদ বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন এবং তাঁর গোপনীয়তা রক্ষা করতেন এমন কঠোরভাবে যে বাড়ীর একজনও, এমন কি নিকটতম আত্মীয়রাও বিপ্লবীদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারত না। ছোটখাটো অনেক বিপ্লবীই এসেছেন এবং থেকেছেন। তাঁদের অনেকের পরিচয়ই আজও আমাদের কাছে অজানা। তাই তাঁদের বিষয়ে আলোচনা না করে আমি এখানে এমন একজন বিপ্লবীর নাম করব যাঁকে এককথায় সকলেই চিনতে পারবে। এই বিপ্লবীটির সঙ্গে প্রভুপাদের মিলন হয় ৮১ নং ল্যান্সডাউন রোডে সলিসিটার অচল মিত্র মহাশয়ের বাড়ীতে। ইনি আর কেউ নন, ইনিই তদানীন্তন কালের স্বনামধন্য বিপ্লবী শ্রীরাসবিহারী বসু মহাশয়। দেশবন্ধুর আগ্রহেই শ্রীবসু মহাশয়ের সঙ্গে প্রভুপাদের মিলন হয়।”
‘রাসবিহারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (উর্দি বাজার, চন্দননগর)-এর বর্তমান অধিকর্তা কল্যাণকুমার চক্রবর্তী এ প্রসঙ্গে জানালেন, “১৯২৪ সালে রাসবিহারী যখন আত্মকথা লেখেন, তখনও ভারত ব্রিটিশ শাসনের আওতায়। তাই তিনি লেখায় কোথাও ব্যবহার করেছেন ছদ্মনাম, কোথাও বা নামের আদ্যক্ষর। গোয়েন্দা পুলিশ ভীষণ সজাগ। এমতাবস্থায় যাঁরা বা যিনি তাঁকে আশ্রয় দিয়ে নিরাপদে রেখেছিলেন, তাঁর নাম রাসবিহারী যে প্রকাশ করবেন না, এ তো খুব স্বাভাবিক!”
তা হলে কি ‘রাসবিহারী রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ মদনমোহন মন্দিরে রাসবিহারীর আত্মগোপনের সত্যতা মেনে নিচ্ছে? কল্যাণবাবুর উত্তর, “অনেক সময় নিজেদের প্রচারের জন্য দাবি করা হয় অনেক কিছু, যা মিথ্যেও হতে পারে।তবে এ ক্ষেত্রে প্রথমত, নবদ্বীপে থাকার কথা রাসবিহারী নিজেই বলেছেন। আর দ্বিতীয়ত, ১৯১৫ সালে জাপান যাওয়ার আগে পর্যন্ত রাসবিহারী কোথায় গেছেন, কোথায় থেকেছেন তা সম্পূর্ণ গোপনীয়। লিখিত প্রমাণ নেই বললেই চলে। ১৯১৫-র পর থেকে সবটা জানা যায়। তাই এ ক্ষেত্রেও প্রমাণ না মেলাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রাণগোপাল গোস্বামীর জীবনীগ্রন্থ বা তাঁদের পারিবারিক ইতিহাস সে কথা জানাচ্ছে। ঘর এবং ঘরের কিছু কিছু জিনিস সংরক্ষিত রেখেছেন আজও তাঁরা। নিছক সন্দেহের কারণে জোর করে না মানার প্রশ্ন ওঠে না।”
শমীকস্বপন ঘোষ— যিনি রাসবিহারী ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করেছেন— জানালেন, “কারও কথায় নয়, ১৯১৫ সালের ম্যাপ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে, গঙ্গা তখন মদনমোহন মন্দিরের অনেকটাই নিকটবর্তী এবং নবদ্বীপের প্রায় এক প্রান্তেই এই মন্দিরের অবস্থান। অতএব, রাসবিহারীর কথামতো নবদ্বীপের এক প্রান্তে বৈরাগীর ঘর, তা মিলে যাচ্ছে। পরে যদি কোনও ভাবে মন্দিরে রাসবিহারীর থাকার কথা প্রচার হয়ে যেত, তা হলে সেই মন্দির গুঁড়িয়ে দিত ব্রিটিশরা। অতএব মন্দিরের নামোল্লেখ যে কোথাও থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক।”
আবার প্রাণগোপাল গোস্বামীর সঙ্গে দেশবন্ধু, পশুপতি প্রমুখের যোগাযোগ ছিল। পশুপতিই রাসবিহারীকে নবদ্বীপে নিয়ে এসেছিলেন, সে কথা রাসবিহারীর লেখায় পাই। আর রাসবিহারী যাচাই না করে, সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কোথাও আশ্রয় নেবেন না। তাই প্রাণগোপালের কাছে তাঁর আশ্রয় নেওয়া অসম্ভব নয়, বরং মদনমোহন মন্দিরই সবচেয়ে নিরাপদ ছিল তখন।
আবার সংশয় জাগে যখন দেখি রাসবিহারী লিখেছেন, “মারাঠি ছেলেটি বাংলা বলতে পারত। কখনো কখনো উচ্চারণ ঠিক হইতো না। কাজেই বাজার করিবার জন্য বাড়ির মালিক বৈরাগী মহাশয়ের আশ্রয় লইতে হইল। বৈরাগীকে একদিন মাছ কিনিয়া অনিবার জন্য বলায় সে ইহাতে রাজি নয়। দু-চার বার অনুরোধ করার পর রাজি হইল। তাহার পর প্রত্যেকদিন গামছা করিয়া মাছ কিনিয়া আনিতো। একদিন তাহাকে নিমন্ত্রণ করলাম। মাছের ঝোল অম্লান বদনে খাইয়া গেলেন…”
প্রভুপাদ প্রাণগোপাল সকলকে আমিষাহার ত্যাগ করিয়ে প্রসাদভোজী হতে বলতেন, তাঁর দ্বারা কি এমন বিপরীত আচরণ সম্ভব!
দ্বিধা কাটাতে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলাম নবদ্বীপ মদনমোহন মন্দিরের বর্তমান অধিকর্তা বড় প্রভুপাদ নিত্যগোপাল গোস্বামীকে। তিনি জানালেন, এ ঘটনা সর্বৈব সত্য। কোনও ভুল নেই এতে। তবে প্রভু প্রাণগোপাল নন, সেই বৈরাগী ছিলেন মদনমোহন মন্দিরের ঠিক বিপরীতে যে নিতাইবাড়ি, সেখানকার এক ব্রাহ্মণ সেবক। তিনি মাছ এনে রান্না করে দিতেন। রাসবিহারীর আহারে কষ্ট হচ্ছে দেখে, প্রভুপাদ ব্রাহ্মণকে দিয়ে মাছ আনিয়ে রান্না করানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মন্দিরের বাইরের দিকের দরজা দিয়ে আমিষাহার আসত। দেশের জন্য, বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে প্রভুপাদ নিয়মের এই ব্যত্যয় অনুমোদন করেছিলেন। প্রভুপাদ প্রাণগোপাল গোস্বামী যে কতখানি দেশভক্ত ও বাস্তববাদী ছিলেন— এ ঘটনা তারও প্রমাণ বলা যায়।
সুতরাং নবদ্বীপের মদনমোহন মন্দিরই যে সেই স্থান, যেখানে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু প্রায় মাসাধিক কাল বৈষ্ণব ব্রাহ্মণবেশে লুকিয়ে ছিলেন, তা বলা যেতে পারে।a
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy